#বৃষ্টি_নামার_পরে❤
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩
২০.
“দুপুরবেলা সবাই খাওয়া শেষ করে ভাতঘুম দিয়েছে। মৃন্ময় অফিসে,অনেকক্ষণ একা একা শুয়ে থেকে গুঞ্জনের ঘুম আসছিলো না।তাই উঠে দাদীমার ঘরে চলে গেলো।দাদীমা ঘুমুননি,গুঞ্জন সোজা দিদার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল,বিকেল।অনেকক্ষণ একথা-সেকথা বলে হাসাহাসি করলো। এক পর্যায়ে গুঞ্জনের বাবা-মায়ের কথা আসলো প্রসঙ্গত ভাবে।দাদীমা শান্ত গলায় বললেন,
-“আমার গুঞ্জনটা এই ক’দিন কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলি। তুই চুপচাপ থাকলে বাড়িটা আজকাল কেমন গুমোট হয়ে থাকে, ভালো লাগে না।অনুর বাড়াবাড়ি সহ্য হয় না,নিজের নাতনি বলে কিছু বলতেও পারি না।এমন পরিবেশে কেউ কি ভালো থাকতে পারে?”
“গুঞ্জনের চোখের কোণে জল।ওর গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না,জড়িয়ে যাচ্ছে।তাও কোনোমতে বললো,জানো তো দিদা? আমি প্রথম প্রথম বুঝতামই না কেন সবাই আমার সাথে এমন করে?সবাই কী মনে করেছে আমি লোহা?পাথর?আমাকে কষ্ট দিলে ওরা ওদের ছেলেকে ফিরে পাবে?আচ্ছা দিদা,ও তো আমারই ভাই ছিলো। দুজনেই তো একইসাথে, একই সময়ে মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিলাম?একই সাথে পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম?তাহলে ওর মৃত্যুতে সবাই আমাকে দায়ী করে কেন?আমায় অপয়া বলে কেন?আমার ভাইকে কি আমি মেরে ফেলেছি?আব্বু বলে আমি নাকি ওদের কাছে ফুরিয়ে গেছি?আমার কোনো প্রয়োজন নেই?আমাকে নাকি কেউ কোনোদিন ভালোবাসবে না,আমার নাকি সেই যোগ্যতা নেই!তুমি বলো দিদা,এসব কি সত্যি?হুম?”
“দাদীমার চোখেও জল।কোনোমতে সেটা গোপন করে বললো,না!তুই ভালো মেয়ে,তোর কিসের দোষ যেখানে তুই কিছু করিসইনি?তুই সবার ভালোবাসার যোগ্য। দেখিস,একদিন তুই সবার ভালোবাসা পাবি।তোকে ভালোবাসতে ওরা বাধ্য।সেদিন আসতে আর খুব বেশি দেরি নেই বোনু।তুই আমার কথা মিলিয়ে নিস!”
” গুঞ্জন দিদার কোলে মাথা রেখে নিজের না বলা গোপন কথাগুলো বলছে,কাঁদছে।ওর নিজেকে যেন খুব হালকা লাগছে।কথাগুলো বলে যাচ্ছে দিদার কাছে,যদি আর কোনোদিন কারো কাছে কথাগুলো বলার সুযোগ না হয় তাহলে?কারো কাছে তো বলা উচিৎ, নইলে কেউ গুঞ্জনকে মনে রাখবে কি কখনো?আসলে এই পৃথিবীতে গুঞ্জনকে মনে রাখার মানুষ বলতে গেলে নেই-ই!তাই কাউকে জানিয়ে রাখাটা খুব প্রয়োজন!কান্নাভেজা কন্ঠে আক্ষেপের সুরে বললো,সেদিন আসতে না বেশি দেরি হয়ে যায়!”
“দাদীমা গুঞ্জনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।প্রত্যেকবার নামাজ পড়ার সময় তিনি গুঞ্জনের জন্য নির্দিষ্ট সময় নিয়ে দো’আ করেন।এই দুঃখী মেয়েটি যেন ভালো থাকে, সুখে থাকে সেই প্রার্থনা করেন।তিনি চোখের পানি মুছে গুঞ্জনকে কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই সময়ই অনু এলো ঘরে।দরজায় দাঁড়িয়ে গুঞ্জনের উদ্দেশ্যে বললো,
-” তুমি এখানে কি করছো?”
“গুঞ্জন চোখ মুছে বললো, দিদার আদর খাচ্ছি!”
“অনু অহংকারী গলায় বললো, তোমাকে সবসময় খালি এর আদর ওর আদর খেতেই দেখা যায়,ফাজিলের মতোন।”
“গুঞ্জন দাদীমার কোল থেকে উঠে আসলো।অনু’র হাত ধরে দিদার রুম থেকে বেরিয়ে এসে করিডোরে এসে দাঁড়ালো।অনুর হাত ছেড়ে দিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,তুমি কি বলতে চাচ্ছো সরাসরি বলবা?”
“অনু রেগে বললো,তুমি এসব করেই মুনুকে ভুলিয়েছো, তাই না?নইলে মুনু কখনোই তোমার মতো মিডেলক্লাস আনস্মার্ট মেয়েকে বিয়ে করতো না!”
“গুঞ্জন ভ্রু কুঁচকে বললো, ওহ তাই নাকি?তাহলে কাকে করতো শুনি?”
“অনু বললো,এই যে আমার মতো। আই মিন আমাকে করতো।আমি অনেক স্মার্ট এবং মুনুর পছন্দমতো।মুনু তো তোমাকে পাত্তাই দেয় না!”
“গুঞ্জন বিরক্ত হয়ে বললো, তোমার এসব আজাইরা প্যানপ্যানানি, ঘ্যানঘ্যানানি নিজের কাছেই রাখো।তোমার মতো ক্ষেত না আর দুনিয়ায় নেই,বুঝলা?সেই জন্যই তোমার মুনু আমার মতো স্মার্ট মেয়েকে বিয়ে করেছে।বুঝলা?সারাদিন তো আঠার মতো ওনার পেছনে পড়ে থাকো,দেয় পাত্তা
উনি তোমাকে?বাঁদরের মতো গলায় ঝুলে থাকতে চাও,বেহায়া মেয়ে।আবার আমায় বলো আনস্মার্ট?মুনু মুনু বলে ন্যাকামি বন্ধ করো।আর তোমার ওই মুনুকেই বা কে পাত্তা দেয় যে আমি গুঞ্জন তোমার আদিক্লামি মুনুকে পাত্তা দিবো?যত্তসব!”
“অনু জ্বলন্ত চোখে গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললো,
গুঞ্জন!তুমি কিন্তু নিজেকে খুব বেশি চালাক ভাবছো!তোমার এসব কাজকর্মের ফল ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।আমায় তুমি অপমান করছো কিন্তু!”
“গুঞ্জন মৃদু হেসে বিরক্তমাখা কন্ঠে বললো, আমার উপর রাগের কারণটা জানতে পারি কি?আমি কি এমন কাজকর্ম করলাম যে এর ফল ভালো হবে না?হুয়াই?আর অফকোর্স তোমাকে আমি অপমান করছি এবং ভবিষ্যতে তোমার এসব ফালতু কাজকর্ম দেখলে সবার সামনেই তোমাকে অপমান করবো,দরকার পড়লে জুতো দিয়ে বারি ও দিবো।তাই এমন কোনো কাজ করো না,যাতে আমি এসব করতে বাধ্য হই,গট ইট!”
“বলেই গুঞ্জন মুখ ঝামটা দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।আর রাগে অনু কাঁপছে,তাকে এত ইনসাল্ট করে গেলো ওই আনস্মার্ট গুঞ্জন?ভাবতে পারছে না ও!”
২১.
“কুয়াশা ঢাকা এক গোধূলি সন্ধ্যা তখন,যখন বিকেলটা মরে এসেছে!আশেপাশে জানান দিচ্ছে অসংখ্য পাখির দল!কিচিরমিচির আওয়াজে পুরো এলাহি কান্ড!চড়ুই পাখিটা গুঞ্জনের চোখের সামনে দিয়ে ফুড়ুৎ করে উড়াল দিলো আকাশে।পাখিটা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত গুঞ্জন জানালা দিয়ে ওদিকে একমনে তাকিয়েই রইলো। পাশে বসে আছে মৃন্ময়ের কাজিন নাবিলা,আর আরিশা।নাবিলা হলো অনু’র ছোট বোন।অনু যতই অহংকারী,উশৃংখল ঠিক তার বিপরীত হলো নাবিলা!সাদাসিধে, মিষ্টি মনের মেয়ে। সবার সাথে অল্প সহজেই মিশে যেতে পারে,বয়সে অনু’র দু’বছরের ছোট হবে।তো তিনজন মিলে গল্প করছিলো ঠিক এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে মৃন্ময়ের চাচীমা নাবিলাকে ডাকা শুরু করলেন।একটুও না থেমে তিনি মেয়েকে একনাগাড়ে ডেকেই চলেছেন!শুনতে পেয়ে নাবিলা তার মাকে বললো,’এনিথিং রং, মাম্মি?”
-“নো মাই চাইল্ড!তোমাকে এতক্ষণ ধরে ডাকছি তো, শুনতে পাচ্ছো না,এসো!”
-“ইয়াহ! আই এম স্যরি!”
-“ইট’স ওকে!”
“নাবিলা গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো।বললো,থ্যাংকস আপ্পি।তোমার সাথে থেকে আমার মুড ভালো হয়ে গিয়েছে।আমি মাম্মির সাথে যাচ্ছি ড্রইংয়ে।”
“গুঞ্জনও নাবিলাকে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলো।বললো, ঠিক আছে।আমরা পরে আবার গল্প করবো!”
“মৃন্ময়ের চাচীমা গুঞ্জনকে বললো, তোমরাও নিচে চলে আসো।আসলে অনু মৃন্ময়ের জন্য নাস্তা বানাচ্ছে তো,তাই!ওর জীবনের প্রথম রান্না!”
“গুঞ্জন অবাক হলো।আরিশার দিকে তাকিয়ে দেখে ও মুচকি হাসছে।চোখের ইশারায় গুঞ্জনকে যেতে বলছে।গুঞ্জন বুঝতে পেরে বললো, আসছি।”
“গুঞ্জনরা এতক্ষণ আরিশার রুমে বসে ছিলো।অনু’র রান্নাবান্না নামক লাইভ সিরিয়াল দেখার জন্য আরিশাকে সঙ্গে করে বসার ঘরে নিয়ে আসলো গুঞ্জন।সোফায় বসে আরিশাকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলো, আরু তুমি ওইসময় মিটিমিটি হাসছিলে কেন?”
“গুঞ্জন যেন খুব মজার একটা কথা বলেছে।আরিশা হেসে বললো,অনু আপ্পির রান্নাবান্নার কথা শুনে।”
“গুঞ্জন বললো, হাসার কি আছে?”
-“হাসার কি নেই বলো তো।চাচীমা বললো যে,ওর জীবনের প্রথম রান্না।এটা কি হাসার কথা নয়?”
-“অফকোর্স নয়।হতেই তো পারে প্রথম রান্না।”
-“ভুল আপ্পি।যতবার দেশে আসে ততবারই ভাইয়াকে ইম্প্রেস করার জন্য এই মেয়ে ন্যাকামি করে রান্না করার।রান্না সে কিছুই জানে না অথচ কেউ সাহায্য করতে গেলে বলে ও হচ্ছে অনু আর অনুর কোনোকিছুতেই কারো হেল্প লাগবে না,একাই পারবে।কাউকে কোনোকিছুতে হাত লাগাতেই দেয় না।অবশেষে সারাবাড়ি তোলপাড় করে একগাদা আজাইরা আইটেম রান্না করে,সে খাবার মুখে দিলে দশদিনের রুচি চলে যায়।বুঝলে?”
“গুঞ্জন বললো,কিছু পারে না তাতেই এতো ভাব?”
-“হুম!”
-“দেখি আজ কি কোর্মা-পোলাও রান্না করে!”
-“রান্না করলেও দিবে নাকি? দাদাভাইকে খাওয়াবে জোর করে।প্রথমবার যখন রান্না করেছিলো তখন অবশ্য বাসার সবাই খেয়েছে,তবে পরে বমি করতে করতে একেকজনের হুঁশ নেই।”
“গুঞ্জন বললো,তা তোমার দাদাভাই কি রেসপন্স করেছিলো?”
-“বেচারার মুখ রাগে লাল-নীল,কমলা হয়ে গিয়েছলো,কিন্তু সবার সামনে তা প্রকাশ করেনি,এরপর থেকে অনু আপি যতবার রান্না করেছে সেদিনগুলোতে অফিস থেকে খেয়ে আসে দাদাভাই।আসলে একে কিছু বলতে পারে না।”
“গুঞ্জন সন্দেহী গলায় বললো, কেন?”
-“কেউ কিছু বললেই ভ্যা করে কেঁদে একটা সিনক্রিয়েট করে।সেজন্য কিছু বলে না!যতটা পারে ওকে এড়িয়ে চলে।তবে এই ছাগলী ওর পিছু ছাড়ে না!”
“গুঞ্জন আর কিছু বললো না।চুপ করে আরিশার পাশে বসে রইলো।দেখার অপেক্ষা এই ঢংগী কারো হেল্প ছাড়া কি রান্না করে,আর সেই খাবার খেয়ে ওর মুনুই বা কি রেসপন্স করে।”
___________
২২.
“রাত প্রায় দশটায় মৃন্ময় বাসায় ফিরলো।আর তখনই শুরু হলো অনু’র হামলা।ওর রান্না খাবার খাওয়ার জন্য মৃন্ময়কে অনেক জোর করলো, কিন্তু মৃন্ময় না করে দিলো।পরক্ষণেই আবারও যখন জোরাজুরি শুরু করলো অনু তখন মৃন্ময় সবার সামনেই অনুকে একটা রামধমক দিয়ে ফেললো।আর বেচারি মুখ ফুলিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।সবাই অবাক হয়ে দেখছিলো মৃন্ময়ের কান্ড।আর গুঞ্জন এসব দেখে হতভম্ব হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো।দেখে মনে হচ্ছে কারো উপর প্রচন্ড রেগে আছে,কিন্তু কার উপর রেগে আছে গুঞ্জন সেটা বুঝতে পারলো না।আরিশা মুখ ভার করে চুপিচুপি এসে গুঞ্জনের পেছনে দাঁড়ালো। গুঞ্জন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বললো, দাদাভাই বোধহয় আজকে প্রচন্ড রেগে আছে।”
-“কার উপর রেগে আছে জানো?”
-“না আপ্পি!”
-“এতদিন তো উনার এই রুপ দেখিনি!”
-“দেখবে কিভাবে?ভাইয়া যে রাগে তা বেশিরভাগ সময়ই প্রকাশ করে না,কিন্তু যখন আর সহ্য করতে পারে না তখন মনে করো দুনিয়া উল্টে গেলেও কারো কথা শুনবে না।কি যে করে তখন,তুমি বিশ্বাসই করতে পারবে না।কেউ কিছু বলতেই পারে না,দেখলে না অনু আপ্পিকে কিভাবে ধমক দিলো।”
“গুঞ্জন চিন্তিত হয়ে বললো, হুম!”
“কাউকে কিছু না বলে,না খেয়ে মৃন্ময় উপরে ঘরে চলে গেলো।ও যেতেই বাসার সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে যার যার ঘরে ঘুমুতে চলে গেলো।গুঞ্জনও একপ্রকার ভয়ে ভয়ে রুমের দিকে যেতে নিলো।কিন্তু মৃন্ময়ের এই নতুন রুপ দেখে সেই সাহসটা আর করতে পারেনি।পা ঘুরিয়ে ছুট লাগালো আরিশার ঘরের দিকে।”
“আরিশা গুঞ্জনকে দেখে অবাক হয়ে বললো,কিছু হয়েছে আপ্পি?”
“গুঞ্জন মৃদু হেসে বললো,না।আমি আজ তোমার সাথে থাকবো!”
“আরিশা হেসে বললো,বুঝতে পেরেছি।দাদাভাইয়ার ভয়ে,তাই না?”
-“বলতে পারো।”
-“ঠিক আছে।এখানে শুয়ে পড়ো!”
“গুঞ্জন আরিশার পাশে শুয়ে পড়লো।কিছুক্ষণ এপাশওপাশ করে আরিশা এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লো।আর গুঞ্জন ভাবছে,কি হবে কিছুদিন পর!কি লিখা আছে ওর ভাগ্যে?”
“গুঞ্জন এসব কিছু ভাবছে ঠিক এসময় মনে হলো কেউ একজন আরিশার ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকছে।অন্ধকারে লম্বা অবয়বটা দেখে গুঞ্জন ভয় পেয়ে যে-ই না চিৎকার করে আরিশাকে ডাকতে যাবে ঠিক সেসময়ই কে যেন ওর মুখ চেপে ধরলো।কিছু বুঝে উঠার আগেই ওকে কেউ পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো।অন্ধকারে অবয়বটা গুঞ্জনের কানের কাছে মুখটা নিয়ে সম্মোহিত গলায় বললো,আমার বউ আমাকে রেখে অন্য ঘরে ঘুমাবে?দিস ইউ নট ফেয়ার মিসেস মৃন্ময় চৌধুরী।এর পানিশমেন্ট পেতে হবে!”
“এতক্ষণে গুঞ্জনের কলিজায় পানি এলো।এ যে মৃন্ময় ছাড়া আর কেউ নয় সেটা বোঝার আর বাকি নেই।ততক্ষণে ওরা নিজেদের ঘরে এসে পড়েছে।মৃন্ময় রুমে এসে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিলো।গুঞ্জনকে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে ওর দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টি দেখে গুঞ্জন দমে গেলো।পিছাতে পিছাতে বিছানার এক কোণে চলে গেলো।”
“মৃন্ময় গুঞ্জনকে পিছুতে দেখে জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো, হা.. ই হাই ডিয়া..র..!”
“গুঞ্জন ভয়ে ঢোক গিলে বললো,আ..আপনি এভা…ভাবে কথা বল..ল.ছেন কেন?”
“মৃন্ময় বিছানায় ঠাস করে শুয়ে পড়লো।বললো,চা টা ভীষণ চমৎকার। আমার না চা’য়ে চুমু খেতে ইচ্ছা করছে!”
“গুঞ্জন চোখ বড়বড় করে তাকালো।অবাক হয়ে বললো,চা?চা…কোথায় পেলেন?আর আপনার কথা এভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে কেন?”
“মৃন্ময়ের হাতে একটা কাচের বোতল। তাতে তরল কিছু পদার্থ আছে। উঠে বসে বোতলটা গুঞ্জনকে দেখিয়ে বললো,এই যে!ভীষণ মজার চা!”
“গুঞ্জন এতক্ষণে বুঝলো এই ব্যবহারের কারণ।বেচারা তো নেশায় বুঁদ হয়ে আছে।তাই উল্টাপাল্টা কথা বলছে।”
“মৃন্ময় হঠাৎ করেই গুঞ্জনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। জড়ানো গলায় বললো, ইউ আর ট্র্যাপেড বাই আ হোর!এনিওয়ে দ্যাট ডাজ’ন্ট ম্যাটার একচুয়েলি,,বাট দ্যা ম্যাটার…!”
“হতভম্ব গুঞ্জন বললো,আপনি এসব উল্টাপাল্টা কি বলছেন?নেশা করে মাথা পুরাই গেলো নাকি?”
“মৃন্ময় আবারও বললো, আই মিন তুমি তো কম একট্রাকটিভ নও।”
-“হোয়াট ডু ইউ মিন?এ্যাম আই আ হোর!গেট লস্ট!আপনার প্যানপ্যানানি বন্ধ করুন প্লিজ!”
“মৃন্ময় ধমক শুনে ঘুমঘুম গলায় বললো,তুমি আমাকে বকছো কেন?তুমি কি আমায় ছেড়ে চলে যাবে?আরে,তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছো কেন?দাঁড়াও প্লিজ…আমি তোমার জুতা লুকিয়ে ফেলেছি!”
“গুঞ্জন অবাকের সপ্তম আকাশে পৌঁছে বললো, এই যে মিস্টার মৃন্ময় চৌধুরী! আপনি কিসব আবোলতাবোল বকছেন?আমি এখানে বসে আছি!”
“মৃন্ময় হঠাৎ উঠে বসলো।গুঞ্জন ওর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো,চুল উষ্কখুষ্ক, চোখ,হাত-পা,গাল টকটকে লাল হয়ে আছে।সম্ভবত ড্রিংকস করার কারণে। কিন্তু বিয়ের পর এই কয়েকমাসে তো ওকে সিগারেট খেতেই যাকে দেখা যায়নি, সেখানে আজ কি এমন হলো যে একে নেশা করতে হলো?ভেবে কিছু পেলো না গুঞ্জন।”
“মৃন্ময় গুঞ্জনের চুলগুলো খুলে দিলো।পিঠে ছড়িয়ে পড়লো এলোকেশী লম্বা চুলগুলো।কিছু বুঝে উঠার আগেই গুঞ্জনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো মৃন্ময়।গুঞ্জন ঠেলে সরে যেতে চাইলেই নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো গুঞ্জনকে।আর এদিকে গুঞ্জন শ্বাস নিতেই পারছে না।গরম অনুভূত হতেই গুঞ্জন মৃন্ময়ের কপালে হাত রাখলো,জ্বরে পুরো গা পুড়ে যাচ্ছে।ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা মৃন্ময়। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছিলো গুঞ্জনের গালে।ঘুমের ঘোরেই মৃন্ময় নাক ডুবালো গুঞ্জনের চুলে।অস্ফুটস্বরে বললো,রুহি তুমি মিথ্যা বলছো, তাই না?”
“গুঞ্জন চমকে উঠলো।এই রুহি আবার কি বলেছে?”
“যাইহোক,জ্বরের জন্য মৃন্ময় কিসব আবোলতাবোল বলছে।গুঞ্জন তাতে পাত্তা না দিয়ে মৃন্ময়ের মাথায় পানি দেবার কথা ভাবলো।উঠতে গিয়ে দেখে ওর চুলের উপর শুয়ে ওকে ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরে আছে,যাতে কোনোভাবেই গুঞ্জনের পক্ষে উঠা সম্ভব নয়।হতাশ হয়ে শুয়ে পড়লো আবারও।একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।”
“মাঝরাতের দিকে হঠাৎ গুঞ্জনের ঘুম ভাঙলো।তখন অনেক চেষ্টা করে মৃন্ময়ের পাগলামি বাদ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।মৃন্ময়ের মাথায় পানি দিয়ে দিলো,ঘুমের মাঝেই ঔষধ খাইয়ে ওকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।”
“করিডোর পেরিয়ে ড্রইংরুমের ব্যলকুনিতে আসতেই দেখা হয়ে গেলো নাবিলার সাথে। ব্যলকুনিতে চেয়ার পেতে বসে আছে।গায়ে ঘুমের পোশাক।গুঞ্জনকে দেখে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করল,আপ্পি!তুমি এখানে?কোথাও গিয়েছিলে?”
“গুঞ্জন মজা করে হেসে বললো,তোমার জন্য বয়ফ্রেন্ড খুঁজতে সিস্টার!”
-“নো ওয়ে।নিশ্চয়ই দাদাভাইয়ার সাথে ছোটখাটো ঝগড়া?”
“গুঞ্জন হেসে বললো, হুম।এমনিই ঝগড়া।এখন বলো,তুমি কি করছিলে?ঘুমুওনি এখনো যে?”
-“আই নো, তুমি জানো কিনা?আমার রাতে মাম্মির সাথে না থাকলে ঘুম আসে না,ইভেন মাম্মি যতক্ষণ না আমার কপালে কিস করে আমাকে আদর করে দিবে ততক্ষণ আমার ঘুমই আসেনা।”
“গুঞ্জন মৃদু হেসে বললো, তাই?তা তোমার অনু আপ্পির সাথে থাকলেই চলে!দুজন একসাথে ঘুমুতে পারো না?”
-“পাগল!ওর সাথে থাকে কে?ইভেন ও কাউকে ওর সাথে থাকতে দেয় না।আর আমিও ওর সাথে থাকি না,মানে সারা বিছানা দখল করে শোবে,হাত-পা নাড়াবে।আমি একদমই পছন্দ করি না।বাই দ্যা ওয়ে,তোমাকে তোমার আম্মু এভাবে আদর করে ঘুম পাড়াতো না?”
“গুঞ্জন কি বলবে ভেবে পেলো না।তাই চুপ করে রইলো।”
“নাবিলা একটু মজা করে চোখ টিপ মেরে বললো,এখন আর কিভাবে আদর করবে, এখন তো দাদাভাইয়াই তোমাকে আদর করে,হা হা হা!আর দাদাভাই না করলে কি তুমি আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিবে,হা হা!”
“গুঞ্জন বিস্ময় নিয়ে বললো,কি বলছো!আমি কখনো চুমু দিতে শিখিনি!বলেই মুখে হাত দিলো।ছিহ,কি বলে ফেললো রে।”
“নাবিলা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। বললো,নো টেনশন।না পারলে সমস্যা নেই!একজন নিশ্চয় শিখিয়ে দেবে!দরকার হলে আমি শিখিয়ে দেবো!!
“চকিতে ভ্রু কুঁচকে গুঞ্জন তাকালো নাবিলার দিকে!চমকানো গলায় জিজ্ঞেস করলো,কে?”
“নাবিলা কিছু বললো না,রহস্যময়ী হাসি ঠোঁটের কোণে… এনজয় এভরি মোমেন্ট অফ ইউর লাইফ উইথ ইউর লাইফ পার্টনার।”
“চকিতে চমকে উঠা গুঞ্জন তখনো তাকিয়েই আছে গালে টোল পড়া মিষ্টি হাসির মেয়ে নাবিলার দিকে।কালচে-বাদামী চুলে তাকে এই রাতেও সূর্যের আলো মনে হচ্ছে।নাবিলার ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে আছে,ঘুমের পোশাকের উপর সাদা ফুলের ছাপ রয়েছে, সেই রহস্যময়ী হাসিতে নাবিলাকে এই মুহূর্তে দেবী দেবী লাগছে!মৃন্ময়ের করা সকালের আর একটু আগের সেই ঘটনার কথা মনে হতেই গুঞ্জনের হঠাৎ করে খুব লজ্জ্বা লাগছে।ভীষণ লজ্জ্বা!লজ্জ্বায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে!”
চলবে…ইনশাআল্লাহ!