বৃষ্টি তোমাকে দিলাম পর্ব-২৩

0
215

#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পর্ব-২৩

ধারা চোখ মেলে নিজেকে আবিষ্কার করল হাসপাতালের বিছানায়। আসমানি রঙা দেয়াল, মাথার কাছে বড় জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া দিনের আলো আর বাতাসে উড়তে থাকা সাদা পর্দা। জায়গাটা চেনা, আবার চেনা নয়। সে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়ে রইল বিছানায়৷ কাউকে দেখতে পেল না আশেপাশে। একসময় উঠে বসল। শেষবার যখন জ্ঞান হয়েছিল তখন দেখা হয়েছিল রাশিকের সাথে। রাশিক একটা মিস্ট্রির নাম। ধারা চেষ্টা করেও সমাধান করতে পারবে না হয়তো। কিছু একটা হয়ে গেছে তার জীবনে। অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। মাথায় হিজিবিজি কিছু স্মৃতি রেখে গেছে। অবশ্য তার ধারণা সে প্রায় সুস্থ। মাথার যন্ত্রণাটা শুধু আছে।

দরজা ঠেলে যে মানুষটা ঢুকল তাকে দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে হলো ধারার। বাবা!

বাবা দ্রুত পায়ে হেঁটে ধারার বিছানার কাছে চলে এলেন৷ ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, “কেমন আছিস মা?”

ধারা ছলছল চোখে অভিমানী গলায় বলল, “তুমি এতদিন কোথায় ছিলে বাবা?”

“বাড়িতে। তোকেও নিয়ে যাব এবার।”

খুশিতে ঝিকমিকিয়ে উঠল ধারার চোখ। অবশ্য সেই থাকে একটা আশঙ্কা উঁকি দিয়ে গেল মনে।বাড়িতে গেলে বর্ষণের সাথে আবার দেখা হবে!

ধারা জিজ্ঞেস করল, “মা আসেনি?”

“আসছে। কথা বলছে তোর ডাক্তারের সাথে।”

“শাহেদ?”

“হ্যাঁ।”

“আমি যে বাড়িটাতে ছিলাম সেটা কার বাড়ি ছিল বাবা? আমি তোমাদের কথা রোজ জিজ্ঞেস করতাম। কোথায় আছি জিজ্ঞেস করতাম। লোকটা কিচ্ছু পরিষ্কার করে বলত না।”

“ওর চিকিৎসা পদ্ধতিই আলাদা। কী করে আমরাও বুঝি না। তবে তুই এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়েছিস সেটা ওর জন্যই।”

ধারার অনেক ইচ্ছে হলো প্রশ্ন করে এর মাঝে কতদিন পার হয়েছে। কিন্তু সাহস হয় না। শাহেদও নিজ থেকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি।

বাবা বলে চলেছেন, “ওই বাড়িটা তোর জহুরুল চাচার। মনে আছে তার কথা?”

“ছোটোবেলায় বাসায় আসত যে?”

“হ্যাঁ। এই হসপিটালটা তো তারই। তার সাথে যোগাযোগ করে ভর্তি করেছি তোকে। যে বাড়িটাতে ছিলি সেটা খুব সুন্দর না?”

“হ্যাঁ৷ দারুণ সুন্দর।”

“এই হাসপাতালেরই একটা অংশ সেটা। এক বিশাল বড়লোকের ছেলের মানসিক সমস্যা হয়েছিল যখন তখন ওই বাড়িটা সে করেছিল ছেলেকে রাখার জন্য৷ এখান থেকে একেবারে কাছেই সেটা। ছেলে ভালো হয়ে যাওয়ার পর সেই লোক হাসপাতালকে দান করে দিয়ে গেছে বাড়িটা। স্পেশাল রোগীদের রাখা হয় সেখানে। শাহেদের অনুরোধে তোকে সেখানে নেয়া হয়েছিল।”

ধারা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমার সুস্থ হতে আর কতদিন বাকি বাবা?”

“এবার ছেড়ে দেবে তোকে দেখিস।”

তার এবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল, তার আসলে কী হয়েছে। কিন্তু এবারেও সাহস হলো না। অবশ্য শাহেদ বলেছে একে একে তার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া হবে। দেখা যাক কী হয়! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ধারা।

তখনই ঢুকলেন মা। মায়ের মুখটা মলিন হয়ে আছে। মা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন ধারাকে। কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই আমাকে চিনতে পারছিস ধারা?”

ধারা হাসিমুখে বলল, “কেন চিনব না মা?”

“যখন বেশি অসুস্থ ছিলি তখন আবোল তাবোল বলতি।”

বাবা মৃদু ধমকে বললেন, “আহ, এসব বোলো না ওকে।”

মা চুপ হয়ে গেলেন। ধারাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। তবে বাবার অগোচরে ফিসফিসিয়ে টুকটাক প্রশ্ন চলতে থাকল।

“ওই বাড়িতে কেমন ছিলি?”

“ভালোই।”

“ছেলেটার চরিত্র ভালো তো? আমি তোকে দিতে চাইনি। তোর বাবা বলল ছেলেটা ভালো। কিছু করবে না। আবার নাকি দেখাশুনা করতে মহিলা ছিল?”

“হ্যাঁ।”

“তবু ভরসা পাইনি। আমি থাকতে চেয়েছিলাম, তাও দিল না।”

“কোনো সমস্যা হয়নি তো মা।”

“উপকার হয়েছে কিছু?”

“হ্যাঁ। ওই বাড়িতে যাওয়ার পর মনে হচ্ছিল সুস্থ হয়ে গেছি।”

“তাহলে আবার এখানে আনতে হলো কেন?”

ধারা জবাব দিতে পারল না। সে নিজেও তো উত্তর জানে না। রাশিককে দেখে সব এলোমেলো হয়ে গেছে!

মা বাবা বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না। তারা চলে যাওয়ার পর ধারার খাওয়াদাওয়া সারতে হলো। তারপর এলো শাহেদ।

শাহেদকে সাদা এপ্রোনে বেশ লাগছে!

শাহেদ হাসিমুখে প্রশ্ন করল, “ঘুম হলো?”

ধারা ক্লান্ত স্বরে বলল, “আপনি কি আদৌ আমাকে রাশিকের ঘটনা খুলে বলবেন?”

“ডায়েরিদুটোর কথা ভুলে যাও ধারা।”

“কেন ভুলব? প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেলে আমি সুস্থ হব না।”

“সুস্থ হওয়ার জন্যই তোমার মাথায় প্রশ্ন আসা দরকার ছিল। সেজন্যই ডায়েরি পড়তে দিয়েছিলাম। তুমি যাতে সত্য মিথ্যার পার্থক্য করতে পারো। বলো তো তুমি আপাতদৃষ্টিতে কোন জিনিসটাকে সত্য বলে ধরে নেবে?”

“যেটা আমি চোখে দেখব।”

“ঠিক। আর সেটাই তোমার স্মৃতিতে থাকবে। আমরা দিনরাত অজস্র জিনিস কল্পনা করি। সবই কি আমাদের মাথায় থাকে? বেশিরভাগ কথা আমরা ভুলে যাই। কল্পনার অংশ ভুলি। বাস্তবে ঘটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা চরিত্রদের আমরা ভুলে যাই না।”

“তার মানে?”

“তার মানে এই যে, মনে করো তোমার যা মনে আছে সেটাই সত্যি। বাকি ডায়েরির কথাগুলো কল্পনা।”

ধারা ভীষণ অবাক হয়ে বলল, “ওগুলো আমি কল্পনা থেকে লিখেছি?”

“হ্যাঁ।”

“আমি কি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম?”

শাহেদ নরম সুরে বলল, “পাগল না ধারা। মানসিক অস্থিরতার মধ্যে ছিলে তুমি যেটা স্বাভাবিক হতে দিচ্ছিল তা তোমায়। ব্যাস এই-ই!”

ধারা চুপচাপ বসে রইল। এমন ঘটনা সে পড়েছে। কিন্তু নিজের সাথে হতে পারে এমনটা কল্পনা করেনি। পৃথিবীর বেশিরভাগ জিনিস হয় ভাবনার অতীত।

শাহেদ জিজ্ঞেস করল, “আর কী জানতে চাও?”

“রাশিক…”

“রাশিকের কথা ভুলে যাওয়াই ভালো ধারা। সে একজন ফ্যামিলি ম্যান।”

“ওনার জন্য আমার কোনো অনুভূতি নেই। এটাই জানতে চাইছিলাম যে বিয়ে করেছে কি না।”

“করেছে।”

“আচ্ছা…” জিজ্ঞেস করতে করতে আটকে গেল ধারা।

“বলো, প্রশ্ন করো। তুমি প্রশ্ন করার ক্ষমতা আর সত্যটাকে গ্রহণ করার মতো মানসিক অবস্থায় এলেই বুঝব সুস্থ হয়ে গেছ। বাড়ি যেতে পারবে তারপর।”

ধারা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে, “কতদিন ধরে আমি এখানে আছি?”

“সাত মাস।”

ধারা চমকাল, সাথে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বয়ে গেল বুক চিরে।

শাহেদ হেসে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী ভেবেছিলে?”

“কয়েক বছর কেটে গেছে।” বলে হেসে ফেলল সেও।

সুমাইয়া আমান নিতু