#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
৩০.
রাহুল যখন ও বাড়ি থেকে বের হলো তখন প্রায় বিকেল। বর্ষনমন্দ্রিত অন্ধকারেও যেনো চারিপাশে ফুটে উঠেছে অন্যরকম রওশন। মেঘমাখানো অন্ধকার থাকতে থাকতেই চোখ মুখ বন্ধ করে ঝুম বৃষ্টি নেমে পরলো। এদিক ওদিক একটা রিক্সাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। অশনি ক্ষণপ্রভা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে রাহুল একটা দোকানের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিলো। বন্ধ দোকান। সামনে দুটি খালি বেঞ্চ। বাঁশ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা উপরে টিন।
প্রায় আধ ঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে থেকেও যখন কোনো রিক্সার দেখা পাওয়া গেলো না রাহুল তখন ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়েই নেমে পরলো রাস্তায়। ঘন ঘন বিকট আওয়াজে তড়িৎ তখন। রাস্তার এক ধার দিয়ে কাক ভেজা হয়ে ফিরছিলো রাহুল। দু ঘন্টা পর তার একটা টিউশনি আছে। এখান থেকে বাসায় পৌছুতেই লেগে যাবে এক ঘন্টা। তারউপর নিঝুম বৃষ্টি। রাহুল ধীর পায়ে হেটে চলল। টিউশনিতে যাওয়ার নিয়ম টা হঠাৎ আজকে একটু অনিয়মিত তে পরিণত করতে ইচ্ছে হলো। বৃষ্টির পানির সাথে দূর্লভ চোখের পানি ভাসিয়ে যেতে লাগলো নিজের গন্তব্যে। কি জোরে জোরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! আচ্ছা এই ব্জ্রপাতে তো সে মরেও যেতে পারে আজ? হতে পারেনা? হতেই পারে? নাথিং ইজ ইম্পসিবল ফর এনভায়রনমেন্ট।
সুদূরপ্রসারী অবাঞ্ছিত ভবিষ্যৎ ভাবার কালেই কারোর ডাক পরলো। বৃষ্টির আওয়াজে স্পষ্ট শুনা গেলো না। রাহুল ঝাপসা চোখে তাকালো। ভেজা চুলগুলো লেপ্টে ছিলো কপালের সাথে৷ হাত দিয়ে মুখের পানি মুছার ব্যর্থ চেষ্টা করে রাহুল ভালোভাবে তাকালো। ওমনি তার সামনে এসে দাড়ালো একটা রিক্সা। নীল পলিথিনের নিচে ভেজা ঝপঝপে একটা মিস্টি মেয়ে। মুখে শীতল হাসি। রাহুল ঠিক ঠাহর করতে পারলো না মেয়েটাকে। সচেতন চোখে তাকিয়ে থাকতেই মেয়েটা হাত নাড়িয়ে হাই দিয়ে চিতকার করে বলল,
‘এই বৃষ্টিতে ভিজে কোথায় যাচ্ছেন?’
বৃষ্টির প্রকট শব্দ ভেদ করে রাহুলও চিতকার করে বলল, ‘ আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।’
‘আমি নিভা। ভুলে গেছেন?’
‘কোন নিভা?’
‘টিকলি টায়রার ফ্রেন্ড। ওই যে দেখা হলো।’
রাহুল চিনতে পেরেও পারেনি এমন অবহেলার সুরে বলল, ‘ওহ।’
‘বৃষ্টিতে ভিজছেন কেনো? ঠান্ডা লাগবে না?’
‘না। আমার ওতো অসুখ বেসুখ হয় না।’
‘কি বললেন? জোরে বলুন। আচ্ছা, উঠে আসুন রিক্সায়। এই পথে এখন আর রিক্সা পাবেন না।’
রাহুল অবাক হলো। মেয়েটার দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে পুরোদমে তাকাতেই মেয়েটাকে পুরোদস্তুর মনে পরলো। হ্যাঁ, এই মেয়েটাকে ফুফিদের বাসায় দেখেছিলো। রাহুল বলল,
‘আপনি যান, আমি রিক্সা পেয়ে যাবো।’
‘উঠে আসুন। পাবেন না রিক্সা। আমি জানি। এই রাস্তা দিয়ে আমার চলাফেরা আছে। আর আগামী দু-তিন ঘন্টার মধ্যে এই বৃষ্টি থামবে না।’
‘আপনি কীভাবে জানলেন?’
‘এতোবছর হলো বৃষ্টি দেখছি একটু আকটু অভিজ্ঞতা তো আমারও হয়েছে তাইনা?’
রাহুল হাসলো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো রিক্সায় উঠা ঠিক হবে কিনা। মেয়েটার কথা যদি সত্যি হয় তবে রাহুলের দুটো টিউশনি মিস যাবে। আর এই রাস্তার যে অবস্থা রিক্সা না পেলে সর্বনাশ। তাছাড়া শিক্ষার্থীর গার্ডিয়ান ভীষণ কড়া। তাদের কথা হলো, মরে যাও তবুও আমার ছেলে মেয়েকে পড়াতে আসবে। এমনও হতে পারে মাস শেষে বেতনও কম দিয়ে দিয়েছে। হাতে মাত্র এই পরপর দুটো টিউশনি অবশিষ্ট আছে। এ দুটো খোয়া গেলে রাহুল চলবে কেমন করে। সব চিন্তা শেষে রাহুল রিক্সায় উঠার সিদ্ধান্ত নিলো। রিক্সার জায়গা খুব বেশি চাপা হওয়ায় রাহুল হুট ফেলে দিলো। নিভা ব্যস্ত গলায় বলল,
‘আরে করেন কি? ভিজে যাবো তো? এভাবে ভিজেই যদি যাই তবে তো হাটাই ভালো ছিলো।’
রাহুল এক পলক তাকিয়ে উপর থেকে নীল পলিথিনটাও সরিয়ে রিক্সাওয়ালা মামার হাতে ধরিয়ে দিলো। নিভা পুরোদস্তুর ভিজে যেতেই রাহুল বলল,
‘রিক্সার জায়গা চাপা।’
‘রিক্সার জায়গা চাপাই থাকে।’
‘আপনার কি খুব অসুবিধা হবে? অসুস্থ হয়ে পরবেন?’
‘না।’ মুখে না বললেও নিভা জানে আজ রাতেই তার হালকা পাতলা জ্বর উঠবে।
‘আপনি এখানে কোনো কাজে এসেছিলেন?’ নিভার প্রশ্ন।
‘হুম। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আপনি?’
‘আরে আমার বাসা তো এই রোডেই। কিন্তু আপনাকে কখনোই খেয়াল করিনি।’
রাহুল অন্যদিকে তাকালো। অন্যমনস্ক হলো। এই রোডে বাড়িটা কেনা হয়েছে চার বছর ধরে। তার আগে থাকা হতো অন্য বাড়িতে। আর প্রায় সাত বছর থেকে রাহুল পরিবার ছাড়া থাকে। হুটহাট পূর্ণিমা চাঁদের মতো এই এলাকায় উঁকি দেয়। ভাবনার দড়ি ছিড়লো কোনো যত্নের সুরে,
‘আপনার কি মন খারাপ? চোখ-মুখ ও ফোলা। বৃষ্টিতে ভিজে হলো বুঝি?’
রাহুল মাথা নাড়িয়ে না করলো। প্রাণহীন দৃষ্টি দুটি আবারো অন্যদিকে রাখলো। নিভার আড়ালেই নিষ্প্রাণ দুটি চোখ কাদতে বসলো নিঃশব্দে। নিভা রাহুলের মাথার পেছনের সাইডটার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। খুব স্বল্প পরিচিত মানুষের সাথে এতোটা কথা বলা যায়না।
অর্ধ রাস্তায় আসতেই বৃষ্টি কমে এলো। রাহুল আকস্মিক বলল, ‘মামা দাড়ান।’
রাহুল নেমে পরতেই নিভা বিস্ময়সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। রাহুল সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলল,
‘বৃষ্টি কমে এসেছে। এবার এখান থেকে রিক্সা পেয়ে যাবো। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এতোটা উপকার করার জন্য। ভাড়া দিয়ে অপমান করলাম না।’
বিস্ময়ে থেকেই নিভা মাথা নাড়ালো। হঠাৎই বোধ হলো লোকটা ঠোঁটকাটা সাথে স্ট্রং পারসোনালিটি।
‘মামা উনাকে উনার স্থানে নিয়ে যান।’
রিক্সা চলতে শুরু করলো। রাহুল আরেকটা রিক্সা পেলো। ভাড়া করেই এক নজর তাকালো সেই রিক্সা বরাবর দূর-দূরান্তে। তাকাতেই দেখতে পেলো এক মোহান্ত অতল দর্শনেন্দ্রিয় পেছনে ঘুরে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে তাকাতেই সরিয়ে নিলো অভিলাষী সেই নয়ন।
_________________________________
মাঝে কেটে গেলো দু-তিন দিনের মতো। খাবার পর ফোন হাতে ঘরে বসে ছিলো টিকলি। আদরের নাম্বারটাতে ডায়াল করতেই পাশ থেকে দেখতে পেলো টায়রা। ছু মেরে ফোনটা নিয়ে এক দৌড়ে বারান্দায় যেতে যেতে তারস্বরে চেঁচিয়ে বলল,
‘আমি কথা বলবো। আজকে আমি কথা বলবো।’
টিকলিও বোনের পেছন পেছন ছুটলো। ফোন নিয়ে কাড়াকাড়ি করতেই ওপাশ থেকে ফোন ধরে বসা হলো। টায়রা ফিসফিস করে বলল,
‘হুশশ…চুপ থাক।’
ফোন কানে নিতে নিতেই টায়রা টেনে বলল,
‘হ্যাললো… দুলাভাই। কি খবর হুম? গোপনে গোপনে পিরিত করে ফেললেন? এখন আবার গোপনে গোপনে কথাও আদান-প্রদান হচ্ছে? বলি সারাদিন কি শুধু বউয়ের খবর নিলেই চলবে? শালির দিকে একটু নজর দিতে হবে না? এতো সুন্দর শালি আপনার!’
টিকলি টায়রার হাতে চিমটি কাটলো। টায়রা হাত ঝাড়া মেরে দূরে সরে দাঁড়িয়ে আবারো বলল,
‘কি? শালির কণ্ঠ শুনতে না শুনতেই মুখের বুলি হাওয়া? ভয় পেলেন নাকি? আরে ভয় পাচ্ছেন কেনো আমি সব জানি। আমি আপনাদের সিকিউরিটি গার্ড বুঝলেন? এই যেমন ধরেন, টিকলি আপনার সাথে কথা বলছে কিন্তু ঘরে কখন আব্বু আম্মু আসে তার দেখার দায়িত্ব আমার। বিভিন্ন ভাবে কথা কাটিয়ে টিকলিকে বিয়ের জোর-ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও আমার। এক কথায় আমি আপনাদের হ্যাল্পিং হ্যান্ড। তো, এতো পরিশ্রম করি আপনাদের জন্য তার বিনিময়ে শালীকা কে তো কিছু দেওয়া উচিত। ফাউ ফাউ দুলাভাই একদম গ্রহণযোগ্য নয়।’
ওপাশ থেকে তখন বিস্ময়ে দুর্বাক গলায় বলা হলো,
‘দুলাভাই?? ভাইয়া বিয়ে করেছে? আমাকে না জানিয়েই?’
টায়রা হতবাক হয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি ফোনটাকে সামনে এনে হাত দিয়ে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
‘এই তুই কার নাম্বারে দিছস?’
‘কেনো? তোর ভাইয়ার নাম্বারে।’
‘সত্যি?’
‘ওমা! মিথ্যে হতে যাবে কেনো? পাগল হলি নাকি? প্রতিদিন তো এই নাম্বারেই ফোন দিয়ে কথা বলি।’
ওপাশ থেকে শতবার হ্যালো হ্যালো শুনা গেলো। আদর গেছে ওয়াশরুমে। ভাইয়ের ঘরে আসতেই আর্দ্র দেখলো ফোনটা বাজছে। ফোনের উপরে নাম ভেসে উঠেছে ‘শুকতাঁরায় মনতাঁরা’। আগে ছিলো শুধু মনতাঁরা। কিন্তু এখন আবার শুকতাঁরাও লাগানো হয়েছে। কৌতুহল বশত ফোনটা রিসিভ করতেই অজানা সব তথ্য পাওয়া গেলো। অবাকতায় বশীকরণও হয়ে যাওয়া হলো যখন টিকলির নামটা কর্ণগোচর হলো। আর্দ্র আবারও বলল,
‘ভাইয়া টিকলিকে বিয়ে করেছে, টায়রা?’
টায়রা চমকালো। আয়হায়! এ বেটা তো টায়রাকে চিনে ফেলেছে এবার কি হবে? কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে আদর ভাইয়া আর টিকলিদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। নিশ্চয়ই আদর ভাইয়া ইচ্ছে করে ভেবেচিন্তেই ব্যাপারগুলো জানায়নি। এখন টায়রা বলে দিলে যদি আবার বিপদ হয়। যদি উনার বাবা-মাকে বলে দেয়। নানা চিন্তাভাবনার কবলে পরে টায়রা বাইরে ডাট বজায় রেখে বলল,
‘এই, আপনি ফোন ধরেছেন কেনো হ্যাঁ?’
আর্দ্র রাগান্বিত গলায় বলল, ‘একদম ঝগড়া করার তাল তুলবেন না। আমার ভাইয়ের ফোন আমি যখন ইচ্ছা তখন ধরবো।’
‘নাহ ধরবেন না। ফোন যে একটা পারসোনাল জিনিস আপনি জানেন না?’
আর্দ্র মুখ ভেঙিয়ে বলল, ‘নাহ জানি না। আর এতো জ্ঞান দিচ্ছেন অথচ নিজেই তো অন্যের ফোন থেকে ফোন দিয়েছেন।’
টায়রা চোখ বড় বড় করে থেমে থেমে বলল, ‘আপনি বেশি জানেন? আমি কার ফোন থেকে ফোন দিয়েছি? ‘
‘ভাইয়ার ফোনে নাম্বার সেভ করা শুকতাঁরার মনতাঁরা দিয়ে। এদিকে আপনিও ফোন দিয়ে দুলাভাই ডাকছেন। কাজেই নিশ্চয়ই ফোনের মালিক আপনি নন।’
‘আপনার সাথে তর্ক করে কে?’
‘গাধাকে যত পেটাও গাধা কি ঘোড়া হয়।’
‘আপনি কি আমাকে গাধা বলার চেষ্টা করলেন?’
‘চেষ্টা করিনি সেটাই বলেছি।’
‘আপনার সাথে কথা বললেই আমার মুড নষ্ট হয়ে যায়। যখনি কথা বলি তখনি ঝগড়া হয়। এতো অসহ্য কেনো আপনি?’
‘কারণ আপনার সহ্যশক্তি কম। বকবক কিন্তু আপনি করা শুরু করলেন তর্কও আপনি করলেন অথচ দোষ সব এই নিষ্পাপ আমার।’
রাগের ঠেলায় টায়রা ফোন কেটে দিয়ে ফুসফুস শব্দ করে টিকলির দিকে তাকালো। টিকলি বিস্মিত হয়ে বলল,
‘কি হয়েছে? কে ফোন ধরেছিলো?’
‘এই শোন, তোর প্রেম ক্যান্সেল বুঝছস? কোনোমতেই এটা হবে না। আমি হতে দিবো না। তোর দেবর এতো খারাপ কেনো? আমি তোর শ্বশুর বাড়ি গেলেই এই ভাদ্রর মুখোমুখি হতে হবে। ব্যস, ওমনেই লেগে যাবে। এতোটা ঝগড়ুটে মানুষ কি করে হতে পারে?’
‘তুই ই তো বেশি করলি দেখলাম।’ টিকলি চোখ ঘুরিয়ে বলল।
দাঁতে দাঁত চেপে টায়রা উত্তর দিলো,
‘তুই সব জানোস? ওপাশ থেকে কি বলছে না বলছে তা কি শুনছোস? এখনি শ্বশুড় বাড়ির মেম্বারদের পক্ষে সাপোর্ট নেস? দেখিস, কালকে যখন মা আরেকটা পাত্র নিয়ে এসে বলবে, ‘তোর বাবা একটা পাত্র দেখেছে। এবার অন্তত না করিস না।’ তখন আমি মাকে আরো উস্কানী দিবো। এবার আর তোর রেহাই নাই।’
টায়রা চলে যেতে নিয়েও আবার বলল,
‘এই ভাদ্র যদি আবারো আমার সাথে এমন করে তাহলে মনে রাখিস তোর প্রেমে সবচেয়ে বড় কাটা হমু আমি।’
টিকলি হতাশ অবুঝ চোখে তাকিয়ে থাকলো। বিরবির করে বলল,
‘এই মেয়েটা কি আসলেই পাগল হয়ে গেলো? একে কি জরুরি ভিত্তিতে একটা ডাক্তার দেখানো উচিত?’
,
ফোন হাতে নিয়ে ব্যাহত নিষ্পাদন চোখে শূন্যে তাকিয়ে ছিলো আর্দ্র। আজও ঝগড়া দিয়েই কথা শুরু হলো।শেষও হলো। এই মেয়েটা এতো অসভ্য কেনো? মেয়েদের কি এতোটা বেপরোয়া মানায়? তখনি আর্দ্রর হাত থেকে ছু মেরে ফোন নিয়ে আদর ভ্রু কুচকে বলল,
‘আমার ফোন দিয়ে কি করস?’
আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আর্দ্র বলল, ‘টিকলির সাথে যে তোমার ইটিশ-পিটিশ চলতাছে এটা একবার বললে না আমায় ভাইয়া?’
‘ইটিশ-পিটিশ আবার কি? মারবো কানের নিচে এক চর। বড় ভাইয়ের সাথে ঠিকমতো কথাও বলতে জানিস না।’
‘এখন তো মারবাই। এখন তো ভাই পর শালী আপন।’
আদর ভ্রু কুচকে বলল, ‘মাথা কি একবারে গেলো নাকি? আর মাত্র চারদিন হয়েছে সম্পর্কের। এর মাঝে তোকে বলার সুযোগ পাইনি।’
‘শালীকে বলার সুযোগ তো ঠিকই পাইছো।’
‘বারবার শালী শালী করতাছোস কেন? শালী আসতাছে কই থেকে? আমি কি বিয়ে করছি?’
আদর দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল। পা এগুলো ছাদের দিকে। আর্দ্র জোরে জোরে বলল, ‘আবার তোমাকে দুলাভাই তো ঠিকই ডাকে।’
চলবে❤️
#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
৩১.
‘এক্ষুনি আমার সাথে দেখা করুন।’ সাপের ন্যায় ঠান্ডা গলায় বলল টিকলি।
ঘড়িতে তখন বাজে রাত এগারোটা। আদর রাউন্ডে ছিলো। টিকলির কথা শুনে ফিসফিস করে বলল,
‘টিকলি, আমি এখনো হসপিটালে।’
তখনি আকস্মিক এক কাজ করে বসলো টিকলি। ছাদ কাঁপিয়ে চিল্লিয়ে বলল,
‘চুলোয় যাক সব। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি। দেখা করুন।’
আদর অবাক হলো। মাত্রই রণচণ্ডী অন্য আরেক টিকলিকে আবিষ্কার করলো। বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলল। শান্তশিষ্ট টিকলিরও যে এমন একটা রূপ আছে তা আজ প্রথম দর্শন পেলো। সারাদিন মাত্রাতিরিক্ত ব্যাস্ত থাকায় আদরের মেজাজটাও বিগড়ে যাওয়ার পথে। ব্যস্ততার কবলে পরে আদর আজ টিকলিকে ফোন দিতে পারেনি। টিকলি অনেকবার ফোন করলেও ধরতে পারেনি। তাই বলেই কি এতো রাগ দেখাতে হবে? আদরের বিষয়টা বুঝবে না?
‘একটু বুঝার চেষ্টা করুন…’
আদরের কথা শেষ হওয়ার আগেই টিকলি আবারো চেঁচিয়ে উঠলো, ‘আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না…কিচ্ছু না। এক্ষুনি দেখা করুন।’
আদর অসহায় সাথে একটু শক্ত গলায় বলল,
‘আপনার বুঝতে হবে টিকলি আই এম আ ডক্টর। এতো অবুঝপনা আপনাকে মানায় না। প্লিজ ট্রাই টু বি আন্ডারস্ট্যান্ড।’
টিকলি অবাক গলায় বলল,
‘অহংকার দেখাচ্ছেন, ডাক্তার? আপনার কাছে যদি আপনার ডাক্তারি পেশাটাই এতো বড় হয়ে থাকে তাহলে আমি কোথায়? না একটা ফোনকল, না একটা মেসেজ, নো নাথিং। দিজ ইজ কলড রিলেশন? যদি এটাকেই সম্পর্ক বলে তাহলে চাই না আমার এমন সম্পর্ক।’
টিকলির কথায় আদর হতবাক হয়ে গেলো। বুদ্ধিমান আদর উত্তর দেওয়ার মতো কিচ্ছু খুঁজে পেলো না। অকূলপাথারে পড়লো যেনো। টিকলি আবার বলল,
‘আমার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। আপনি কালকেও আমার সাথে কথা বলেননি। কি করছেন টা কি আপনি? পাঁচদিন হয়ে গেলো কোনো দেখা-সাক্ষাৎ কিচ্ছু নেই আমাদের। আপনার কাছে আমি ব্যতীত বাকি সব ইম্পোর্টেন্ড। তাহলে আমি কে? আমাকে এভাবে জীবনে রাখার মানে কি? বাদ দিয়ে দিন। তবুও এতো কষ্ট কেনো দিচ্ছেন? কথা বলছেন না কেনো ডাক্তার?’
টিকলি আবারো চিল্লিয়ে উঠলেই ওপাশ থেকে ফোন কাটা হলো। বারংবার হ্যালো বলেও কোনো রেসপন্স না পেয়ে টিকলি ছাদের রেলিং ধরে বসে পরলো। ডুকরে কেদে উঠতেই আবারো ফোন লাগালো। অপাশ থেকে ফোন ব্যস্ত পাওয়া গেলো। ‘কেটে দিলো?’ বিরবির করে টিকলি আরো বার দুয়েক ফোন দেওয়ার পর ওপাশ থেকে ফোন ধরে আদর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘আমি এখন ব্যস্ত। সম্পর্ক টায় আমি প্রথম কনফেস করে বোধ হয় ভুল করে ফেলেছি।’
কথাটা বলেই খট করে ফোন কাটা হলে টিকলি স্তব্ধ হৃদয়ে বসে রইল। বুকের মাঝে উথলে উঠলো কান্নার দিল। এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারলেন উনি?
খানিক বাদেই পেছনে এসে পরম যত্নে টিকলির কাধে হাত রাখলেন জামিলুর রেজা। চমকে ভেজা চোখে পেছনে ফিরে তাকিয়ে বাবাকে দেখতেই জামা ঝাড় দিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো টিকলি। জামিলুর রেজা মেয়ের চোখ মুছে মেয়েকে ধরে দোলনায় বসালেন। টিকলি আত্মা ঢিপঢিপ করছে বাবা কিছু শুনে ফেলার ভয়ে। জামিলুর রেজা মেয়ের মাথা নিজের কাধে রাখলেন। এরপর খুব আদুরে স্বরে বললেন,
‘কাদছিলি মা?’
টিকলি দীর্ঘ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বাবাকে ঝাপটে ধরতেই অবাধ্য অবুঝ নয়ন বেয়ে নীর পরতে লাগলো বিরামহীন। জামিলুর রেজা হতাশ শ্বাস ফেলে হঠাৎই বললেন,
‘আমাকে মাফ করে দে মা।’
টিকলি অবাক চোখে তাকালো। বাবা আবার বললেন,
‘আমি ভুল করেছি। তুই এতো কষ্ট পাবি জানলে এসব করতাম না। আমি আর কখনো তোকে বিয়ের কথা বলবো না। বিয়ের প্রেসার দিবো না। তবুও কাদিস না মা।’
বাবার এ কথায় টিকলি বিস্ময় নিয়ে তাকালো। খানিক বাদে বুঝে আসলেই টিকলির বুক ফাটিয়ে কাদতে ইচ্ছে করলো। এক বিপদের উপর আরেক মুসিবত। একি হলো? উল্টো বুঝলো কেনো বাবা? টিকলি তো এখন বিয়ে করতে চায়। মুখ ফুটে তো এখন বলতেও পারবে না বাবা আমি একজনকে ভালোবাসি তার সাথে আমার বিয়ে দাও। এমনি ওদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক খারাপ তারউপর বাবা উল্টো বুঝলো এরসাথে আদরের সাথে ঝগড়া ফ্রি। টিকলির চিতকার করে বলতে ইচ্ছে করলো,
‘যখন বিয়ে করবো না বলেছি তখন বিয়ে বিয়ে করে লাফিয়েছো। এখন বিয়ে করতে চাই কিন্তু তার আগেই তোমরা বলে দিলে আমাকে আর বিয়ে নিয়ে প্রেসার দিবে না। এখন নিজের বিয়ের কথা কি নিজে মুখ ফুটে বলে বেহায়া পদবি লাভ করবো?’
_________________________________
ভোর সাড়ে পাঁচটা। সকালের প্রথম রোদ-আলোটা পর্দার ফাঁকফোঁকর গলিয়ে সাদা ঝকঝকে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। মিষ্টি সরু রশ্মির বিচরণ সারা ঘরময়। আবহাওয়া দেখে বোধ করা যায় আজ বৃষ্টি নাও হতে পারে। তবে আষাঢ় মাস, এখান বৃষ্টি নিয়ে কোনো গ্যারান্টি দেওয়া যায়না। ফজরের নামাজ পড়ে চোখ লেগে আসতে না আসতেই টিকলির ফোনটা বিকট আওয়াজে চেঁচিয়ে উঠলো। আধো চোখ খুলে ফোনের দিকে তাকাতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো ‘বাদর ডাক্তার’ নাম। টিকলি ফোন কেটে দিয়ে উল্টো করে রাখলো। একটুপর আবারো বাজা শুরু করলো। নিজের মতোই কেটে গেলো। আবারো বিকট শব্দে বাজতেই ঘুমুঘুমু অবস্থায় বিরক্তি নিয়ে টায়রা মাথার পাশ থেকে কুশন ছুড়ে মারলো ফোনের উপর। যারপরনাই গলায় বলল,
‘ফোন এক আছাড় মাইরে ভাইঙ্গে ফেলমু এখন। ধরস না কে? তোর আশিক ফোন দিতে দিতে মইরে গেলো তো।’
টিকলি ততক্ষণে উঠে বসেছে। টায়রার দিকে তাকিয়ে রাগীস্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘আশিক আবার কি? ভাষা ঠিক হবো না তোর? বেয়াদব।’
ফোনটা আবার বাজতে শুরু করলো। আরো দু তিনবার বেজে বেজে কেটে যাওয়ার পরও ধরা হলোনা। তবুও ফোনের কোনো ক্লান্তি নেই। আবারো বেজে উঠলো। টিকলি অসহায় টলমলে চোখে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় কেউ বলল,
‘আধ ঘন্টার মধ্যে নিচে নামুন উইথ ব্ল্যাক শাড়ি।’
টিকলি অবাক হলো। অতিমাত্রায় রাগ নিয়ে বলল,
‘ফোন কেনো দিয়েছেন?’
আদর ক্লান্ত গলা ঠেলে দিয়ে বলল, ‘প্লিজ টিকলি নামুন। আমি ভীষণ ক্লান্ত। সারারাত ঘুমাইনি।’
আদরের অসহায় গলা শুনে টিকলি থেমে গেলো। চোখের পাতা জোড়া ছলছল করে উঠলো। চোখ বন্ধ করে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে রুদ্ধশ্বাসে বলল,
‘শাড়ি পড়তে পারবো না। আমি শাড়ি পড়তে জানিনা।’
ওপাশ থেকে আর শোনা হলোনা। ফোন কেটে দিলো। টিকলি হতাশ নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে বারান্দার সামনে থেকে রাস্তায় উঁকি দিলো। কিছুক্ষণ উঁকি ঝুঁকি দেওয়ার পরই কালো পাঞ্জাবিতে শ্যামলা রাগী মুখশ্রীতে দাড়িয়ে থাকা দেখা গেলো আদরকে। টিকলি নিষ্চ্ছল পায়ে হেটে টায়রার সামনে এসে টায়রাকে টেনে তুললো। টায়রা বিরক্তি নিয়ে উঠে বলল,
‘তোদের সমস্যা কি একটু বলবি? সবাই প্ল্যান করছোস যে আমাকে আজকে ঘুমাতে দিবিনা? একটু আগে তোর জামাই ফোন করে করে কানের বারোটা বাজালো সাথে ঘুমেরও। এখন আবার তুই শুরু করলি?’
আলমারি থেকে কালো রঙের একটা জামদানি বের করে টায়রার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গুরুগম্ভীর মুখে টিকলি বলল,
‘তাড়াতাড়ি পড়ায় দে। দশ মিনিট সময়।’
শাড়িটা হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে বিস্ফোরিত চোখে দেখতে লাগলো টায়রা। এরপর খুব আহত গলায় বলল,
‘শেষমেষ কি তোদের পাবনায় এডমিট করতে হবো? এন্ড দ্যা ক্যাপশন ইজ, প্রেমে পাগল।’
টিকলি ভ্রু কুচকে তাকালো। টায়রা খানিক উচ্চস্বরে বলল,
‘এতো সকালে কালো শাড়ি পইড়ে কই যাবি?’
‘শোক পালন করতে। এখন তাড়াতাড়ি পড়ায় দে।’
‘আজকে কি? কোনো দিবস? বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দিন কি? নাকি গনহত্যার দিন নাকি একুশে মার্চ?’
‘তুই কি পড়াবি?’
‘পড়াইতাছি। কিন্তু বুঝলাম তোরা মানসিক প্রতিবন্ধী তাই এই ভোর বেলা শাড়ি টাড়ি পড়ে ঘুরতে যাইতাছোস কিন্তু আব্বু আম্মু জিগাইলে কি কমু?’
‘বলবি বান্ধবীরা মিলে আজকে প্ল্যান করছিলাম কালো শাড়ি পরে পিকনিক করতে যামু।’
‘কিন্তু আমি গেলাম না কে?’
‘তোর পেট খারাপ।’
‘আস্তাগফিরুল্লাহ! এখন যদি সত্যি সত্যি পেট খারাপ হয়ে আমার বাথরুমে দৌড়াইতে হয় তাইলে দেখিস তোরে কি করি?’
,
কড়া রোদ উঠে গিয়েছে। আকাশে সাদা আলোর ঝলকানি। তবুও বিরক্তহীন ক্লান্ত দেহে আদর গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালো পাঞ্জাবির সাথে হাতে পড়া কালো ঘড়িটা এক ঝলক দেখতেই আবিষ্কার করলো ঘড়িতে ছটা বিশ বাজে। প্রায় এক ঘন্টা যাবত আদর এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। শ্রান্ত নিরব নিধ্র চোখ দুটো নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই দূরে আবিষ্কার করলো নির্জন রাস্তা পেরিয়ে কালো শাড়ির কুচি ধরে ব্যস্ত পায়ে হেটে আসছেন মহারানী। মহারানীর মাথায় বড় করে ঘোমটা দেওয়া। যার দু’পাশে দু’আঙ্গুল দিয়ে রাজকীয় ভাবে ধরে হেটে আসছেন তিনি। আদর তাকিয়ে থাকলো অন্তকাল পরিশ্রান্তের ন্যায় চোখের পলক না ফেলে। আস্তে আস্তে মহারানী কাছে চলে আসলো। আদরের অবচেতন হাত মহারানীর জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিলো। টিকলি ভ্রু কুচকে বলল,
‘গাড়ি কার?’
আদরের ঘোর কাটলো। বিপন্ন গলায় বলল,
‘অবশ্যই আমার।’
টিকলি আর উত্তর দিলো না। গাড়িতে না উঠেই বলল,
‘কি বলতে চান বলুন?’
‘কি বলতে চাই মানে? গাড়িতে উঠুন।’ আদর রাগী গলায় বলে।
‘কেনো উঠবো?’ চট করে মাথার আচঁল ফেলে দিয়ে চোখ কুচকে টিকলি বলল।
‘দেখুন টিকলি আমি প্রচন্ড টায়ার্ড। হসপিটাল থেকে ভোরে বাসায় গিয়ে ফ্রেস হয়ে পাঞ্জাবিটা পরে ওমনি বের হয়েছি। জেদ ধরবেন না প্লিজ।’
টিকলি জ্বলজ্বল চোখে চেয়ে নির্বাকে গাড়িয়ে উঠে বসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদর গাড়িতে উঠে বসতেই টিকলি বলল,
‘এসেছেন কেনো? কাল রাতে যখন আসতে বললাম তখন তো আসেন নি।’
‘আমি ব্যস্ত ছিলাম টিকলি। আপনার বুঝতে হবে। আমার সমস্যাটা আপনি না বুঝলে আর কে বুঝবে?’
‘আমার বেলায় কেনো আপনার এতো সমস্যা, ডাক্তার?’
‘আপনি এতো অবুঝের মতো কথা বলছেন কেনো টিকলি?’
‘ঠিক আমি অবুঝ। তো, এই অবুঝের সাথে তো থাকা যায়না। আপনি বরং এক কাজ করুন। খুব বুঝমান কাউকে খুঁজে নিন।’
এই বলেই টিকলি দরজা খুলে নামতে ধরলো আদর তাড়াতাড়ি হাত চেপে ধরে টিকলিকে টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘সমস্যা কি হ্যাঁ? আপনার জন্য এই ভোরবেলা আমি না ঘুমিয়ে ছুটে এসেছি। আর আপনি তেজ দেখিয়েই যাচ্ছেন। ব্যস্ততা থাকলে কি আমার দোষ? ব্যস্ত থাকতে কি আমার খুব ভালো লাগে? আর অন্যকাউকে খুঁজে নিবো মানে কি? কালকেও এ কথা বলেছেন। এ কথা শুনেই তো আমি ফোন কেটে দিয়েছি। জানেন সারারাত একটা কাজেও আমার মন বসেনি। শুধু নিজের দিকটা ভাবেন। আমার উপর যে কতটা প্রেসার যায় তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই আপনার।’
আদর হাত ঝাড়া মেরে ছেড়ে দিয়ে নিজের সিটে বসে চোখ বন্ধ করলো। নিজের হাত ধরে টিকলি বসে থাকলো। খুব আড়ালে কাজল রাঙা চোখ দুটো থেকে কয়েক ফোটা পানি পরে গেলো। চুড়ি গেথে ফর্সা হাত লাল হয়েও যাওয়া হলো। নিঃশব্দে থেকেই হঠাৎ ডুকরে কেদে উঠলো টিকলি। আদর চোখ খুলে আহত দৃষ্টিতে তাকালো। এই মেয়েটার হয়েছে টা কি? আদর মেয়েটার মনের হাব-ভাব কিছুতেই ধরতেই পারছে না। এই একটু আগে তেজ দেখালো এখন আবার কান্না! কি মুশকিল! আদর ক্লান্ত গলায় বলল,
‘আপনি নাকি কাদেন না টিকলি তবে এখন কেনো কাদছেন? একটু বকাও কি সহ্য করা যায় না?’
টিকলি ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে অন্যদিকে ফিরে তাকালো। আদরকে মন দিয়ে দেওয়ার পর থেকেই তার সব নিয়ম উলোটপালোট হয়েছে। এখন অকারণেই সে বড্ড কাদে। তবে খুব গোপনে। সবার অগ্রচরে।
আদর হাত বাড়িয়ে টিকলির মাথাটা নিজের বুকের একপাশে রাখলো। টিকলির কান্নার বেগ বাড়লো। মানুষটার এই প্রথম এতো কাছের ছোঁয়া পেয়ে আবেগে অতিমাত্রায় আপ্লুত হয়ে গেলো। বোধ হলো, একটু বেশি করে ফেলেছে সে। বারকয়েক টিকলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে টিকলিকে শান্ত করতেই খুব নরম সুরে আদর বলল,
‘এবার বলুন তো, এতো হামকি-ধামকির কারন কি? কাল রাতে এতো জোরে চিতকারই বা করা হচ্ছিলো কেনো?’
টিকলি নাক টেনে টেনে বলল, ‘কাল রাতে আমাদের এক দূরের ফ্রেন্ড সুইসাইড করেছে।’
আদর ভ্রু কুচকে বলল, ‘তার সাথে এসবের সংযোগ কি?’
‘ও সুইসাইড করেছে ওর বয়ফ্রেন্ডের জন্য। ওর বয়ফ্রেন্ডও একজন ডাক্তার। প্রথম কিছুদিন খুব ভালোভাবে রিলেশন টা চললেও একসময় ওর বয়ফ্রেন্ড ওকে এড়িয়ে যেতে শুরু করলো। দেখা করতো না, ফোন দিতো না, ফোন রিসিভও করতো না। পরে জানা গেলো হসপিটালের কোনো এক নার্স এর সাথে ডাক্তারের প্রেম চলছে। খুব ভালোবেসেছিলো ছেলেটাকে। শোকে সুইসাইড করলো।’
আদর অবাক গলায় বলল, ‘মানে সিরিয়াসলি? তার মানে এরজন্যই আপনি কাল অজস্র বার আমাকে ফোন দিয়েছেন। ফোনে আমাকে না পেয়ে ভেবেছেন আমিও কোনো নার্স নিয়ে বিজি। এজন্যই এতো রাগারাগি?’
টিকলি কোনো উত্তর না দিয়ে আদরের বুক থেকে সরে এলো। মাথা নিচু করে বলল,
‘এখন আমি কি করবো?’
‘ওহ মাই গড। ভেবেছিলাম ম্যাচিউর মেয়ের প্রেমে পরেছি। বিন্দাস লাইফ। কোনো প্যারা নাই। কিন্তু আপনি তো দেখি…’
আদরের কথা শেষ হওয়ার আগেই গাল ফুলিয়ে টিকলি বলল, ‘তো যান, ম্যাচিউর মেয়ে খুঁজে নেন আমার কাছে কি?’
টিকলি আবারো নেমে যেতে ধরলেই আদর হাত চেপে ধরে রাগী গলায় বলল,
‘আপনি কি নতুন কাউকে পেয়েছেন? সত্যি করে বলুন? বারবার অন্যকাউকে খুঁজে নিতে বলছেন কেনো? আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে প্রচন্ড। ‘
টিকলি চোখ মুখ বিকৃত করে হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলল, ‘উফফ…ডাক্তার ব্যথা পাচ্ছি তো। একটু আগেও এখানেই ধরেছিলেন। চুড়ি গেথে গেছে।’
আদর হাত ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর ভারিক্কি মুখে বসে রইল। আড়চোখে তাকিয়ে টিকলি বলল,
‘কোথায় যাবো আমরা?’
গম্ভীর মুখেই উত্তর দিলো আদর, ‘যেখানে যেতে চাইবেন। সারাদিনের জন্য ছুটি নিয়েছি। তবে রাতে ব্যস্ত থাকবো তখন আবার এইসব উল্টাপাল্টা ভেবে বসবেন না।’
‘সত্যি? চলুন তবে। আজ মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়াল দিবো আকাশে। তবে গাড়ি না নিয়ে রিক্সা নিলে ভালো হতো।’
‘এখানে রিক্সা নিলে কেউ দেখে চিনে ফেলার চান্স থাকতে পারে। পরে আপনার সমস্যা হবে যেহেতু এলাকা আপনার। সামনে কোথাও থেকে রিক্সা নিয়ে ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি পাঠিয়ে দিবোনি।’
‘ইশশ…এত্তো ভালো কেনো আপনি ডাক্তার?’
আদর হেসে দিয়ে বলল,
‘হুম। কাল রাতে এক মুহুর্তের জন্য এ কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম আমি।’
চলবে❤