বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব-৩৪+৩৫

0
620

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

৩৪.
উড়ন্ত চুলগুলোকে হাত খোপায় বন্দী করতে করতে নিভা প্রশ্ন করলো,

‘আপনি এ বাসায় কতদিন থেকে আছেন?’

‘এইতো বেশ কিছু মাস।’

‘চারজন থাকেন তাই না? আমি শুনেছিলাম দুজন বিবাহিত। আরেকজন কি আপনার সমবয়সী?’

রাহুল হেসে জবাব দিলো, ‘আমার বন্ধু। নাম নয়ন।’

‘ওহ। আচ্ছা আপনার নিজের বাসা কোথায়?’

রাহুলের চোখে মুখে আকাশের মতোই তখন ঘন কালো মেঘ নেমে এলো। হাসি হাসি মুখ বালুচরে বিলীন হয়ে চোখে মুখে ফুটলো চাপা আর্তনাদ। রাহুল জোরপূর্বক হাসলো শুধু আর কোনো কথা বলল না। নিভা প্রশ্নটা ব্যক্তিগত ভেবে এড়িয়ে গেলেও কৌতুহল লুকাতে না পেরে আবারো প্রশ্ন করলো,

‘নিজের ফুফির বাসা রেখে আপনি ভাড়া থাকেন কেনো?’

রাহুল স্মিত হেসে উত্তর দিলো, ‘তেমন কোনো কারণ নেই। ওই… কারোর ঘাড়ে চেপে বসে থাকতে ইচ্ছে করেনা। নিজের পায়ে দাড়াতে চাই নিজের পরিশ্রমে।’

নিভা মৃদু হাসলো। এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতেই খেয়াল করলো তার ভীষণ রকম অস্বস্থি হচ্ছে। এরপর আর কোনো কথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাথে এও খেয়াল করলো এতোক্ষণ পর্যন্ত সে নিজেই শুধু বকবক করে গেছে। প্রশ্ন করেছে। আর রাহুল শুধু উত্তর দিয়েছে। এর বাইরে কোনো প্রশ্ন করেনি। নিভার চিন্তা ভাবনায় ভাটা দিয়ে তখনি রাহুল বলে উঠলো,

‘আপনি খুব মিশুক কিন্তু আমি একটু ইন্ট্রোভার্ট। লাজুক নই তবে মানুষের সাথে মিশতে একটু সময় লাগে। অপরিচিতদের সাথে একটু কম কথা বলা হয়। আসলে আমার পরিচিত দুনিয়া খুবই সীমিত। সেখানে বলা চলে, এখন আপনিও আমার সেই সীমিত দুনিয়ায় একজন। অল্প হলেও তো পরিচিত।’

পকেটে হাত রেখে ঠোঁটের কোণায় সৌজন্যমূলক হাসি ঝুলিয়ে বলছিলো রাহুল। নিভার মন খারাপ ভাব গুলো কেটে যেতে লাগলো আস্তেধীরে। সে একবার টিকলি আর টায়রার কথা বলতে চাইলো। মনে হলো, টিকলি আর টায়রাকে দেখিয়ে এ মুহুর্তে লোকটাকে দারুন এক সারপ্রাইজ দেওয়া যাক। কিন্তু পরমুহূর্তেই মত পালটানো হলো। মন বলল, নাহ… এখন যদি টিকলি টায়রার সাথে রাহুলকে দেখা করায় তাহলে তো রাহুল বিভিন্ন প্রশ্ন করবে, কেনো এসেছে? কতক্ষন হলো এসেছে? কি করছে এখানে? কার সাথে এসেছে? যদিও নিভার খালার বাসায় এসেছে বলে কাটিয়ে দেওয়া যাবে তবুও টিকলিরা তো বাসায় বলে এসেছে পিকনিকে যাচ্ছে। এখন রাহুল যদি আবার টিকলির বাসায় ফোন করে বলে দেয়। তখন তো আরেক কেলেঙ্কারি। সব ভেবেচিন্তে নিভা আর কিছু বলল না। মানবিকতার খাতিরে সেও হাসি ফিরিয়ে দিলো। রাহুল পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে হাসিমুখে মাথা ঝাকিয়ে বলল,

‘এখন আমার ঘুমানোর সময়। এই সময় না ঘুমালে প্রচন্ড মাথা ব্যথা করে বাকিদিন। সরি আপনাকে সময় দিতে পারলাম না। অন্য একদিন জবরদস্ত আড্ডা চলবে।’

,

ঘরে ঢুকতেই নিভা দেখতে পেলো এক পাশের সোফায় বসে আছে টিকলি টায়রা অপরপাশে বসে আছে আদর আর্দ্র। আর্দ্র আর টায়রার মাঝে কিছুক্ষণ আগেই এক দফা তুমুল ঝগড়ার ইতি ঘটেছে। এখন দুজন গাল ফুলিয়ে দু সাইডে বসে আছে। নিভা গিয়ে আর্দ্রর পাশে বসতে না বসতেই টায়রা পিশাচিনীর মতো খেঁক করে বলে উঠলো,

‘ওই, ওইপাশে বসছোস কেন? এইপাশে আয়। আমরা এইপাশে চোখে দেখোস না?’

নিভা উঠতে নিলেই আর্দ্র হাত চেপে ধরে বলল,

‘নাহ তুই এপাশেই বসবি। আমার সাথে।’

টায়রা ভেঙিয়ে বলল, ‘মেয়ে দেখলেই ময়না ছলাৎ ছলাৎ করে! ও আমার বেস্টফ্রেন্ড। আমার পাশে বসবে ও।’

‘এক্সকিউজ মি। আপনার বেস্টফ্রেন্ডের আগে ও আমার বোন।’

‘তো? বোন তো কি হইছে? বোন বলেই চিপকায় বসতে হবে?’

‘কেনো আপনার জ্বলে?’ আর্দ্র ভ্রু নাচিয়ে এমন এক ভাবভঙ্গি নিয়ে বলল যে টায়রা ফুসে উঠে টিকলির উপর চেঁচালো এবার,

‘এই তুই উঠবি? তোর শ্বশুড় বাড়ি ঘুরা শেষ হয়নাই?’

টিকলি গরম চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমি আবার কি করলাম?’

‘উঠোস না কেন? বাসায় যাবি না?’

‘আপনি যাবেন যান। আমার ভাবীকে নিয়ে টানাটানি করেন কেনো?’ আর্দ্র সোফা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে আবার বলল, ‘ভাবী চলে গেলে বেচারা আমার ভাইটা একা হয়ে যাবে না?’

আদর চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আমি বিয়ে করলাম কবে?’

আদরের কথা কেউ তেমন পাত্তা দিলো না। টায়রা আর্দ্রকে তখনের মতো ভেঙিয়ে বলল,

‘এক্সকিউজ মি। আপনার ভাবীর আগে ও আমার বোন। তাও মায়ের পেটের।’

নিভা গালে হাত দিয়ে ঝগড়া দেখতে দেখতে টিকলিকে বলল,

‘হোয়াট আ ঝগড়া! ফিলিংস লাইক সিনেমা হলে বসে ঝগড়া শো দেখছি। আমি মুগ্ধ, আপ্লুত, মোহিত!’

কপাল কুচকিয়ে টিকলি বিরক্ত কণ্ঠ ঠেলে বলে উঠলো,

‘বাদ দে, এরা সবসময় এমন করে। এতোক্ষণ ছাদে কি করছিলি?’

নিভা যেনো একটা কথার মতো কথা পেলো। খুব উৎসাহ নিয়ে সোফার উপর দু পা তুলে বসে বলল,

‘এই তোর একটা মামাতো ভাই আছে না?’

অবহেলার গলায় টিকলি বলল, ‘ছিলো একটা।’

‘রাহুল নাম না?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুই জানিস সে কোথায় থাকে?’

‘এই মিরপুরেই একটা ব্যাচেলর বাসায় থাকে শুনেছিলাম। কিন্তু কোথায় থাকে সেটা জানি না।’

নিভা সোফায় হেলান দিয়ে হেহে করে হেসে বলল, ‘এ বাসার উপর তলায়।’

টিকলি নড়েচড়ে বসলো। ভ্রু কুচকে বলল, ‘মানে?’

‘মানে তোমার একমাত্র মামাতো ভাইটা এ বাসার তিনতলায় ভাড়া থাকে। ব্যাচেলর।’

বিশাল বড় এক হা করে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে টিকলির মনে হলো সে ডুবে যাচ্ছে অকূল পাথারে। নির্জন দ্বীপে সে হারিয়ে গেছে। একা একদম একা টিকলি খুঁজে পাচ্ছে না কোনো দিশা। শুধু মনে হচ্ছে, ‘হায় আল্লাহ! এ মেয়ে বলে কি! রাহুল ভাইয়া এ বাসায় ভাড়া থাকে মানে? এবার? এবার কি হবে?’

‘ভাইয়া কি আমাকে দেখেছে?’

নিভা হাত নাড়িয়ে মাছি তাড়াবার ন্যায় উত্তর দিলো, ‘আরে নাহ।’

‘তুই কিছু বলছিস?’

‘আরে নাহ। বলতে চাইছিলাম পরে ভাবলাম, অন্তত একটা বাঁশ থেকে তো বান্ধবীকে রক্ষা করি। তাহলে এতো জনমে তোদের সাথে মিলে যে পাপগুলো করছি দয়া করে হলেও আল্লাহ একটা পাপ অন্তত মাফ করলেও করতে পারে।’

‘ফাইজলামি করস এই মুহুর্তে আইসে? আমার চিন্তা লাগতাছে। ভাই আমরা এই বাসা থেকে বের হবো কেমনে?’

‘কেন বাইরে কি বাঘ দাঁড়ায় আছে অর শিয়াল, কুত্তা, গরু, হাতি, মহিষ এনিথিং?’ নিভা ভ্রু কুচকে বলল। টিকলি নিভার বাহুতে পরপর দুটো থাপ্পড় দিয়ে বলল,

‘রাহুল ভাইয়া যদি দেখে ফেলে সেটার কথা বলেছি।’

‘আরে দেখবে না। প্যারা নিস না। ইউ নো লাইফ ইজ প্যারাহীন। তোর ভাই এখন ঘুমাবে। এ সময় না ঘুমালে নাকি বাকিদিন তোর ভাইয়ের মাথা ব্যথা করে। হুহ…ঢং…।’

নিভা মুখ ভেঙিয়ে বিদ্রুপ করে কথাগুলো বলতেই টিকলি আবার নিভার হাতে থাপ্পড় দিয়ে বলল,

‘আমার ভাইকে নিয়ে কিচ্ছু বলবি না। আমার ভাই অনেক ভালো। ওর মতো ভালো মানুষ আর একটাও হয় না।’

টিকলির কথার মাঝপথেই আদর তড়িঘড়ি করে ওর সামনে এলো। টিকলি ভালোভাবে তাকাতেই দেখলো ফর্মাল পোশাকে আদর দাঁড়িয়ে আছে। সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালো টিকলি। মুহুর্তেই বিষন্নতার বৃষ্টি নেমে গেলো মুখে। আদর প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে মুখ ভাড় করে কিছু বলতে চাইলেই টিকলি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে নরম গলায় বলল,

‘কি কাজ পরে গেছে?’

আদর কোনো কথা বলল না। টিকলি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঢোক গিলল। অনেক বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

‘সাবধানে যাবেন। আমরাও চলে যাচ্ছি।’

আদর থমথমে মুখে বলল, ‘আর কিছুক্ষণ থেকে যান। আমার খুব আর্জেন্ট কাজ পরে গেছে তা নাহলে আমি যেতাম না।’

টিকলির চোখ তৎক্ষণাৎ টলমল করে উঠলো। ভাঙা গলায় বলল, ‘থেকে কি করবো ডাক্তার?’

তখনি আর্দ্র হুশিয়ারি দিয়ে বলল, ‘আমরা কেউ নই? ভাইয়াই সব? ভাইয়া চলে যাচ্ছে বলেই চলে যেতে হবে? তোমরা পরে যাবে। দরকার পরলে আমি তোমাদের বাসায় দিয়ে আসবো।’

টিকলি জোরপূর্বক মুচকি হাসলো। উপরের দিকে তাকিয়ে চশমার আড়ালে কাজল কালো চোখদুটোর নিচে আঙ্গুল দিয়ে চেপে মুছে নিলো। আদর এক পলক তাকালো টিকলির দিকে। টিকলিও তাকালো। চোখে চোখ মিল হলো। কিছু না বলা ব্যথা অনুভব হলো। কিছু অসহায় কথা বলা হলো। আদর চলে গেলো। টিকলি ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকতেই টায়রা বলল,

‘বাব্বাহ! জামাইয়ের জন্য কতো দরদ! জীবনে আমার জন্য কাদছোস এমনে?’

টিকলি উত্তর দিলো না। বিষন্ন মনে সোফায় বসতেই সিড়ির সামনে থেকে আদরের কন্ঠস্বর ভেসে এলো। ভিড়ানো দরজাটা খুলে আদর টিকলিকে ডাকলো। স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে টিকলি ছুট লাগালো। সিড়ির সামনে আসতেই আদর দরজা চাপিয়ে দিয়ে বলল,

‘এতো জোরে কেউ দৌড় দেয়? এক্ষুনি তো পড়ে যেতেন?’

‘আপনি এখনো যাননি?’

‘এইতো চলে যাবো।’

টিকলি আশায় ছিলো হয়তো আদর যাবে না। মাথা নিচু করে ছোট করে সে বলল,

‘ওহ।’

আদর টিকলির চুলগুলো কানের একপাশে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘আর কিছুক্ষণ থেকে যান।’

টিকলির চোখ দুটো আবার ছলছল করে উঠলো। ঠোঁট চেপে বলল, ‘যার জন্য থাকবো সে তো চলে যাচ্ছে, ডাক্তার। তবে থাকবো কার জন্য?’

আদর টিকলির গালে এক হাত রাখলো। এরপর খুব নিঃসহায় গলায় বলল, ‘আমি তো থেকে যেতে পারছি না, টিকলি।’

আদরের স্পর্শ পেতেই অবাধ্য জলেরা গাল বেয়ে আদরের হাতের উপর দিয়ে গড়িয়ে গেলো। ব্যস্ত হাতে আদর টিকলির চোখ মুছে দিয়ে বলল, ‘আহা! কাদছেন কেনো? আপনি এমন করলে আমি যাবো কীভাবে?’

‘আপনি বলেছিলেন আজ সারাদিন আমার সাথে থাকবেন। আর এখন মাত্র বিকেল সাড়ে চারটা বাজে।’

টিকলির কথায় আদর হেসে দিলো। এরপর খুব তৃপ্তি নিয়ে বলল, ‘কি বাচ্চামো! এই বাচ্চাটাকে কবে যে বউ করে আমার রাজ্যে নিয়ে আসবো!’

আদর হেসে টিকলির গাল টিপে দিলো। এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে থেকে টিকলির মনে হলো, এই বাক্যের মতো এতো সুন্দর কথা আর হতে পারেনা। এতো সুন্দর অনুভূতি এতো সুন্দর মুহুর্ত আর হতে পারেনা কিন্তু সব তো হারিয়ে যাবে। ইশশ…সময়কে ধরে রাখার মতো কোনো মেশিন কেনো নেই টিকলির কাছে? তবে কিছু সময়কে কক্ষনো যেতে দিতো না। আটকে রাখতো সুখময় সময়গুলোকে আর নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দিতো দুঃখগুলোকে। তখনি আদর বলল,

‘আপনি কি বলতে পারবেন টিকলি? আমার এই আটাশবছর জীবনে কেনো আপনার পা পরলো? আঠারো বছর বয়সে কেনো আপনার পদার্পণ হলো না, আমার বুকে? কিংবা তারও আগে! কতগুলো বছর আপনি হীনা কেটে গেছে ভাবলেই মন বলে, চল আদর। মিশনে নামি। জীবনের আগের অধ্যায়গুলোকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসে তোর টিকলির নাম গুলোকে আঠা মেরে বসিয়ে দি। এমন আঠা! যে আঠা জীবনে কেউ লাগায়নি তুই হীনা!’

তখনি যেনো নিরন্তর প্রবল প্রণয়ে ছেয়ে উঠলো টিকলির অন্তঃস্থলে থাকা অন্তঃকরণ। অবিরত ভালোবাসার বুলি বলে ক্রমেই অপস্রিয়মাণ হয়ে যেতে লাগলো আদর। এক পা এক পা করে সিড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলো সাথে টিকলিকে দিয়ে গেলো এক আকাশ ভালোবাসা। এক সমুদ্র প্রেম। এক পাহাড় উত্তাল অশান্ত মনের বাণী।

______________________________

টিকলিরা যখন খান বাড়ি থেকে বের হলো তখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। নিভাও এসেছে ওদের সাথে। টায়রা টিকলি জোর করেই নিয়ে এসেছে। আজ রাতটা টিকলিদের বাসায়ই কাটানোর বায়না। আর্দ্র আসতে চেয়েছিলো কিন্তু টায়রার বেড়াজালে পড়ে টিকলি বারন করেছে। গেট দিয়ে বের হতেই দেখা গেলো ওই সময় ওই গেট দিয়ে আরেকটি যুবক ভেতরে ডুকলো। ছেলেটা এমন ভাবে তাকালো যে কার দিকে তাকালো ঠিক ঠাওর করা গেলো না। টিকলি টায়রা নিভা একে অপরের দিকে তাকাতেই টায়রা চোখ কুচকে বলল,

‘এই লোক কার দিকে তাকালো?’

টায়রার মাথায় চাপড় দিয়ে টিকলি বলে, ‘যার দিকে তাকাক। তোর তাতে কি?’

‘আরে বুঝস না মাম্মা। আমার দিকে তাকালে তো কিছু একটা হিল্লে হয়ে যেতো। তুমি তো বইন প্রেম ট্রেম কইরে বিন্দাস লাইফ পার করতাছো। আমার তো আর একা একা সিংগেল লাইফ ভালো লাগে না। বোনের কষ্ট তো বুঝবা না!’

‘চুপ থাক, বেয়াদব।’ বলেই নিভা রিক্সা ডাকতে গেলো।

,

‘মামা, আজকে যা দেখছি না!’

রাহুল ভ্রু কুচকে বলল, ‘কি দেখছস?’

নয়ন এক লাফ দিয়ে রাহুলের কাছে আসলো। মুখোমুখি বসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে ফিসফিস করে বলল,

‘আজকে দেখি কি জানোছ? আমাদের বাসা থেকে তিনটা মেয়ে বাইর হয়ে গেলো। তিনটাই যা সুন্দর না রে! ডানপাশের টা তো একবারে আমার দিল কাইরে নিছে।’

রাহুল বিরক্ত হয়ে নয়নের কাছ থেকে সরে গিয়ে বলল,

‘তোর এই রোগ কবে যাবো বলতো? মেয়ে দেখলেই ছুক ছুক স্বভাব। যারেই দেখোস তার উপরেই তুমি ফিদা। ঠাস ঠুস করে ক্রাস খাও।’

‘তুমি যদি দেখতা তাইলে তুমিও তোমার দিলের যতো পেয়ার আছে সব ঢাইলে দিতা।’

‘হ। তোর মতো তো সবাই প্রতিবন্ধী। অটিজম শিশু।’

চলবে❤️

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

৩৫.
রোদ্দুরে সকাল। ঝকমকে এক ফালি নরম রোদ এসে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো বিছানা জুড়ে। সুন্দর সকালটাকে পাড় করেই দুপুর গড়ালো। সাথে বাড়লো তাপ। গরমের উত্তাপ। গায়ে জড়লো ঘাম। রোদ্রে ক্লান্ত দেহ চলতে চায়না।তবুও চলাতে হয়। কাল রাতে নিভা টিকলিদের বাসায় ছিলো। সকালে টিকলিদের সাথেই ভারসিটি এসেছে। দুপুরে ক্লাস শেষ করে ওরা যখন ভারসিটি থেকে বের হলো তখন নিভা বলল,

‘তোরা তাহলে চলে যা।’

টায়রা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুই এখন কোথায় যাবি?’

‘খালামনির বাসায়।’

‘কেন যাবি? তোর নিজের বাসা নাই?’

‘আরে আম্মু কিছুদিন থাকবে নানুবাড়ি। খালামনি তো কাল রাতেই এসে পরছে। আম্মু আসার আগ পর্যন্ত খালামনির বাসায় ই থাকতে হবে।’

নিভার কথা মাঝেই আচমকা কোথা থেকে যেনো সামনে রিক্সায় করে রাহুল এসে থামলো। টিকলি ভীষণ রকম অবাকতার সাথে চোখ কুচকে তাকাতেই দেখলো পাশে আরেকটা ছেলে। চেনা চেনা লাগছে কিন্তু চেনা যাচ্ছে না।

ভর দুপুরে কড়া উত্তাপে রাহুল তার শার্টের কলার পেছন দিকে ঠেলে দিতেই পাশ থেকে নয়ন খুব উৎফুল্লতার স্বরে ফিসফিস করে বলল,

‘আরেব্বাস, ভাই এই তিনটাই তো সেই মাইয়া। যার কথা কালকে তোরে বললাম। ওই যে দেখ, মাঝখানে যেই মেয়েটা দাঁড়ায় আছে না ওই মেয়েই আমার দিল কাইড়ে নিছে।’

রাহুল ভ্রু কুচকে নয়নের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো। সামনে তাকাতেই দেখলো মাঝখানের মেয়েটা টায়রা। রাহুল চোখ পাকিয়ে নয়নের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘আমার বোন।’

নয়ন মিনিট পাঁচেকের জন্য হা হয়ে গেলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘এতো সুন্দর মাইয়া তোর বইন?’

রাহুলের কপালে কিছু সূক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু পরমুহূর্তেই নয়নের কথা শুনে কটমট করে বলল,

‘একদম নজর দিবি না। চোখ তুইলে ফেলামু একবারে। যেখানে মন চায় সেখানে ফ্লার্ট কর কিন্তু আমার বোনদের ধারের কাছেও যাতে না দেখি।’

রাহুল এগিয়ে গেলো। নয়নও মুখ গোমড়া করে রাহুলের পেছন পেছন গেলো। সাথে বিরবির করে বলল, ‘শালার ভাগ্যটাই আমার খারাপ। পোড়া কপাল।’ নয়ন এগিয়ে যেতেই টিকলি টায়রাকে ইশারা করলো। ফিসফিস করে বলল,

‘সর্বনাশ! এই লোক রাহুল ভাইয়ার সাথে কি করে?’

টায়রাও ফিসফিস করে জবাব দিলো, ‘আমি কীভাবে জানবো? তুই যেখানে আমিও তো সেখানেই।’

রাহুল সামনে যেতেই নিভা হাসিমুখে বলল, ‘আপনি? ভালো আছেন?’

রাহুল স্বভাবসুলত মাথা ঝাকিয়ে হেসে বলল, ‘জি। কাল বিকালেই আমাদের দেখা হয়েছিলো। এই সময়টুকুতেই খারাপ থাকি কি করে?’

‘হুম। তাও তো কথাই।’ নিভা হেসে ফেলল। রোদের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠলো সুন্দর মুখখানা।

টায়রা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে টিকলিকে বলল, ‘কাহিনী কি রে? কাল বিকালে দেখা হইছে মানে?’

‘তেমন কিছু না। পরে বলবোনি।’

তখনি নয়ন টায়রার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বলল,

‘হাই, আই এম নয়ন। হোয়াটস ইউর নেম?’

টায়রা বত্রিশটা দাঁত বের করে বলল, ‘মাই নেইম ইজ চোখ।’

থতমত খেয়ে নয়ন বলল, ‘সরি?’

রাহুল এসে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে নয়নের দিকে তাকালো। নয়ন অন্যদিকে ঘুরে বিরবির করে বলল,

‘ভাই হচ্ছে একটা আইটেম বোম। বোন হচ্ছে ধানি লঙ্কা।’

টিকলি মিনমিনে গলায় বলল, ‘ভাইয়া তুমি এখানে?’

‘হুম চল। ফুফা ফোন করে বলল তোদের ভারসিটি থেকে নিয়ে আসতে।’

টায়রা ভ্রু কুচকে বলল, ‘বাবা বলেছে? হঠাৎ কেনো? আমরা তো প্রতিদিন একা একাই যাই।’

‘জানি না। আসতে বলেছে তাই এসেছি৷’ কপালে ভাঁজ ফেলে রাহুল সন্দেহজনক চোখে তাকিয়ে আবার বলল, ‘আচ্ছা কাল তোরা কোথাও গিয়েছিলি?’

টিকলি তুতলিয়ে বলল, ‘কে কেনো ভাইয়া?’

‘যেটা জিজ্ঞেস করলাম সেটা বল।’

‘ওইতো ভাইয়া পিকনিকে গিয়েছিলাম। বান্ধবীরা সবাই মিলে পিকনিক করছিলাম। তো নিভা ছিলো ওর খালার বাসায়। পিকনিকে এটেন্ড করেনি। তাই আমরা বাসায় ফেরার সময় ওকে ওর খালার বাসার সামনে থেকে পিক করে নিয়েছিলাম। কাল রাতে ও আমাদের সাথেই ছিলো।’ কথাগুলো বলার পর টিকলি নিজেই হতবাক হয়ে গেলো। কি সুন্দর! অনর্গল মিথ্যে কথা বলে দিলো। একটুও বাজলো না। টিকলি কবে এতো মিথ্যা বলা শিখলো? প্রেমে পরলে কি সবাই মিথ্যে বলা শিখে?

‘কিন্তু কেনো রাহুল ভাইয়া? কি হয়েছে?’ টায়রার প্রশ্ন।

রাহুল এবার হেসে উত্তর দিলো, ‘তেমন কিছু না। ওই আমার বন্ধু নয়ন তোদের আমাদের বাসার সামনে দেখেছে তো তাই।’

কিছু মনে পরেছে এমন ভান ধরে নিভা বলল, ‘ও হ্যাঁ, আমরাও তো দেখেছি। আমরা যখন চলে যাচ্ছিলাম তখন সে বাসার ভেতর ঢুকছিলো তাই না নয়ন ভাই?’

নয়ন মাথা নাড়ালো। রাহুল টিকলির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

‘বাসার ভেতরে ঢুকেছিলি নাকি বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলি?’

টিকলি বিরবির করে বলল, ‘এতো প্রশ্ন করে ক্যা?’ চোখ মুখ কুচকে টিকলি আরো একটা মিথ্যা বলল, ‘বাইরে দাড়িয়েছিলাম।’

টায়রা সন্দেহ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কিন্তু ভাইয়া? তুমি…’

টায়রাকে মাঝপথে আটকিয়ে রাহুল বলল, ‘আমি ওই বাসায়ই ব্যাচেলর হিসেবে ভাড়া থাকি।’

টায়রা অবাক হয়ে টিকলির দিকে তাকালো। টিকলি অসহায় চোখে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিলো ঘটনা সত্যি। টায়রা ফিসফিস করে বলল, ‘কি বলে! আল্লাহ যে কালকে কি জোর বাঁচায় দিছে! বেঁচে থাকতে আর ওই বাড়িতে পা রাখবো না।’

________________________________

তখন বিকেল। টিকলি টায়রাকে বাড়ি পৌছে দিয়েই রাহুল মিরপুরের নিজের ছোট্ট এই ব্যাচেলর বাসায় এসে পড়েছিলো। এসেই ঘুম দিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে বিকেলে ছাদে যেতেই আবিষ্কার করলো ছাদের এক কিনারে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিভা। রাহুল পেছন থেকে বলল,

‘হাই।’

নিভা ঘুরে সবসময়কার মতো হাসি দিয়ে বলল, ‘ওহ, হ্যালো।’

‘কি খবর?’

‘এইতো চলছে।’

রাহুল কৌতুহল থেকে প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কি এখানে বেড়াতে এসেছেন? না মানে আগে তো কখনো দেখি নি।’

এলো চুলগুলোকে ঠিক করতে করতে নিভা জবাব দিলো, ‘সেরকমই। আসলে এ বাড়িতে আসা হয়। কিন্তু তেমন থাকা হয়না। আম্মু গেছে নানুবাড়ি। কিছুদিন থাকবে। তাই আমিও কয়েকটা দিন আছি এখানে।’

‘ওহ আচ্ছা। আপনারা কয় ভাই-বোন?’

‘আমি একাই।’ নিভা হেসে আবার বলল, ‘এর জন্যই আমার এখানে আসতে ভালো লাগে। সারাদিন বাসায় একা একা ভালো লাগে না। এখানে আসলে আদর আর্দ্র ভাইয়ার সাথে মজা করা হয়। মাঝে মাঝে টিকলি টায়রার কাছে থাকি। দিন কেটে যায়। বাই দা ওয়ে, আপনারা কয় ভাই-বোন? ‘

রাহুলের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। একদম কালকের মতোন। নিভা ভ্রু কুচকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। আশ্চর্য! লোকটাকে যখনি নিজের ফ্যামিলির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয় তখনি লোকটা কেমন চুপ হয়ে যায়। নিভার ভাবনার মাঝেই রাহুল খুব আস্তে করে বলল,

‘দুই ভাই-বোন।’

‘ওহ তাই। আপনার বোন আছে বুঝি? নাম কি? কোন ক্লাসে পড়ে?’

‘নাম রুমকি। ক্লাস থ্রি তে পড়ে।’

‘অনেক ছোট।’

রাহুল হেসে মাথা ঝাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ সাথে খুব আদুরে। আমার বাধ্য।’

‘তাই? একদিন দেখা করাবেন আমার সাথে?’

নিভা খুব উৎসাহ নিয়ে কথাটা বলল। নিভার কথায় রাহুলের মুখটা আবারো থমথমে হয়ে গেলো। নিভার হাসি-হাসি মুখ মিলিয়ে গেলো। বিভ্রান্তিকর অস্থিরতাগুলো লুকিয়ে জানতে চাইলো, ‘আপনি কি রাগ করলেন আমার উপর? আপনি যদি না চান তবে দেখা করবো না।’

রাহুল হেসে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ‘আরে নাহ। তেমন কিছু না। আমার সাথেই তেমন দেখা হয় না।’

‘কেনো?’

‘হুম?’

‘বললাম কেনো দেখা হয়না?’

‘এমনি। আমি দূরে থাকি তো তাই।’

‘কেনো আপনি আপনার নিজের বাড়িতে যান না?’

রাহুল এর পরিপেক্ষিতে আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না। খুব অস্বস্থি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল আকাশের দিকে মুখ করে। অপরিচিত মানুষের এতোটা গভীর প্রশ্ন রাহুলের পছন্দ না। কিন্তু এই প্রশ্নগুলো তো খুবই ন্যাচারাল। স্বভাবসুলত মানুষ করবেই। কিন্তু ন্যাচারাল মানুষগুলোর জন্যই তো ন্যাচারাল প্রশ্ন। রাহুল তো ন্যাচারাল না। তার জীবন যে টিকলি, টায়রা, নিভা, আদর, আর্দ্রের মতো এতোটা স্বাভাবিক না। নিভা তুড়ি বাজালো। সম্ভিত ফিরে রাহুল কিছু বলতে যাবে তার আগেই শুনতে পেলো নয়নের গলা। নয়ন ছাদে উঠতে উঠতে বলছে,

‘এই তুই কি করিস এতোক্ষন ছা…দে…।’

নিভাকে দেখে নয়ন থেমে গেলো। চোখগুলোকে একটু কচলিয়ে বলল,

‘আপনি?’

নিভা কাধ নাড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ আমি।’

রাহুল নয়নের কাধ ধরে আস্তে করে বলল, ‘উনি আদর আর্দ্রের খালাতো বোন হয়।’

‘ওহ তাই বুঝি দুপুরে ওভাবে কথা বলছিলি? আমি তখন কিছুই বুঝতে পারিনি।’

‘হুম।’

নয়ন এবার ফিসফিস করে বলল, ‘তা তুমি আদর ভাইয়ের বোনের সাথে এতো কি কথা বলো? প্রেম পড়ছো নাকি মাম্মা?’

রাহুল নয়নের পেটে কনুই দিয়ে গুতা দিলো। নয়ন পেট ধরে মুখ ফুলিয়ে আউ করে সরে দাড়ালো।

_____________________________

রাতে জামিলুর রেজা টিকলিদের ঘরে এলো। টিকলি কপালে হাত রেখে আধশোয়া হয়েছিলো আর পাশেই টায়রা চুল আচড়াচ্ছিলো। জামিলুর রেজাকে দেখে টায়রা নড়েচড়ে বসে বলল,

‘কিছু বলবে বাবা?’

টিকলি কপাল থেকে হাত সরালো। বাবাকে দেখে শোয়া থেকে সুন্দর করে উঠে বসে বলল,

‘কখন ফিরেছো বাবা?’

‘এইতো কিছুক্ষণ আগেই।’

‘খেয়েছো?’

‘হুম।’

ঘরে শায়লা আক্তার ঢুকলো। টিকলি এক পলক তাকিয়ে আবার বাবার দিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,

‘আজ আমাদের ভারসিটি থেকে আনতে রাহুল ভাইয়া কেনো গিয়েছিলো?’

‘আমি বলেছিলাম তাই।’

‘কেনো?’

জামিলুর রেজা কোনো প্যাঁচে গেলেন না সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি কাউকে পছন্দ করো টিকলি?’

কথাটা কানে যাওয়া মাত্র টিকলির বুক কেঁপে উঠলো। আকস্মিক প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। মুখে ফুটে উঠলো অজানা তীব্র ভয়। হাত কচলাতে কচলাতে এদিক ওদিক তাকিয়ে টায়রার দিকে তাকালো। টায়রা নিজেও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বাবার মুখের দিকে। সেও যে এই প্রশ্নে বেশ শক খেয়েছে তা একদম ঝকঝক করে মুখে ভেসে উঠেছে। টিকলি যেনো বোবা হয়ে বসে আছে। কথা বলার জন্য ঠোঁট দুটো খুলতে পারছে না। জামিলুর রেজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আবারো বললেন,

‘বাদর ডাক্তার কে?’

টিকলি যেনো এই প্রশ্ন শুনে আরো অবাক হয়ে গেলো। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। গহীন অন্ধকারে এক ফুটা আলোর দিশা খুঁজে পেলো না। শায়লা আক্তার তখন পেছন থেকে ঝাঝাঁলো গলায় বললেন,

‘উত্তর দিচ্ছিস না কেনো? কাল রাতে খাবার টেবিলেই ফোন রেখে এসেছিলি মনে আছে? তখন এই নামে সেভ করা একটা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছিলো। লকস্ক্রিনে মেসেজটা ভেসে উঠেছিলো। আর মেসেজ টা ছিলো, ‘আমি আজ রাতে ব্যস্ত থাকবো।’ তুই নিশ্চয়ই পরে দেখেছিস?’

টিকলি ঢোক গিলল। চোখ বন্ধ করে নিজের এই অপকর্মের জন্য নিজেকে কিছু গালাগালও দেওয়া হলো। পাশ থেকে তখন টায়রা থেমে থেমে বানিয়ে বানিয়ে বলে উঠলো,

‘আরে না মা। তেমন কেউ না। সে তো একটা মজা ছিলো। এক বন্ধুর নাম মজা করে সেভ করা হয়েছিলো।’

‘বন্ধুটা তো আর ডাক্তার নয়? ডাক্তার হলে তো আর তোমাদের বন্ধু হতে পারে না। আর ধরেই নিলাম বন্ধু কিন্তু এই মেসেজ কেনো পাঠাবে?’ জামিলুর রেজা প্রশ্ন করলেন।

টায়রা আবার কিছু বলতে ধরলেই টিকলি টায়রাকে থামিয়ে দিলো। জিহবা দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে বলল, ‘থাক আর মিথ্যা বলিস না।’

টায়রা থেমে গেলো। শায়লা আক্তার উচ্চস্বরে বললেন,

‘তার মানে তুই প্রেম করিস?’

টিকলি কোনো উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে বসে থাকলো। টায়রা নখ কামড়িয়ে ভাবতে থাকলো কি করে ব্যাপারটাকে সামাল দেওয়া যায়। জামিলুর রেজা টিকলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।বললেন,

‘তোমার যদি কোনো পছন্দ থাকে তাহলে আমার আপত্তি নেই। আমরা চেয়েছিলাম তোমাকে বিয়ে দিতে। কিন্তু আমরা জানতে চাই ছেলেটা কে? তোমার যোগ্য কি না?’

বাবার কথায় খানিকটা ভরসা পেলেও টিকলি জানে ছেলেটা কে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর সব উলোট পালোট হয়ে যাবে। আর হলোও তাই। টিকলি বাবার হাত ধরে বলল,

‘বাবা, উনার নাম আদর। আদর খান।’

জামিলুর রেজার স্বাভাবিক ভ্রু জোড়া কুচকে এলো। সন্দেহ কন্ঠ নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কোন আদর?’

টিকলি ঢোক গিলে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে সময় নিয়ে বলল, ‘আজিম খানের ছেলে। নিউরোলজিস্ট।’

জামিলুর রেজা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভীষণ অবাকতার সুরে বললেন, ‘হোয়াট? এটা কি সেই ছেলে যার সাথে আমি প্রথমে তোমার বিয়ে ঠিক করেছিলাম?’

টিকলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে মাথা নাড়ালো। জামিলুর রেজা অবাকের উপর বিস্ময় হলেন। শতগুণ অবাকতা কন্ঠে ঢেলে বললেন,

‘কিভাবে এটা করতে পারো তুমি? তোমার কি মনে নেই তারা কি কি করেছিলো? কিভাবে আমাদের অপমান করেছিলো? এমনকি তোমাকে পনেরো দিনের….ছি ছি ছি!’

জামিলুর রেজা হাইপার হয়ে গেলেন। টিকলি দাঁড়িয়ে বাবার মুখোমুখি হয়ে ব্যস্ত গলায় বলল, ‘বাবা দোষ টা আমার ছিলো। আমার কথাটা একবার শুনো।’

জামিলুর রেজা এক কথায় বললেন, ‘আর একটা কথাও হবে না। ভুলে যাও সেই ছেলেকে। একসময় আমি সেই ছেলেকে পছন্দ করে তোমার জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিলেও এখন আর মানতে পারবো না। সেই পরিবার খুবই বেয়াদব এবং অসভ্য।’

জামিলুর রেজা চটপট পায়ে চলে গেলেন ঘর থেকে। টিকলি থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসে পড়লো খাটে। কানে অনবরত বাজতে থাকলো বাবার বলা কথাগুলো। একসময়ের ছোট্ট একটা মিথ্যে বলায় আজ কত বড় কান্ড ঘটে গেলো! টিকলি কি আদেও কখনো পাবে আদরকে? দু’নয়ন বেয়ে জলেরা পড়তে থাকলো অফুরন্ত। টায়রা টিকলির কাধে হাত রেখে চোখ মুছিয়ে দিলো। ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘আদর ভাইয়াকে ফোন কর।’

টিকলি তৎক্ষণাৎ ফোন লাগালো। পাগলের মতো একটার পর একটা ফোন দেওয়ার পরও ওপাশ থেকে ধরা হলো না। টিকলি শব্দ করে কেদে উঠলো কিছুক্ষণ পর মেসেজ এলো, ‘আমি খুব ব্যস্ত। জাস্ট দশ মিনিট ওয়েট করুন। আমি ব্যাক করছি।’

টিকলি আরো জোরে শব্দ করে কেদে উঠতেই টায়রা ওকে জড়িয়ে ধরলো। হেচকি দিয়ে কাদতে কাদতে টিকলি বলল,

‘দেখেছিস, তুই তো কাল বারবার বলছিলি, আমি এতো কাদছি কেনো? এখন দেখেছিস সেই যে কাল দেখা হলো এরপর আর তার সাথে কথা হয়নি। সে এতোটাই ব্যস্ত। তার এই ব্যস্ত জীবনে আমি আমাকে খুঁজে পাইনা। অথচ ব্যস্ততা শেষ হলে পাগল সে। সেই পাগলামির কি মানে! কি দাম!’

চলবে❤️