#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
৩৮.
ভেজা জপজপে শরীর নিয়ে আদর আর হাসপাতালে গেলো না। বাসায় গিয়ে গোসল করে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো আর্দ্র বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে ফোনে কারোর সাথে কথা বলছে। আদর ভ্রু কুচকে টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছে বারান্দায় নেড়ে দিলো। ততক্ষণে আর্দ্র ফোন রেখে দিয়েছে। আদর তর্জন গর্জন করে বলল,
‘তোর সমস্যা কি? ফোনে কথাটা পর্যন্ত আমার রুমে এসে বলস। তোর রুম কি ভাইঙ্গে গেছে?’
আর্দ্র হাই তুলে সারা বিছানায় গড়াগড়ি করলো। এরপর খুব আয়েশী ভঙ্গিতে বলল,
‘তোমাকে দেখেই এলাম। যাই হোক দারুন একটা গুড নিউজ আছে জানো।’
তুচ্ছতাচ্ছিল্য রূপে হেসে আদর ভ্রু নাচিয়ে বলল,’কি? নতুন প্রেম?’
আর্দ্র হেসে মাথা ঝাকিয়ে, হাত নাড়িয়ে বলল, ‘আরে এখনো প্রেম হয়নাই ভাইয়া। ফিলিংস আসতাছে না। আই লাভ ইউ কথাটা মুখ দিয়ে বেরই হতে চায় না। তবে মেয়েটা বাকিদের মতোই আমার জন্য পাগলা। বোরিং লাগে আমার। কেউ একটু অন্যরকম হলে কি হয়?’
আদর গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বলল, ‘এটা ষোলো নাম্বার তাই না?’
‘আরে ভাইয়া প্রেম হয়নাই তো এখনো।’
আদর আর কথা বাড়ালো না। চুলগুলো আচড়ে হাতে ঘড়ি পড়তেই আর্দ্র ভাবুক মুখে প্রশ্ন করলো,
‘আচ্ছা ভাইয়া? এমন কোনো কথা আছে যা তুমি এখনো টিকলিকে বলতে পারোনি।’
‘হুম আছে তো। দুটো না বলা কথা রয়ে গেছে।’
আর্দ্র কৌতূহল স্বরে বলল, ‘তাই? কি কি?’
গায়ে পারফিউম লাগাতে লাগাতে আদর বলল, ‘সরি আর ভালোবাসি বলা হয়নি।’
আর্দ্র কিছুক্ষণ বড় বড় করে চোখ মেলে চেয়ে থেকে বলল, ‘কি বলো? এখনো সেই সরি বলোনি? ভালোবাসিও বলো নি?’
‘যে কথা চেষ্টা করেও বলা হয়ে উঠে না তা আর বলার কি দরকার? থাকুক আড়ালে গোপনে। সরিটা খুব করে বলতে চেয়েও বলতে পারিনি। তাই এখন আর চেষ্টা করিনা।’
‘আর ভালোবাসা?’
‘যে কথা মুখে না বলেও কাজকর্মে অনুভূতিতে ব্যক্ত হয়ে অপরিসীম প্রেম জোগায় সে কথা না বলাই উত্তম।’
,
রাত নয়টা। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হলো এই কেবলই। আকিদা হক রুহুল হক আজ এ বাড়িতে থাকবেন। রাহুল খাওয়া দাওয়ার পাট চুকানো মাত্র চলে গিয়েছে। রুমকি বসে ছিলো টিকলি টায়রার মাঝে। টিকলির সামনে বসে আছে জামিলুর রেজা আর শায়লা আক্তার। মাথা নিচু করে টিকলি বসে ছিলো। ক্রমাগত হাত মোচড়াতে মোচড়াতে হাত এখন ব্যথা ধরে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে আকাশ গর্জন করছে। বড় বড় বজ্রপাতের ঝলকানিতে মাঝে মাঝেই প্রকৃতি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠছে। শায়লা আক্তার রুমকির দিকে ঘুরে বললেন,
‘আম্মু, তুমি তোমার আব্বু আম্মুর কাছে যাবে একটু?’
রুমকি নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। টিকলি এবার নড়েচড়ে বসলো। জামিলুর রেজা গম্ভীর গলায় বললেন,
‘বিকালে কোথায় গিয়েছিলে?’
মিনমিন করে টিকলি বলল, ‘একটু কাজ ছিলো বাবা।’
‘কিসের কাজ?’
এই প্রশ্নের পরিপেক্ষিতে টিকলি উত্তর খুঁজে পেলো না। ব্যস্ত চোখে এদিক ওদিক তাকাতেই শায়লা আক্তার নিচু গলায় হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,
‘কার সাথে বৃষ্টিতে ভিজে এসেছিলি?’
টিকলি চোখ মুখ খিচে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলো। টায়রা আড়চোখে তাকিয়ে আস্তে করে বলল,
‘আম্মু একটু আস্তে করে কথা বলো। তোমার বাঘিনী ভাইয়ের বউ শুনে ফেললে তো আবার শুরু হয়ে যাবে।’
জামিলুর রেজা চোখ পাকিয়ে টায়রার দিকে তাকাতেই টায়রা মুখে আঙ্গুল দিলো। টিকলির কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে জামিলুর রেজা কড়া আদেশে বললেন,
‘আজ থেকে তোমার বাইরে যাওয়া বন্ধ৷ ভারসিটি যাওয়ার প্রয়োজন হলে আমি নিয়ে যাবো নিয়ে আসবো। আমি না পারলে তোমার মা। তোমার মা না পারলে রাহুল যাবে।’
জামিলুর রেজা থমথম পায়ে হেটে চলে গেলেন। টিকলি মাথা তুলে বাবার যাওয়ার পানে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলো। চোখের কোণায় বিন্দু বিন্দু পানি জমতেই শায়লা আক্তার অবাক গলায় বললেন,
‘একটা ছেলের জন্য তুই…’
কথা শেষ করার আগেই টিকলি মাথা তুলে তাকালো। অত্যন্ত আহত গলায় বলল,
‘তুমি বদলে গেলে কেনো মা? তুমি তো এমন ছিলে না। ছোটোবেলায় আমি দুষ্টুমি করলে বলতে আমি নাকি তোমার মেয়ে না। তোমার মেয়ে এতো দুষ্ট হতেই পারে না। হাসপাতালে নিশ্চয়ই অদলবদল হয়ে গেছে। তবে এখন আমার কেনো মনে হচ্ছে? হাসপাতালে আমার মা অদলবদল হয়ে গেছে?’
শায়লা আক্তার নরম মনের মানুষ। অত্যন্ত দুঃখী হয়ে সে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। চোখের কোণায় উপচানো জল গুলোকে ধরে রেখেই ভাঙা গলায় বললেন,
‘আমার মেয়ের নামে এতো বড় অপবাদ যারা দিয়েছিলো সেই পরিবারে আমি কিছুতেই মেয়ে বিয়ে দিবো না। ওই পরিবারে তুই কখনো ভালো থাকবি না। সামান্য কিছু হলেই তারা ‘পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট’ এই ভুয়া কথার মতোই তোকে কথা শুনাবে। ওই পরিবার ভালো নয়। তুই তো জানিস না তারা ফোন দিয়ে সেদিন কতো বাজে কথা বলেছিলো। পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট কি কেউ হয়? তবুও তারা এতো বাজে কথা কীভাবে বলতে পারে? হ্যাঁ রে ওই ছেলের সাথে তো তোর সব ভেঙেই গিয়েছিলো আবার জোড়া লাগলি কি করে তোরা?’
শায়লা আক্তার নিজ মনে কথা গুলো বলে চলে যেতেই নিস্তব্ধ টিকলি জানালা গলিয়ে দৃষ্টি বাইরে রাখলো। মনের কোঠায় তেজি মেঘগুলো গর্জন করতে করতে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়লো। টিকলি কাদতে পারছে না। এদিকে তার বুক ছিড়ে যাচ্ছে। গলায় অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে শরীর কেঁপে উঠছে। নিঃশ্বাস চলছে না। মুখটাকে কিঞ্চিৎ হা করে নিঃশ্বাস ফেলতে হচ্ছে। একটুপরেই বাইরে তুমুল আষাঢ়ে বর্ষন শুরু হলো। বৃষ্টির ছাচে টিকলির গলার অংশ ভিজে উঠলো। টায়রা হাত বাড়িয়ে জানালা আটকে টিকলিকে কাছে টানলো। টায়রাকে জড়িয়ে ধরেই অনুভূতি শূন্য কৌঠার ঘরে পৌছিয়ে টিকলি বলল,
‘আমার বাইরে যাওয়া বন্ধ। আমার কি আর কক্ষনো উনার সাথে দেখা হবে না? বাবা-মা কি মানবে না কোনোদিনও? আমি এ কথাগুলো তাকে বললে সে কিভাবে রিয়েক্ট করবে টায়রা?’
টায়রা উত্তর খুঁজে পেলো না। টিকলির মাথা হাত বুলিয়ে বড়দের মতো করে বলল,
‘দুই তিনদিন থেকে ঘুমোস না। তুই একটু ঘুমা তো। আমি দেখছি ব্যাপারটা।’
,
রাত তখন দশটা। ঘড়ির কাটা ছুটছে যেনো তুমুল গতিতে। চিন্তায় ক্লান্ত হয়ে আসছে শরীর। বৃষ্টি শীতল পরিবেশেও জড়ে পড়ছে ঘাম। টিকলি ঘুমিয়ে গেছে। টায়রার ফোনে আদরের নাম্বার নেই। টিকলির ফোন থেকে ফোন করা হলে ওপাশে বেজে বেজে কেটে গেলো কিন্তু ধরা হলো না। টায়রা যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বারান্দার দোলনায় বসলো। একটু পর আবার ফোন দিতেই ওপাশ থেকে ফোন ধরা হলো। টায়রা হ্যালো বলতেই অবাকতার সুরে কেউ উচ্চকণ্ঠে বলল,
‘আপনি কেনো?’
টায়রার ভ্রু দুটো কুচকে এলো। ফোন সামনে এনে নাম্বারটা চেক করেই ক্রোধান্ধ হয়ে বলল,
‘অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে আর কয়দিন ফুটাবেন?’
আর্দ্র অবাক হলো। কাবার্ডের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘যদি নিশানা ঠিক থাকে তাহলে গুলি ছুড়তে ক্ষতি কি?’
আর্দ্র সন্দিহান গলায় আবার বলল, ‘কি ব্যাপার বলুন তো? যেদিন আমি ফোন ধরি সেদিন আপনিও ফোন করেন। ব্যাপারটা কি কাকতালীয় নাকি ইচ্ছাকৃত?’
টায়রা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘সেটা তো আর আমি জানি না। আমি তো আর আপনার নাম্বারে ফোন দেইনি। উলটে আপনি এসে ফোন ধরেছেন। সুতরাং বলা যায়, ব্যাপারটা আপনার দিক থেকে ইচ্ছাকৃত।’
‘ঝগড়া করার তাল তুলবেন না একদম।’
টায়রা চেচিঁয়ে বলল,
‘এই, আপনার সাথে ঝগড়া করতে আমার বয়ে গেছে বুঝছেন? ফোন আপনি কেনো ধরছেন? আপনাকে ফোন দিছি?’
‘ভাইয়া মাত্র হাসপাতাল থেকে আসলো। ফ্রেশ হতে গেছে। ফোন বাজার শব্দ পেয়ে আমি এসেছি পরে দেখি…। এই ওয়েট, আপনাকে এতো কৈফিয়ত কেনো দিবো? আপনি নিজেই তো নিজের বোনের ফোন থেকে ফোন করেছেন।’
‘আমার কাছে ভাইয়ার নাম্বার ছিলো না।’
‘তো? তাই বোনের ফোন চুরি করে ফোন দিতে হবে?’
‘আপনি যে আপনার ভাইয়ের ফোন চুরি করে ধরছেন তার বেলায়?’
‘আপনার সাথে ঝগড়া করার মুড নাই আমার। টিকলি কোথায়?’
‘ঘুমোচ্ছে।’
‘এতো তাড়াতাড়ি?’
‘শুনেন আপনার সাথে খেজুরে আলাপ পারার জন্য আমি ফোন দেই নাই। তাড়াতাড়ি ভাইয়াকে ডেকে ফোন দেন।’
আর্দ্র রাগে ফুসতে ফুসতে বলল, ‘ডাইনি।’
‘আপনি ডায়েন। এবার ভাইয়াকে দেন।’
আর্দ্র ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও ফিরে এলো। ভ্রু কুচকে বলল, ‘ব্যপার কি? আমার ভাইয়ের জন্য এতো উতলা কেনো? বোনের জামাইয়ের দিকে নজর দেন? আস্তাগফিরুল্লাহ! ছি ছি! নজর হেফাজতে রাখুন। ‘
টায়রা খুব অসহায় হয়ে পড়লো, ‘দেখুন ভাদ্র সাহেব। প্লিজ..ইটস ইমার্জেন্সি। দিন।’
তখনি ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। আর্দ্র কথা না বাড়িয়ে আদরের হাত ফোন ধরিয়ে দিতেই আদর ভ্রু কুচকে বলল,
‘কে? আর তুই আমার ফোন ধরস কেন?’
আর্দ্র উত্তর না দিয়ে চলে গেলো। ফোনের স্কিনে নাম্বার দেখে নিয়ে আদর বলল,
‘হ্যাঁ টিকলি বলুন। কি করছেন?’
‘ভাইয়া আমি টায়রা।’
আদর কাধে ফোন রেখে মাথা দিয়ে চেপে কথা বলছিলো। টায়রার নাম শুনে ভ্রু কুচকে ফোন হাতে নিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
‘টায়রা? কেমন আছো? কিছু হয়েছে? টিকলি কোথায়?’
‘ঘুমোচ্ছে।’
আদর আবার ভ্রু কুচকে বলল, ‘ঘুমোচ্ছে? এতো তাড়াতাড়ি?’
‘হুম। ভাইয়া শুনুন।’
‘জি বলো।’
লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে টায়রা কথা শুরু করলো। সম্পূর্ণ কথা বলা শেষ হতেই আদর হতাশ শ্বাস ফেলে বলে উঠলো,
‘উনাকে কান্নাকাটি করতে বারণ করো। আর একটু ডেকে দাও।’
টায়রা টিকলিকে ঘুম থেকে উঠালো। টিকলি ক্লান্ত আধখোলা চোখে তাকাতেই টায়রা হাতে ফোন ধরিয়ে দিলো। ফোন কানে নিয়ে টিকলি বলল,
‘বলুন।’
‘এক দুইদিনের কাপড় নিয়ে ব্যাগ গুছান। আর রেডি হয়ে মোড়ে আসেন। আমি আসছি। টায়রাকেও রেডি থাকতে বলেন।’
টিকলি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। চোখের ঘুম উবে গেলো। ফোন সামনে এনে নাম্বারটা চেক করে নিয়ে বলল,
‘বেশি কাজের প্রেসারে বোধহয় পাগল হয়ে গেছেন ডাক্তার। আমি এখন কীভাবে বের হবো? বাবা মা বোধ হয় ঘুমিয়ে গেছেন। আর আমার বাইরে বের হওয়া বন্ধ। তারউপর বাসায় মামা মামী আছে।’
‘লুকিয়ে আসুন। দেড় ঘণ্টার ভেতরেই আমি এসে পরবো। পারবেন না আসতে? না পারলেও আসতে হবে।’
নিজ মতে কথাগুলো বলেই ফোন কাটা হলো। টায়রা টিকলির ফোনের সাথে কান পেতে ছিলো। আদরের কথা শুনে সে নাচতে নাচতে ব্যাগ গুছিয়ে বলল,
‘আই এম সিউর, আদর ভাইয়া আমাদের নিয়ে কোনো ট্যুরে যাবে। উফফ….বন্ধ দুনিয়া থেকে একটু শান্তিু পাবো। নে নে তাড়াতাড়ি রেডি হ। চুপিচুপি বাসা থেকে বের করার দায়িত্ব আমার।’
,
আদর গিয়ে আর্দ্রকে ডেকে নিয়ে আসলো। এরপর খুব নিচু গলায় বলল, ‘রেডি হ।’
আর্দ্রও ফিসফিস করে বলল, ‘কেনো ভাইয়া?’
আর্দ্রের মাথায় একটা চাটি মেরে আদর ধমকে বলল, ‘এতো প্রশ্ন করিস কেনো? যা রেডি হ। বাবা মা যাতে না জানে। শুধু নিভাকে জানিয়ে যাবি। নিভা কোথায়?’
‘ছাদে।’
‘ও দিন রাত ছাদে কি করে?’
‘একটু আগেই বৃষ্টি থামলো না? তাই ভেজা পরিবেশ দেখতে গেছে।’ আর্দ্র দাঁত বের করে বলল। আদর কটমট করে বলল,
‘তাড়াতাড়ি বলে তাড়াতাড়ি রেডি হ যা। টিকলিকে পিক করতে যেতে হবে।’
______________________________
তুমুল বৃষ্টি থেমেছে একটু আগেই। ভেজা ছাদ। পুরো ছাদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে উড়ন্ত শিমুল তুলোগুলো ভেজা ভারী হয়ে নেতিয়ে আছে। নিভা খালি পায়ে হেটে বেড়াচ্ছে। ছাদের একপাশে হরেক রকমের ফলের গাছ। আরেকপাশে ফুলের গাছ। প্রতিটা গাছের পাতায় পাতায় পানি। ভেজা পাতায় ছুয়ে দিতেই টুপ টুপ করে পানি বর্ষিত হচ্ছে। নিভা খিলখিল করে হাসলো। মধ্যরাতে খোলা চুলে খালি পায়ে এক রমণী ভেজা ছাদ চষে বেড়াচ্ছে। ছাদের এক পাশে টিমটিম করে জ্বলছে হলুদ বাতি। হরেক ফুলের গন্ধে ম ম চারিপাশ। এক কোণায় হাসনাহেনা গাছ ফুল ঝড়িয়ে সাদা গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। নিভা সেদিকে যেতেই খেয়াল করলো উল্টো ঘুরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মুখের সামনে জ্বলছে নিভু নিভু লাল বাতি। আকস্মিক নিভা ভয় পেলেও পরক্ষণেই সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালো। সন্দিহান চোখে গলা উঁচু করে বলল,
‘কে ওখানে?’
রাহুল ফিরে তাকালো। নিভাকে দেখেই চমকে উঠে হাতের সিগারেট টা দূরে ফেলে দিলো। ফেলে দিতেই মনে হলো ভুল করে ফেলল। সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলার দরকার ছিলো। নিভা এক পা এগিয়ে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালালো। সাদা আলোতে রাহুলকে আবিষ্কার করতেই খুব অবাক হয়ে বলল,
‘আরে আপনি?’
রাহুল স্মিত হেসে বলল, ‘আমিও আপনাকে দেখে অবাক হয়েছি। আমি তো প্রতিদিন এসময় ছাদে আসি।’
নিভা ভ্রু কুচকে বলল, ‘সিগারেট খেতে?’
রাহুল মাথা চুলকিয়ে আবার হেসে দিয়ে বলল, ‘আপনি এসময়ে?’
নিভা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে বলল, ‘বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগের দৃশ্য আর শেষ হওয়ার পরের দৃশ্য কিন্তু চমৎকার।’
‘তা ঠিক। তাই বুঝি এসময় ছাদে এসেছেন?’
নিভা মাথা নাড়ালো। এরপর কিছুক্ষণ আর কোনো কথা হলো না। নিভা উদাস চোখে আকাশের দিক তাকিয়ে থাকলো ক্ষণকাল। হঠাৎ আকস্মিক কিংবা দৈবাৎ বলা যায় কিন্তু নিভা প্রশ্ন করলো,
‘আপনি কাউকে ভালোবাসেন না?’
রাহুল থতমত খেলো। শুকনো কাশিও কাশা হলো। তবুও মুখে সত্য হাসি ফুটিয়ে অত্যন্ত নরম কণ্ঠে বলল, ‘বাসি তো।’
নিভা আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে রাহুলের দিকে চোখ নামিয়ে আনলো। খুব কৌতুহল কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘কাকে?’
মাথা ঝাকিয়ে রাহুল উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে কৌতুক স্বরে প্রশ্ন করলো, ‘বলবো?’
নিচু স্বরে নিভা বলল, ‘হুম।’
‘সত্যি বলবো?’
‘হুম বলুন।’
‘কাউকে বলে দিবেন না তো?’
নিভার বুক ঢিপঢিপ করে উঠলো। মাত্রাতিরিক্ত বুক কাঁপানো নিয়ে বলে উঠলো, ‘নাহ। এ জীবন থাকতে কক্ষনো কাউকে বলবো না।’
‘কথা দিলেন?’
‘হুম। এবার বলুন।’
দূরের ওই মেঘে ভাসানো চাঁদ-তাঁরাবিহীন কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে রাহুল হাসিহাসি মুখ করে বলল, ‘টিকলিকে।’
প্রায় সাথেসাথে আশেপাশে যেনো বজ্রপাতের মেলা বসলো। মনে হলো এই তিন তলা শক্তপোক্ত বাড়িটা এক নিমিষেই দুমড়ে মুচড়ে গেলো। নিভা স্তব্ধ হয়ে শুনলো। কানে যেনো বারংবার বাজলো শব্দটা। মাথায় বলের মতো ঢপ খেতে লাগলেই নিভা দিশেহারা হয়ে গেলো। বোধ হলো, আশেপাশে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে সব। ধ্বংস হচ্ছে। চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে। দগ্ধ হচ্ছে। সে সাথে কথা ফুরিয়ে যাচ্ছে নিভার। শরীর ক্রমেই অসাড় হয়ে আসছে। ভর ছেড়ে দিচ্ছে। রাহুল মুচকি হেসে তখনি আবার বলল,
‘অনেক ছোটোবেলা থেকেই ওকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু কখনো বলা হয়নি। আপনি যেনো আবার ওকে বলে দিবেন না।’
নিভা স্থির নিশ্চল চোখে তাকিয়ে ছিলো। নিষ্প্রাণ দুটি চোখ বন্ধ করে আবার মেলে ধরতেই চোখের কোণায় অজান্তেই চিকচিক করে জানান দিয়ে উঠলো অশ্রুকণা। মনেতে বারংবার বেজে উঠলো প্রশ্নের দল, ‘টিকলি? কীভাবে? কীভাবে সম্ভব? টিকলি কেনো?’ তখনি ছাদে এসে দাড়ালো আর্দ্র। রাহুলকে দেখে হাসিমুখে কথা বলে নিভাকে টেনে আড়ালে নিয়ে এলো।
‘এতো রাতে কি করস এখানে? যা ঘরে যা। আর শোন, আমরা এক দুই দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। টিকলিও যাবে। বুঝলি? বাসার কেউ কিন্তু জানে না তুই কাউকে বলবি না। শুধু বলবি তুই এ ব্যপারে কিচ্ছু জানিস না।’
নিভা রোবটের মতো আর্দ্রের সব কথা শুনলো। কিন্তু উত্তর দেওয়ার জন্য গলা থেকে শব্দ বের করতে পারলো না। হঠাৎ করেই নিজ হাতে সাজানো গোছানো দুনিয়াটা কেমন এলোমেলো হয়ে যেতে লাগলো। একদিকে টিকলির প্রতি রাহুলের বছরের পর বছর একতরফা গভীর ভালোবাসা অন্যদিকে আদর টিকলির মরণপ্রাণ ভালোবাসা, প্রেম। তারউপর তারা যাচ্ছে ঘুরতে। রাহুল আছে কষ্টে। দুই পরিবারে বিবাদ। আর্দ্র টায়রার ঝগড়া। এই এতোকিছুর মধ্যে নিভার অস্তিত্বটা ঠিক কোথায়! সবকিছুর মাঝে যেনো নিভা শুধুই সাক্ষীপক্ষ। সবার জীবনের আড়ালের গোপনের খবরের সাক্ষী হয়ে রইল। কিসের টানে এতোদিন ছুটলো সে? কিসের পেছনে ছুটলো? তার জীবনটা কি শুধুই মরিচীকা?
চলবে❤️
#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
৩৯.
নিশুতি রাতে নেই কোনো কোলাহল। রাস্তায় নেই কোনো যানবাহন। দূর দূরান্তেও নেই মানুষের পদচ্ছাপ। নেই অযথা মানুষের গিজগিজ। দম আটকানো ফাঁকা চারিপাশে। সোডিয়ামের টিমটিমে এক প্রকার আলোয় মুখচ্ছবি অস্পষ্ট। রাত তখন বাজে বারোটা। গলির মুখের মোড়ে দাড়াতেই দেখতে পেলো আদর আর্দ্র গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যস্ত পায়ে ঢিপঢিপ বুকে এগিয়ে যেতেই আদর বিরক্ত মুখে বলল,
‘আধ ঘন্টা লেট।’
টিকলি মাথার স্কাপ টাকে আরেকটু টেনে নিলো। মুখের মাস্ক ঠিক করে এদিক ওদিক চঞ্চল চোখে তাকিয়ে বলল, ‘গাড়িতে উঠুন। এখানে থাকা সেফ না। কে কোথা থেকে দেখে ফেলে।’
আদর ভাবলেশহীন ভাবে ক্লান্ত হয়ে গাড়ির সাথে শরীর এলিয়ে দিয়ে টিকলির সারা মুখে চোখ বুলালো। সেই প্রথমদিনের মতো মুখে মাস্ক চোখে লেন্স মাথায় স্কাপ কাধে ঝুলানো ব্যাগ। একদম সেই প্রথম দিনের টিকলি। আদর হঠাৎ বলল,
‘মিস. পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মহিলা আপনার বেবির এখন কত মাস চলে? আমার হিসেব নেই।’
টিকলি বড় বড় চোখ করে আদরের দিকে তাকিয়ে নিজের পেটের উপর হাত রাখলো। একবার পেটের দিকে তাকিয়ে আরেকবার আদরের দিকে তাকালো। আদরের বাহুতে একটা শক্ত থাপ্পড় মেরে বলল,
‘ফাইযলামি করেন?’
আদর বোকা বোকা চেহারায় বলল, ‘ফাইযলামি করলাম? আরে আপনি তো বলেছিলেন আপনার বয়ফ্রেন্ড এক মাস আগে আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে আর আপনি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট।’
আদর হেসে দিয়ে আবার বলল, ‘সিরিয়াসলি মানুষ কতটা বোকা গাধা হলে এই কথা বলতে পারে।’
‘বাদর সাহেব, খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।’
আদর ঠোঁট কামড়ে হাসলো। টিকলি ফুসে উঠে বলল, ‘আপনি যান। আমি আপনার সাথে কোত্থাও যাবো না। অসভ্য লোক একটা।’
আদর আবার হাসলো মাথা নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আর্দ্রর চিৎকার শোনা গেলো, ‘ভাইয়া….’
আদর চমকে উঠলো। আকস্মিক চিৎকারে টিকলি আদরের হাত খামচে ধরলো। দাঁত কিড়িমিড়ি করে আদর বলল, ‘ঠাটিয়ে দিবো এক চড়।’
আর্দ্রর কোনো হেলদোল হলো না। ও টায়রার দিক তাক করে আঙ্গুল তুলে বলল, ‘এই শাকচুন্নিও আমাদের সাথে যাবে? তুমি তো বলোনি।’
টায়রা গরম চোখে তাকালো। তেজি গলায় বলল, ‘কে শাকচুন্নি? আপনার বউ শাকচুন্নি। ফালতু লোক একটা।’
আদর বিরক্ত হয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, ‘সারাটাদিন শুধু ঝগড়া ঝগড়া ঝগড়া। তুই ভাবলি কি করে তোকে আনলে টায়রাকে আনবো না?’
আর্দ্র কাদো কাদো চোখে তাকিয়ে বলল, ‘বিয়ে না করতেই পর হয়ে যাচ্ছো? ভাইয়ের থেকে শালী আপন?’
আদর ধমকে বলল, ‘ তুই উঠবি?’
আর্দ্র সামনের সিটে বসতে গেলে আদর আবারো খেকিয়ে উঠলো, ‘এখানে বসছিস কেনো? এখানে টিকলি বসবে।’
‘তো আমি কোথায় বসবো?’
‘পেছনে যা।’
তৎক্ষণাৎ টায়রা আন্দোলনের স্বরে বলে উঠলো, ‘ইম্পসিবল। আমি মরে গেলেও এই মদনের সাথে বসবো না।’
আর্দ্র গলা উঁচিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই টিকলি সামনের সিটে বসে পরলো। রেগে বলল, ‘এই গাড়ি স্টার্ট দেন তো। দুটোকেই রেখে যাই।’
টায়রা ফুস ফুস করতে করতে পেছনের সিটে বসে বলল, ‘তোরে আমি আর কোনোদিন হেল্প করমু না। বোন নামের কলংক তুই।’
টিকলি টায়রার কথা পাত্তা না দিয়ে আর্দ্রকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাইয়া, বাসায় কি কাউকে বলে আসছেন?’
‘হুম নিভাকে বলছি।’
‘ওকে নিয়ে আসলেই তো পারতেন।’
আদর উত্তর দিলো, ‘এখানে সবাই কাপল কাপল ঘুরবে। মাঝখানে ও একা এসে কি করবে?’
অনতিবিলম্বে তক্ষুণি আর্দ্র টায়রা ক্ষিপ্ততা সহকারে সমস্বরে বলল, ‘কিসের কাপল? শুধু তোমরা দুজন কাপল।’
টায়রা আর্দ্রের দিকে তাকিয়ে নাক ছিটকে বলল, ‘এই ডেমরা হবে আমার কাপল? ছি!’
টায়রার রিয়েকশন দেখে আর্দ্র থতমত খেয়ে বলল, ‘এই ঢেড়ি হবে আমার কাপল? থু!’
‘অসহ্য, আমি।’
‘অতিষ্ট, আমি।’
টিকলি কানে হাত রেখে আদরকে বলল, ‘গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে দুটোকে ফেলে দিন তো।’
______________________________
সকাল সকাল মনোয়ারা খান বিরবির করতে করতে গেলেন আদরের ঘরে। ছেলের তো এবার বিয়ে করা ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কতদিন এভাবে বসে থাকবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কি ভালো মেয়ে পাবে? এদিকে আজিম খান প্রত্যেক দিন এ বিষয় নিয়ে তার সাথে রাগারাগি করে। মনোয়ারা খানের শরীর জ্বলে যায়। সে বুঝে না, ছেলের বিয়ে নিয়ে বাপের এতো তড়জড় কিসের?
আদরের ঘরে গিয়ে আদরকে না পেয়ে মনোয়ারা খান ভাবলেন হয়তো ছেলে তার হাসপাতালে চলে গেছে। তবুও বড় ছেলের খোঁজে ছোট ছেলের ঘরে গেলেন। গিয়ে দেখলেন ছোট ছেলেও ঘরে নেই। মনোয়ারা খানের ভ্রু জোড়া স্বাভাবিক ভাবে কুচকে গেলো। এতো সকালে দু ভাই ঘরে নেই। ব্যাপারটা তো সহজ কথা নয়। ভিষণ রকম শরীর কাঁপা নিয়ে তিনি ঘর ছাড়লেন। মা মনটা অকারণেই ভাবতে বসলো, ‘দু ভাই মিলে কি আবার গণ্ডগোল পাকালো? হায় খোদা! এবার যদি কিছু হয় আমি ওর বাপকে সামাল দিবো কীভাবে?’
মনোয়ারা খান নিভার ঘরে গেলো। নিভার কাচা ঘুম ভাঙিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা, আদর আর্দ্র কোথায় জানিস?’
নিভার ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে বলে ফেলল, ‘ঘুরতে গেছে।’
মনোয়ারা খানের কপাল কুচকে গেলো। ঘুরতে গেছে তার মানে কি দুটো মিলে আবার পালালো? ঘুরতে গেলো তো বলে যেতো। কিন্তু পালিয়ে যাবার মতো তো এবার কিছু হয়নি। মনোয়ারা খান কপাল কুচকে প্রশ্ন করলেন, ‘কোথায় গেছে?’
নিভা বলতে যাবে তার আগেই মস্তিষ্কে ঢপ খেলো। ঘুম ছুটে পালালো। বিরাট বড় যে একটা ঝামেলা পাকিয়ে ফেলল তা বুঝে আসতেই ঢোক গিলল। ব্যস্ত কণ্ঠে তোতলানো স্বরে বলল, ‘আমি জানি না। জানি না তো ওরা কোথায়। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছিলাম তো তাই উল্টো পালটা বলে ফেলছি।’
মনোয়ারা খান জহুরি নজরে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ এরপর আর কোনো কথা বললেন না। কপালে চিন্তিত কয়েকটি ভাঁজ ফেলে উঠে চলে গেলেন। নিভা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জানালা গলিয়ে বাইরে তাকাতেই মনের মেঘগুলো হঠাৎ ডুকরে উঠলো। কাল সারারাত ঘুমানো হয়নি। ফজরের নামাজ পড়ে একবারে ঘুমোতে গেছে। এখন হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠার ফলস্বরূপে মাথায় এক ধরনের চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। নিভা আবার শুয়ে পড়লো।
,
শায়লা আক্তার হাত খোপা করতে করতে মেয়েদের ঘরের দরজার সামনে গেলেন। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই বেশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। পুরো রুমে চোখ বুলিয়েও কোথাও মেয়েদের অস্তিত্ব পাওয়া গেলো না। তার শরীর ধরধর করে ঘামা শুরু করলো। হাত দিয়ে মুখ হাপড়ে মুছলেন। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও মেয়েদের পেলেন না। নিজ ঘরে গিয়ে তিনি স্বামীকে খবর লাগালেন। জামিলুর রেজা ব্যস্ত পায়ে মেয়েদের ঘরে গেলেন। ঘরে মেয়েদের না পেয়ে বললেন,
‘সারা বাড়ি খুঁজেছো?’
শায়লা আক্তার মুখে আচঁল দিয়ে কেদে উঠলেন। মাথা ঝাকিয়ে বললেন, ‘হুম’
জামিলুর রেজা চতুর চোখে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেলেন আলমারি কিঞ্চিৎ খোলা। আলমারির
হাতল ধরে টেনে পুরোপুরি খুলতেই দেখলেন মেয়েদের ব্যাগ নেই। সাথে বেশকিছু জামাকাপড়ও নেই। জামিলুর রেজা চোখ পাকিয়ে শায়লা আক্তারকে দেখে দাঁত কিড়িমিড়ি করে বললেন,
‘কেমন মা তুমি? মেয়েদের খেয়াল রাখতে পারো না? দু’বার মেয়েরা পালিয়ে গেলো।’
গম্ভীর লাল মুখে চটপট পায়ে ঘর ছাড়লেন জামিলুর রেজা। নিচে গিয়ে বিষন্ন মুখে সকালের নাস্তা তৈরি করলেন শায়লা আক্তার। একটু পর জমকালো শাড়ি পড়ে নিচে নেমে এলেন আকিদা হক। মাথায় ভেজা তোয়ালে বাধা। শায়লা আক্তার একবার দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। আকিদা হক টেবিলে বসতে বসতে বললেন,
‘টিকলি টায়রা ঘুম থেকে উঠে নি আপা?’
শায়লা আক্তার জবাব দিলেন না। আকিদা হক ভ্রু কুচকে তাকাতেই শায়লা আক্তার নড়েচড়ে উঠলেন। এই মহিলা তিল কে তালের রস বানিয়ে ছাড়ে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
‘ওই তো….ঘুরতে গেছে ওরা। বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে গেছে।’
‘কখন গেলো? এই এতো সকালে ঘুরতে গেলো? কোথায় গেছে আপা?’
শায়লা আক্তার বিরক্ত হলেন। এতো প্রশ্নের কি দরকার? গমগমে মুখে শায়লা আক্তার উত্তর দিলেন,
‘এইতো আশেপাশেই গেছে।’
নিচে নেমে এলেন রুহুল হক। টেবিলের কাছাকাছি আসতেই স্ত্রীর বেশভূষা দেখে ভ্রু কুচকালেন। মুখটাকে ভীষণ রকম তিক্ততায় ভরিয়ে তুলে চাপা গলায় বললেন,
‘তোমাকে তো আমি গোসল করতে দেখলাম না।’
আকিদা হক জবাব দিলেন না। টেবিল থেকে একটা পেয়ারা নিয়ে খেতে লাগলেন মনের সুখে। রুহুল হক চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
‘একটু তো লজ্জা সরম করো। সাতসকালে তোয়ালে ভিজিয়ে মাথায় প্যাচিয়ে নিচে নেমে এসেছো নাটক দেখাতে? তুমি কি নতুন বউ? বুইড়া বয়সে ভীমরতি। এসব ক্রিমিনালগিরি ভাব ছাড়ো। তা না হলে লাত্থি মেরে ওই ফুটা টিনের চালের বাপের বাড়ি দিয়ে আসবো।’
আকিদা হক রুহুল হকের কথা শুনে সাপের ন্যায় ফুসে উঠলেন। ক্যাট ক্যাট করে বললেন, ‘বোনের বাড়ি এসে কথা ফুটেছে না?’
‘তোমার কথা বন্ধ করার ব্যবস্থা করো না। জিহবায় আগুন লাগিয়ে দিবো।’
আকিদা হক বড় বড় পা ফেলে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায় চলে গেলেন। রুমকিকে ঘুম থেকে টেনে তুললেন। উঠতে না চাইলে দু চারটা চর থাপ্পড়ও লাগালেন।
____________________________
ওরা এসেছে গাজীপুর ফাউগান ইকো রিসোর্টে। শুনশান জনমানবহীন রাস্তা পেয়ে গাড়ি একটানে দেড় ঘণ্টার মাঝেই এসে পড়েছে এই রিসোর্টে। আদর আগে থেকেই রুম বুক করে রেখেছিলো। রিসোর্টে পৌঁছেই টিকলি টায়রা এক রুমে চলে গেলো। আদর আর্দ্র আরেক রুমে গেলো। খুব সকালে আদর টিকলিকে ফোন করে জাগালো। ফোনের শব্দে টায়রাও উঠে পড়েছে। ঘুমু ঘুমু চোখে টিকলি কান থেকে ফোন রাখতেই টায়রা বলল,
‘কে ফোন করেছিলো?’
‘উনি।’
‘কি বলল?’
‘ফ্রেশ হয়ে বাইরে যেতে বলল দুজনকেই।’
ঘড়িতে দেখলো সাতটা বাজে। টায়রা ক্লান্ত গলায় বলল, ‘এতো সকালে?’
‘হুম।’ টিকলি চোখ কচলিয়ে ফোন সামনে ধরলো। ধরতেই অবাক হয়ে দেখলো মায়ের আট টা কল। টিকলি ভয়ার্ত গলায় বলল,
‘আম্মু ফোন দিছিলো।’
টায়রা ঘাড়ে হাত রেখে হাই তুলছিল। টিকলির কথা শুনে হাই তুলা মুখটা হা হয়েই রইল। বিস্ফোরিত নয়ন দুটো মেলে দিয়ে বলল,
‘তুই এইবারেও ফোন খোলা রাখছস?’
টায়রা বিরক্তে চোখ মুখ কুচকে আবার বলল, ‘মানে, মানুষ এতো বলদও হয়? এক ভুল বারবার করস।’
,
ফাউগান ইকো রিসোর্টটা গাজীপুরের বেশ একটু গভীরে। বন জঙ্গলের মাঝে। দু’পাশে গজারি গাছের বন। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। রিসোর্টের এক পাশে আছে মাছ ধরার জন্য পুকুর। একপাশে সুইমিংপুল। একপাশে টিনের ঘর। কেউ যদি চায় তবে টিনের ঘরেও থাকতে পারে গ্রামীণ পরিবেশ উপভোগের উদ্দেশ্যে। রিসোর্টে ভেতরে বাইরে হরেকরকম ফলের গাছ। এক পাশে খোলা সবুজ মাঠ। আদর আর টিকলি পাশাপাশি হাটছিলো। হালকা এক ফোটা দু ফোটা বৃষ্টি। আদর প্যান্টের পকেটে হাত ডুকিয়ে হাটতে হাটতে বলল,
‘মাথায় উড়না দিন।’
টিকলি বিনাবাক্যে মাথায় উড়না টেনে নিলো। আদর হাটতে হাটতেই প্রশ্ন করলো, ‘বাসা থেকে কেউ ফোন দিয়েছিলো?’
‘হুম মা দিয়েছিলো। আপনার?’
‘হুম। মা ফোন দিয়েছিলো।’
‘ধরেছিলেন?’
‘হুম। বলেছি, ঢাকার আশেপাশে দুদিনের জন্য এসেছি।’
টিকলি কথা বাড়ালো না। নির্বাকে মন খারাপে হেটে যেতেই আদর বলল, ‘বিষয়টা কি আপনার বাবা বেশি বেশি করছে না?’
টিকলি ভ্রু কুচকে তাকালো। আদর বলল, ‘না আমার বাবারও দোষ আছে। কিন্তু আপনার বাবা তো ব্যাপারটা শুনতেই চাইছে না। আমাকে ভুলে যেতে বলছে আবার বাড়ি থেকে বের হওয়াও বন্ধ করে দিচ্ছে।’
টিকলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘নাথিং টু ছে।’
‘বাস্তব কথার কোনো উত্তর থাকে না।’
টিকল ভ্রু কুটি করে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার কাছে যেমন আপনার ফ্যামিলির দোষ নেই। তেমনি আমার কাছেও আমার ফ্যামিলির দোষ নেই। আমার বাবার রিয়েক্ট করা স্বাভাবিক। কেউ নিশ্চয়ই তার মেয়ে সম্পর্কে খারাপ কথা শুনতে চাইবে না।’
আদর আর কথা বাড়ালো না। নিশ্চুপ কদম ফেলতে ফেলতে খুব দীর্ঘ একটি শ্বাস ফেলল। টিকলি বলল,
‘ আমরা হঠাৎ এখানে কেনো এলাম?’
গম্ভীর মুখে আদর জবাব দিলো, ‘আপনি তো বলেন আমি আপনাকে সময় দেই না। তাই কালকে সুযোগ পেয়ে দুদিনের ছুটি নিয়েছিলাম। পরে রাতে টায়রার কাছ থেকে সব শুনে মাথায় জেদ উঠে গেলো।’
টিকলি আবারো ভ্রু কুচকে তাকালো। হাটা থামিয়ে দিলো। আদরও থেমে দাঁড়িয়ে খুব নিঃসহায় গলায় বলল, ‘আপনার থেকে আমি আলাদা থাকতে পারবো না।’
টিকলি স্তম্ভিত হয়ে শুনলো। কানে যেনো তালা লেগে গেলো। আদর আবারো হাটা ধরলো। মুচকি হেসে টিকলি দৌড়ে গিয়ে আদরের হাত ধরলো।
,
জামিলুর রেজা রাগে থরথর করে কাঁপছেন। আকিদা হক আর রুহুল হক চলে গেছেন ঘন্টা খানেক হলো। এখন বাজে সকাল দশটা। ঘরের মেঝেতে রাগের সাইনবোর্ড হিসেবে কিছু ফুলদানি ভেঙে পরে আছে। জামিলুর রেজা কাউকে ফোন লাগালেন। ওপাশে ব্যক্তি ফোন ধরতেই তিনি হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,
‘নিজের ছেলেকে সামলে রাখতে পারেন না? কেমন কুলাঙ্গার ছেলের জন্ম দিয়েছেন মশাই?’
আজিম খান খেপে গেলেন। অনেক দিন বাদে জামিলুর রেজার কল পেয়ে তার ভ্রু জোড়া নিতান্তই বিরক্তিতে কুচকে উঠেছিলো। তারউপর স্নেহের ছেলের সম্পর্কে এমন কথা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেলো।
‘মুখ সামলে কথা বলুন।’
‘কিসের মুখ সামলে কথা বলবো? আমার মেয়েকে নিয়ে আপনার ছেলে পালিয়েছে। এই আপনার ডাক্তার ছেলে? ডাক্তারের চরিত্র এমন হয়?’
আজিম খান অবাক হলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকালেন। তবুও ছেলের পক্ষ হয়ে বললেন,
‘আপনার মেয়ে যেতে না চাইলে তো আর আমার ছেলে ধরে বেধে নিয়ে যায়নি। নিজের মেয়ের চরিত্র আগে ঠিক করুন।’
জামিলুর রেজা গলা ফাটানো চিৎকার দিলেন,
‘আজিম খান… আপনার মুখ আমি বটি দিয়ে কেটে ফেলবো সাথে আপনার ছেলেকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে কুত্তাকে খাওয়াবো।’
‘আগে নিজের মেয়ের চরিত্র ঠিক করুন। তারপর কোপাতে আসবেন। প্রেগন্যান্ট মেয়েকে তো গছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।’
জামিলুর রেজা হাত মুঠো করে রাগ সংবরনের চেষ্টা করলেন। দাঁত কিড়িমিড়ি করে বললেন, ‘বানোয়াট কথা বলবেন না।’
‘কিসের বানোয়াট? আপনার মেয়ে নিজে আমার ছেলেকে বলেছিলো, সে পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট। এখন আবার আমার ছেলের সাথেই ফষ্টিনষ্টি করছে।’
জামিলুর রেজা হতবাক হয়ে গেলেন। টিকলি বলেছিলো? তবে কি বিয়ে করতে চায়নি দেখেই এই মিথ্যে পথের অবলম্বন? জামিলুর রেজা হুঙ্কার ছেড়ে আবার বললেন,
‘আপনি মূর্খ নাকি? পনেরো দিনের কেউ প্রেগন্যান্ট হয়? পড়ালেখা করেন নাই? বাপ-দাদা স্কুলে পাঠায় নাই? যত্তসব অশিক্ষিত। আপনার মতো বাড়িতে আমি মেয়ে বিয়ে দেইনি বলে নিজেকে সৌভাগ্য মনে হচ্ছে। আল্লাহ চোখ খুলে দিয়েছে। খুব শীঘ্রই আমার মেয়ের বিয়ে দিবো আমি।’
জামিলুর রেজা ফোন কাটলেন। আজিম খান জোরে জোরে শ্বাস ফেলে মনোয়ারা খানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার ছেলেরা আমার মান সম্মান কিচ্ছু রাখলো না।’
জামিলুর রেজা শায়লা আক্তারের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, ‘পনেরো দিনের মধ্যে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো।’
চলবে❤️