বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব-৩৬+৩৭

0
612

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

৩৬.
আট মিনিটের মাথায়ই ফোন দিয়েছিলো আদর। টিকলি ফোন কানে ধরেই রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘এতোটা ব্যস্ত আপনি!’

টিকলির কণ্ঠশুনে আদর ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘কুল ডাউন। কি হয়েছে? আপনি তো জানতেন আমি ব্যস্ত থাকবো।’

টিকলি ঠোঁট ভেঙে কেদে দিলো। আদর দিশেহারা হয়ে পরলো। হতাশ কন্ঠে বলল, ‘এতোটা পাগলামি করলে কি করে চলবে? আমি ব্যস্ত ছিলাম।’

টিকলি তৎক্ষণাৎ জ্বলে উঠলো, ‘সবসময় বেশি বুঝেন কেনো? আমি একবারো বলেছি আপনার জন্য কাদছি? আমি তো জানি আপনার ব্যস্ততম জীবনে আমার কোনো ভূমিকা নেই।’

আদর বিস্মিত হয়ে পরলো। কিছুক্ষণ অবাক থেকে বলল, ‘আপনার ঘুম দরকার টিকলি। ঘুমান। বেশি উল্টাপাল্টা বকছেন।’

টিকলি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চিতকার করে বলল, ‘আপনি কি আমার কথাটা শুনবেন? তা নাহলে আমি বিয়ে করে ফেললাম।’

আদর যেনো বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে রইল। শতগুণ অবাকতার স্বরে বলে উঠলো, ‘রাত ভিড়েতে কি শুরু করলেন? এখানে বিয়ের প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে?’

‘ডাক্তার..’

‘ওকে ওকে…আপনি বলুন। আমি শুনছি। তবুও এতো হাইপার হবেন না। ওহ মাই গড! পুরাই হট।’

‘আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?’

‘মজা করবো? তাও আবার আমি? তাও এই সময়ে? আপনার সাথে? এখন মজা করলে আপনি এক চিৎকারে আপনাদের দু’তলা বাসাটা ভেঙে ফেলবেন। প্রেমের পর নতুন নতুন চিৎকার শিখেছেন বলে কথা!’

টিকলি চোখ বন্ধ করে শান্ত হলো। নিজেকে যথাযথ গাম্ভীর্য করার চেষ্টা চালালেও পারা গেলো না। অন্যথাকারী মনটা আবার কেদে উঠে আদরকে বলল,

‘আমি বাবাকে সব বলে দিয়েছি।’

এতোক্ষণ টিকলির রাগ কমানোর প্রচেষ্টায় ঠাট্টার ছলে কথা বললেও এ মুহুর্তে ভ্রু জোড়া বেঁকে গেলো আদরের। অসম্ভব কৌতূহল নিয়ে ভ্রু কুটি করে বলল, ‘কি বলেছেন?’

‘আপনার কথা। আপনার মেসেজ কাল বাবা দেখে ফেলেছে। আমি আজকে সব স্বীকার করেছি। কিন্তু বাবা মানছে না। আপনাকে ভুলে যেতে বলেছে।’ কথা বলতেই টিকলি কেদে দিলো। জীবনের এতোগুলো বছরে যা কাদেনি। প্রেম করার পর তার চেয়ে বেশি কাদছে। প্রেম করলে বোধ হয় মানুষের সাহস বাড়ে, মিথ্যে কথা বলাও শিখে, কথা গোপন করতে জানে, নিজেকে আড়াল করতে শিখে, সাথে খুব করে কাদতে পারে।

আদর অবিশ্বাস্য চোখে কিছুক্ষণ শূন্যে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ পর খুবই হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে দীর্ঘ কন্ঠে বলল,

‘কিচ্ছু বলার নেই।’

টিকলি ঠোঁট চেপে কান্না আটকিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কিচ্ছু বলার নেই?’

‘নাহ। শুধু এটুকুই বলবো এতোটা বাড়াবাড়ি আপনি না করলেও পারতেন। আমাকে না জানিয়েই এতো বড় ডিসিশন না নিলেও পারতেন। আপনার বাবাকে জানানোর এখনি কোনো দরকার ছিলো না। কথাটা কাটিয়ে দিতেন। আমি চেয়েছিলাম আগে আমি আমার পরিবারকে বুঝাবো। এরপর আমার পরিবার ভুল স্বীকার করে আপনার পরিবারের সাথে কথা বললেই ব্যাপারটা মিটমাট হয়ে যেতো। কিন্তু আপনি কি করে ফেললেন! নাথিং টু ছে।’

কথাগুলো বলেই ফোন কাটা হলো। টিকলি দাড়ানো থেকে ধপ করে বসে পড়লো। চোখের সামনে ফোনটা ধরে বিরবির করে বারবার বলল, ‘কেটে দিলো? কেটে দিলো সে ফোনটা? আমার দিকটা একটুও বুঝার চেষ্টা করলো না?’

________________________________

এর মাঝে কেটে গেলো দুদিন,,,

“কি দরকার, মিছে আবদার
ভুলের পাল্লা ভারী
জানি নয়ছয়, সবই অভিনয়
তাই তো দুজনের আড়ি”

শুভ্র প্রভাতটা মেঘে ভরপুর। জারুল গাছ থেকে চুইয়ে টুপটাপ করে পড়ছে বৃষ্টির পানি। হিজল গাছে ফুটেছে লাল ফুল। টিকলি ঊষর বেলায় বসে গেছে গিটার হাতে। সারারাত নির্ঘুম টিকলির চোখ ভারী, ক্লান্ত। তবুও ঘুমের ছিটাফোঁটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আদরের কাছ থেকে সেদিন একটু আকটু গিটার বাজানো শিখে নেওয়া হয়েছিলো। সেই শেখা গিটার বাজানো বাজিয়েই অশ্রু জড়িয়ে দু লাইন গাওয়া হলো।

নির্ঘুম কালো রাত্রি কেটে যেতেই ভোরবেলায় কফি হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে আদর। দেয়াল ঘেঁষে জেগে উঠা বাগানবিলাস। চারিপাশের বাতাসে সাদা শিমুল তুলোর উড়াউড়ি। গম্ভীর মনের মন খারাপ সাথে হালকা তেজ তবুও ভালোবাসার কাছে একবার পরোয়ানাবিহীন তো আরেকবার পরাজিত। পাতার ন্যায় বেগুনি রঙের ফুলগুলো মুঠো ভরে ছিড়ে নিয়ে বৃষ্টিপ্রহর প্রত্যুষে অনেকদিন বাদে বহু বছর বাদে গেয়ে উঠা হলো,

“তোমার হাসির জন্য আমি সব করে যাই
ভালোবেসে দিয়েছি তোমায় আমার পুরোটাই।”

টায়রা উঠে এসে টিকলির কাধে হাত রাখলো। বন্ধ চোখে টিকলি গেয়ে উঠলো,

“চাইনি আমি হারাও তুমি
বাড়াও মনের দূরত্ব…..”

সকাল সকাল উঠা আর্দ্রের অভ্যাস নয়। তবুও আজ কীভাবে যেনো সকালে উঠে পড়েছে। ভাইয়ের ঘর থেকে গানের আওয়াজ এলে চমকে উঠাও হয়েছে। ব্যস্ত পায়ে হেটে ভাইয়ের ঘরের বাইরে দাড়াতেই শুনতে পেলো,

“তবুও দুজন দূরে হারাই
জিতেও দুজন হেরে যাই।”

ধীর আঙ্গুল গুলো গিটারের তারে চালিয়ে টিকলিরও গাওয়া হলো,

“তবুও দুজন দূরে হারাই
জিতেও দুজন হেরে যাই।”

আর্দ্র গিয়ে ভাইয়ের পেছনে দাড়ালো। আদর ভোরের উঁকি দেওয়া সূর্যটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীর কণ্ঠে গাইলো,

‘তবুও দুজন দূরে হারাই…’

শূন্যে দৃষ্টি স্থির রেখে টিকলি গান সমাপ্ত করলো,

‘জিতেও দুজন হেরে যাই….।’

অভিমানের পাল্লা ভীষণ ভারী। তবুও দু’প্রান্ত থেকে নিজেদের খুব অজানায় গোপনে গাওয়া হয়ে গেলো একই গান। কেউ জানলো না। আড়ালেই হয়ে গেলো অভিমানের গান। এই অভিমানের কবলে পরে দেওয়া হচ্ছে না ফোন। করা হচ্ছে না কোনো যোগাযোগ দুদিন ধরে। টায়রা টিকলির পাশের কালো বিনব্যাগে বসলো। টিকলির হাত থেকে গিটারটা নিয়ে টুংটাং সুর তুলে বলল,

‘বাব্বাহ! আদর ভাইয়া তো তোকে গিটার বাজানোও শিখিয়ে দিয়েছে। আই এম ইমপ্রেসড।’

টিকলির কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। সে যেমন একদিকে তাকিয়ে বসেছিলো তেমনই বসে আছে। টায়রা এবার গলা খাকারি দিয়ে গিটারের পানে চোখ রেখে বলল,

‘তোর কি মনে হয়না তোর ইগো বেশি?’

টিকলি ঘুরে তাকালো। ভ্রু কুচকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই টায়রা আবারো সুর তুলল। কিছুক্ষণ পর আবার বলল,

‘দোষটা কি তোর নয়?’

টিকলি আবার তাকালো। ভ্রু কুচকে চোখ দুটো ছোট করে বলল, ‘মানে? সব আমার দোষ?’

টায়রা হাত থেকে গিটার নামিয়ে পাশে রাখলো। টিকলির মুখোমুখি বসে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল,

‘তুই পুরো বিষয়টা অবজারভেশন কর একবার।’

‘যেমন?’

‘যেমন তুই দেখ, সবকিছু কিন্তু তোর জন্যই হয়েছে। ঘটনা ঘাটতে গেলে কিন্তু দেখা যাবে ভুলগুলো তোরই। তুই বিয়ে করতে চাসনি প্রথমে। হ্যাঁ, আমারও দোষ আছে। আমিও চাই নি তুই বিয়ে কর। কিন্তু যাই হোক আদর ভাইয়ার তো দোষ নেই। তুই বলেছিলি, তুই নিজে পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট। ব্যস, বাড়িতে গিয়ে নিজের বাবা মাকে আদর ভাইয়াও সেটাই বলেছে। তাই কি স্বাভাবিক নয়? অপরিচিত কারোর জন্য সে নিজে কেনো বাবা মার কাছে মিথ্যে বলবে? আফটার অল সেও ওই টাইমে বিয়ে করতে চাইনি। এখন, সেদিন রাতে বিষয়টা আমি কাটিয়ে দিতে চাইলাম কিন্তু তুই বলে দিলি আব্বুকে সবটা। এটা তো আগে থেকেই জানা ছিলো যে বাবা মা মানবে না। তাই আদর ভাইয়ের পারমিশন না নিয়ে এতো বড় কথাটা আগেই বলে দেওয়া তোর উচিত হয়নি। তাই আদর ভাইয়া রেগে আছে। তার উপর তুই ফোন দিচ্ছিস না দু’দিন ধরে। সে আরো রেগে আছে। আল্টিমেটলি সব ঘটনার পেছনের মূল কারণ কিন্তু তুই।’

টায়রা চোখ মুখ কুচকে কথাগুলো বলে এক চোখ খুলে বোনের রিয়েকশন দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু টিকলির মুখে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া খুঁজে পাওয়া গেলো না। কপালে কিছু সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে সে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। কিছুক্ষণ পর উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো। টায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রভাতের অপার্থিব মেঘের গর্জন শুনতে শুনতে গিটার হাতে নিয়ে পুনরায় টুংটাং শব্দ তুলল।

,

স্নিগ্ধ বিকেল। টিকলি সাদা জামা পড়লো। গায়ে জড়ালো নীল রঙের উড়না আর পায়জামা। নীল আকাশের মাঝে এক টুকরো সাদা মেঘের ন্যায় ফুটে উঠলো মোমের পুতুলের মতো মুখখানা। কানে নীল রঙা ঝুমকা। হাতে নীল-সাদা চুড়ি। আজ চশমা পড়লো না। কিন্তু টিকলির ক্ষেত্রে চশমা না পরে চলাফেরা করা বিশাল বড় এক যুদ্ধ। তাই চোখে পাওয়ার লেন্স লাগানোটা আবশ্যক। টিকলিকে রেডি হতে দেখে টায়রা ভ্রু কুটি করে বলল,

‘এই বৃষ্টি-বাদলের দিনে একলা যাস কই তুই?’

কোমড় ছাড়ানো ঘন কালো রেশমি চুলগুলোকে ঠিক করতে করতে মুচকি হেসে টিকলি জবাব দিলো,

‘জামাইয়ের কাছে।’

টায়রা চোখ বড় বড় করে তাকালো। টায়রা কিছু বলতে চাইলো টিকলি না শুনেই সাদা পার্স নিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। পেছন থেকে টায়রা চেঁচিয়ে বলল,

‘যাচ্ছো যাও। কিন্তু সাবধান নিচে ভাল্লুক মামা নাহ… মামী এসে বসেছে।’

নিচে যেতেই টিকলি আশ্চর্য হয়ে পড়লো। বসার ঘরে বসে আছে বাবা-মা। আর তার সামনের সোফায় বসে আছে রুহুল হক আকিদা হক আর ছোট্ট রুমকি। জামিলুর রেজা ভ্রু কুচকে টিকলির দিকে তাকালেন। টিকলি স্বাভাবিক হয়ে মামা মামীকে সালাম জানালো। রুমকিকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর করে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এক পা বাড়াতেই আকিদা হক কেমন যেনো উপহাসের গলায় বললেন,

‘কোথাও যাচ্ছো নাকি টিকলি?’

টিকলি আস্তে করে উত্তর দিলো, ‘ওই তো মামী একটু কাজ ছিলো।’

জামিলুর রেজা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কি কাজ পরলো?’

শায়লা আক্তারও বললেন, ‘এই বৃষ্টি কাদার দিনে কি কাজ পরলো শুনি?’

টিকলি কারোর কথার উত্তর খুঁজে পেলো না। বসার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে টায়রা। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে টিকলির পাশে এসে দাঁড়ালো। আকিদা হক ভ্রু কুটি করে ন্যাকা গলায় বললেন,

‘ইশশ…আজই কাজ পরে গেলো? আমরা এসেছি কোথায় একটু গল্প গুজব করবে তা না..’

টায়রা ফট করে বলে ফেলল, ‘গল্প তো সমানে সমানে আই মিন বয়সে বয়সে হয়। আপনার সাথে তো আমাদের বয়স যায় না। যেই বয়সের মেয়ে সেই বয়সের মেয়ের সাথেই তো গল্প করবো মামীজান।’

টায়রা দাঁত কেলিয়ে টেনে টেনে বলল। টিকলি টায়রাকে কনুই দিয়ে গুতা দিলো। শায়লা আক্তার চোখ পাঁকিয়ে তাকিয়ে ছিলেন মেয়ের দিকে। আকিদা হক একটু চুপসে গেলেন তবুও দমলেন না। জামিলুর রেজার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘তা ভাই মেয়ের বিয়ে দিবেন না? দু মেয়েই আপনার বড় হয়েছে। একজনের অন্তত বিয়ে এবার দেওয়া উচিত।’

টায়রা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে আকিদা হকের দিকে তাকিয়ে থাকলো। জামিলুর রেজা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,

‘ছেলে খুঁজছি।’

চায়ে চুমুক দিয়ে ডাইনির মতো হেসে আকিদা হক কুটনির গলায় বলেন, ‘আহা! ওতো খুঁজা খুঁজির কি দরকার? আপনাদের ঘরেই তো পাত্র আছে?’

টায়রা বিরবির করে বলল, ‘এখানে আসছেই কুটনিগিরি করতে বেয়াদ্দব মহিলা।’

শায়লা আক্তার ভ্রু কুচকে বললেন, ‘মানে?’

‘মানে বুঝেন না আপা? আপনার নিজের ভাতিজা থাকতে ওতো দূরে কেনো যেতে হবে?’

আকিদা হক কথাটা বলতেই টিকলি বিস্ফোরণ চোখে তাকালো। শায়লা আক্তারের যেনো কথাটা মনে ধরেছে। টিকলি শক্ত গলায় ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

‘বাবা আমাকে বেরুতে হবে এন্ড ইটস আর্জেন্ট।’

‘বৃষ্টির দিনে বের হতে হবে না। ঘরে যাও।’

আকিদা হক কেমন যেনো চোখে তাকিয়ে ছিলো। মনটা ভরপুর তার কুটনৈতিক চালে। টায়রা বিরবির করে বলল, ‘এই আকিদা, ওইদিকে তাকা। তাকা। তাকা বলতাছি। দাড়া….।’

টায়রা টিকলিকে ফিসফিস করে বলল, ‘এক দৌড়ে গেটের বাইরে চলে যাবি।’

‘হু?’

টিকলি কিছু বুঝে উঠার আগেই টায়রা গগনবিহারী চিৎকার দিয়ে হাত দিয়ে সামনের এক জায়গায় ইশারা করে বলল, ‘আল্লাহ গো! ভাল্লুক….. মামী!’

সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে আকস্মিক এই চিৎকারে ভয় পেয়ে টায়রার হাত যেদিকে তাক করা সেদিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘কই কই? কি? কি?’

আকিদা হক ভয় পেয়ে চমকে দাঁড়িয়েছেন। টায়রার দেখাদেখি সেও চিৎকার করে সেইদিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কিছু দেখতে না পেয়ে ভ্রু কুচকে বিরবির করে বললেন, ‘এক মিনিট। কি বলল? ভাল্লুক মামী?’

এই সুযোগে টিকলি দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। আকিদা হক টায়রার দিকে গরম চোখে তাকাতেই দেখলেন টায়রার পাশে টিকলি নেই। তিনি ভাল্লুক মামী কথাটা ভুলে গিয়ে অবাক কন্ঠে বললেন,

‘টিকলি কই গেলো?’

রুহুল হক ধমকে বললেন, ‘তাতে তোমার কি? এতো বেশি কথা বলছো কেনো? তোমাকে কি এখানে ঘটকালি করতে এনেছি?’

সবার সামনে স্বামীর মুখ থেকে এহেন ধারার কথা শুনে আকিদা হক অপমানিত বোধ করলেন। সোফায় বসে পুনরায় চা খেতে লাগলেন। টায়রা দাঁত বের করে হাসছিলো। বাবা-মার দিকে চোখ পড়তেই দেখলো তারা চোখ পাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে। টায়রা আলগোছে সেখান থেকে এক পা এক পা করে সরে নিজের ঘরে চলে এলো।

চলবে❤️

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

৩৭.
ক্লান্ত দেহখানি চেয়ারে এলিয়ে দিতেই চেম্বারের দরজা ঠেলে হুড়মুড় করে কেউ ডুকলো। গর্জনাধিকারী আকাশটা ধীরে ধীরে কালো রঙা মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। ঘরময় জুড়ে ঠান্ডা বাতাসের বিচরণ। আদর ভ্রু কুচকে অস্বাভাবিক অবাকতা নিয়ে তাকিয়ে থাকার কালেই জামা ঝেড়ে বিরক্ত মুখে টিকলি এসে বসলো চেয়ারে। বাইরে একদম হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। টিকলির বদ্ধ কালো চুলের উপর বিন্দু বিন্দু সাদা উজ্জ্বল পানির আলোড়ন। চুল ঝাড় দিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করে টিকলি অত্যন্ত বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘ওমন হা করে তাকিয়ে রয়েছেন কেনো? এক গ্লাস পানি খাওয়ান। নাকি আপনাদের এখানে পানিও পাওয়া যায়না? থাক, এসব ডাক্তার ফাক্তারের পানিও রোগী রোগী গন্ধ করবে। খাবো না।’

আদর ছোট ছোট চোখে তাকালো। হঠাৎ মনে হলো, চশমা পড়ুয়া টিকলি বেশি সুন্দর। ওই ফোলা রক্তিম ফর্সা গাল দুটোর সাথে কালো চশমায় টিকলিকে মনে হয় অধিক চিন্তাশীল, বিচক্ষণ, মেধাবী, বুদ্ধিসম্পন্ন নারী এবং ভীষণ চতুর। অন্যরকম আলাদা আদুরী টিকলি। আদর নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে তুলে গম্ভীর মুখে বলল,

‘আপমি এখানে কেনো?’

‘উফফ ডাক্তার…সবসময় গম্ভীর মুখে কথা বলবেন না তো।’

আদর নড়েচড়ে বসলো। এরপর বলল, ‘আমরা বাইরে দেখা করতাম…’

আদরের কথা শেষ হওয়ার আগেই টিকলি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,

‘বাইরে দেখা করতাম মানে? আমি এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছি। আপনি কি বাইরে রেস্টুরেন্ট কিংবা পার্কে বসে আমার চিকিৎসা করতেন?’

আদর থতমত খেলো। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই উদ্ধিগ্ন গলায় বলল, ‘চিকিৎসা নিতে এসেছেন মানে? মাথা ব্যথা আবার বেড়েছে নাকি? ঠিকমতো ওষুধ খান না ?’

টিকলি গালে হাত দিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ওসব কিছু না ডাক্তার।’

আদর ভ্রু কুচকে বলে, ‘তবে?’

টিকলি ভিষণ হতাশ কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আমি স্বপ্ন দেখি না বাদর সাহেব।’

আদর ভ্রুর কোণা উঠিয়ে তাকালো। টিকলি আবারো দুঃখে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলে উঠলো,

‘আমি স্বপ্ন দেখি না। রাজপুত্র রাগ করে রাজকন্যার স্বপ্নে ধরা দেয় না।’

আদর চেয়ারে হেলান দিলো। মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চেয়ারটাকে দুলাতে দুলাতে গোপনে বাকাঁ হেসে বলল,

‘স্বপ্ন দেখার জন্য ঘুমাতে হয় মিস টিকলি। আমি আপনাকে ঘুমের ওষুধ লিখে দিচ্ছি। খেয়ে ঘুমাবেন। ভালো ঘুম হবে। আর হ্যা হুড়মুড় করে ঢুকে পরেছেন। নিশ্চয়ই ভিজিট দেননি। এখন ভিজিট সহ ৬০০ টাকা জরিমানা দিবেন আমার টাইম ওয়েস্ট এর জন্য।’

‘ডাক্তারগুলো সত্যি কিপটা হয় সাথে আবেগহীন।’

আদর হাসলো। হাতের কলম নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘তো? আপনার বুঝি খুব আবেগ?’

‘অবশ্যই। তা নাহলে এমনি এমনি এসেছি?’

‘নিজে ভুল করেছেন আবার দুদিন ফোন দেননি। তারউপর আবার বড় বড় কথা?’

‘আপনিও তো ফোন দেননি ডাক্তার।’

টিকলির চোখ টলমল করলো। আদর উঠে এসে টিকলির পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ফ্যাচফ্যাচ করে কাদবেন তো চশমা ভেঙে চোখ উঠিয়ে আনবো।’

টিকলি চোখ কুচকে বলল, ‘আপনি আমার ডক্টর আমি আপনার পেসেন্ট। একজন পেসেন্টের সাথে প্রেমিকার মতো বিহেভিয়ার মানায় না।’

‘সারারাত বাসর করে সকালে উষ্ঠা দিয়ে কয়, এই তুমি কে? এই হচ্ছে আপনার দশা।’

আদর গিয়ে আবার নিজের জায়গায় বসলো। টিকলির গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। ঠোঁট টিপে হেসে দিলো। আদর যে এতোটা বাজে কথা বলতে পারে তা কখনো কল্পনাও করেনি টিকলি। সংকোচ নিয়ে চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘চলুন।’

‘কোথায় যাবো?’

‘দেখছেন না? বাইরে মেঘ করেছে। আজ আমরা বৃষ্টিতে ভিজবো।’

‘আমার কাজ আছে টিকলি।’

‘কোনো কাজ নেই। দুই ঘন্টা ম্যানেজ করাই যায়।’

‘আর আপনি? বাসায় গিয়ে কি বলবেন?’

‘বলে দিবো কিছু একটা।’

‘বৃষ্টিতে ভিজবেন ভালোকথা। যদি ঠান্ডা জ্বর লেগে ঘ্যানঘ্যানানি শুনি তবে আজন্মের বৃষ্টিতে ভেজার স্বাদ মিটিয়ে দিবো।’

‘চলুন তো।’

‘আচ্ছা আপনি ডুকলেন কীভাবে? বাইরে তমাল দাঁড়িয়ে ছিলোনা?’

‘হ্যাঁ তো আপনার এসিস্ট্যান্ট দাঁড়িয়ে ছিলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলেছি আমি আপনার স্যারের হবু বউ। এক্ষুনি ডুকতে দেন তা নাহলে আপনার স্যার আপনার জান ধোলাই করবে।’

আদর ঠোঁট কামড়ে হাসলো। বলল, ‘মারাত্মক পাজি হয়ে গেছেন।’

‘প্রেমের প্রভাব।’

________________________________

দিন গড়িয়েছিলো তিনদিন। নিভা আদরদের বাসায়ই ছিলো একয়দিন। প্রতিদিনের রুটিনমাফিক কাজকর্মের সাথে জুড়ে নেওয়া হয়েছিলো নিয়মমাফিক বিকালে ছাদে যাওয়াও। সারাদিন ঘরে বসে থাকতে থাকতে ত্যক্তবিরক্ত নিভা ছাদে গেলেই চনমনা হয়ে উঠে। ছলচ্ছল কিশোরীর মতোন সারাদিন মন ছুটাছুটি করে কখন ছাদে যাওয়ার সময় আসবে। অকারণে বুকটা আনচান আনচান করে রাহুলের সাথে সময় কাটাতে। আজও ব্যতিক্রম হলো না। সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে দেখলো রাহুল আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছে। নিভা হেসে পেছন থেকেই বলল,

‘বাহ! আজ আগে?’

রাহুল ঘুরে দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে হাসলো। এই কয়েকদিনে নিভার সাথে তার ভালো সখ্যতা হয়েছে। না চাইতেও নিজের মনের অনেক কথাই বলা হয়েছে সাথে এও বুঝেছে এই মেয়েটাকে বিশ্বাস করা যায়। নিজের মনের সব কথা ঢেলে দিয়ে একটু হালকা হওয়া যায়। বয়সের গ্যাপ থাকলেও খুব বন্ধুসুলভ আচরণ ফুটে উঠেছে ওদের মাঝে। বিকেলের অনেকটা সময় ছাদে একসাথে বসে আড্ডা দিতে দিতে খুব গোপনেই ভীষণ পরিচিত হয়ে উঠেছে দুজন। একেক দিন একেকরকম খেজুরে আলাপে মত্ত তারা। হাসিতে মাতোয়ারা দুটি প্রাণ। খোশমেজাজে খোশগল্পে মজে উঠতে না উঠতেই দেখা যায় দু তিন ঘন্টা পার হয়ে গেছে। নিভা কানের পেছনে চুল গুঁজে দিয়ে ছাদের ছোট দেয়ালের উপর চড়ে বসলো। রাহুল একটু আতংকিত গলায় বলল,

‘এই, পড়ে যাবেন। আস্তে।’

নিভা একবার পেছনে দেখে নিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘পড়বো না। আজকে কি টপিক? কি টপিকে গল্প করবো? দুদিনে এতো গল্প করেছি দুজন যে আমার চৌদ্দগুষ্ঠির সব খবর আপনি জানেন।’

রাহুল মাথা দুলিয়ে হাসলো। খানিক বাদেই মুখটা মলিন করে নিভা বলল, ‘কিন্তু আপনার ফ্যামিলি সম্পর্কে তেমন কিছুই বলেন না? শুধু এড়িয়ে যান। এটা কি ঠিক?’

রাহুলের মুখটা গম্ভীর হয়ে এলো। কালো মেঘের কোলে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে গেলো সূর্য। চারিদিকে বৃষ্টি আসার আগামবার্তা। ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগতেই লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। রাহুল নিভার পাশে দূরত্ব বজায় রেখে দেয়ালে চড়ে বসলো। নিজের পরিচয়, আপন পরিবারের কথা ভাবলেই নিজেকে খুব নিষ্প্রয়োজনীয় মনে হয় রাহুলের। পরিবার নামক শক্ত দেয়ালটা যেভাবে আকড়ে ধরে সেভাবে রাহুলকে আঁকড়ে ধরেনি উল্টে সরিয়ে দিয়েছে নিজ স্থান থেকে। মেঘেরডাক শুনতে শুনতে রাহুল আকাশের দিকে ইশারা করে বলল,

‘ওই যে দেখছেন, কালো মেঘ। আমার জীবনটা ওই মেঘের মতোই।’

নিভা আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্রকৃতি দেখে মনে হয়না একটুপর ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামবে? হয়তো আপনার জীবনেও কেউ বর্ষা নামাতে আসবে।’

রাহুল হেসে বলল, ‘আমি যা চাই তা কোনোদিনও পাই না নিভা।’

নিভা কৌতূহল চোখে তাকালো রাহুলের দিকে। রাহুল উপহাসের ন্যায় হেসে মুখ আকাশের দিক তাক করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

‘ছোটবেলা থেকেই ভীষণ মা নেউটা ছিলাম বুঝলেন? আমার জীবনে আমার মাই সব। বাবা ব্যবসার কাজে এদিক ওদিক থাকতেন তেমন কাছে পাইনি। আমার মা ছিলেন প্রচন্ড ভালো মানুষ। তার মতো নীতিবাদী নারী খুব কম রয়েছে। টিকলি অনেকটা আম্মুর মতোন। ভীষণ আবেগি। আবার টায়রাও খানিকটা আম্মুর মতোন প্রতিবাদী। সবকিছু বেশ ভালোই চলছিলো। সুখময় স্বস্তিতে দিন পার করছিলাম। কিন্তু সুখময় সময়গুলো সবসময় সুখের হয়না। আমার সুখের সময়টাতেও দুঃখ ঘনিয়ে এলো। ওই যে বললাম আমি জীবনে যা চাই তা কখনোই পাইনি। ছোটবেলায় চাইতাম বাবা কেনো সময় দেয়না। সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন আমরা একসাথে থাকতাম। সেই দিনগুলো বাবা-মায়ের মাঝখানে শুয়ে ঘুমাতাম নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে করতাম।’

রাহুল ফিচেল হাসলো। নিভা উদ্বেগ নিয়ে বলল, ‘তারপর? তারপর কি হলো?’

‘তারপর? হঠাৎ একদিন শুনি আমার মায়ের ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে। আমি তখন সবে নাইনে উঠেছি। মায়ের একদম লাস্ট স্টেজ। এক দু মাসের মধ্যেই আমি কিছু বুঝে না উঠতেই আমাকে অন্ধকার জগতে ফেলে দিয়ে মা চলে গেলো। আমি সেদিন প্রথম বাবাকে কাদতে দেখলাম। নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো। আমার বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলো মাকে বাচাঁনোর। কিন্তু পারেনি। আল্লাহর হুকুম কি কেউ ফেরাতে পারে? বিশ্বাস করবেন না কিন্তু আমার মায়ের মৃত্যুর চল্লিশ দিন পার না হতেই আমার বাবা গ্রাম থেকে বিয়ে করে নিয়ে আসে আরেক মহিলাকে। আমার পুরো দুনিয়া যেনো থমকে গেলো। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ওই দিনটাই যেনো হয়ে উঠলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভাগা কালোদিন। এরপর থেকেই আমার জীবন হয়ে উঠলো নরকের মতো। হতভাগ্য মানুষ আমি!’

রাহুল বিদ্রুপের মতো হাসি হাসলো নিজের উপর। নিভা অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল, ‘সব শুনে মনে হয়েছিল আপনার বাবা আপনার মাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু চল্লিশ দিন না যেতেই বিয়ে করেছেন। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।’

রাহুল মেকি হাসি দিয়ে বলল, ‘আমিও পারিনি। প্রথম কিছুদিন মহিলার সাথে আমি কোনোরকম কথা বলিনি। কিন্তু দিন গড়াতে গড়াতে একসময় দেখলাম, মহিলাটি বাবার সামনে আমাকে খুব আদর করেন। কিন্তু আড়ালে ভীষণ রকম শাসায়। তার চোখে মুখে ফুটতো হিংসের আগুন। এক বছরের মাথায়ই তাদের আরেকটা মেয়ে হলো রুমকি। আমি তখন ক্লাস টেন। মহিলাটি আমাকে দিয়ে সকল কাজ করাতো। বাচ্চার কাঁথা ধোয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল কাজ। বাচ্চাকে ফিডারে দুধ পর্যন্ত আমি খাইয়ে দিতাম। একটু উনিশ থেকে বিশ হলেই মহিলাটি আমাকে ধরে মারতেন। কেনো মারতেন জানিনা। অকারণেই ভিষণ মারতেন। এরমধ্যে আমার এসএসসি পরীক্ষা ঘনিয়ে এলো। রুমকির তখন প্রায় এক বছর। আমার খুব ভক্ত ছিলো। আমিও ওকে প্রচন্ড আদর করতাম। কিন্তু অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই আলাদা ম্যাচে থাকা শুরু করলাম। তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে ওই বাড়িতে যেতাম রুমকিকে দেখতে। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত খরচ বাবাই চালিয়েছেন। কিন্তু তারপর থেকে কষ্ট করে না খেয়েদেয়ে থাকলেও তার থেকে এক টাকা নেই না আমি। ‘

নিভার ওই বড় বড় পাপড়ি বিশিষ্ট চোখে পানি জমেছে। রাহুল হেসে দিয়ে বলল বলল, ‘আরে আপনি কাদছেন কেনো?’

নিভা জানে না কেনো কাদছে। কিন্তু একটা ছেলের এতো করুন জীবনকাহিনী শুনলে পাথরও কাদবে। নিভা চোখ মুছে বলল, ‘তো এখন কি প্ল্যান? কি করছেন?’

‘জব খুঁজছি।’

‘বিয়ে করবেন না?’

‘দেখি। ভাবিনি এখনো।’

হালকা হেসে কথাগুলো বলে রাহুল ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে খুব ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

‘আমাকে একটু ফুফির বাসায় যেতে হবে। এমনিতেও অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

‘কেনো?’

রুমকি এসেছে। ওকে একটু দেখতে যাবো। মেয়েটা ভাইয়া বলতেই অজ্ঞান।’

______________________________

ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হুট খোলা রিক্সায় ঘোরা হলো ঢাকা শহর। কর্দমাক্ত রাস্তাতে পাশাপাশি হাটাও হলো। ভিজে জুবুথুবু হয়ে একে অপরকে লুকিয়ে ক্যামেরাবন্দী করাও হলো। খোলা আকাশের নিচে ফাঁকা রাস্তায় ইচ্ছেমতোন দু পাশে দু হাত মেলে দিয়ে ভিজা হলো। ঠোঁট মেলে হাসিতে হাসিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো দুই মানব মানবী। তৃপ্তি করে ভিজা হলো প্রাণোচ্ছল কিশোর-কিশোরীর ন্যায়। বৃষ্টিভেজা প্রেমছন্দে মাতোয়ারা শহরজুড়ে ওরা যেনো মুক্ত প্রেমপাখি। আদর টিকলিকে এগিয়ে দিলো। বাড়ির খানিকটা দূরে থেকেই টিকলি রিক্সা থেকে নেমে গেলো। আদর পেছন ডেকে বলল,

‘স্বাদ আহ্লাদ মিটেছে?’

টিকলি ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে দিয়ে বলল, ‘ইশশ ডাক্তার এমন স্বাদ আহ্লাদ প্রতিদিন মিটালেই আপনি হয়ে যাবেন পৃথিবীর সেরা প্রেমিক।’

‘তাই না? ঠান্ডা লাগলে পরে দেখাবো মজা। এবার তাড়াতাড়ি বাসায় যান। গিয়েই আমাকে কল করবেন।’

,

কাক ভেজা হয়ে বাসায় ডুকতেই দেখা গেলো বসার ঘরে সেইভাবেই সবাই বসে আছে সাথে শুধু রাহুল যোগ হয়েছে। রুমকিকে কোলে নিয়ে বসে আছে সে। জামিলুর রেজা ঘাড় ঘুরিয়ে টিকলিকে দেখে বললেন,

‘ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি জামা পাল্টাও।’

শায়লা আক্তার তোয়ালে নিয়ে সেখানেই হাজির হয়ে গেছেন। মেয়ের মাথা মুছে দিয়ে বললেন, ‘জ্বর আসলে হাড্ডি এক জায়গায় করবো মাংস এক জায়গায় করবো।’

টিকলি মাথা নিচু করে চলে যেতে নিলেই আকিদা হক চুড়েল গলায় বললেন, ‘তা এই বৃষ্টির মধ্যে ওতো জরুরি ভাবে বের হওয়ারই কি দরকার ছিলো? আর এতো বৃষ্টিতে ভিজে আসারই বা কি দরকার ছিলো? বৃষ্টি কমলে আসতে পারলে না?’

আকিদা হকের কথা তেমন পাত্তা দিলো না টিকলি। রাহুল ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ‘যা যা। তাড়াতাড়ি ঘরে যা। এমনভাবে ভিজেছিস যেনো মনে হচ্ছে ইচ্ছা করে ভিজেছিস।’

টিকলি ভীত চোখে তাকিয়ে বিরবির করে বলল, ‘তুমি এতো চালাক না হলেও পারতা রাহুল ভাই।’

সকলের কথা শুনে ঘর থেকে নিচে নেমে এসেছে টায়রা। টিকলিকে দেখে বলল, ‘হায়হায় এমন ভাবে ভিজেছিস কেনো? এমনি তোর ঠান্ডার সমস্যা।’

আকিদা হক বললেন, ‘বাইরে গিয়েছিলে বুঝি বৃষ্টিতে ভিজতেই?’

টায়রা মুখ টানা মেরে বলল, ‘এতো সুন্দর জামা পড়ে সাজুগুজু করে কেউ নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে ভিজতে যাবে না? এটা আপনার থেকে ভালো আর কে জানে মামীজান। আমি তো শুনেছি আপনার ওই বয়স্ক স্কিন নষ্ট হয়ে যাবে বলে আপনি রান্নার ঘরে উঁকিও দেন না।’

রাহুল ঠোঁট টিপে হেসে দিলো। আকিদা হক রুহুল হকের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চাপলেন। নিশ্চয়ই এসব রুহুল হকই বলেছেন। তাছাড়া আর কে বলবে? পরমুহূর্তেই আকিদা হক টায়রার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললেন,

‘এই এক মিনিট টায়রা, তুমি কি বললে? বয়স্ক স্কিন? আমার স্কিন বয়স্ক? আপা আপনার মেয়ের কথা শুনেছেন? টিকলির আগে এরই বিয়ে দিতে হবে আপা।’

‘আমার মনে হয় আমার আগে আপনাকে বিয়ে দিতে হবে। যেভাবে বিয়ে বিয়ে করছেন। মনে হচ্ছে, নতুন করে কবুল বলার স্বাদ জেগেছে।’

কথাগুলো বলেই টায়রা দৌড়ে টিকলিকে নিয়ে উপরে চলে গেলো। ঘরের দরজাও আটকিয়ে দিলো।

চলবে❤️