#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
২৬.
কেটে গেছে দিন পনেরো। ছোট ছোট অনুভূতিতে মত্ত টিকলি-আদরের ফোনালাপ। সপ্তাহে একদিন দুইদিন বিরামহীন আলাপকালে ক্রমেই দূর্বল হয়ে উঠলো আকর্ষণরা। আষাঢ়ে বৃষ্টির পদাচরণ শহর জুড়ে। জল বর্ষণে মুখরিত এবং আরামদায়ক পরিবেশ। বাড়ির পাশে বড় গাছটাতে কদম ফুলে ছেয়ে গেছে। ছাদের একপাশের মাঝারি সাইজের টপে বেলি, জুই, জিনিয়া ফুটেছে। সুন্দর দীপ্তিযুক্ত এই ফুলের সুভাসে বর্ষাকালের আগমন। সাথে অভ্যর্থনা জানায় মেঘলা আকাশকে। আষাঢ় বাদল এমন এক দুপুরে হঠাৎ আদরের ফোন আসবে ভাবতে পারেনি টিকলি। পরিবারের সাথে খেতে বসার সময়টাতেই ফোন এসেছিলো। ফোন কেটে দিলো। সবাই ভ্রু কুচকে তাকালো টিকলির দিকে। খানিকটা ইতস্তত বোধ করে টিকলি জবাব দিলো,
‘নিভা ফোন করেছে।’
টায়রা মুখে খাবার পুড়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তা ধরলি না কেনো?’
‘খেয়ে তারপর কল ব্যাক করবো।’ টিকলি খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
চটপট সবার আগে খাওয়া শেষ করে ঘরের দিকে দৌড়ে এগোলো টিকলি। ঝটপট আদরকে ফোন দিয়েই বলল,
‘সরি সরি। খাচ্ছিলাম। সবাই সামনে ছিলো।’
আদর ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমি কথা বলার জন্য ফোন দেইনি টিকলি। কথা বলার মতো সময় এখন হাতে নেই। এক্ষুনি অপারেশনে যেতে হবে আমায়। তবে একটা ইনফরমেশন দিতে ফোন করেছি। এক্ষুনি ফোন না দিলে কোনোমতেই শান্তি হচ্ছিলো না।’
‘কি ইনফরমেশন ডাক্তার?’
‘কাল আমি ফ্রি থাকবো বিকালে। চারটায় দেখা করা চাই ই চাই। কোথায় দেখা করবেন এড্রেস টা মেসেজ করে দিয়েন। রাখছি। বায়।’
টিকলিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কাটা হলো। উৎফুল্লে মুখের বুলি কপচিয়ে গেলো। এতোটা খুশি হলো যে, বাইরে প্রকাশ পেয়েও পেলো না। অত্যন্ত চাপা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো সদ্য ফুটা প্রেমিক মন। পেছন থেকে তখন কারোর গোয়েন্দার গলা শুনা গেলো,
‘কে ব্যাপার রে তোর? কে ফোন করেছিলো?’
টিকলি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। টায়রাকে দেখে নিয়েই জড়োসড়ো হয়ে গেলো। তবুও বাইরে ডাট বজায় রেখে বলল,
‘বললাম না নিভা ফোন দিয়েছিলো।’
টায়রা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো, ‘সত্যি? কই দেখি?’
টিকলির ফোন নিতে গেলেই টিকলি দু কদম সরে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত ভাবে বলল, ‘ফোন নিতে হবে কেনো? আমি বলছি তো।’
টায়রা অবাক কণ্ঠে বলল, ‘বেশ কিছুদিন যাবত থেকে দেখছি তোর ফোন আসছে বারবার। জিজ্ঞেস করলেই বলিস নিভা ফোন করেছে। নিভার এতো কীসের দরকার তোর কাছে?’
‘এমনি। দরকার থাকতে পারেনা?’
টায়রা মৃদু হেসে বলল, ‘ওহ তাই? দাড়া এক মিনিট।’
টায়রা আকস্মিক ফোন লাগালো নিভাকে। ওপাশ থেকে নিভা ফোন ধরতেই বলল, ‘তুই একটু আগে টিকলিকে ফোন দিছস?’
বৃষ্টিভেজা দিনে ঘুমিয়ে আরাম। দুপুরে খেয়ে নেয়েই কাঁথা মুড়ি দিয়ে ভাত ঘুম দিয়েছে নিভা। টায়রার কথা শুনে ঘুমুঘুমু কন্ঠেই শাসালো সে,
‘থাপ্পড় চিনস? এই কথার জন্য ফোন দেওয়া লাগে আবার? টিকলির সাথে গত সাতদিনে আমার ফোনে কথা হয়নাই। মেসেজ হইছে শুধু।’
টায়রা ভার কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা তুই ঘুমা। ডিস্টার্ব করার জন্য সরি।’
ফোন কাটতেই টিকলির দিকে তাকালো টায়রা। টিকলি উদাস চোখে আকাশ ফেটে গড়িয়ে পড়া জল-বর্ষন দেখছিলো। ধরা খাওয়া মুখটা লুকিয়ে চুরিয়ে রাখতে চাইলো ওই আকাশের বুকে। টায়রা বলল খানিকটা ধরা গলায়,
‘আমাদের মধ্যে তো কখনো কিছু লুকানো থাকতো না টিকলি। আমাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেললি আপু?’
শেষ শব্দটা বলেই চোখ মুছে ঘর ছেড়ে দৌড়ে পালালো টায়রা। কিছুটা নিরবে অশ্রু গলিয়ে পরলো টিকলির কোমল ফুলা গালবেয়ে। আচ্ছা, টিকলি কি টায়রার সাথে প্রতারণা করে ফেলল? মিথ্যে কেনো বলল? কেনো কষ্ট দিয়ে ফেলল? টিকলি তো চেয়েছিলো আদরের সাথে আগে ওর দেখা হোক। এরপর বুঝুক ব্যপারটা আসলে কোন পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো সে। তারপর পুরো ঘটনা টায়রাকে বলবে। হয় টায়রা সারপ্রাইজড হতো নয়তো হতাশ হতো। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো?
________________________________
আর্দ্রর পা ভালো হয়েছে। চলতে ফিরতে অল্প একটু সমস্যা হলেও মানিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। দুপুরে খেয়ে ক্লান্ত বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই তার উপর আদেশ এলো ভারসিটি গিয়ে নিভাকে টিফিন বক্সে করে খাবার দিয়ে আসতে। নিভার মা নামক একমাত্র খালামনিটি নাকি নানুবাড়ি গিয়েছে। আর্দ্র বিরক্ত হয়ে বলল,
‘মাত্র খাইলাম আম্মু। এখন পারবো না, যাও। তোমার বোনের এতো বাপের বাড়ি যাওয়া লাগে কেনো?’
মনোয়ারা খানের তেজস্বী কণ্ঠ,
‘তোদের বাপ-বেটার মতো তো আর কেউ এতো খারাপ না। দু বছর হলো বাপের বাড়ি গিয়ে একটা রাত থাকতে পারি না। সকালে যেতে না যেতেই সন্ধ্যায় ফিরে আসতে হয়। ভালো লাগে না আর বাপু? কিসের ঘানি টানছি? মাঝে মাঝে মনে হয় এসব সংসার টংসার সব চুলোয় যাক। যত জ্বালা আমার। আল্লাহ আমার মরণ নেয় না কেনো? কবরে বসে তোদের বাপ-বেটাদের কার্যকলাপ দেখতাম। দেখি মা ছাড়া কেমনে চলিস? এখন তো কথা শুনছিস না। ‘
আর্দ্র চোখ মুখ কুচকে খিচ মেরে বিছনায় শুয়ে মায়ের বিলাপ শুনতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর মনোয়ারা খানের নরম কণ্ঠ ভেসে এলো,
‘যা না বাবা। তোর বাবা কি আর এখন ওতো পারে এই শরীরে? আদর ও নেই। হাসপাতালে সারাক্ষণ পরিশ্রম করে যাচ্ছে। মেয়েটা কি না খেয়ে থাকবে? ওর মা কতো করে ফোন দিয়ে বলল, মেয়েটাকে একটু দেখে রাখতে। একটু গিয়ে খাবারটা দিয়ে আয়। মেয়েটাকে বাড়ি আসতে বললাম আসবে না। দুপুরের পরে নাকি স্পেশাল দুটো ক্লাস আছে। ক্যান্টিনের খাবারও খায় না। এই খালিপেটে থাকলে তো মেয়েটার অসুখ করবে। একবেলার খাবারটাই তো। রাতে ওর মা এসে পরবে। যা একটু।’
বিরক্ত নিয়ে উঠে বসে আর্দ্র চিল্লিয়ে বলল, ‘সবসময় ব্ল্যাকমেইল কেনো করো মা? অসহ্য।’
,
সকাল দিক দিয়ে আজ রোদ উঠলেও দুপুর থেকে আকাশের মন খারাপময় মেঘলা। ভারী বর্ষন হবে বোধ হয়। আর্দ্র বাইকে বসে ভারসিটির গেটে দাঁড়িয়ে ছিলো। মিনিট পাঁচেক পর নিভার আগমন। পেছন পেছন গুটিগুটি পায়ে আরেক রমণীর আগমন বার্তা। আর্দ্রর চোখ পরলো নিভা পার করে সেই রমণীর উপর। আর্দ্র তাকালো ভালো মতোন। হেসে খিলখিল করে কথা বলে এগিয়ে আসছিলো ধীরে ধীরে। কি অদ্ভুত তার চুল খেলানোর দৃশ্য, চোখ বড় করার অভ্যাস, মুচকি হেসে হেসে শাসিয়ে কথা বলার ধরন। আর্দ্র নিমিত্তে তাকিয়ে থাকলো। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কেউ সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
‘এই আর্দ্র ভাইয়া? কই তাকায় আছো? খাবার দেও। খিদা লাগছে।’
চমকে নিভার দিকে তাকিয়ে আর্দ্র আবারো একই স্থানে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো। দৃষ্টিতে কেউ ধরা না দিতেই দেখা গেলো নিভার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টি খোঁজা সেই রমণী।
আর্দ্র খাবার দিচ্ছে না দেখে আর্দ্রর হাত থেকে খাবারটা কেড়ে নিলো নিভা। এরপর বলল,
‘মিট মাই ফ্রেন্ড টায়রা…।’
অবচেতনে আর্দ্র বলল, ‘জানি।’
অবাক কণ্ঠে নিভা বলে, ‘জানো?’
সম্ভিত ফিরে আর্দ্র পকেটে হাত গুজে দাড়ালো। একান্ত নিজস্ব ভঙ্গিতে বলল,
‘অবশ্যই চিনি তো ইনাকে। এমন মাথামোটা পাগল বাচাঁল মানুষকে কে চিনবে না বল তো? ঢাকা শহরে এমন মহিলা আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে তো আমার মনে হয় না।’
টায়রা তেড়ে এসে বলল, ‘ইউ ভাদ্র।’
টায়রার স্টাইলেই আর্দ্র বলল, ‘ইউ ফুটা টায়ার… জাস্ট সাট আপ।’
‘ইউ সাট আপ।’
নিভা বিস্ফোরণ চোখে ওদের দেখতে দেখতে বলল,
‘তোমরা একে অপরকে চিনো কীভাবে?’
আর্দ্র চুপ হয়ে মিনিট খানিক ভাবতে লাগলো এখন কি বলা যায়। তারপর বলল,
‘তুই যে আমাদের বাসায় এসে ছাদে গেলি। তোর ফোনে ময়নাপাখি ২ নামে সেভ করা নাম্বার থেকে ফোন এলো। তখন তোর ফোন আমি রিসিভ করেছিলাম। এই মহিলা তো রীতিমতো আমাকে কিডনাপার বানিয়ে দিয়েছিলো সেইদিন।’
নিভা তবুও বোকার মতোন বলল,
‘আমি তাও বুঝলাম না। ও ফোন দিয়েছে কিন্তু তুমি ওকে চিনলে কীভাবে?’
আর্দ্রকে থামিয়ে দিয়ে টায়রা বলল,
‘আমি বলছি শোন, তোকে বলেছিলাম না নিঝুম দ্বীপে আমাদের সাথে দুজন ছেলে ছিলো। আমাদের অনেক হেল্প করেছে। ইনারাই তারা। আদর এবং এই ভাদ্র।’
নিভা তাকিয়ে থাকলো মিনিট খানিক হা করে। আর্দ্র নখ কামড়ে ভাবতে লাগলো,
‘নিভা না বাসায় গিয়ে আবার আব্বুর সামনে বলে দেয়। আব্বুর সামনে বললেই আব্বু আবার ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে লাফাবে। তারউপর এক পা বাড়িয়ে উল্টো পাল্টা ভেবে নিজ দায়িত্বে সবার অজান্তে বিয়ে ঠিকও করে ফেলতে পারে। পরে ভাইয়া আমার গর্দান নিবে।’
টায়রার কথায় আর্দ্রের ভাবনায় ভাটা পরলো,
‘তোর মতো এতো ভালো একটা মেয়ের আর আদর ভাইয়ার মতো এতো সুইট একটা ছেলের এমন বলদ বেয়াদব মার্কা ভাই কীভাবে থাকতে পারে? আমি তো ভেবেই পাগল হয়ে যাই।’
আর্দ্র মুখ থেকে হাত সরিয়ে ঠোঁট বিকৃত করে জবাব দিলো,
‘এ্যাহ… নিজে খুব ভালো মনে হয়। টিকলির মতো এতো ভদ্র একটা মেয়ের এমন একটা অভদ্র ফুটা টায়ার মার্কা বোন কীভাবে থাকতে পারে আমিও ভেবে পাই না। এই তুই কি খায়ে এরে বান্ধুবী বানাইছোস? আবার ফোনে নাম্বার সেভ কইরে রাখছোস ময়নাপাখি ২। বাই দ্যা ওয়ে, ময়নাপাখি ১ কে ?’
আর্দ্র ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো। নিভা চোখ মুখ কুচকে জবাব দিলো, ‘টিকলি।’
‘ওহ ভালো কথা। আমার বোন আসে নাই? আমার বোনরে তো দেখি না।’
‘আমি তো চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি ভাইয়া। কাকে খুঁজো তুমি?’
‘তোরে কে খুজঁছে? টিকলি কই?’
‘আসে নাই মাথা ব্যথা।’
টায়রা অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ ভার করে জবাব দিলো। মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলো। টিকলি আজ কেনো আসলো না কে জানে? এমন কখনো হয়নি টিকলিকে ছাড়া টায়রা একা ভারসিটি এসেছে। আজ প্রথম। আর্দ্র আড়চোখে তাকিয়ে থাকলো টায়রার ওই দুঃখী ভারাক্রান্ত মুখটার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাইক স্টার্ট দিয়ে শা… করে চলে গেলো ঠিক সেদিন টায়রা যেভাবে চলে গিয়েছিলো।
________________________________
ঝুম ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তড়িঘড়ি করে রেসটুরেন্ট ঢুকলো টিকলি। জামা ভিজে একাকার। আধভেজা শরীরে রেসটুরেন্টে পা রাখতেই খিদখিদ লাগতে শুরু করলো। দেখা করার কথা ছিলো খোলা আকাশের নিচে মাঠের তেপান্তরে অবাধ্য নদীর ঢেউয়ের পাড়ে কিন্তু এই বৃষ্টিটাই বাধ সাজলো। সবসময় বৃষ্টি ভালোকিছু বয়ে আনে না কিংবা সুখেরও হয়না। ভেজা জামা ঝাড়তে ঝাড়তেই টিকলি ফোন লাগালো আদরকে।
‘এসেছেন আপনি?’
‘জি। বাম পাশের তিন নম্বর টেবিলটা।’
ফোন কানে ধরেই হালকা উঁকিঝুঁকি দিতেই টিকলি পেয়ে গেলো। এখান থেকে লোকটার পেছনের অর্ধঅংশ এবং বাম হাতের বাদামী রঙের ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে। দেখা পাওয়া মাত্র এক অনাবিল সুখে, আনন্দে, শান্তিতে টিকলির আত্মা ঠান্ডা হয়ে গেলো। হঠাৎই মনে হলো, স্বার্থক আজকে নার্ভাসনেস এ ভারসিটি না যাওয়া, এই বৃষ্টি, এই কর্দমাক্ত দিন, এই আধ ভেজা শরীর।
কান থেকে ফোন সরিয়ে অনেক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এগিয়ে সামনে যেতেই দেখা হয়ে গেলো খুব অনাকাঙ্ক্ষিত একটা মানুষের সাথে। মানুষটিকে চিনতে মিনিট দুই সময় লাগলো। মাস্কের সেই ফালতু লোকটার কথা মনে পরতেই টিকলি আঙ্গুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলো,
‘আপনি….’
আদর বসে অপেক্ষা করছিলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটার জন্য। হঠাৎ কারোর বাজখাঁই গলার কন্ঠস্বরে আদর ঘুরে তাকাতেই দেখা গেলো, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথায় স্কাপ, মুখে মাস্ক, জামা কাপড় ভিজে একাকার। মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আদর বুঝার চেষ্টা করলো তার এমন অভদ্র আচরণের কারণ। ভালো ভাবে পরখ করতেই দেখলো, এটা সেই বোকা পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়ে। বুঝা মাত্রই আদর চট করে উঠে দাড়ালো। নিজ তেজি গলায় বলল,
‘আপনি??’
টিকলি চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আপনি এই টেবিলে কেনো?’
আদর পকেটে হাত ডুকিয়ে তারস্বরে বলল,
‘কেনো টেবিলটা কি আপনার সো কল্ড পনেরো দিনের বাচ্চার বাবা কিনে নিয়েছে?’
‘ফালতু কথা বলবেন না।’
‘ওহ আচ্ছা এটা তবে ফালতু কথা? তাহলে ভালো কথা বলি। আপনার বাচ্চার এখন কত মাস চলছে জানি? উমমম…ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে পাঁচ-ছয় মাস তো হওয়ার ই কথা ছিলো। কিন্তু আপনার পেটের তো কোনো ইম্প্রুভমেন্ট নাই। হায় আল্লাহ! বাপের মতো ধোকাবাজ হলো বুঝি? ইশশ আমার এখন আপসোস হচ্ছে নিউরোলজিস্ট না হয়ে গাইনোকোলজিস্ট কেনো হলাম না?’
‘এই দেখুন, বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না।’
‘এই দেখাদেখির অভ্যাস টা আর আপনার গেলো না। নিন কি দেখাবেন দেখান?’
‘ইডিয়েট। অত্যাধিক মাত্রায় বাড়াবাড়ি করছেন এবার।’
‘বাড়াবাড়ি আপনি করছেন। সুন্দর দিনের সুন্দর একটা মুহুর্ত সুন্দর একটা মুড আপনাকে দেখেই নষ্ট হয়ে গেলো।’
আদরের এহেন কথায় হঠাৎ একটা আকস্মিক কাজ করে বসলো টিকলি। মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে ঝগড়ায় তাল দিলো,
‘আর আপনাকে দেখে মনে হয় আমার মুড একদম রেললাইনের গতিতে চলছে? আপনাকে আমার বিন্দুপরিমাণ দেখতে ইচ্ছে করে না। আই উইশ আর কখনো আপনার এর ফাটাবাঁশের মতো চেহারার সাথে আমার দেখা না হতো।’
আদর স্তব্ধ, নিস্তব্ধ, নিরব দর্শকের মতো শুনে গেলো। শুধু তাকিয়ে থাকলো ওই মুখখানার দিকে যে মুখটার দিকে তাকালেই হৃদয়-বুক জমিন কেঁপে যায়। ভূমিকম্প শুরু হয় মন-আসমান জুড়ে। ওই চশমার আড়ালে যে দুটো চোখ দেখার আদরের খুব ইচ্ছে ছিলো তা আজও আড়াল হয়ে আছে লেন্সের পেছনে। ইশশ…এই কপাল! এই কপাল থেকে শুরু হওয়া দু গাছি চুল তো আদরের খুব প্রিয়। তবুও আদর বুঝতে পারলো না। ধরতে পারলো না। কণ্ঠ শুনেও বুঝতে পারলো না? কীভাবে সম্ভব?
টিকলি তখনো বলছিলো,
‘কথা বলছেন না কেনো?’
আদর আস্তে করে নিজের মুখ থেকে মাস্ক খুলল। টিকলি চোখ বড় বড় করে তাকালো। আস্তে আস্তে চোখ শীতল হলো। দগ্ধ হলো। পুড়লো। টিকলি হঠাৎ বসে পরলো একটা চেয়ারের উপর। চোখ মুখ ঢেকে রাখলো হাতের দশ আঙ্গুল দিয়ে। মাথার চুল খিচে ধরলো। অনুভব করতে পারলো না কিচ্ছু। হাহাকার বিভীষিকাময় কষ্টে হঠাৎই বুকটা ছেয়ে উঠলো। নতুন নতুন অনুভূতি গুলো কি তবে এখানেই শেষ হয়ে যাবে? এখানেই কি তবে ইতি ঘটে যাবে হয়েও হলো না ভালোবাসার? প্রেম প্রেম গন্ধ কি তবে দুর্গন্ধ ছড়াবে?মরে যাবে কি অনুভব পাখিরা? খুব অজান্তেই… খুব বেশি অজান্তেই ভুল হয়ে গেলো। মস্ত বড় ভুল। কলি বের হওয়া গাছটাতে ফুল প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই মরে গেলো। আর হবে কি কখনো এক হওয়া?
আদর খুব গোপন নিরবে বেরিয়ে গেলো রেসটুরেন্ট থেকে। টিকলি আরো বেশি ভেঙে পরলো। উপরে তাকিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতেই দেখা গেলো আজও সেই রেস্টুরেন্টে। প্রথম যেদিন এই ফালতু লোকটার সাথে দেখা হয়েছিলো। প্রথম যেদিন টিকলি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট সেজেছিলো। প্রথম যেদিন নিজের অহেতুক বোকামির পরিচয় দিয়ে আদরের কাছে অপমানিত হয়েছিলো। মজার কারণ হয়েছিলো। আদর নামক এই বেয়াদব ব্যক্তি বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিলো টিকলির মনের কাছে।
চলবে❤️
#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
২৭.
কাকভেজা শরীরেই বিছানায় বসে পরলো টিকলি। বিছানার এক কোণায় আধশোয়া অবস্থায় ফোন চালাচ্ছিলো টায়রা। বিছানা কেপে উঠতেই সে তাকালো। ভেজা শরীর নিয়ে বিছানায় বসতে দেখে টায়রা বিরক্ত হলো। গম্ভীর গলায় বলল,
‘বিছানা ভিজে যাচ্ছে।’
টিকলির কোনো হেলদোল পাওয়া গেলো না। টায়রা ভ্রু কুচকে তাকালো। এবার খানিক উঁচু গলায় বলল,
‘বিছানা ভিজে যাচ্ছে তো।’
তখন হঠাৎ টিকলির চোখ থেকে টপ করে পানি পরলো তার মসৃণ হাতের উপর। টায়রা থেমে গেলো। রাগ-ক্ষোভ অভিমান ভুলে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে টিকলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলল,
‘কি হয়েছে?’
টিকলি অতর্কিতভাবে ঝাপটে ধরলো টায়রাকে। বাধন ছাড়া কান্নায় মত্ত হতে হতেই হেচকি উঠে গেলো। ঘরময় কেঁপে উঠলো টিকলি আর্তনাদময় বেদনার অভিসারে। টায়রার বুকে অঘটন ঘটার পূর্বাভাস। টিকলিকে বুক থেকে সরিয়ে টায়রা তাড়াতাড়ি ঘরের কাঠের দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে দিয়ে এলো। এরপর আবার টিকলিকে জড়িয়ে ধরে বসলো। টিকলির কান্নার বেগ বাড়লো। টায়রা দিশেহারা পথভ্রষ্ট পথিকের মতো এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।
টিকলি কাদে না। খুব বেশি যখন কষ্ট পায় তখন এভাবে চিতকার করে কাদে। বোনকে কাদতে দেখে টায়রার চোখ বেয়েও পানি পরলো। ওই যে বলেছিলাম, টায়রা প্রচুর কাদতে পারে। কিছুক্ষণ পর টিকলির কান্নার মাত্রা কমলো। টায়রা তখন শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে আমাকে বল? কে বকেছে তোকে? আমি দেখে নিবো তাকে।’
টিকলির থেকে উত্তর পাওয়া গেলো না। টায়রা উৎকন্ঠা নিয়ে টিকলির হাত পা ভালো করে দেখে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায় গিয়েছিলি এই বৃষ্টির মাঝে? বল না বল। কেউ কিছু করেছে? খারাপ কিছু হয়েছে তোর সাথে? শরীরের কোথাও কেউ হাত দিয়েছে? কাদছিস কেনো? একবার নামটা বল দেখ আমি কি করি….’
‘আমি আদরকে ভালোবাসি।’ টিকলি কাদার মাঝেই আস্তে করে বলল। টায়রা শুনলো না টিকলির কথা নিজের মতো কথা বলতে যাওয়ার মাঝেই টিকলি আরেকবার জোরে বলল, ‘টায়রা, আমি আদরকে ভালোবাসি।’
টায়রা থেমে স্তব্ধ হয়ে গেলো। নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে থাকলো টিকলির দিকে। টর্নেডোর মতো আশেপাশে সব ঘুরপাক খেলো। মুখের বাক শক্তি হারিয়ে শুধু এক নিমিত্তে তাকিয়েই থাকলো। টিকলি আবার বলল,
‘আমি আজ উনার সাথেই দেখা করতে গিয়েছিলাম।’
‘তুই আমাকে একবারও বললি না টিকলি?’ টায়রার করুণ গলা। চোখের পাতা বন্ধ করে ঠোঁট চেপে টিকলি বলল,
‘আমি ভেবেছিলাম উনার সাথে দেখা করার পর তোকে সব বলবো।’
‘তো কানতাছোস কেন? ভালোবাসছোস দেখা করছোস এখন দেখমু প্রেমও হয়ে যাবো। এখন আইসে কান্নাকাটি করতাছোস কেন? আমি তো আর তোর কেউ না।’
টায়রা তেজস্বী গলায় বলল। টিকলি কোনো উত্তর না দিলে টায়রা আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘ আদর ভাই তোরে ভালোবাসে না? কথা বলোস তোরা ফোনে? নাম্বার কেমনে পাইছোস? যোগাযোগ কেমনে?’
টিকলি উদাস চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলো, ‘উনি ভালোবাসে কিনা আমি জানিনা।’
‘যোগাযোগ কেমনে হইলো? নাম্বার পাইছস কেমনে?’ টায়রা ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো।
‘মামাজান আমাকে যে নিউরোলজিস্ট এর কাছে নিয়ে গেছিলেন সেই ডাক্তারই উনি ছিলেন।’
‘ওহ! এরপরই সব হয়ে গেলো? এরজন্যই তোমার এতো ঘন ঘন ফোন আসে? আর বারবার উনি উনি করোস কেন? জামাই লাগে তোর?’ টায়রা ধমক দিয়ে বলল।
‘তুই আমার সাথে মজা করতাছোস? ফাইযলামি লাগতাছে এসব তোর কাছে?’
টিকলির রাগী গলা। হাই তুলে টায়রা উত্তর দেয়,
‘বিরক্ত লাগতাছে। প্রথমে ভাবলাম না জানি কি হইছে? আর এখন শুনি লাভ কেস। ধ্যাত আমার ইমোশন গুলার বারোটা বাজায় দিলি।’
টিকলি বৈরাগী চোখে তাকিয়ে থাকলো বারান্দা গলিয়ে আকাশের দিকে। খুব ধীর গলায় বলল, ‘তুই বুঝতে পারছিস না টায়রা।’
‘কি বুঝতে পারছি না?’
টায়রার দিকে একাচ্ছন্ন নয়নে তাকিয়ে টিকলি জবাব দিলো, ‘এই সেই পাত্র যার সামনে আমি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট সেজেছিলাম।’
অবাক বিষয়তৃষ্ণা শূন্য দৃষ্টিতে টায়রা তাকিয়ে থাকলো। স্বগতোক্তি করে বলল, ‘কি বলস?’
‘হুম।’
‘সত্যি?’
‘হুম। আজ যখন রেসটুরেন্টে গেলাম দেখা করার উদ্দেশ্যে তখন দেখি মাস্ক পরা অবস্থায় সেই লোক। পরে মাস্ক খুলতেই দেখলাম উনি।’
‘কিন্তু তাতেই বা কি হয়েছে? এতে এতো কাদা-কাদির কি আছে?’
‘উনি আমাকে চিনার পর বিনাবাক্যে রেসটুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেছেন। সমস্যা টা এইখানেই। চলে কেনো গেলো সে?’
‘দেখ, তুই যেমন তাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে কেদে ফেলেছিস। ঠিক তেমনি সেও হয়তো তোকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পরেছিলো। পুরুষ মানুষতো আর যখন তখন কাদতে পারে না? তাই হয়তো নির্বাকে চলে গিয়েছে।’
‘সত্যি কি তাই?’
‘হতেই পারে?’
‘যদি এমন না হয়। আমাকে চেনার পর যদি সে আর আমার সাথে কথা না বলে? ওই মিথ্যা বানোয়াট প্রেগন্যান্সি এবং বয়ফ্রেন্ডের কথা সত্যি ভাবে তখন?’
টিকলি রুদ্ধ গলায় বলল। বলতে গেলেই চাপা হয়ে এলো গলা। মন খারাপেরা আবারো বাধ ভাঙলো।টায়রা হতাশ চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
‘হ, সবাই তো তোমার মতো বলদ।’
টায়রা আবার বলল, ‘আর শোনো মেয়ে, তুমি একদম আমার সাথে কথা বলবা না। তুমি আমার থেকে লুকায়ছো এত্তোবড় ঘটনাটা। বিশ্বাসঘাতকতা করছো।’
‘এমন করিস না বোন। আমি অনেক সরি। আপু ভেরি ভেরি সরি।’
________________________________
ঝুম বৃষ্টিতে আদর রেসটুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নির্লিপ্ত পায়ে কাদা মাড়িয়ে হেটে হেটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে লেগে গেলো প্রায় দু-ঘন্টা। কাকভেজা হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসতেই মনোয়ারা খানের মুখোমুখি হলো। মায়ের অবাক চোখের কৌতুহল ভরা দুটি মনি। আদর এক পলক তাকিয়েই আবারো অনুরাগহীন পায়ে চলে গেলো নিজের ঘরে।
ভাই এসেছে খবরটা পেয়েই ভাইয়ের খোঁজে আদরের ঘরে চলে এলো আর্দ্র। আদর নিরবচ্ছিন্ন নিরবতায় বসে ছিলো একান্ত ব্যক্তিগত পছন্দের নিজের কালো চেয়ারটাতে। আর্দ্র ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
‘কি করো ভাইয়া? কি হইছে?’
ক্লান্ত গলায় আদর বলল, ‘কি হবে? হওয়ার মতো তো কিছু নেই।’
‘কোথা থেকে আসলে?’
‘কাজে গিয়েছিলাম একটা।’
‘ওহ। আচ্ছা, তুমি কি প্রেমে পরলা নাকি?’
কপালে হাত দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল আদর। আর্দ্রের কথায় কপাল থেকে হাত নামিয়ে ভ্রু কুচকে বলল, ‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
আমতা আমতা করে আর্দ্র উত্তর দিলো, ‘না মানে। তোমার ফোনে দেখলাম আরকি।’
‘কি দেখলি?’
‘কাল যখন তুমি ওয়াশরুমে ছিলে তখন দেখলাম মনতাঁরা নামে সেভ করা একটা নাম্বার থেকে কল আসলো।’
আদর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারো এলোমেলো হয়ে গেলো। নিরস দেহটা নিছকই প্রাণহীন বনে গেলো। চেয়ারের হাতলে এলিয়ে দিলো মাথা। প্রথম দিনই মনতাঁরা নামে টিকলির নাম্বার সেভ করে রেখেছিলো। কেনো রেখেছিলো কে জানে! কিন্তু মন শুধু এটাই জানে এই তাঁরা ফোন করলেই আদরের বুকপাটাতন জ্যোৎস্নানাথ পাওয়ার উদ্দেশ্যে মেতে উঠতো। গোলাপে গোলাপে ছেয়ে যেতো দ্বিজরাজের বাগান। সৌন্দর্যে ভরে উঠতো যেই পয়োনিধি কুৎসিত।
আর্দ্র চলে যেতে নিলেই আদর অনুভবশূন্য গলায় ডাকলো,
‘আর্দ্র।’
পেছন ফিরে তাকিয়ে আর্দ্র জবাব দিল, ‘জি ভাইয়া।’
‘সেই পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েটা টিকলি। তোর তো জানার খুব ইচ্ছে ছিলো তাই জানিয়ে দিলাম।’
আর্দ্র বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো। যেনো এই দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে এক্ষুনি অবাকতারা একে একে জড়ে পরবে। টালমাতালা গলায় আর্দ্র বলল, ‘কি? টিকলি…’
আর্দ্রকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদর কঠোর গলায় বলল, ‘এই নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। নিজের ঘরে যা।’
,
টিকলি ফ্রেস হয়ে আসার কিছুক্ষণ পরই আগমন ঘটলো শায়লা আক্তারের। মায়ের দিকে গোয়েন্দা নজরে তাকিয়ে থাকলো টায়রা। শায়লা আক্তার ধমকে বললেন,
‘এমনে চ্যারা চোখে তাকায় থাকোস কেন? মনে হয় চুরি করতে ঢুকছি।’
‘নাহ তুমি তো সচরাচর আসো না আমাদের ঘরে।’
‘আমাদের ঘর? ঘর লেইখে দিছি নাকি তোদের? কত টাকায় বিক্রি করলাম?’
টিকলি বিরক্ত গলায় বলল, ‘মা, কিছু বলবা? বললে বলো তা নাহলে এক কাপ কফি দাও। মাথা ব্যথা করতাছে।’
শায়লা আক্তার মেয়ের পাশে বসলেন। মেয়ের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে মধুমিশ্রিত গলায় বললেন,
‘কান্না করছস নাকি? চোখ মুখ ফোলা কেনো? তখন মনে হলো কারোর কান্নার আওয়াজ শুনলাম।’
‘না মা। কান্না করবো কেনো? এমনি সাইনাসের ব্যথা বেড়েছে। তুমি কি বলতে এসেছো বলো না।’
‘হুম। শোন মা, তোর বাবা একটা পাত্র দেখেছে…’
শায়লা আক্তার কথা শেষ করার আগেই টায়রা চেঁচিয়ে বলল, ‘কি? বাবা আবার পাত্র দেখেছে?’
কটমট করে শায়লা আক্তার বললেন, ‘নাহ, ছেলেবাড়ি থেকে সম্বন্ধ এসেছে। আর তুই এতো লাফায় উঠোস কেন? বিয়ে কি তুই করবি?’
‘অবশ্যই আমার লাফায় উঠতে হবে কারণ টিকলির থেকে আমি মাত্র এক বছরের ছোট। সে হিসেবে টিকলির বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার বিয়ে দেওয়া তোমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু এই দায়িত্ব আমি মেনে নিতে পারিনা। কারণ আমি এতো তাড়াতাড়ি আমার বিন্দাস লাইফ শেষ করে দিতে পারিনা বোন ছাড়াও থাকতে পারিনা আবার জামাই ছাড়াও থাকতে পারিনা। ইশশ..কি যন্ত্রণা! কি করলে এই সব একবারে পাওয়া যাবে আইডিয়া দাও তো আম্মু।’
‘ঠাটায় একটা চর মারার পর আইডিয়ারা হাটি হাটি পা পা করে এমনেই চলে আসবে আম্মাজান।’ দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল শায়লা আক্তার।
‘আমি এখন বিয়ে নিয়ে ভাবছি না মা। প্লিজ এসব বিয়ে বিয়ে খেলা বন্ধ করো। একটু শান্তি দাও। তা নাহলে দু’চোখ যেইদিকে যাবে আমি সেদিকে চলে যাবো।’ টিকলির অকপটে জবাব।
‘সাথে আমারেও নিস। এই মাসুম বোনটারে ফেলায়ে এক একা যাইস না। ভয় পাবি। সাথে আমার অভিশাপও লাগবো।’ টায়রা কাদো কাদো হয়ে বলল।
টিকলি বিরক্ত হয়ে বলল,
‘সবসময় ফাইযলামি করলে কানের তিন আঙ্গুল নিচে খাবি একটা।’
,
সেদিন রাত থেকেই ধুমিয়ে জ্বর এলো আদরের। জ্বরে পাগল প্রায় আদরের সেবা যত্নে নিয়োজিত সর্বকাছের মা মনোয়ারা খান। কেদে বুক ভাসাচ্ছেন তিনি ক্ষনে ক্ষনে। ছেলের জ্বর হয়না প্রায় দু’বছর যাবৎ। হঠাৎ করে এই মাত্রাতিরিক্ত জ্বর হওয়ার কারণ কেউ ধরতে না পারলেও মনোয়ারা খান কান্নাভেজা গলায় বললেন,
‘আরো বেশি করে বৃষ্টিতে ভিজ। জ্বর তোর আসবে না তো কার আসবে।’
মায়ের কথা আদরের কানে গেলো না। দেয়ালে দেখা গেলো একটা টিকটিকি ঘুরে চলেছে অবিরাম। আদর আধো চোখ দিয়ে তা দেখে মৃদু হেসে জ্বরের ঘোরে নিচুগলায় বলল,
‘মা দেখো টিকটিকি। মিস. টিকটিকি।’
মনোয়ারা খান কিছুক্ষণ হাবুলের মতোন তাকিয়ে থেকে বিলাপ পেরে কেদে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত জ্বরের কবলে পরে তার ছেলেটা পাগল হয়ে গেলো? টিকটিকি দেখিয়ে বলছে মিস. টিকটিকি। হায় আল্লাহ! এই দিন দেখানোর আগে আমার মরণ কেনো হলো না? আমাকে তো কোনোদিন কেউ বলেনি মিস. মনোয়ারা খান আর একটা টিকটিকিকে মিস? এতো সম্মান??
চলবে❤️