বৃষ্টি নামার পরে পর্ব-২২

0
3986

#বৃষ্টি_নামার_পরে❤
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২২

৩৯.
“গুঞ্জনের পরিবারের সবাই ড্রয়িংরুমে বসে আছে,মৃন্ময়ের বাবা-মা, দাদীমাও আছেন।মৃন্ময় সোফায় বসে মায়া আহমেদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।জামান সাহেব তাঁর পাশে বসা।স্বামীর অনুমতি নিয়ে মায়া আহমেদ বলতে শুরু করলেন গুঞ্জনের সাথে এমন রুড বিহেভ করার কারণগুলো।”

“গুঞ্জনের সাথে আমাদের একটা ছেলেও ছিলো।কিন্তু আট বছর বয়সে আমাদের ছেলেটা মারা যায়।আমাদের ছেলেটা,মানে গুঞ্জনের জমজ ভাইটা যেদিন পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলো তখন থেকেই গুঞ্জনের প্রতি ওর বাবার একটা অনীহা তৈরি হয়।আর আমিও তখন কেমন একটা রাগ অনুভব করি ওর প্রতি।ওর বাবার মতো আমারও মনে হতো,ও অপয়া!নাহলে ওর সামনেই আমাদের ছেলেটা পানিতে ডুবে মারা গেলো কেন!এইসব ভাবনা ঢুকে গিয়েছিলো।সেজন্য গুঞ্জনকে কখনো ভালোবাসতে পারিনি।কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি কথা।কিন্তু এখন মনে হয়,মেয়েটাকে বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছি!”

-“সেটা বুঝলাম! কিন্তু ফ্যামিলির অন্য মেম্বাররা কেন ওর সাথে এমন করে?”

-“যেখানে মা-বাবাই সন্তানকে দেখতে পারে না,সেখানে অন্য কেউ কিভাবে টলারেট করবে?আর গুঞ্জনের ভাই মানে আমার ছেলেটা সবার খুব আদরের ছিলো।তাই গুঞ্জনের প্রতি সবার এতো বিদ্বেষ!”

-“কিন্তু গুঞ্জন তখন ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ে ছিলো,ও কিভাবে পানি থেকে ওর ভাইকে তুলতো?যেখানে ওর নিজের জীবনেরই রিস্ক ছিলো!আট বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের জায়গায় থাকলে আপনারা বুঝতে পারতেন হয়তো!”

“মায়া আহমেদ আর জামান সাহেব চুপ করে রইলেন।তাঁদের চোখে অপরাধবোধ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।গুঞ্জনের ফুপ্পিরা,চাচ্চু-চাচীরাও মাথা নত করে বসে রইলো।কারো মুখে রা’ নেই।”

“মৃন্ময় আবারও বললো, কখনও জেনেশুনে, কখনও অজান্তে, আবার কখনও অনিচ্ছাসত্ত্বে বাধ্য হয়ে বাবা-মায়েরা সন্তানদের সাথে এমনও কিছু আচরণ করেন যার মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের উপর নির্যাতন করেন।যেটা এই ফ্যামিলির প্রতিটা মানুষ গুঞ্জনের সাথে করেছেন!”

“মৃন্ময় আবারও ওদের বোঝাতে বললো,কখনও শারীরিক, কখনও মানসিক নির্যাতন। সন্তানদের সাথে কখনো কখনো বাবা-মায়েরা এমনও কিছু আচরণ করে যার এফেক্ট বাচ্চাটার মনে সারাজীবনের মতো গেঁথে যায়।এই ট্রমাটা একটা বাচ্চা বা এডাল্ট মানুষের জন্যও খুব কষ্টদায়ক।ওরা ঘরকুনো হয়ে পড়ে,হাসতে ভুলে যায়,নিজের সমস্যা,অসুবিধার কথাগুলো বাবা-মায়েদের বলতে ভয় পায়,সংকোচ করে।”

“বাবা-মায়ের দায়িত্ব আমরা পালন করতে পারিনি বাবা।অনেক ভুল-ত্রুটি রয়ে গিয়েছে। প্রতিপালন হয়তো করতাম মেয়েটাকে তবে ভালোবাসা,আদরটা দেওয়া হয়নি।বললেন, জামান সাহেব!”

“মৃন্ময় চুপ করে রইলো।মৃন্ময়ের বাবা ইকবাল চৌধুরী বললেন, একটা বাচ্চার দেহ ও মনের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য সুস্থ ও স্বাভাবিক পারিবারিক পরিবেশ খুব দরকার।বাচ্চাদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশকে চরমভাবে প্রভাবিত করে।মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে, শিশুদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের জন্য ভগ্নগৃহ বা ব্রোকেন হোমের পরিবারে মৃত্যু, বাবা-মায়ের সন্তানের প্রতি অবহেলা,অনীহা,বিবাহবিচ্ছেদ, সেপারেশন বা ডিজারশনের কারণে মানুষের জন্য অনেক বেশী ক্ষতিকর।আর গুঞ্জন তো বলতে গেলে একা একাই বড় হয়েছে,ওর মনে তাহলে কতটা এফেক্ট ফেলেছে এসব ঘটনা, চিন্তা করে দেখুন!”

“আনিসা চৌধুরী বললেন,এসবকিছু মানুষের মনে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। কেননা মানুষের নিরাপত্তা বিধান ও স্বার্থ রক্ষার একান্ত আশ্রয়স্থল বাবা-মা। সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ে।আপনাদের এই আচরণগুলোর কারণে গুঞ্জন ওর অল্প অভিজ্ঞতাকে সঞ্চয় করে নিজের ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য অপরাধবোধে ভোগেছে। এসবের জন্য নিজেকে দায়ী করে ও দুশ্চিন্তা নিয়ে বড় হয়েছে। ফলে গুঞ্জন হতাশা, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, অপরাধবোধ, স্নেহবঞ্চনা, দুশ্চিন্তায় ভোগেছে।মেয়েটা শেষ হয়ে যাচ্ছিলো দিনদিন!”

“মৃন্ময় বললো,জানেন আপনারা!গুঞ্জন সমস্ত জগত্‍ সংসারকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর স্থান মনে করে। ছোটবেলায় অসুস্থ হয়ে পড়লে ও নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় বোধ করতো,বলতে পারতো না! পরিণামে গুঞ্জন বিভিন্ন মানসিক ট্রমাতে আক্রান্ত হয়?জানেন?”

“জামান সাহেব বললেন,আমি ওর পড়াশোনা বা অন্যকিছুতে ঘাটতি রাখিনি!”

“মৃন্ময় অদ্ভুত হেসে বললো, আসলে গুঞ্জন তার নিজ গৃহে অতি আপনজন দ্বারা নির্যাতিত।বড় হয়েছে ভয়, দুশ্চিন্তা, কষ্ট নিয়ে।আচ্ছা,টাকাই কি সব?গুঞ্জনের সব ঘাটতি আপনি পূরণ করতে পেরেছেন সত্যিই?সন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ত্বমূলক আচরণ করেছেন আপনি!যে ছেলে সন্তানের জন্য এমন করেছেন, সে কি ফিরে এসেছে?এবার মেয়েটাকেও হারানোর পথে ঠেলে দিয়েছেন আপনারা!”

“জামান সাহেব সহ বাকিরা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মৃন্ময়ের দিকে।উনারা বুঝতে পারছেন না মৃন্ময়ের কথা।দাদীমা ভ্রু কুঁচকে সন্দেহী গলায় বললেন,মানে?”

“মৃন্ময় থামলো।গ্লাসের পানিটা এক ঢোকে খেয়ে নিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,গুঞ্জনের ব্রেন টিউমার দিদা!”

“জামান সাহেব চমকে উঠে বললেন, কিহ?কিসব বলছো তুমি?মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?”

-“না!এটা সত্যি!”

“মায়া আহমেদ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।তিনি বোধহয় কথাটা বুঝতে পারছেন না।বাড়ির অন্য সব সদস্যরাও চোকমুখ কুঁচকে মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।গুঞ্জনের যে ব্রেন টিউমার হতে পারে সেটা যেন কারো বিশ্বাসই হচ্ছে না।মৃন্ময় কাঁপাকাঁপা গম্ভীর গলায় বললো,ওইদিন যে গুঞ্জন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো সেটা এজন্যই।তাছাড়া ডাক্তাররা সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই কনফার্ম হয়েছে।ওর অবস্থা এখন খুব ক্রিটিকাল, বলা যায় অনেকটাই!”

“দাদীমার চোখের কোণে পানি।ইকবাল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,আমার মেয়েটা জানে?”

“মৃন্ময় ফিকে হেসে বললো,জানে।”

“আনিসা চৌধুরী চুপ।তাঁর চোখেও পানি।মায়া আহমেদ আর জামান সাহেব দুজন কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।গুঞ্জনের ছোট চাচ্চু বললেন,গুঞ্জন জানে মানে?ও কি রিয়্যাক্ট করেছে?”

“মৃন্ময় আবারও হাসলো।বললো,কি রিয়্যাক্ট করবে আবার?সারাজীবন তো এর চেয়ে ভয়ংকর ঘটনাও ও পার করে এসেছে।এবার মৃত্যুপথযাত্রী
হয়ে ওর আর কি-ই বা রিয়্যাক্ট করার আছে?ওর জীবনের হাসি-কান্না সবকিছু তো কবেই হারিয়ে গিয়েছিল,নতুন করে আর কি-ই বা হারাবে?শুধু নিজেকে আমার কাছ থেকে দূরে সরাতে চাইছে,যা আমি হতে দেবো না।”

“জামান সাহেব গুঞ্জনের কাছে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো।মৃন্ময় আটকে দিয়ে বললো,ওর কাছে যাওয়ার রাইট আপনাদেরকে আমি দিইনি,তাই গুঞ্জনের কাছ থেকে দূরে থাকবেন।”

“জামান সাহেব হতভম্ব হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।মৃন্ময় ইকবাল চৌধুরীকে বললো,আব্বু!আমি গুঞ্জনকে নিয়ে আমাদের বাসায় যাবো।”

“তারপর জামান সাহেবকে বললেন,সন্তানদের ভালোবাসুন।পক্ষপাতিত্ব করবেন না।আপনার বাকি সন্তানরাও যেন গুঞ্জনের মতো নির্যাতনের শিকার না হয়,তাও তুচ্ছ কারণে!”

“বলেই গটগটিয়ে হেঁটে গুঞ্জনের রুমে চলে গেলো।ঘরভর্তি মানুষ সবাই আগের মতোই অবাক এবং হতভম্ব।নিভৃত আর হিয়া কান্না করছে।মায়া চৌধুরী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।”

_____________________

৪০.

“গুঞ্জন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইছিলো।ওর চোখে পানি।বাইরে আবারও বৃষ্টি নেমেছে।গুঞ্জনের ইচ্ছে হচ্ছে সেদিনের মতো বৃষ্টিতে ভিজতে। ভিজতে ভিজতে মেঘ হতে ইচ্ছা করছে।ক’দিন?আর ক’দিন গুঞ্জন আছে এ পৃথিবীতে?”

“মৃন্ময় পেছন থেকে এসে গুঞ্জনকে জড়িয়ে ধরলো।এমন চুপচাপ,মন খারাপ করা গুঞ্জনকে মৃন্ময় দেখতে চায় না।আগের সেই প্রাণোচ্ছল,সারাক্ষণ হুমকি-ধমকি দিয়ে মারামারি করা গুঞ্জনকে যে ওর চাই,চা-ই!”

-“আচ্ছা গুঞ্জন!তোমার চুলে কি এসব?”

“গুঞ্জন ভ্রু কুঁচকে বললো,মানে?আমার চুলে কি?”

-“আই মিন,তোমার চুলে কি নারকেল তেল দাও?ওই চিপচিপে হয়ে থাকে!”

-“না তো!আমি নারকেল তেল দিই না।আমি জলপাই তেল দিই!”

-“না মানে!আমি আসলে বলতে চাইছিলাম যে,তোমাকে না আজ কাজের মহিলা রহিমার মতো লাগছে।”

“গুঞ্জন গর্জন করে উঠলো।বললো,কিহহহ???আমি কাজের মহিলা?আমি রহিমা?”

“মৃন্ময় ভয় পেয়ে গেলো।বললো,এত বড় চিৎকার রহিমার আম্মা?আমার কান উড়ে গেলো!”

-“আমি রহিমার আম্মা?আমাকে কি ফকিন্নি লাগছে?”

“গুঞ্জন আস্তে চিৎকার করো।আমার হার্ট অলরেডি ফুটো হয়ে গিয়েছে।আমি হার্ট-অ্যাটাক করবো আরেকবার এভাবে চিৎকার করলে।”

“গুঞ্জন রেগে মুখ ফুলিয়ে বললো,আমার ইচ্ছে করছে আপনাকে ভয়ংকর একটা অভিশাপ দিতে।”

-“কি অভিশাপ দিয়ে ফেলো।”

-“দিবো?”

-“দিতে পারো।নো প্রবলেম!”

-“আপনি বলুন কেমন ধরনের অভিশাপ দেবো।আমি গুঞ্জন আবার এতোটাও সস্তা না যে,দুই টাকার অভিশাপ দেবো!”

“মৃন্ময় হাসি আটকে বললো,তাহলে মূল্যবান অভিশাপটা দিয়ে দাও না রহিমার আম্মা!”

“গুঞ্জন ভীষণ রাগলো।বললো,আপনি একসময় এমন একটা দ্বীপে পৌঁছবেন যেখানে কোনো মানুষ নেই,হনুমান আছে।হনুমান গুলো সারাদিন আপনার কোলে বসে থাকবে।আপনি নড়াচড়া করলেই ঠাস ঠাস করে আপনার ফর্সা গালে চড় মেরে লাল করে দিবে।আপনি মুখ থুবড়ে বালুর উপর পড়ে থাকবেন!”

“মৃন্ময় বললো,আর কিছু?”

-“আপাতত আর না!আমার এই অভিশাপ নেওয়ার জন্য সেসময় আপনি নিজেকে ধন্য মনে করবেন।আমাকে ধন্যবাদ দেবেন।গুড লাক জানাবেন নিজের ভাগ্যকে!”

-“তোমাকে পেয়েছি এটাই আমার গুড লাক!”

-“আচ্ছা, আমি মরে গেলে আপনি কি আবার বিয়ে করে নিবেন?কাকে করবেন?রুহি আপুকে?নাহ!ওর তো এনগেজমেন্ট হয়ে গিয়েছে। তাহলে নিশ্চয়ই অণুকে?”

“মৃন্ময় রাগলো।চিৎকার করে বললো,আর একবার মরার কথা বললে আমিই সুসাইড করবো।জাস্ট সুসাইড।তোমার মুখে যেন আমি আর এসব কথা না শুনি,গট ইট???”

“গুঞ্জন চুপ করে রইলো।মৃন্ময় হঠাৎ গুঞ্জনের গলায় নাক ডুবালো।কাঁপা গলায় বললো,তোমার কিছু হবে না গুঞ্জন। আমি কিছু হতে দেবো না।গুঞ্জন হাসলো,কিছু বললো না।এই না বলা কিছুতেই যে আরও হাজারো কথা জমে আছে,সেটা কি মৃন্ময় জানে?জানলে কি করতো?একদিনেই কি মৃন্ময় গুঞ্জনের সব কথা জেনে যেতো?”

আপনাদের মতামত জানতে চাই!

চলবে….ইনশাআল্লাহ!