বৃষ্টি নামার পরে পর্ব-২১

0
3986

#বৃষ্টি_নামার_পরে❤
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২১

৩৭.
“মৃন্ময়ের চোখে জল।চাঁদের আলোয় ওর ফর্সা মুখখানা দেখে গুঞ্জনের খুব খারাপ লাগছে। গুঞ্জন মৃন্ময়কে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ হু হু করে কেঁদে দিলো।কাঁদতে কাঁদতে একসময় হিঁচকি উঠে গেলো।মৃন্ময় গুঞ্জনকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।কাঁদুক না মেয়েটা,সারাজীবন তো কষ্ট পেয়েই এসেছে।কিভাবে সামলাবে সে গুঞ্জনকে বুঝতেই পারছে না।এতবড় কথাটা জেনে গুঞ্জনের ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে সেটা মৃন্ময় যদি বুঝতে পারতো তাহলে সেই কষ্টের একটা বিরাট ভাগ ও নিজের কাঁধে নিয়ে নিতো।কিন্তু আফসোস!গুঞ্জনের এতো বড় অসুখের ভাগটা ও নিতে পারছে না।ওর খুব কষ্ট হচ্ছে,গুঞ্জনের মাথায় হাত রেখে মৃন্ময় গম্ভীর গলায় বললো,আমাকে যে ভালোবাসো এতদিন বলোনি কেন?”

“গুঞ্জন ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো,আপনিও তো বলেননি!তাই আমিও বলিনি!”

-“রিভেঞ্জ নিচ্ছিলে?”

-“ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে রিভেঞ্জ নেওয়া যায়?”

-“হয়তো না!কিন্তু তুমি যে নিচ্ছো গুঞ্জন!”

“গুঞ্জন মুখ তুলে চাইলো মৃন্ময়ের দিকে।কেঁদেকেটে চেহারার অবস্থা লাল।বললো,আমি কোথায় রিভেঞ্জ নিলাম?”

“মৃন্ময় গম্ভীর গলায় বললো,এই যে!বারবার আমার থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছো!আমি হয়তো কোনো না কোনোভাবে তোমায় আটকে দিতাম।কিন্তু তুমি আমাকে এমন একটা সিচুয়েশনে এনে দাঁড় করালে যে আমি কিভাবে তোমাকে সারাজীবনের জন্য নিজের সাথে বেঁধে রাখতে পারবো সেটাই ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে।বলো গুঞ্জন,কিভাবে পারবো?”

“গুঞ্জন ফিকে হেসে বললো,আমাকে নিয়ে মানুষ আর যমে টানাটানি হচ্ছে,তাই না?না না,ঠিক মানুষ নয়।আপনি আর যমদূতের মধ্যে টানাটানি হচ্ছে।আসলে আমাকে নিয়ে ভাবার সময় কই অন্যকারো?”

-“গুঞ্জন প্লিজ চুপ করো!”

-“চুপ করলেই তো সত্যটা মিথ্যে হয়ে যাবে না!”

-“আমি তোমার চিকিৎসার জন্য যতকিছু করতে হয়,যেখানে যেতে হয় সেখানে যাবো!সবকিছু করবো।আমার প্রাণভোমরাকে নিয়ে যমদূত টানাটানি করবে সেটা তো হতে পারেনা!”

-“সেটাই হবে। এসব করেও লাভ কিছু হবে না।”

“মৃন্ময় গুঞ্জনকে প্রায় ধমকে বললো,তুমি যদি এখন বাজে কথা বন্ধ না করো তাহলে আমি নিজেই মরে যাবো দেখবে!”

“গুঞ্জন রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মৃন্ময়ের দিকে।ঠাস করে একটা চড় মেরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,আপনি মরবেন কেন?আপনার কি কিছু হয়েছে?আপনি শক্তিশালী ছেলে আপনি আমার থেকে বেশি বাঁঁচবেন!নেক্সট টাইম এসব কথা আমার মতো মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের সামনে বলবেন না!”

-“গুঞ্জন তুমি সবসময় এমন কেন?তুমি না থাকলে আমি কার জন্য বাঁচবো?তুমিও মরার কথা বলবে না নেক্সট টাইম।মাইন্ড ইট!”

“গুঞ্জন মুচকি হেসে বললো, আমার জন্য বাঁঁচবেন।আপনি আমার এপার-ওপার।খুব ভালোবাসি যে আপনাকে!”

“মৃন্ময় ওর কথার পিঠেই বললো,তোমাকে যে আমিও খুব ভালোবাসি গুঞ্জন?কপালে চুমু দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,তুমিও তো আমার একাল-সেকাল!”

“এটুকু বলতেই হঠাৎ করে দৈবাৎ একগুচ্ছ বাতাস হু হু করে বয়ে গেলো ওদের দুজনকে ঘিরে।রাতের আকাশ ধূসর মেঘে ঢেকে গিয়েছে।শুক্লপক্ষের চাঁদটা মেঘের ভিতর ঢুকে কালচে-নীল আভা ছড়াচ্ছে।তারপর কোনো আভাস না দিয়ে যখন ঝুম বৃষ্টি নামলো ওদের দুজনের উপর,তখন গুঞ্জন খিলখিল করে হেসে উঠলো।মৃন্ময় হতভম্ব হয়ে বললো, হোয়াট দ্যা হেল!এটা কি হলো?”

“গুঞ্জন বললো,বৃষ্টি!বৃষ্টি হচ্ছে।”

“মৃন্ময় গুঞ্জনের হাত টেনে ধরে বললো, আরে ভিজে গিয়েছো তো গুঞ্জন।এখান থেকে চলো প্লিজ!তোমার শরীর ভালো নেই!”

“গুঞ্জন মৃন্ময়কে থামিয়ে দিয়ে বললো,চলুন না একটু ভিজি!যদি আর কখনো সুযোগ না হয়?যদি আর বৃষ্টির ছোঁয়া অনুভব না করতে পারি?যদি….যদি এটাই আমার শেষ বৃষ্টি দেখা হয়?আমি তো আর কোনোদিন ভিজতে পারবো না বৃষ্টিতে,তাই না?প্লিজ চলুন একটু ভিজি!”

“মৃন্ময় গুঞ্জনের করুণামাখা চাহনি দেখে আর না করতে পারলো না।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।গুঞ্জন মৃন্ময়ের সাথে বৃষ্টিতে ভিজছে।ওর খুব কান্না
পাচ্ছে,চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে।কিন্তু পারছে না।ওর খুব বাঁচতে ইচ্ছা করছে হঠাৎ করে।নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে গুঞ্জন।কান্নাগুলো বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে।ফলে মৃন্ময় বুঝতে পারছে না যে গুঞ্জন কাঁদছে।বৃষ্টি কিছু কিছু মানুষের কষ্টগুলোকে আড়াল করতে পারে খুব সহজে।”

“বৃষ্টি নামার পরে!
আর কি কখনো সাথে পারো তারে?
হবে কি দেখা?
এই অন্ধকার রাতে,পিচঢালা পথের মাঝে!
উদাস মনের সঙ্গী হবে সে?
আমার জীবনে বৃষ্টি হয়ে নামবে কি সে?
একগুচ্ছ সুবাসিত বৃষ্টির দলেরা,
ফুল হয়ে ফুটবে কি মেঘমেদুর আকাশ পানে?
ঝরে পড়বে কি আমার জীবনে?
বৃষ্টি নামার পরে!”

_____________________

৩৮.
“রাত প্রায় দশটার দিকে ভেজা কাপড়ে বাসায় ফিরলো ওরা।ড্রইংরুমের একদল উৎসুক দৃষ্টি এড়িয়ে গুঞ্জনকে নিয়ে মৃন্ময় রুমে আসলো।মৃন্ময় ফ্রেশ হয়ে গুঞ্জনকে বলে দিলো ফ্রেশ হয়ে আসতে।বাসার সবাইকে এতো রাতে এসব না বলাটাই বেটার।কাল সকালে বলবে আর ভালো করে গুঞ্জনের প্যারেন্টসদের বুঝিয়ে দেবে মেয়েটাকে কি করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে ওরা।হয়তো প্রত্যক্ষভাবে নয়,কিন্তু গুঞ্জনের এই অবস্থার পেছনে পরোক্ষভাবে হলেও ওদের দায় আছে।”

“অনেকক্ষণ কিছু চিন্তাভাবনা করে মৃন্ময় সবকিছু ভালোভাবে বোঝার জন্য কার কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারে ভাবলো।চট করে কিছু একটা মনে হতেই সেলফোনটা হাতে নিলো।”

“মৃন্ময় ওর ছোটবেলার ফ্রেন্ড জেসিকাকে ফোন দিলো।জেসিকা একজন নিউরো সার্জন।তবে এ মধ্যে মুহূর্তে ও কানাডায় আছে।এখন ফেরারও সসম্ভাবনা নেই।জেসিকা বেশ কিছুক্ষণ পর জেস্কা কল রিসিভ করলো।মৃন্ময় কুশল বিনিময় করে তারপর গুঞ্জনের বিষয়ে কথা বলা শুরু করলো।জেসিকা সবকিছু খুব গভীর মনোযোগ নিয়ে শুনলো!”

“মৃন্ময় জিজ্ঞেস করলো,তোকে তো সব বললাম, তুই আমাকে বুঝিয়ে বল প্লিজ!কিছু সমস্যা হতে পারে কি?”

“জেসিকা বললো,হুম! অনেক সমস্যা হয় বা হতে পারে!এ সময়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং কেয়ারফুল থাকতে হয়।তুই গুঞ্জনের খেয়াল রাখিস।এ সময় কিন্তু অসহ্য মাথাব্যথা, গা ব্যথা হয়।তবে বমি হলে ব্যথা খানিকটা কমে। সাময়িক ভাবে আচ্ছন্ন বা অজ্ঞান হয়ে যান কেউ। এর সঙ্গে টিউমার কোথায় হয়েছে তার উপর নির্ভর করে আরও কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন কম দেখা, চোখের কাজ করলে কপাল ব্যথা হওয়া বা বাড়া, ডাবল ভিশন। মুখে অসাড় ভাব, খাবার গিলতে কষ্ট হয়, কানে কম শোনা, মাথা ঘোরা, ভারসাম্য রাখতে অসুবিধে, মহিলাদের হঠাৎ বুকে দুধের সঞ্চার, আচমকা ঋতুবন্ধ, এমনকী বেশি মৃগী হলেও ভাবতে হয় ব্রেন টিউমারের কথা।”

-“কী করবো তাহলে?”

-“একই ধরনের মাথাব্যথা দিনের মধ্যে বারে বারে ঘুরে ফিরে এলে এবং দিনের পর দিন চলতে থাকলে, দিন সাতেকের মধ্যে নিউরোলিজিস্ট দেখাতে হয়,কিন্তু গুঞ্জনের বেলায় তুই দেরি করে ফেলেছিস খুব!”

-“সি টি স্ক্যান, এম আর আই, অ্যাঞ্জিওগ্রামও করতে হয়।চোখ, কান বা অন্য কোথাও সমস্যা থাকলে কিছু বিশেষ টেস্টও করতে হতে পারে।সবগুলো করা হয়েছে?”

-” হুম।ডাক্তার তো তা-ই বললো!সব করেই ওরা নিশ্চিত হয়েছে!তুই বল!”

-“শোন!মস্তিষ্কের প্রতি সেন্টিমিটার জায়গা কোনও না কোনও শারীরিক বা মানসিক কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে অংশেই টিউমার হোক না কেন, যত ছোটই হোক, বিপদের সম্ভাবনা আছে। ছোট টিউমার, উপসর্গ তেমন নেই, দৈবাৎ নজরে এসেছে বা সামান্য উপসর্গ আছে কিন্তু অপারেশন করলে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি তাহলে বিষয়টি খুব ক্রিটিকাল। রোগীকে নজরদারিতে রেখে দেখা হয় টিউমার কী গতিতে বাড়ছে, শারীরিক কষ্ট দেখা দিচ্ছে বা বাড়ছে কি না, টিউমার বাদ না দিলে কী কী ক্ষতির সম্ভাবনা আছে, অপারেশন বা রেডিয়েশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুঞ্জন মেনে নিতে প্রস্তুত কি না ইত্যাদি তা জেনে নিস!অপারেশন করে সুস্থ ভালো জীবন দেওয়া গেলেই অপারেশনের প্রশ্ন।নইলে ভুলেও কিছু করিস না!”

-“কি অপারেশন হওয়ার সম্ভাবনা গুঞ্জনের?”

-“দেখ,কি ধরনের অপারেশন হবে তা নির্ভর করে টিউমারের আকার এবং কোথায় হয়েছে তার উপর। যেমন বড় টিউমার, যদি মনে হয় কিছু না করে রেখে দেওয়া বিপজ্জনক, আবার এত গুরুত্বপূর্ণ টিস্যু এবং নার্ভকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে যে পুরো বাদ দিলে বিপদের সম্ভাবনা আছে, ডি বালকিং সার্জারি করা হয়। অর্থাৎ আশপাশকে কম বিব্রত করে যতখানি সম্ভব টিউমার কেটে বাদ দেওয়া। এতে দু’টো লাভ, প্রথমত, টিস্যু পরীক্ষা করে টিউমারের ধরন নির্ধারণ করা যায়। অপারেশন-পরবর্তী চিকিত্সা মূলত এর উপরই নির্ভর করে। দ্বিতীয়ত রোগী কষ্টের হাত থেকে কিছুটা বা পুরোটা মুক্তি পান।”

-“অপারেশনটা কিভাবে, কোথায় করা হয়?”

-“মাথায় অপারেশন করা যায়, কখনও কম্পিউটারে টিউমারের জায়গা মেপে বাইরে থেকে রেডিয়েশন পাঠিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ছোট বিশেষ ধরনের টিউমারে গামা নাইফ দিয়ে অপারেশন করে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়। বড় টিউমারেও অনেক সময় অপারেশন করে যতটা সম্ভব বাদ দিয়ে বাকিটুকুর জন্য গামা নাইফ ব্যবহার করা যেতে পারে। গামা নাইফ লক্ষ্যকেন্দ্রিক বলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব কম।তাছাড়া ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে অপারেশন এবং রেডওথেরাপি করে ভালো ফল হয়।আমি এ সময় কাছে থাকলে কিছু একটা করতে পারতাম।তুই সবগুলো রিপোর্ট আমাকে পাঠিয়ে দিস!”

-“হুম,পাঠিয়ে দেবো।অপারেশন সাকসেসফুলি হবার পরে কি আর কোনো সমস্যা হয়?”

-“দেখ,অপারেশনের পর রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। তবে জটিল টিউমারে সামান্য কিছু ক্ষেত্রে রোগীর মুখ অল্প বেঁকে যেতে পারে, চোখে ট্যারাভাব আসতে পারে। শ্রবণশক্তির ঘাটতি, ভারসাম্য কমে যাওয়া, স্মতিশক্তি কিছুটা কমা ইত্যাদি নানা কিছু হতে পারে। আসলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটিই নির্ভর করে টিউমার কোথায় হয়েছে, কী গতিতে বাড়ছে এবং তার ধরনের উপর। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগ যথা সময়ে ধরা পড়লে খুব ভালো ভাবে অবস্থা সামলানো যায়।সবকিছু ভালো হয়।গুঞ্জনের বেলায় যাতে সবকিছু ঠিক হয়ে যায় আমি সেই আশা করছি!”

-“দোয়া করিস আমার গুঞ্জনের যাতে কিছু না হয়।আজ রাখছি।আমি তোকে বাকিসব ডিটেইলস পাঠিয়ে দিচ্ছি!”

-“আচ্ছা,ঠিক আছে!”

“ফোন রেখে মৃন্ময় পেছন ফিরে দেখলো গুঞ্জন দাঁড়িয়ে আছে।ওর চোখমুখ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে,চোখের কোণে চিকচিক করছে জলেরা।খোলা চুলগুলো ঠান্ডা বাতাসে আছড়ে পড়ছে মৃন্ময়ের মুখে।মোহময় এই রাতের অশ্রুসিক্ত ঘটনাগুলো মৃন্ময়ের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে।মনে-প্রাণে চাইছে যেন,এই দুঃস্বপ্নটা যাতে থেমে যাক,ভেঙ্গে যাক, চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাক এই দুঃস্বপ্ন দেখা!মিথ্যে হয়ে যাক আজকে ঘটা গুঞ্জনের অসুস্থতার ঘটনাটা।সত্যি হয়ে থাকুক গুঞ্জনের ভালোবাসার কথাটা!”

চলবে….ইনশাআল্লাহ!