বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব-৩২+৩৩

0
659

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

৩২.
সূর্য তখন আকাশের মাঝ বরাবর। দ্বিপ্রহরের কড়া উত্তাপ সাথে মনের কোলাহল। প্রসন্ন চোখ দুটি মাঝেমধ্যে চেয়ে দেখে আদরকে পরমুহূর্তেই মজার কোনো কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে অবিচ্ছেদ ঠোঁটে। তৃষ্ণায় ধুঁকছে গলা তবুও অন্যরকম প্রশান্তি শরীর জুড়ে। অল্প একটু চাওয়ার থেকে অধিক পাওয়ার সুখ অন্তরে। কালো রঙ মোড়ানো দেহ ভরপুর। শাড়িতে পা বেজে পড়ে প্রায় যেতে যেতেই রোদে ভিজে ক্লান্ত শরীরে প্রিয় মানুষটি ধরে ফেলার বারংবার অনুভূতির কাঁপন ধরানো। হাতের ভাঁজে হাত রেখে রিক্সা দিয়ে সারা ঢাকা শহর চষে বেড়ানো। প্রেম প্রেম ভাব ছড়িয়ে দেওয়া যে প্রেম করে নাই কবুও। এমনি কড়া উত্তাপের মধ্যাহ্নে টিকলি তৃষ্ণার্ত গলায় বলল,

‘পিপাসা পেয়েছে। খিদেও পেয়েছে। আপনি এমন কেনো ডাক্তার? এতো কিপ্টা! সেই ভোরে বেরিয়েছি অথচ এখনো খাওয়ার নাম নিলেন না।’

আদর স্মিত হেসে বলল,

‘এই যে এতো জায়গায় টাকা দিয়ে ঘুরালাম তবুও পেট ভরলো না? এখন এক্সট্রা টাকা খরচ করে আবার আলাদা খাওয়াতেও হবে?’

টিকলি অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

‘হোয়াট আ বিশাল কিপ্টা ইউ আর!’

আদর ঠোঁট প্রসারিত করে মাথা দুলিয়ে হেসে দিলো। টিকলি আদরের চুল ঠিক করে দিতেই টিকলির হাতের ভাঁজে হাত রাখলো আদর। পরমুহূর্তেই রিক্সার হুট উঠিয়ে দিয়ে বলল,

‘চলুন তবে, কিপ্টার আরেকটু কিপ্টামি দেখাই।’

টিকলি ফিসফিস করে বলল,

‘মানে? আর হুট উঠালেন কেনো ডাক্তার?’

‘রোদের তাপ দেখেন না? ভীষণ গরম! মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিলো।’

আদরও ফিসফিস করে টিকলির মতো করে বলল। ফিসফিস শব্দ বাধা পেয়ে বারংবার কানে এসে লাগতে থাকলো। বাতাসের দাপটে অস্ফুটে ফসফস ধ্বনি শুনা গেলো। শরীর শিহরিত হলো। সচেতন দৃষ্টিতে আদরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে টিকলি বলল,

‘আপনার মতলব কি ডাক্তার? আর খিদে পেয়েছে বললাম না। কিপ্টামি বাদ দিয়ে কোনো রেসটুরেন্টের সামনে রিক্সা দাড় করান। ডাক্তার রা আসলেই কিপ্টা হয় টায়রা ঠিক বলে।’

আদর মাথা দুলিয়ে আবার হেসে বলল,

‘আপনাকে একটা রয়েল রেসটুরেন্টে নিয়ে যাই চলেন। আমার রয়েল রেসটুরেন্ট। আমার পকেটও বাঁচবে আপনার খাওয়াও হবে।’

,

দুপুরে খেতে বসেই জামিলুর রেজা প্রশ্ন ছুড়লেন টায়রার দিকে,

‘টিকলি কোথায় টায়রা?’

টায়রা কিছুক্ষণ তুতলিয়ে বলল, ‘পিকনিকে গেছে। কেনো মাকে বলেছিলাম তো।’

শায়লা আক্তার চোখ বড় বড় করে বললেন,

‘মিথ্যাবাদী। তুই কখন আমাকে বললি? দরজায় তো এ বেলা অবধি খিল দিয়ে বসেছিলি। ডাকলেও সাড়া দিসনি। সকালের খাবারটাও খাসনি। আর এখন শুনছি টিকলি পিকনিকে গেছে।’

ঢোক গিলে জোরপূর্বক হেসে টায়রা বলল, ‘ওহ বলেনি? ভুলে গিয়েছিলাম বোধহয়। ‘

জামিলুর রেজা চিন্তিত মুখে ভরাট গলায় বললেন,

‘পিকনিকে গেছে? কাদের সাথে? কখন গেছে?’

‘বান্ধবীদের সাথে। সকালে গেছে।’

‘এখনো ফিরলো না যে?’

‘একটা বান্ধবীর বাসায় পিকনিক করছে তো। ওদের সুন্দর বাগান বাড়ি আছে। সারাদিন ওখানেই থাকবে।’

‘তুমি যাওনি কেনো তাহলে?’

টায়রা ইতস্তত করে বলল, ‘ইয়ে মানে, আমার সকাল থেকে পেট খারাপ ছিলো। এর জন্যই তো সকাল থেকে দরজায় খিল দিয়ে বসেছিলাম।’

শেষের কথাটা খুব উৎফুল্লের সুরে বলল টায়রা।জামিলুর রেজা টায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

‘কি বলো? এখন ভালো আছো? খাবার-দাবার একটু মেইনটেইন করতে পারো না? ফাস্টফুড কমিয়ে খাও।’

‘আচ্ছা বাবা।’

‘এখন শরীর সুস্থ আছে তো? কয়বার বাথরুমে গিয়েছো? বেশি খারাপ শরীর?’

টায়রা বিরবির করলো, ‘খাওয়ার সময় এসব কি শুরু করলো আব্বু? বারবার এই কথা কেনো তুলতাছে? আল্লাহ জানে সত্যি সত্যি না আমার পেট খারাপ হয়ে যায়।’ চোখ মুখ কুচকে টায়রা উত্তর দিলো,

‘হুম। একদম সুস্থ আছি।’

‘তাহলে এখন যেহেতু সুস্থ আছো তাহলে তুমিও পিকনিকে চলে যাও। ঘুরে ফিরে বিকালেই এসে পরো দুই বোন মিলে।’

টায়রা অবাক হয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে বলল, ‘অ্যা…???’

জামিলুর রেজা খাওয়া থামিয়ে অবাক গলায় বললেন,

‘হ্যাঁ, তুমি তো বললে তোমার কোনো এক বান্ধবীর বাসায় পিকনিক হচ্ছে তো যেহেতু সুস্থ আছো তাহলে বাসায় বসে থেকে শুধু শুধু ইঞ্জয় থেকে বঞ্চিত থাকবে কেনো? গো এন্ড ইঞ্জয় ইউর সেল্ফ।’

‘কিন্তু বাবা…’

শায়লা আক্তার টায়রাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ফুস করে বলে উঠলেন,

‘ঠিক ই তো বলেছে তোর বাবা। তোরা দু বোন তো দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারিস না। ওদিকে টিকলিরও বোধ হয় খারাপ লাগছে তোকে ছাড়া। এদিকে তোরও বরিং লাগবে সারাদিন ঘরে একা একা। তার চেয়ে দু বোন একসাথে থাকলে আমরাও একটু নিশ্চিন্ত থাকবো আর তোদেরও ভালো লাগবে। আর এসব পিকনিক টিকনিক তো এখনি করবি কিছুদিন পর যখন বিয়ে হয়ে যাবে তখন তো এসবের জন্য হা-হুতাশ করে মরে গেলোও আর পাবিনা।’

টায়রা আবারো কিছু বলতে গেলে জামিলুর রেজা থামিয়ে দিয়ে সন্দেহপ্রবন দৃষ্টিতে বললেন,

‘কি ব্যাপার বলো তো? তুমি কি কিছু লুকাচ্ছো? এমনিতে দু বোন দুজনকে ছাড়া এক মিনিট থাকতে পারো না আর এখন জোর করে পাঠানো যাচ্ছে না। তোমার বান্ধবীর বাসা চিনো নিশ্চয়ই? না চিনলে টিকলিকে ফোন করে ঠিকানা নিয়ে নাও। আমি গিয়ে তোমাকে দিয়ে আসি।’

‘না। না। না বাবা আমি একাই যেতে পারবো। আমি…আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।’

,

খয়েরী রঙের গেটের সামনে রিক্সাটা থামতেই নেইম-প্লেট এ দেখা গেলো বাড়ির নাম ‘খান ভিলা’। টিকলি অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। ভ্রু কুচকে পুরো তিন তলা বাড়ির এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যবেক্ষণ করে বলল,

‘এটা কার বাড়ি, ডাক্তার?’

রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে আদর ছোট করে জবাব দিলো,

‘আমার।’

চোখ কপালে তুলে টিকলি উচ্চস্বরে বলল,

‘কি??’

গেট দিয়ে প্রবেশ করতে করতে আদর জবাব দিলো,

‘হুম। আসুন।’

গেটের ভেতর প্রবেশ করেও টিকলিকে আসতে না দেখে আদর আবার পেছন ফিরলো।

‘কি হলো আসুন।’

ভীতি গলায় টিকল বলল, ‘আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন ডাক্তার? আপনার বাড়িতে যাবো মানে? আপনার বাড়িতে গেলেই তো আপনার বাবা-মা আমাকে চিনে ফেলবে।’

‘কিভাবে চিনবে?’

‘আপনি পাগল হয়ে গেলেন নাকি? আমাদের বিয়ের কথাবার্তা যখন চলছিলো তখন দু পক্ষের ছবি দেওয়া নেওয়া হয়েছিলো না? আমরাই না মূর্খের মতো কেউ কারোর ছবি দেখিনি।’

‘আরে কিচ্ছু হবে না আসুন।’

টিকলির হাত ধরে জোরে টেনে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো।

দরজা খুলাই ছিলো। ভেতরে প্রবেশ করতেই প্রথমে চোখে পড়লো বসার ঘর। বসার ঘরে দেখা গেলো, এক বাটি ভর্তি পপকর্ন হাতে টিভি দেখছে আর্দ্র তার পাশেই বসে আছে নিভা। আদর চমকে তাকালো। টিকলি বিস্ময়, অবাকতার সাথে ভয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে এমন দশা। চোখগুলো হয়ে উঠেছে রসোগোল্লার ন্যায় বড় বড়। এদিকে আর্দ্ররও হাত থেকে পপকর্নের বাটি পরে যাওয়ার জোগাড়। মুখটাকে কিঞ্চিৎ হা করে সে সম্মুখে চেয়ে রইল। নিভা টিভির চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে মাথা ঘুরিয়ে টিকলিকে দেখেই থতমত খেয়ে গেলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল চোখ বড় বড় করে।

ঘরে চারটি মানুষ একেক জনকে দেখে চাররকম চমকিত নয়নে তাকিয়ে আছে। চমকিত হৃদয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হিসাব মেলানোর চেষ্টা করলে বারংবার গড়মিল বেধে যাচ্ছে। এদিকে টিকলি দুরুদুরু ভীতু মন সাথে অবাক প্রসন্ন চোখে তাকিয়েই দেখলো সামনের সুদূর ভবিষ্যত। যে ভবিষ্যতে বাধন ছিড়ে যাচ্ছে ওর আর আদরের। টিকলির আত্মা লাফিয়ে উঠলো। আদর স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে নিভার উদ্দেশ্যে বলল,

‘তুমি??’

নিভাও একই সুরে প্রশ্ন করলো, ‘তুই?’

সাথে আর্দ্রও বলল, ‘টিকলি?’

এদের মাঝে থতমত খেয়ে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল টিকলি। এসব কি হচ্ছে? টিকলি ফিসফিস করে বলল,

‘নিভা এখানে কেনো ডাক্তার?’

আদর ফিসফিস করে জবাব দিলো, ‘নিভা আমার খালাতো বোন।’

‘আপনার বাবা-মা?’

‘টেনশন করবেন না বাড়িতে বাবা-মা নেই।’

টিকলি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে তাকালো। নিভা চিতকার করে বলল,

‘এই তোরা ফিসফিস করস কেন? কাহিনী কি?’

আদর তিনগুন অবাক গলায় বলল, ‘নিভা? আমাকে তুই বললা?’

‘তোমাকে বলি নাই ভাইয়া। টিকলিকে বলছি।’

‘তুমি উনাকে চিনো কীভাবে?’

‘আমার বেস্টফ্রেন্ড আর আমি চিনবো না?’

আদর প্রশ্নবিদ্ধ চোখে টিকলির দিকে তাকালো। টিকলি মাথা নাড়ালো। আর্দ্র বাহবা দিয়ে বলল, ‘বাহ! ভাইয়া ইউ আর ভেরি ফাস্ট। তো, কেমন আছো টিকলি?’

টিকলি মাথা নাড়িয়ে অনেক কষ্টে গলা দিয়ে আওয়াজ বের করে বলল, ‘ভালো। আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?’

‘আহ দিলে বড় ব্যথা লাগে গো। ভাবী হবা। আপনি ডেকো না প্লিজ। ভাইয়া ডাকো তাতেই বুক খানখান হয়ে যায়।’

টিকলি লজ্জায় রাঙা হলো। আদর শুকনো কাশি দিয়ে উপরে যেতে যেতে বলল, ‘ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

টিকলি গিয়ে নিভার পাশে বসতেই দেখলো নিভা তার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেনো এখনি গিলে খাবে। টিকলি কিছুই হয়নি এমন গলায় বলল,

‘হোয়াট? গরুর মতোন তাকায় আছোস কেন?’

‘তুই যে আমার ভাইয়ের সাথে প্রেম করতাছোস এটা আমারে বলছিলি?’

‘এটা যে তোর ভাই তুই আমারে বলছিলি?’

নিভা গালে হাত দিয়ে বসে বলল, ‘কেমনে মামা? আমার এই ভাইরে তুই পটাইলি কেমনে?’

টিকলি ভাব ধরা গলায় বলল, ‘তোমার ভাই ই আমারে পটায়ছে বুঝছো?’

‘বিশ্বাসযোগ্য না।’

‘না করলি বিশ্বাস। যাই হোক, আন্টি আংকেল কই গেছে?’

‘খালামনি, খালু, আমার আব্বু আম্মু সবাই মিলে নানুবাড়ি গেছে। নানার কি জানি জমি সংক্রান্ত ঝামেলা হইছে। বুঝোস না মামা না থাকলে যা হয়। আর তাই আমি এইখানে।’

‘কখন আসছোস?’

‘দু-তিন ঘন্টা তো হলোই।’

‘ওহ।’

টিকলিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে নিভা বলল,

‘বাব্বাহ! শাড়িও পড়ছোস আবার? জীবনেও তো শাড়ি পড়তে দেখলাম না।’

‘আজকেই ফার্স্ট পড়ছি। ছয়বার উষ্ঠাও খাওয়া হইছে।’

টিকলি নিভার কথোপকথনের মাঝেই ফোনটা বাজখাঁই শব্দে মেতে উঠলো। কালো রঙের ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে টায়রার নাম্বার দেখেই ভ্রু কুচকালো। কল রিসিভ করে উদ্ধিগ্ন গলায় বলল,

‘কি রে কিছু হয়েছে? কোনো সমস্যা? আব্বু আম্মুকে সবকিছু ঠিক মতো বুঝায় বলছিলি?’

আর্দ্র টিভি দেখায় মগ্ন ছিলো এতোক্ষন। টিকলির কথার ধরন দেখেই বুঝে ফেলেছে মিস. চাপাবাজ ফোন দিয়েছে। কান খাড়া করে আর্দ্র শুনতে লাগলো। এর মাঝেই নিভা হাত বাড়িয়ে ফোনের লাউডস্পিকার অন করে দিলো। ওপাশ থেকে টায়রা তখন বলল,

‘রাখ তোর বালের ঢং। আমার মেজাজ হাই লেভেলে গরম আছে।’

আর্দ্রর গলায় পপকর্ন আটকে কাশি উঠে গেলো। টিকলি লাউডস্পিকার অফ করতেই নিভা আবার অন করে দিলো। টিকলি মিনমিন করে বলল, ‘কি হয়েছে?’

টায়রা কাদো কাদো গলায় বলল,

‘সকাল থেকে খাই নাই। দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম। কাউকে জানাই নাই তুই বাসায় নাই। কিন্তু দুপুর একটা বাজতেই পেটে ইঁদূর দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। কোনোমতে আধঘন্টা নিজেকে কন্ট্রোল করার পর ঘর থেকে বের হয়ে দেখি বাবা খাবার নিয়ে টেবিলে বসে আছে। আমি যেতেই তোর কথা জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম তুই পিকনিকে গেছিস সারাদিন থাকবি। সবকিছু বলা শেষ হতেই বাবা বলল তাহলে তুমিও যাও। টিকলি হয়তো বোর ফিল করছে আর তোমারও নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে বান্ধবীরা সবাই মজা করবে আর তুমি এখানে বসে থাকবে?’

‘কেনো? তুই বলস নাই তোর পেট খারাপ?’

‘বলছি তো। এটাও বলছি পেট খারাপ ভালো হয়ে গেছে।’

এ পর্যায়ে আর্দ্র নিভা ফিক করে হেসে দিলো। টিকলি নিভার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ফোনের লাউডস্পিকার অফ করে দিয়ে বিরবির করে বলল, ‘মাথামোটা।’

তখনি টায়রা চেঁচিয়ে বলল, ‘ওই তুই আমারে কি বললি? আর হাসলো কেরা? নিশ্চয়ই তোর জামাই? একবার হাতের কাছে পাই। ওই শালার লাইগে আজকে আমার এই দূর্দশা। এ্যাহ..রাত পোহাতে না পোহাতেই বউয়ের রাগ ভাঙাতে চলে আসছে সাথে আমার কপালে শনি লিখে নিয়ে আসছে।’

টিকলি কড়া কণ্ঠে বলল,

‘থাপ্পড় লাগাবো একটা।’

‘হ তুমি তো লাগাবাই। এখন আমি কি করবো সেটা বলো। এই ভর দুপুরে কই যাবো?’

টিকলিও অসহায় কণ্ঠে বলল,

‘আমি তো জানি না। কি করবি এখন?’

টায়রা কেদে দিবে এমন গলায় বলল, ‘আল্লাহ আমার মরণ নেয় না কেন? এতো বেকুব বোন আল্লাহ আমার কপালেই জুটায়ছিলো। সলিউশন বের করার বদলে উলটে আমাকে জিজ্ঞেস করে।’

সিড়ি দিয়ে নামছিলো আদর। বাড়িটা তিনতলা হলেও এই বাড়িতে দুটো সিড়ি। একতলা দুতলা মিলে ড্রইংরুমের মাঝখান দিয়ে সিড়ি। আর গেট থেকে তিনতলা পর্যন্ত আরেকটা সিড়ি। আদর সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে প্রশ্ন করলো,

‘কি হয়েছে টিকলি?’

টিকলি ফোন হাতে নিয়ে সংক্ষিপ্ত করে যতটুকু বলা যায় বলল। এরপর ফোন কানে নিয়ে টায়রাকে বলল,

‘এক কাজ কর পার্কে চলে যা।’

টায়রা ফুসে বলল, ‘আমার ছোট হইলে ঠাডায়ে একটা চর মারতাম। ভর দুপুরে পার্কে যায়ে রোদ্রের মধ্যে মুড়ি খামু?’

‘ওহ তাও তো কথা। তাইলে রেসটুরেন্টে যা। আর তা নাহলে ওয়েট কর আমি আসতাছি।’

আদর ভরাট কণ্ঠে বলল, ‘কোথাও যেতে হবে না। আপনি টায়রাকে এখানে আসতে বলুন। আর্দ্র গিয়ে নিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। বাবা-মা রাত ছাড়া আসবে না।’

টিকলি মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আমি চলে যাই না ডাক্তার?’

‘না। বিকেলে আমি দিয়ে আসবো।’

টিকলি মিনমিন করে বলল,

‘টায়রা তুই এ বাড়িতে আয়।’

‘কোন বাড়ি?’

‘উনার বাড়ি।’

‘কেনো?’

‘কারন আমি এখন ওখানেই।’

‘ওহ। কিন্তু আমি যাবো না।’

‘কেনো?’

‘কারন ওই ভাদ্র আছে।’

‘কিচ্ছু হবে না লক্ষী বোন আয়। কিছু হলে আমি আজ ভাইয়াকে বকা দিয়ে দিবো।’

টায়রা ভ্রু কুচকে বলল, ‘সত্যি?’

‘হুম। আয় নিভাও আছে।’

‘আচ্ছা।’

ফোন রাখতে গেলেই টায়রার মনে পরলো বাড়ির ঠিকানা ভুলে গেছে ও। যেদিন আর্দ্র এক্সিডেন্ট করলো সেদিন আর্দ্রকে ড্রপ করেছিলো। কিন্তু এখন খেয়াল নেই।

‘আমি তো বাড়ি চিনি না।’

টিকলি বলল, ‘আর্দ্র ভাইয়া গিয়ে নিয়ে আসবে।’

আর্দ্র বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে এক বাক্যে চিল্লিয়ে বলল, ‘না। কোনোদিন না।’

চলবে❤️

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

৩৩.
হিম পবনে শরীর মৃদু কেঁপে উঠছে। সকাল থেকে কড়া রোদ থাকায় আঁচ করা গিয়েছিলো আজ বোধ হয় বৃষ্টি হবে না। কিন্তু আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছে একটু পরই ঝুমঝুম করে বর্ষন পরবে। আর্দ্র বিরক্তি দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে যেতেই দেখলো টায়রা এসে রিক্সা থেকে নামলো। ভাইয়ের বকা ঝকা শুনে শেষ পর্যন্ত আর্দ্র টায়রাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। ব্যাস্ত পায়ে আর্দ্র এগিয়ে গেলো। টায়রা রিক্সা ভাড়া দিয়ে ঘুরে দাড়াতেই আর্দ্র উচ্চস্বরে বলল,

‘আপনি আমাদের বাড়ি চিনেন না?’

‘কেনো? চেনার কথা ছিলো বুঝি?’ টায়রা ভ্রু কুচকে পার্সের চেন লাগাতে লাগাতে বলল।

‘মশকরা করছেন? আমি যেইদিন বাইক এক্সিডেন্ট করলাম সেদিন তো আপনি পৌঁছে দিলেন।’

‘শুনুন, মিস্টার ভাদ্র, নিজেকে এতোটা ইম্পোর্টেন্ড ভাববেন না। আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম বলেই কি আপনার বাড়ির রাস্তা মুখস্থ করে রেখেছি? আর তাছাড়া আমি আপনাদের বাড়িতে প্রথম যাচ্ছি সো আপনার উচিত আমাকে প্রপার ভাবে ট্রিট করা। আপনার তো উচিত ছিলো আমার বাড়ি গিয়ে আমাকে নিয়ে আসা। সেই জায়গায় আমি এতোটা পথ একা এসেছি।’

টায়রা মুখ ভেঙিয়ে কথাগুলো বলতেই আর্দ্র পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বিদ্রুপাত্মক হাসি হেসে বলল,

‘আচ্ছা, এবার এসেছেন আসল কথায়। রাস্তা চেনাটা আসল কথা না একচুয়েলি আমি যাতে নিজে এসে আপনাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই এটা হলো মূল কথা।’

হাওয়ায় চুল উড়িয়ে দিয়ে টায়রা ভাব নিয়ে বলল,

”এ্যাহ…যেই না তার বদন
ঠিকঠাক নাম হলো মদন।”

আর্দ্র ফুসে উঠে বলল,

‘এই…আপনি আমাকে মদন বললেন?’

‘তা নয়তো কি? বলেছি না নিজেকে এতো ইম্পোর্টেন্ড ভাববেন না? আপনি কখন এসে আমাকে নিয়ে যাবেন তার আশায় আমি বসেছিলাম নাকি? যেকেউ আসলেই হতো।’

‘কেনো আপনি কি কচি খুকি? আপনাকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’

টায়রা মুখ বাকিয়ে বলে,

‘নাহ আমি কচি খুকি না। কিন্তু অপরিচিত কারোর বাড়িতে তো আমি একা একা ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে যেতে পারিনা? আমার একটা প্রেস্টিজ আছে না?’

‘ওহ আচ্ছা? তাই নাকি? প্রেস্টিজ? তা শুনছিলাম আপনার নাকি পেট খারাপ? সকাল থেকে এ পর্যন্ত বারো-তেরোবার বাথরুমে যাওয়া-আসাও হয়ে গেছে?’

আর্দ্র ভ্রু নাচিয়ে দুষ্ট মুখচ্ছবিতে বলল। টায়রা বড় বড় চোখ মেলে তাকালো। বিরবির করে বলল, ‘এই কথা এই লোক কেমনে জানলো?’ আর্দ্র টায়রার চোখের সামনে হাত নাড়ালো। সম্ভিত ফিরে আঙ্গুল তুলে চোখ মুখ কুচকে টায়রা বলল,

‘দেখুন, একদম অসভ্যের মতো কথা বলবেন না। ওটা বাবাকে কাটানোর জন্য মিথ্যা বলেছিলাম।’

আর্দ্র হাটা দিলো। হাটতে হাটতেই সুর করে গাইলো দু লাইন,

‘বুক চিনচিন করছে হায়,
বাথরুম তোমায় কাছে চায়।’

টায়রা পেছন থেকে চিল্লিয়ে বলল,

‘আপনি এতো খারাপ কেনো?’

‘যেই একটা সুন্দর গান বললাম ওমনি খারাপ হয়ে গেলাম?’

‘এটা সুন্দর গান?’

‘অবশ্যই। আপনি জানেন এই গান গেয়ে আমি ছোটোবেলায় ক্লাস টু তে থাকতে প্রাইজ পেয়েছিলাম। তিনজন প্রতিযোগিতা দিয়েছিলো আমি থার্ড হয়েছিলাম। ইয়া বড় একটা পানি খাওয়ার মগও পেয়েছিলাম।’

আর্দ্র দাঁত কেলিয়ে বলল। টায়রা মুখটাকে কিঞ্চিৎ হা করে কিছুক্ষণ আহাম্মক এর মতো তাকিয়ে থেকে রাস্তার মাঝেই হু হা করে হেসে উঠলো। আর্দ্র বিরক্ত চোখে তাকিয়ে চলে যেতে যেতেই অনেক দূরে চলে গেলো। টায়রা পেছন থেকে চেচিঁয়ে বলল,

‘এই আমাকে নিয়ে যান।’

‘আসেন তাড়াতাড়ি। কোলে নিয়ে যাবো।’

ভ্রু কুচকে রেগে জোর আওয়াজে বলল টায়রা,

‘আস্ত একটা বেয়াদব। আমি বলেছি কোলে নিতে?’

______________________________

গালে হাত দিয়ে চিন্তিত মনে সোফায় বসে ছিলো টিকলি। ঠিক তার বরাবর আরেকটা সোফায় বসে ফোন সামনে নিয়ে আড়চোখে টিকলিকেই পর্যবেক্ষণ করা চলছিলো অন্য দুটি অক্ষিপটে। নিভা টিকলির পাশ থেকে বলে উঠলো,

‘কি চিন্তা করস?’

বুক ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিকলি কপাল কুচকে উত্তর দিলো,

‘আর্দ্র ভাইয়া গেছে টায়রাকে আনতে এটাই সবচেয়ে বড় চিন্তা।’

আদর ফোন থেকে চোখ সরালো। টিকলির দিকে পুরোদস্তুর তাকাতেই দেখলো নিভা ওর দিকে তাকিয়েছে। আদর আবারো ফোনে ডুব দিলো। নিভা বলল,

‘তোরা থাক। আমি ছাদে যাই। এ বাসার ছাদ টা অনেক সুন্দর।’

টিকলি উৎফুল্লতার সুরে বলল, ‘তাহলে আমিও যাই, চল। একা একা বসে থেকে কি করবো?’

আদর কোণাচোখে এক ঝলক তাকালো। নিভা খেয়াল করে বলল,

‘নাহ তুই থাক। আমি একাই যাই।’

কথাটা বলা মাত্র নিভা দৌড়ে চলে গেলো বাইরে। নিভা চলে যেতেও আদর ভালোভাবে তাকালো টিকলির দিকে। বাইরে তখন ঝড়ো হাওয়া। আষাঢ়ে বর্ষার আগামবার্তা। জানালা দরজার পর্দারা উড়ছে মুক্ত হয়ে। হু হু করে বাতাস ঢুকে ঘরময় হয়ে গেছে অত্যন্ত শীতল। টিকলি উঠে দাঁড়িয়ে জানালার থাই আটকে দিতে দিতে বলল,

‘একটু আগেও কি সুন্দর রোদ ছিলো! অথচ এখনি আকাশ মেঘ করেছে।’

আদর গিয়ে দাড়ালো টিকলির পেছনে। খুব সন্নিকটে। সকালে বকুল ফুলের মালা কিনে দিয়েছিলো আদর।টিকলির খোলা চুলের ভাঁজে গাথা বকুল ফুলের মালা, কাজল কালো দুটি চোখ রাঙা, হালকা গোলাপি রং ছোয়ানো দু’ঠোঁট জুড়ে, কানে বড় বড় কালো ঝুমকো, হাতভর্তি কালো লাল মিশ্রণের চুড়ি। নৌকা গলার ব্লাউজে লাল সুতোর কাজ করা। কালো জামদানি শাড়ির লাল আঁচল। আদর হাত বাড়িয়ে থাই খুলে দিলো। হু হু করে আবারো বাতাস ভেতরে ঢুকতেই টিকলি ঘুরে তাকালো। আদরকে এতোটা কাছে দেখে শিরদাঁড়া কেঁপে উঠলো। ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো শরীর জুড়ে। উন্মাদ অনুভূতির চোখদুটো দিশেহারা হয়ে তাকিয়ে রইল ওই শ্যামলা মুখের যুবকটির দিকে। যেই যুবকের চোখ নেশাক্ত। গভীর পাতাল চোখদুটো ভীষণ মাতাল। টিকলির কোমড় ছাড়ানো ঘন কালো রেশমি কেশ আর কালো শাড়ির লাল আঁচল উড়ে এসে পড়লো তার মুখচ্ছলে। টিকলি আস্তে করে সরিয়ে নিলো। আবারো ঘুরে দাড়ালো জানালার দিক। চোখবন্ধ করে আদরে মত্ততা গলায় বলল,

‘বাতাসের সাথে বালি আসছে তো ঘরে।’

টিকলির কথা জবাব না দিয়ে দ্বিগুণ মাতালজনিত গলায় আদর বলল,

‘এই সুন্দর চুলের ভাঁজে যে একটা টিকলির অভাব আছে তা কি আপনি জানেন, শুকতাঁরার মনতাঁরা?’

টিকলি কোমলতার যোগে চাইলো জানালা গলিয়ে বাইরের পানে। খুব অসহায় চোখ দুটোতে খেলে গেলো নিদারুন প্রেম! প্রেম প্রেম অনুভূতি নিয়ে দুঃখ বিলাশ করে চোখ দুটো বলল, ‘এভাবে বলবেন না! আমার দেহের প্রাণ চলে যায়!’

আদর সেদিকে তাকিয়ে আবারো মুগ্ধ গলায় বলল,

‘আপনার ইচ্ছা কি টিকলি? যেকোনো ইচ্ছা? এই মেঘলা দিনে ঘরে একলা আমার সাথে কি করতে আপনার বেশি ভালো লাগবে?’

টিকলি চমকে ঘুরে তাকালো। অবাকপ্রসন্ন চোখে তাকিয়ে আদরের চোখে কিছু একটা খুঁজলো। কিন্তু নেই…সেসব অবেদন, অভেদ্য চাওয়া পাওয়া কিছুই আদরের চোখে নেই। আছে শুধু বিশুদ্ধ নিরাপদ ভালোবাসা। ভালোবাসা আর ভালোবাসা। আছে প্রেম, অনুরক্তি, টিকলির প্রতি প্রবল অনুরাগ, মমতা, স্নেহ আর একরাশ মুগ্ধতা। টিকলি আশ্বস্ত হলো। মনে আশ্বাস নিয়ে বলে উঠলো,

‘এই বৃষ্টিস্নিগ্ধ দিনে একা আমরা দুজন বারান্দার কিনারে বসে আমি গিটার বাজানো শিখতে চাই, ডাক্তার। আপনার কাছে। আপনি থাকবেন আমার পেছনে বসে আমি থাকবো আপনার সামনে বসে। হাতের উপর হাত রেখে শিখাবেন আমায় গিটার বাজানো?’

আদর মোহবিষ্ট চোখে টিকলির দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আসুন।’

,

তখনও বৃষ্টি পড়েনি। মেঘলা সময়ে বারান্দার দ্বারপানে টিকলি বসে ছিলো গ্রাস কার্পেটে গিটার হাতে। একটা কালো রঙের টুল নিয়ে টিকলির পেছনে বসেছে আদর। বাদামী রঙের গিটারে আদর টিকলির হাত বাজিয়ে দিলো। হাতের উপর হাত রাখতেই শিউরে উঠলো দুটি মন। দুজন দুজনার খুব কাছে। অনুভব করা যাচ্ছে হৃদয়ের শব্দ। প্রেয়সীর চুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা অন্তর। আদর বলল,

‘আমি গিটার বাজাতে পারি এটা আপনি জানেন কীভাবে টিকলি?’

হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে আদরের দিকে তাকিয়ে টিকলি মিষ্টি হেসে ফিসফিস করে বলল, ‘সিক্রেট। বলা যাবে না। বলা বারন।’

আদর ভ্রু কুচকে বলল, ‘আর্দ্র বলেছে?’

টিকলি মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হুম। নিঝুম দ্বীপে একদিন বলেছিলো। সাথে এও বলেছে আপনি খুব সুন্দর গান পারেন।’

‘ডাহা মিথ্যা।’

‘ডাহা সত্যি। এবার শিখান।’

আদর ধরলো গিটার শক্ত করে। টিকলির হাত তারে লাগিয়ে দেখিয়ে দিতে দিতে সময় পার হলো কিছুক্ষণ। টিকলির হাতে গিটার পেছন থেকে ধরে ছিলো আদর। বাতাসে খোলা চুল এলোমেলো হয়ে বারংবার উড়ে পড়ছে আদরের মুখে আর টিকলি মগ্ন গিটার শিখতে। এদিকে আদর তাকিয়ে ছিলো প্রণয় নয়নে আসক্ত দৃষ্টিতে। হঠাৎ কেউ বলে উঠলো,

‘পার্ফেক্ট।’

এরপর আবারো দুই নারী-পুরুষ কন্ঠ সমস্বরে বলল, ‘আমরা কিন্তু কিচ্ছু দেখিনি।’

আদর টিকলি চমকে তাকালো। ঘরের দরজার সামনেই দেখা গেলো দুজন দুজনের ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। টিকলি ঝটপট উঠে দাড়ালো। উঠে দাড়াতেই টান খেলো আঁচলে। আদরের হাতের নিচে চাপা পড়েছে শাড়ির আঁচল। আদর ছাড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত দিয়ে অন্যদিক ঘুরে তাকিয়ে শুকনো কাশি কাশলো। টায়রা এগিয়ে এসে প্রফুল্লচিত্তে বলল,

‘ভাইয়া, দেখুন তো ছবিটা জবরদস্ত হয়েছে না?’

আদর আড়চোখে তাকালো। আর্দ্র টায়রাকে মাড়িয়ে বলল,

‘ভাইয়া, আমারটা দেখো। উনার টা দুই টাকা দামের ফোন। ছবি ভালো আসে না।’

টায়রা চোখ বড় বড় করে কোমড়ে হাত রেখে বলল,

‘এই আপনি কোনটাকে দু টাকা দামের ফোন বললেন? ইটস আইফোন।’

‘তাই বুঝি? সেকেন্ড হ্যান্ড নাকি থার্ড হ্যান্ড?’

‘ফার্স্ট হ্যান্ড। আরে আপনি চিনবেন নাকি? জীবনে আইফোন দেখছেন?’

‘তো আমার হাতে এটা কি? নোকিয়া?’ আর্দ্র ভ্রু কুচকে হাতের আইফোন দেখিয়ে বলল।

ওদের ঝগড়ার মাঝে টিকলি আদরের দিকে অসহায় চোখে তাকালো। আশ্চর্য ভাবে আদর ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলো।

_______________________________

ছাদের কাছাকাছি সিড়িতে আসতেই নিভা শুনতে পেলো কেউ একজন গুনগুন করে মনের সব কষ্ট আবেগ ঢেলে গাইছে,

“ব্যাচেলার আমি ব্যাচেলার
বিন্দাস লাইফে কোনো পেইন নেই আমার
ব্যাচেলার আমি ব্যাচেলার
বিন্দাস লাইফে কোনো পেইন নেই আমার।
ব্যাচেলার হয়ে যখন বাড়ি ভাড়া নিতে যাই
বাড়িওয়ালা বলে ব্যাচেলার এর জায়গা নাই
আংকেল,
আমি আপনার মেয়ের জামাই হতে আসি নাই
থাকার মতো ছোটোখাটো একটা জায়গা চাই
ব্যাচেলার আমি ব্যাচেলার
বিন্দাস লাইফে কোনো পেইন নেই আমার।”

নিভা গোয়েন্দাদের মতো সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কে গাইছে গান। কিন্তু দেখা গেলো না।গুটিগুটি পায়ে ছাদে উঠলো সে। আন্দাজ করলো যেই চারজনকে ব্যাচেলার ভাড়া দেওয়া হয়েছে হয়তো তাদের মধ্যেই কেউ একজন। বৃষ্টিমুখর দিনে মেঘলা আকাশের দিকে মুখ করে গাইছে কোনো অজানা যুবক। নিভা উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিলেই ছেলেটি ঘুরে তাকালো। নিভা অবহেলায় তাকাতে গেলেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অবাকতার চরম সীমানায় পৌঁছে গিয়ে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলল। ঠোঁট দুটো আপনা আপনি নিজ শক্তিতে আলাদা হয়ে চোখের পলক না ফেলে চেয়ে রইল। রাহুল বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘আপনি? আপনি টিকলি টায়রার ফ্রেন্ড না? সেদিন না আমাকে রিক্সায়…..’

রাহুলকে মাঝপথে আটকে নিভা স্বগতোক্তি করলো,

‘আপনি তো টিকলি টায়রার মামাতো ভাই। আপনি এখানে কি করছেন?’

শেষবাক্য খুব দ্রুত বলল নিভা। রাহুল স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

‘এখানে তো আমি ভাড়া থাকি। কিন্তু আপনি??’

‘আদর আর্দ্র ভাইয়াকে চিনেন না? আমি ওদের খালাতো বোন।’

রাহুল হেসে বলল, ‘ওহ আচ্ছা। তো কেমন আছেন?’

‘ভালো আপনি?’

‘যাচ্ছে কোনোরকম।’

নিভা তাকালো সম্পূর্ণ দৃষ্টিতে। রাহুলও তাকালো। চোখে চোখ মিল হলো। নিষিক্ত বাধাহীন অক্ষি। কিছুক্ষণ অস্বস্থিকর মুহুর্ত পার হলো আশেপাশে মাতাল হাওয়ায় ভেসে ভেসে। নীল আকাশ ঢাকা কালো মেঘের চত্ত্বরে। উপরে উড়ে বহুদূর চলে যাওয়া কোনো এক চিলের সান্নিধ্যে।

চলবে❤️