#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
৪০.
শ্যাতশ্যাতে ভেজা পরিবেশ। পিচ্ছিল উর্বর মাটি। শোনা যায়, গাজীপুরের ভূমি বেশ উর্বর এবং এখানের ফল-ফলান্তির গাছ হয় বিন্যস্ত ভাবে। খেতেও নাকি দারুন মজা! ফাউগান ইকো রিসোর্ট টা বেশ বিলাশবহুল। একেকটা ঘর জাকজমকপূর্ণভাবে সাজানো। চোখ ধাধানো সুন্দর। আর্দ্র টায়রা গেছে রিসোর্টের পাশের পুকুরটাতে মাছ ধরতে। তখন প্রায় বিকেল। আকাশ পরিষ্কার। বৃষ্টি নেই। টায়রা খুব উৎসাহ নিয়ে বড়শি ফেলল। সাথে সাথে আর্দ্রও ফেলল। টায়রা মুখ টানা মেরে বলল,
‘ দেখাদেখি মুসলমান।’
আর্দ্র ফুসে উঠলো। পরক্ষণেই কাধ ঝাকিয়ে তৃপ্তিকর ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার বড়শিতেই আগে মাছ উঠবে।’
টায়রা কৌতুক হাসি হাসলো। আদর টিকলি ওদের পেছনেই টেবিলে বসে ছিলো। হাসতে হাসতে টায়রা বলল, ‘ওই তোর পেবা দেবর এ কয় কি? নাইছ জোকস।’
আর্দ্রর গা পিত্তি জ্বলে উঠলো। রোষাগ্নি গলায় বলল,
‘আমি পেবা? নিজে কি? পেবি! এসব ঠেলাগাড়ি মার্কা শরীর নিয়ে নাকি তিনি মাছ ধরবে। হুহ..সাত মন তেলও পুড়বে না আর রাধাও নাচবে না।’
টায়রা নাক ফুলিয়ে তর্জনী আঙ্গুল তাক করে বলল, ‘বাজি?’
টায়রার তর্জনী আঙ্গুল বেকিয়ে দিয়ে আর্দ্র বলল, ‘বাজি। যে হারবে সে তিন ঘণ্টা সুইমিংপুলের ঠান্ডা পানিতে থাকবে।’
টায়রা তর্জনী আঙ্গুল ধরে ঝাকিয়ে চোখ মুখ কুকরিয়ে বলে উঠলো, ‘শালার হাত নাকি লোহা?’
তৎক্ষণাৎ আর্দ্র চেঁচিয়ে আদরের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ভাইয়া আমাকে শালা ডাকছে। এখন আমি শালী ডাকলেই তো তুমি বকা দিবা।’
আদর ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই আর্দ্র মিনমিনে কণ্ঠে বলল, ‘শালী ডাকলেই কি টিকলি আমার বউ হয়ে গেলো?’
আর্দ্রর মিনমিনে গলায় বলা কথাগুলো টায়রার কানে স্পষ্ট হয়ে লাগলো। সে ছি ছি করতে করতে বলল,
‘ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দেন? শরম লাগে না? চোখের উপর পর্দা লাগান মিয়া।’
‘এই, আপনি আর একটা কথা বলবেন আমি ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দিবো।’
টায়রা হাতের কবজি থেকে হাতা উঠিয়ে এমন এক ভাব নিয়ে বলল, ‘দেখি কে ফেলে? কার কত দম? এমন এক সিরিয়াস জায়গায় ল্যাং মারবো না বাপ বাপ করে নিজেই পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে বলবেন, ছেড়ে দে মা কেদে বাঁচি।’
আর্দ্র নাক ছিটকে টিকলি দিকে ঘুরে বলল, ‘ইহার মতোন আজব বস্তুকে কি খাওয়ায় মানুষ করছো?’
টিকলি ঠোঁট ভাসিয়ে হেসে বলল, ‘আমি মানুষ করতে পারি নাই ভাই। বহুত দুঃখ এই মনে। আপনি মানুষ করেন এবার।’
টায়রা জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে টিকলির দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ খেয়াল করলো তার বড়শিতে জোড়ালো টান পরেছে। টায়রা সচেতন দৃষ্টিতে বড়শিটাকে হালকা নাড়ালো। বড়শির টান শক্ত হয়ে এলো। টায়রা জোরে বড়শি ধরে টেনে উঠিয়ে নিয়ে আসতেই লাফিয়ে উঠলো। মুখে হাত দিয়ে চিৎকার করে বলল,
‘মাই গড! আমি মাছ পাইছি? অবিশ্বাস্য!’
আর্দ্র হতবুদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল মিনিট খানিক। টায়রা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে আর্দ্রর সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
‘বাজি কমপ্লিট করেন। তিনঘণ্টা সুইমিংপুলে থাকবেন।’
আর্দ্র করুণ চোখে আদরের দিকে তাকাতেই আদর বলল, ‘দাড়ায় আছোস কেন যা। বাজি তো তুই ই দিছিলি।’
আর্দ্র বিরবির করে বলল, ‘এমন ভাই থাকার চেয়ে এই ঠেলাগাড়ির মতো শত্রুও ভালো।’
_______________________________
সোফায় বসে পাকোড়া হাতে গোয়েন্দা সিরিজ দেখছিলো নিভা। কলিংবেলের শব্দে রান্নাঘর থেকে মনোয়ারা খান তার বিষন্ন গলা উঁচিয়ে বললেন,
‘কে এসেছে মা দেখ তো।’
‘দেখছি খালামনি।’
টিভিতে চোখ রেখেই অন্ধের মতো সামনে এগিয়ে গেলো নিভা। দরজা খুলে ঘাড় ফেরাতেই দেখলো নয়ন দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে। নিভা ঘাবড়ে দু’পা পিছিয়ে গেলো। বুকে থু থু দিয়েই ধমক দিলো,
‘আপনি কি বারো মাসই হাসেন? হাসি কি আপনার রোগ?’
নয়নের হাসিহাসি মুখটা মিলিয়ে গেলো। নিভা অসম্ভব রেগে পেছনে তাকাতেই দেখলো রাহুল দাঁড়িয়ে আছে মুচকি হেসে। নিভার পরান টা ছলকে উঠলো। অকারণে ভেতর থেকে হাহাকার বেড়িয়ে এলো। এই মুচকি হাসির অসম্ভব সুন্দর গোপন দুঃখে ভরা মুখটা যখন জানবে, তার ছেলেবেলার ভালোবাসা তাকে নয় অনেক আগেই অন্যকাউকে মন দিয়ে বসেছে। তখন সে কি করবে! রাগ করবে? পাগলামি করবে? ভাঙচুর করবে? নাকি মনের গহীনে সমস্ত লুকায়িত কষ্টের সাথে এই কষ্টও পুষে রেখে কষ্টের পাল্লা ভারী করে নিস্তব্ধ একা রাতে নিঃশব্দে কাদবে?
‘ভেতরে আসতে পারি?’
রাহুলের কথায় নিভা চমকে উঠলো। অবচেতন মনেই দরজা থেকে সরে দাড়ালো। সম্ভিত ফিরতেই দেখা গেলো তার চোখ ছলছল করে উঠেছে। চারিপাশ ঝাপসা, অস্পষ্ট, মেঘাচ্ছন্ন। ঈষদন্ধকার এই মন বুঝে উঠতে পারে না, নিভা কার জন্য কষ্ট পায়? নিজের জন্য নাকি রাহুলের জন্য? কিন্তু নিজের জন্য কষ্ট পাওয়ার কারণ কি? কোনোকিছুই কি কারণ ছাড়া হয়?
মনোয়ারা খান রান্নাঘর থেকে এসে সোফায় রাহুলকে বসে থাকতে দেখেই ব্যস্ত হয়ে গেলেন। প্রফুল্লচিত্তে বললেন,
‘বাবা তুমি? অবশেষে এলে? পায়ের ধুলি পড়লো তাহলে আমার ঘরে?’
রাহুল সৌজন্যে হাসি দিয়ে বলল, ‘এসব কি বলে লজ্জা দিচ্ছেন আন্টি? আমি তো আপনাদের ঘরেই থাকি।’
‘কি খাবে বলো?’
‘কিছু খাবো না আন্টি। ওই বাড়ি ভাড়াটা দিতে এসেছি।’
নয়ন বাড়ি ভাড়া দিতেই মনোয়ারা খান বললেন,
‘আরে রাখো পরে দিও। কি খাবে সেটাই বলো। নিভা পাকোড়া বানিয়েছে। তোমাদেরও দেই।’
রাহুল কিছু বলার আগেই নয়ন বলল, ‘আন্টি সাথে এক কাপ চা দিলে মোড়ের টং দোকানে গিয়ে চা খাওয়ার সময়টা বেঁচে যেতো।’
মনোয়ারা খান মাথা দুলিয়ে হেসে রান্নাঘরে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, ‘প্রতিদিন বিকালে আন্টির কাছে এক কাপ চা খাওয়ার আবদারে এসে পরো নয়ন।’
নয়ন মাথা নাড়িয়ে নিভার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো। নিভাও উলটে হাসি ফেরত দিলো। কথা বলতে চাইলে দেখা গেলো কোনো কথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে এক অবাঞ্ছিত কথা বলল নয়ন,
‘জানো, প্রতিবার ভাড়া দিতে আমি একাই আসি কিন্তু এবার তোমাকে দেখতে রাহুল এসেছে।’
রাহুল কেশে উঠলো। নিভা অবাক চোখে পানি আনতে চলে যেতেই রাহুল লাত্থি লাগালো নয়নের পায়ে। দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল, ‘তুই কি পাগল?’
‘পাগল হবো কেনো? তুই নিভাকে দেখতে আসোস নাই?’
‘না।’
‘তাহলে কেন আসছোস? তোর পায়ে পড়লেও তো জিন্দেগীতে আসোস নাই।’
‘আমি উনার সাথে কথা বলতে আসছি।’
নয়ন চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আলটিমেটলি ওই একই কথা হলো।’
‘আর একটা কথা বললে তুই মাইর খাবি। চুপ থাক।’
নিভা পানি এনে রাহুলের সামনে ধরতেই রাহুল উঠে দাঁড়ালো। নিভার দিকে তাকিয়ে মৃদুমন্দ হেসে বলল,
‘আজ ছাদে গেলেন না যে? অসুস্থ?’
নিভা হালকা হেসে মাথা নাড়ালো। রাহুল আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তবে?’
‘ওই বাসায় চলে যাবো তো। ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম।’
রাহুল চরম অবাক গলায় বলল, ‘আপনি চলে যাবেন?’
‘জি। কাল সকালে।’
‘আবার কবে আসবেন?’
নিভা এক ঝলক তাকালো। অতৃপ্ত চোখদুটো ঘুরতে লাগলো রাহুলের চোখে মুখে। লোকে বলে, চোখ নাকি কখনো মিথ্যে বলে না। রাহুলের চোখ দুটোকে গাঢ় ভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিভা দেখতে পেলো, সেই চোখে তার জন্য মায়া, স্নেহ, বন্ধুত্বপূর্ণ আবেগ ছাড়া আর কিছুই নেই। কিছুই না! দীর্ঘশ্বাস বুকের মাঝে টেনে নিয়ে নিভা উত্তর দিলো,
‘জানি না। দেখি কবে আসা যায়।’
রান্নাঘর থেকে মনোয়ারা খানের ডাক পরলো। নিভা সেদিকে স্বাভাবিক ব্যস্ত পায়ে হেটে চলে গেলো। তবুও রাহুলের মনে হলো, অস্বাভাবিক! কোথাও কিছু আড়াল হয়ে গেলো। নিভার আজ বিকালে ছাদে যাওয়ার পেছনে ব্যাগ গোছানোর কারণটা নিছকই এক অযুহাত। সে ইচ্ছে করেই যায়নি কেননা ব্যাগ সে রাতেও গুছাতে পারতো। নিজেকে গোপন রাখার চেষ্টা বুঝা গেলো নিভার সকল কার্যকলাপে। কথা বলার ধরণও কেমন যেনো খাপছাড়া ঠেকলো রাহুলের কাছে। ‘কি হয়েছে উনার? খারাপ কিছু হয়েছে কি? নাকি চলে যাবেন এজন্য মন খারাপ?’ বুকের মাঝে অজস্র ভাবনা-প্রশ্ন নিয়ে রাহুল ম্লান মুখে সোফায় বসলো।
,
দু’ঘণ্টা হয়েছে আর্দ্র সুইমিংপুলে বসে আছে। সুইমিংপুলটা দেখতে দারুন! গিটার শেপ। টায়রা তা দেখেই আপসোস করে বলেছিলো, ‘ইশশ..আমার গিটারটা যে কেনো আনলাম না!’
তখন শেষ বিকালের আকাশে কালো মেঘের দল হানা দিয়েছিলো। একটু পরেই নামবে ঝুমঝুম বৃষ্টির সন্ধ্যা। টায়রা সুইমিংপুলের পাশে স্লিপিং চেয়ারে বসে আর্দ্রের দিকে তাকিয়ে দুঃখী দুঃখী গলায় বলল, ‘আহারে…কষ্ট হচ্ছে?’
আর্দ্র উত্তর দিলো না। গাল নাক ফুলিয়ে পানির মাঝে ভাসতেই টায়রা এগিয়ে এলো। সুইমিংপুলের সিড়িতে এক পা রেখে চু চু করে আবারো অসহায় গলায় ঠাট্টার ছল বজায় রেখে বলল,
‘থাক রাগ করবেন না। যাওয়ার সময় পাঁচটা লজেন্স কিনে দিবো।’
টায়রার কথার মাঝেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো। এই বৃষ্টির মাঝে সুইমিংপুলের ঠান্ডা পানিতে আরো এক ঘণ্টা থাকতে হবে ভেবে আর্দ্রের শরীরে এখনি জ্বর উঠে যাচ্ছে। টায়রা উঠে দাড়িয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
‘যাক ষোলো আনা পূর্ণ হলো। এবার বৃষ্টিতেও ভিজতে থাকুন।’
ভারী বৃষ্টির প্রকটে টায়রা ভিজে গেছে অনেকটাই। সে তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে নিলেই আর্দ্র ওর পায়ে এক টান মেরে ওকে ফেলে দিলো সুইমিংপুলে। টায়রা নাকানিচুবানি খেয়ে রোষানলে জ্বলে উঠলো। আকস্মিক পড়ে যাওয়ায় কিছু পানিও খেয়ে ফেলা হলো। ভিষণ মাত্রায় রেগে সে বলল,
‘কি হলো এটা?’
টায়রার মেদ বিহীন কোমড় জড়িয়ে ছিলো আর্দ্রের হাত। টায়রার ভেজা সিক্ত চেহারার দিকে বেশ কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই আর্দ্র তলিয়ে গেলো। টায়রার কোমড় ছেড়ে ডুব দিয়ে আবার উঠে আসলো। মুখ থেকে হাতরে পানি মুছলো। চুলগুলো পেছনে এলিয়ে দিয়ে চোখ মেলে সম্মুখে তাকালো আবারো। স্নিগ্ধ, কোমল, পানিতে ভেজা অকঠিন, মৃদু তেজি যুক্ত টায়রাকে দেখে হঠাৎ আর্দ্র দিশেহারা হয়ে গেলো। আকাশ ফেটে পড়ছিলো অবিরাম ধারায় জলরাশি তার মাঝে পানিতে ভাসমান একই সাথে তারা দুইজন। আর্দ্রের ঘোর ভাঙলো টিকলির চিৎকারে।
‘তুই আবার সুইমিংপুলে কি করিস?’
টায়রা কাদো কাদো গলায় বলল, ‘তোর বদমাইশ খাসি দেবর ফেলে দিয়েছে।’
‘উঠে আয় আমি তোয়ালে নিয়ে আসছি। বৃষ্টিও পড়ছে। ঠান্ডা লেগে যাবে তো।’
টায়রার কথায় আর্দ্র ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে রইল। কোনো তর্কে বির্তকে না জড়িয়ে চোখ দুটো এক ধ্যানে দেখে গেলো সামনের অপরিসীম সুন্দর শ্যামলা মুখশ্রীর রমণীকে। টায়রা সাতরে পাড়ের কাছাকাছি যেতেই আর্দ্র হাত ধরে টান দিলো। আকস্মিক টানে টায়রা থতমত খেয়ে গেলো। আর্দ্র শক্ত করে টায়রার হাত ধরে বলল,
‘এই সুইমিংপুলেই বাকি এক ঘন্টা থাকতে হবে আপনাকে।’
টায়রা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারলো না। অসহায় দৃষ্টিতে আর্দ্রের দিকে তাকাতেই আর্দ্র চোখ টিপে দিলো। অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে টায়রা থেমে থেমে প্রশ্ন করলো,
‘কিছু কি করছেন?’
আর্দ্র ভ্রু উঁচিয়ে সিরিয়াস মুডে বলল, ‘মানে?’
‘পানি কি নষ্ট করছেন?’
‘পানি নষ্ট করবো মানে?’
‘গর্দভ নাকি?’
আর্দ্র একটু ভাবতেই বিস্ফোরিত চোখে টায়রার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এতো ফালতু কেন আপনি?’
টায়রা উচ্চস্বরে বলল, ‘এখন আমি ফালতু?’
‘অবশ্যই।’
‘আপনি ফালতু। অসভ্য, ইতর, বেয়াদব দুনিয়ার সমস্ত খারাপ আপনি।’
আর্দ্র টায়রার হাত আরো শক্ত করে ধরে বলল, ‘ভেবেছিলাম মাফ করবো কিন্তু না। এবার থাকুন আমার সাথে আর তা নয়তো বাজি বাতিল করুন।’
টায়রার শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষন থাকলে যেখানে সে পাক্কা অক্কা পাবে সেখানে আরো এক ঘণ্টা থাকা তো বিলাসিতা ভাই! টায়রা নাক ফুলিয়ে বলল,
‘ছাড়ুন। মাফ করে দিলাম।’
,
সুইমিংপুল থেকে দৌড়ে ঘর অবধি যেতেই টিকলি আধভেজা হয়ে গেলো। তোয়ালে নিয়ে উল্টো ঘুরতেই দেখলো আদর ভয়ার্ত চোখে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। টিকলি চোখ দুটোকে কুঞ্চিত করে বলল,
‘কিছু হয়েছে ডাক্তার?’
আদর ভয়ার্ত ভাব বজায় রেখেই বলল, ‘এভাবে দৌড়ে এলেন কেনো? কোনো সমস্যা?’
টিকলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আদরের ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে ভীষনরকম ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সে। হাতের তোয়ালে টা দেখিয়ে বলল, ‘আর্দ্র ভাইয়া টায়রাকে টেনে পানিতে ফেলে দিয়েছে। ওর জন্যই তোয়ালে নিয়ে যাচ্ছিলাম।’
‘তাই বলে এতো দৌড় দিয়ে কেউ আসে? পড়ে টড়ে গেলে তখন? পা ভেঙে ফেলে দিতাম।’
আদর খানিকটা রাগী গলায় বলল। টিকলি ভীষণ বড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদরের মুখোমুখি দাড়ালো। চোখে চোখ স্থির হতেই অভিলাষী চোখ দুটো দ্বারা অতলস্পর্শী হৃদয়ে নিবিড় গলায় প্রশ্ন করলো,
‘আপনি কি আমার থেকেও বেশি দূর্বল হয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার? দূর্বল হয়ে পড়লেও এই দূর্বলতার কারণ কি?’
আদর স্থিরতাচিত্রে টিকলির ওই গহন চোখে তাকিয়ে থাকলো। টিকলি হীনবল গলায় বলল,
‘আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ছি ডাক্তার। আশেপাশের সবকিছু কেমন যেনো বিশৃঙ্খলায় ভরপুর। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই বাবা সব জেনে গেলো। আবার বুঝে উঠার আগেই আমার উপর কড়া রেস্ট্রিকশন আসলো। এরপর হঠাৎ কিছু না ভেবে আপনার সাথে এসে পরলাম। কেনো এলাম কিছুই বুঝতে পারছি না? কিন্তু এখন চিন্তায় আমার মাথা দুলছে। আপনি বুঝতে পারছেন বাসায় গেলে কি হবে?’
আদরের মুখ থেকে তবুও কথা আসলো না। টিকলি তার অগাধ ধৈর্য্য নিয়ে আদরের কলার চেপে ধরলো। নীল শার্টের ভাঁজ করা কলারটা দুমড়ে মুচড়ে গেলো। টিকলির চোখে বিন্দু বিন্দু পানি জমলো। কিছুক্ষণ প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা চলার পর গাঢ় গলায় টিকলি বলল,
‘কথা বলুন। আমি কেনো একবাক্যে আপনার সাথে এলাম? আমাদের সম্পর্কের নাম কি ডাক্তার? শুধুই প্রেম? ভালোবাসা নয়? কেনো আপনার এতো ইগো? আর পাঁচটা প্রেমিক পুরুষদের মতো আপনি কেনো ভালোবাসি ভালোবাসি বলে মুখে ফেনা তুলতে পারেন না? তবে কি আপনি আমায় ভালোবাসেন না?’
টিকলির কলার চেপে ধরা হাত দুটোর উপর আদর হাত রাখলো। মনোহর চঞ্চল প্রেমময় চোখদুটো ভীষণ টিকলি আসক্ত। পরম যত্ন করা গলায় বলে উঠা হলো,
‘আমি আপনাকে এতোটা ভালোবাসি যে ভালোবাসা ভালোবাসি বলে প্রকাশ করা যায় না।’
বাতাস থমকে গেলো। বাইরের তুমুল বর্ষণও স্তব্ধ হয়ে গেলো। নিশ্চল হয়ে এলো পরিবেশ। নিস্তব্ধ হয়ে গেলো টিকলির শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কষ্টের মতো অলৌকিক অভিনব সুখে ভেসে গেলো টিকলির হৃদয়ছন্দ।
চলবে❤️
#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
৪১.
‘মনতাঁরা!’
টিকলির বুক কেঁপে উঠলো। নাম না জানা রোমাঞ্চিত শিহরণের ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো শরীর বেয়ে। চোখদুটোর কপাট বন্ধ করতেই সুখস্পর্শ আবেগ মিশ্রিত হলো শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আদর টিকলির কপাল থেকে চুল সরিয়ে নিলো। ভিষণ ব্যকুলতার গলায় বলল,
‘আপনার এই কপালটা না আমার ভীষণ প্রিয়!’
টিকলি বন্ধ চোখে বিমূঢ় গলায় বলল, ‘তারপর?’
‘আপনার গালের ওই পক্সের ছোট দুটো গর্ত আমার ভিষণ প্রিয়!’
‘তারপর?’
‘আপনার ওই কপালে দু’পাশ থেকে শুরু হওয়া কোমড় দোলানো দু’গাছি চুলগুলো আমার ভীষণ প্রিয়!’
‘তারপর?’
‘আপনার এই টিকলো নাক আমার ভীষণ প্রিয়। আপনার সবকিছুই আমার ভীষণ প্রিয়। আপনার ওই পিঠের তিল টাও ভিষন প্রিয়! নজরকাঁড়া!’
টিকলি টপাস করে চোখ খুলল। আদরের ঠোঁটের কোণে তখন দূরন্ত মৃদু হাসি। কিছুক্ষণ শূন্যে আহাম্মক এর মতো তাকিয়ে থেকে টিকলি তেজি গলায় বলল,
‘এই আপনি আমার তিল দেখেছেন কখন?’
আদর পা বাড়ালো দরজার দিকে। চলে যেতে যেতে বলল,
‘কালো শাড়ির কালো ব্লাউজের ফাঁকে কালো তিলটার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিলো আমার খুব গোপনে, নির্বিঘ্নে, আপনার অগোচরে।’
,
বাইরে তখনো বৃষ্টি থামেনি। সুইমিংপুল থেকে আর্দ্র আগে উঠলো। টায়রা উঠতে গেলেই পিছলা খেয়ে পরলো। আর্দ্র হাত বাড়িয়ে দিতেই হাত ধরে উঠে এসে হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো। আর্দ্র হাত ধরে চোখ মুখ কুচকে বলল,
‘কাজের সময় কাজী, কাজ ফুরালে পাজি।’
টায়রা অগ্নিদৃষ্টি সহযোগে তাকিয়ে থাকলো কয়েক মিনিট। গটগট পায়ে হাটা ধরতেই দেখা গেলো খানিকটা দূরেই গেটের পাশে ছাউনির নিচে বৃষ্টিতে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাওয়াই মিঠাইওয়ালা। টায়রার থমকে যাওয়া দৃষ্টি অনুসরণ করে আর্দ্রও সেদিকে চোখ রাখলো। খানিকটা অবাক ই হলো এখানে হাওয়াই মিঠাইওয়ালা দেখে। কিছু পুরনো স্মৃতি মনে করাতেই বোধহয় আজ অসময়ে এই হাওয়াই মিঠাইওয়ালার উদয়। আর্দ্র ফিচেল হেসে হালকা গলায় বলল,
‘আপনার মনে আছে? আপনার আমার প্রথম দেখা হাওয়াই মিঠাই কিনতে গিয়ে।’
টায়রা মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘ঝগড়া করে।’
আর্দ্র চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘ওই একই কথা।’
টায়রা ঠোঁট বিকৃত করে বলল, ‘ওই দিনটাই আমার জীবনের কাল। আপনার মতো বধো মার্কা মানুষের সাথে সাক্ষাৎ। আর এখন পর্যন্ত সেই সাক্ষাৎ ফেবিকলের মতো চিপকেই আছে।’
আর্দ্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বোকা বোকা গলায় বলল, ‘বধো কি? কিসব আউল ফাউল নাম! আর আমি বধো হলে আপনি বধি।’
টায়রা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আপনার চেহারায় যে একটা হনুমানের ছাপ আছে আপনি কি জানেন?’
আর্দ্র পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আর আপনার চেহারায় যে একটা বলদ বলদ ব্যাপার আছে তা কি আপনি জানেন?’
‘আর আপনার চেহারায় খাসির সাইনবোর্ড টানানো আছে।’
‘আপনার চেহারায় গাধার পোস্টার লাগানো আছে।’
‘আপনি…আপনি..একটা অসহ্য।’
‘আর আপনি বোধহয় আমার জন্য খুব সহ্য?’
,
রাত তখন একটা। আকাশ পরিষ্কার। বাঁকা একটা চাঁদ তাতে বিদ্যমান। আদর তড়িঘড়ি করে টিকলির রুমে এলো। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
‘কি হয়েছে? এভাবে আর্জেন্ট ফোন করে ডেকে আনলেন?’
‘আমার ভালো লাগছে না ডাক্তার। আমি বাড়ি ফিরতে চাই।’
আদর বিস্মিত হলো, ‘আমাদের তো আরেকদিন থাকার কথা টিকলি।’
‘আপনি বুঝতে পারছেন না। আমার মন টানছে না। প্লিজ কথা না বাড়িয়ে চলুন।’
‘এখন?’
‘হুম।’
,
টায়রাকে কোনোমতে টেনে হিচড়ে ঘুম থেকে তোলা হয়েছে। আদর গাড়ি নিয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো। টিকলিকে দেখতেই ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো। টায়রা ঢুলু ঢুলু পায়ে পেছনের সিটে বসেই মাথা এলিয়ে দিলো। আর্দ্র আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে টিকলির উদ্দেশ্যে বলল,
‘কি হলো? এভাবে চলে যাচ্ছি কেনো আমরা? কোনো সমস্যা হয়েছে টিকলি?’
টিকলি মাথা নাড়িয়ে না করলো। আদরের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল,
‘মনটা কু ডাকছে ভাইয়া। মনে হচ্ছে কিছু একটা খারাপ হবে। আমার এ দিকটা প্রচন্ড খারাপ। মন যা বলে তাই হয়।’
গাড়িতে কেউ আর কোনো কথা বলল না। আদর ড্রাইভিং এ গভীর মনোনিবেশ করতেই টিকলি আস্তে করে বলল,
‘রাগ করছেন?’
আদর তড়িৎ বেগে টিকলির দিকে তাকিয়ে ফিচেল গলায় বলে উঠল, ‘রাগ করার মতো কিছু হয়েছে বলে কি আপনার মনে হয়? যদি মনে হয় তবে আমি রাগ করেছি।’
এর পরিপেক্ষিতে টিকলি আর কথা খুঁজে পেলো না। চুপ হয়ে খুব সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালায় মাথা রেখে কালো আবরণে ঢাকা সুপ্ত রাত জাগা পরিবেশ দেখে গেলো। টায়রা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এই মেয়ে প্রচুর ঘুমোতে পারে বলেই আর্দ্রর ধারণা। তা নাহলে এই অতর্কিত সিচুয়েশনে কেউ এভাবে নাক ডেকে ঘুমোয়? ভাবার কালেই ঝাঁকি খেয়ে টায়রার মাথাটা গড়িয়ে পড়লো আর্দ্রের কাধে। আর্দ্র নাক ছিটকিয়ে ঝটকানা দিয়ে উঠাতে গেলেই আদর খেকিয়ে উঠলো,
‘ঘুমাচ্ছে দেখতে পারতাছস না? ঘুমন্ত মানুষের সাথেও এরম করতে হবো? কাধে মাথা রাখছে কি কাধে ফোসকা পইড়ে গেছে?’
আর্দ্র ভাইয়ের দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে বিরবির করে বলল, ‘একজনের রাগ আরেকজনের উপর ঢালতাছে।’
ঘড়ির কাটা ঘুরছে নিজ গতিতে। কেটে যাচ্ছে সময়।কেটে যাচ্ছে মিনিটের পর মিনিট। টায়রার মাথা ঝুঁকে ঝুঁকে নেমে এসেছে আর্দ্রের বুকের দিকটায়। আর্দ্র টায়রার মাথাটা বুক থেকে উঠিয়ে আবার কাধে রাখলো। অজান্তেই অজ্ঞাত চোখদুটো ঘিরে ধরলো টায়রার মুখোঞ্চল। স্থির দৃষ্টিতে দেখতে দেখতেই কম্পিত হয়ে উঠলো হৃদয়। রাস্তার দু’পাশের গজারি গাছগুলো ছাড়িতে যেতে যেতেই মন বলল,
“রেখে গেলাম কতক স্মৃতি,
আবার কবে ফিরে আসা হবে না জানি।”
টিকলি জানালায় মাথা ঠেস দিয়ে ছিলো। বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। আদর হাত বাড়িয়ে টিকলির মাথা জানালা থেকে উঠিয়ে জানালার কাচ লাগিয়ে দিলো। টিকলি অসহায় চোখে আদরের দিকে তাকাতেই আদর স্নেহভরা গলায় বলল,
‘ঘুম পাচ্ছে?’
টিকলি উত্তর দিলোনা। কেমন করে যেনো মাথা ঝাঁকালো। যার অর্থ হ্যাঁও না নাও না। আদর টিকলির মাথাটা নিজের কাধে রাখলো সযত্নে। এইতো… দ্বিতীয়বার কাছে আসা। ভালোবাসার মানুষটার সংস্পর্শ পাওয়া। খুব কাছে থেকে গায়ের গন্ধ নেওয়া। নিঃশ্বাসের শব্দ গোনা। প্রথমবার কাছে আসাটাও ছিলো এই বদ্ধ গাড়িতে। অভিমানী টিকলির কান্নাময় পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে আদর তার মাথাটা আলগোছে রেখেছিলো বুকের কিনারায়। সুন্দর সুন্দর দিনগুলো কেনো সবসময় সুন্দর থাকে না? কেনো হারিয়ে যায় অতীতের পাতায়? বর্তমানের বেড়াজালে?ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায়? আদর খুব আড়ালে টিকলির চুলের ভাঁজে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো। বুঝলো না কেউ। জানলো না টিকলি। শুধু জানলো আদরের দগ্ধ হৃদয়। টিকলির চোখের পাতা বন্ধ। আদর গাড়ি চালাতে চালাতেই গাইলো দু লাইন,
‘তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা,
তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা।’
আর্দ্র তখন অবধি তাকিয়ে ছিলো শ্যামল মুখশ্রীর টায়রার দিকে। শ্যামলা মানুষগুলো একটু বেশি মনকাড়া হয়। এদের একবার নজরে বন্দী করলে বোধহয় সহজে মুক্ত করা যায় না। আদরের গান শুনে আর্দ্রের দৈবাৎ আবার মনে হলো লাইনটা, ‘তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা।’
টিকলি ঘুমিয়ে পড়েছে। ইশশ…কি মোক্ষম সময় ছিলো আদরের কণ্ঠে গান শোনার। কিন্তু শুনতে পেলো না। ভাগ্যটাই বুঝি খারাপ! টিকলি ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চিত হয়ে আদর মুচকি হাসলো। গলা ছেড়ে ধরলো গানের পরের লাইনগুলো।
,
গাড়ি থেমেছে ঠিক সেই স্থানে যে স্থান থেকে শুরু হয়েছিলো যাত্রা। আর্দ্র ব্যাগ বের করছিলো গাড়ির ব্যাক সাইড থেকে। টায়রা পাশে দাঁড়িয়ে হাই তুলতেই ধমকে আর্দ্র বলল,
‘আরে আর কত ঘুমাবেন? এই ঠেলাগাড়ি মার্কা শরীর নিয়ে একটু হলেও তো হেল্প করতে পারেন নাকি? মনে মায়া দয়া নাই?’
টায়রা আবার হাই তুললো। নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে দু কদম এগিয়ে গিয়েও পেছন ফিরে আসলো। আস্তে করে বলল, ‘শুনুন।’
টায়রার হঠাৎ এতো সুন্দর ডাকে আর্দ্র স্তব্ধ হয়ে গেলো।বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে থাকতেই টায়রা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘বধো মানে বোকা এজ লাইক এজ রামছাগল।’
আর্দ্র চোখ গরম করে তেজিয়ান দৃষ্টিতে তাকালো৷ আঙ্গুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘এক মাঘে শীত যায় না ফুটা টায়ার।’
টায়রা বাতাসে চুল উড়ানোর ভঙ্গিতে পা বাড়ালো সামনের দিকে। টিকলি ব্যাগ হাতে এগিয়ে যাচ্ছিলো। আদর গাড়িতে ঠেস দিয়ে টিকলির যাওয়ার পানেই চোখ রেখেছিলো। একটু কি অশ্রুসিক্ত ছিলো চোখদুটো? জ্বলজ্বল করছিলো কি চোখের ভেতরের মধ্যিখানের মনিদুটো? কয়েক কদম যেতেই টিকলি পেছন ফিরে তাকালো। আলতো করে মাথা দুলাতেই আচম্বিতে চশমার আড়ালে পড়ে গেলো কয়েক ফোঁটা নীর। শীতল অম্বু। গালে ছেপে গেলো বারির দাগ। টিকলি ব্যাগ মাটিতে ফেলে এক দৌড়ে আদরের কাছে গেলো। আদরের গভীর সন্নিপাতিক হতেই আদর রুদ্ধ গলায় খুব আস্তে করে বলল,
‘একবার জড়িয়ে ধরবেন?’
টিকল যেনো এই কথাটির ই অপেক্ষায় ছিলো। পা উঁচু করে জড়িয়ে ধরলো আদরের গলা। তৃতীয় বার এতোটা কাছে আসা কিন্তু প্রথমবার এতোটা নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করা। জড়িয়ে ধরা। নিজের করে রাখার আকুলতা।
‘আমাদের কি আবার দেখা হবে ডাক্তার? এভাবে? কিছু সুন্দর মুহুর্ত একসাথে কাটানো হবে? ইশশ..ডাক্তার আপনি মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছেন। সময় গুলো মুঠোবন্দী করে রাখেন নি। রাখলে আমার আর যেতে হতো না।’
আদর হালকা গলায় হাসলো৷ গম্ভীর, কঠোর, স্বল্পভাষী ভারিক্কি মনের আদরেরও চোখের পাপড়ি ভিজে উঠলো। সত্যি কি দেখা হবে? নাকি সামনে ওত পেতে আছে অন্যরকম ভয়ানক কিছু? টিকলিকে আরেকটু শক্ত করে ধরে আদর কাঁপা কাঁপা গলায় বাচ্চামো করে বলল,
‘আই এম সরি। আদর খুব খুব সরি। অতীতে যা খারাপ হয়েছে তার জন্য সরি। ভবিষ্যতে যা খারাপ হবে তার জন্যেও সরি।’
______________________________
দিনের অগ্রভাগের রূর্যকিরণে চারিপাশ পরিষ্কার। রাতে বৃষ্টি হয়েছে অথচ এখন ভ্যাপসা গরম। গরমে ভিজে উঠেছে ঘাড় গলার কিছু অংশ। খোলা চুল লেপ্টে আছে গলার সাথে৷ শায়লা আক্তার মেয়ে পালানোর শোকে চোখ মুছতে মুছতে কোনো কারণে মেয়েদের ঘরে আসছিলেন। ঘরে পা রাখতেই তিনি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। মুখের বুলি হারিয়ে ফেললেন অজ্ঞাত ভাবে। তাকে যেনো বোবায় ধরলো। হাজার চেষ্টা করেও কথা ফোটাতে পারলেন না মুখে। তিনি খানিকটা অচেতন পায়ে হেটে মেয়েদের বিছানার সামনে গেলেন। নিজের গায়ে হালকা চিমটি কাটতেই দেখলেন বিছানায় সত্যি তার দুই মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। তিনি চমকে উঠলেন। রাতের আধারে পালিয়ে গেলো। আবার পরের রাতের আধারেই ফিরে এলো? শায়লা আক্তার সকল ভাবনার সুতো ছিড়ে টায়রার গায়ে ধাক্কা দিলেন। টায়রা চোখ মুখ কুচকে বিরক্তি নিয়ে উঠে বলল,
‘কি হয়েছে মা?’
‘তোরা কে?’
টায়রা চোখ খুলে মাকে দেখে আবার চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পরলো। ঘুমিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘তোমার মেয়ে।’
শায়লা আক্তার তৎক্ষনাৎ চিতকার দিলেন। গলা ফাটানো চিৎকারে বলে উঠলেন, ‘তোরা কীভাবে এলি?’
শায়লা আক্তারের চিৎকারে টিকলি জেগে উঠলো। টায়রা যথাসম্ভব বিরক্তিকর মুখে উত্তর দিলো, ‘আমরা আবার কখন কোথায় গিয়েছিলাম? আমরা তো এখানেই ছিলাম।’
শায়লা আক্তার অগ্নি সহযোগী চোখে তাকিয়ে টায়রার গায়ে থাপ্পড় মেরে বললেন, ‘উঠ। উঠ বলছি। মজা হচ্ছে আমার সাথে?’
মায়ের অত্যাচারে টায়রা উঠে বসলো। ঠোঁট উলটে বলল,
‘সত্যি বলছি মা। আমরা কোথাও যাইনি। আমরা তো কালকে বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। তোমাদের সাথে চোর পুলিশ খেলছিলাম। দেখলাম তুমি আর বাবা ধরতে পারো কিনা। কিন্তু আপসোস তোমরা ধরতে পারলে না। তাই রাতের বেলা বাথরুম থেকে চুপিচুপি বেরিয়ে এলাম। তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম।’
শায়লা আক্তারের চিৎকারে দরজায় এসে দাড়িয়েছেন জামিলুর রেজা। মেয়েদের দেখে রীতিমতো তার চোখ কপালে। টায়রার মুখে আপসোসের দুঃখী ছায়া। শায়লা আক্তার টায়রার মাথায় থাপ্পড় মারলেন। রাগী গলায় বললেন,
‘আরেকবার আমার সাথে ফাইযলামি করলে বাসা থেকে বের করে দিবো।’
‘বিয়ে দিয়ে তারপর বের করো। এখন বের করলে আমি কোথায় যাবো বলো? আমি তো তোমার মেয়ে একটু তো মায়া দয়া করো।’
শায়লা আক্তার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘টায়রা, তোর গালে আমি ঠাস করে চর মারবো। ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে দিছস। বেয়াদব। ঠিকমতো বল কখন এলি তোরা? কীভাবে এলি?’
টায়রার দাঁত কেলিয়ে আবারো দায়সারা জবাব,
‘যেভাবে গিয়েছিলাম সেভাবেই ফিরে এসেছি।’
চলবে❤️