বৃষ্টি নামার পরে পর্ব-২৫ এবং অন্তিম পর্ব

0
4704

#বৃষ্টি_নামার_পরে❤
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৫ (অন্তিম)

৪৪.
“আনন্দ আর খুশিতে কেটে গেলো তিন তিনটা দিন।যতই দিন যাচ্ছে ততই মৃন্ময়ের দুশ্চিন্তা বাড়ছে।কি হবে কিছুই কারো জানা নেই!”

“সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছে ওরা।রাত আটটা বাজে।এয়ারপোর্টে সবার সঙ্গে বসে আছে গুঞ্জন।সব ফর্মালিটি শেষ করতে আরও বেশ খানিকক্ষণ লাগবে।গুঞ্জন ভাবলো দেশের কথা,নিজের সংসারের কথা।ছোট্ট পরিবারটা ছেড়ে ও কত দূরে চলে এসেছে!বুকটা চিনচিন ব্যথা করছে।চোখের সামনে ভেসে উঠছে নিজের স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি।গ্রামের বাড়ির সেই অসাধারণ দৃশ্য।শহরের অলিগলি।নিঃস্তব্ধ রাতের অসম্ভব সুন্দর তারাভরা আকাশ।ধূসর মেঘে ঢাকা আকাশ থেকে নামা সেই ঝুম বৃষ্টির কথা ওর খুব মনে পড়ছে।সেই রাত,যেদিন গুঞ্জন প্রথম জানতে পেরেছিলো ও ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত।যে রাতে ও মৃন্ময়কে বলেছিলো হৃদয়ের গভীরে লুকোনো সত্যটি,যে রাতে সেই ঝুম বৃষ্টিতে ভিজেছিলো গুঞ্জন।ভালোবাসার মানুষটির সাথে কাটয়েছিলো ভালোবাসাময় রাত।সবকিছু খুব মনে হচ্ছে।আসার সময় গুঞ্জনকে সবাই দেখতে এসেছিলো।দোয়া করেছিলো!”

“সবার কাছ থেকে এমন ভালোবাসা পেয়ে আপ্লুত গুঞ্জন।সবাই ওকে সাহস দিচ্ছিলো।বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে সিনিয়র-জুনিয়র সবাই গুঞ্জনের খোঁজ খবর নিয়েছে,মানসিকভাবে সমর্থন জুগিয়েছে,সেগুলো দেখে গুঞ্জন সত্যিই নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করেছে। সবার ভালোবাসা পেয়ে গুঞ্জনের মনে হচ্ছে যাক,কিছুটা ভালোবাসা নয়!অনেক ভালোবাসা পেয়েছে গুঞ্জন।সত্যিই গুঞ্জন তাহলে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিলো।”

“সবার জন্য হোটেল বুকিং করে রেস্ট নিয়ে খাওয়া দাওয়া করা হলো।”

“পরদিন!সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে গুঞ্জনকে নিয়ে যাওয়া হলো।ডাক্তাররা আবারও নতুন করে গুঞ্জন আর মৃন্ময়ের কাছ থেকে সবকিছু শুনলেন।যে,বেশ কিছুদিন ধরেই মাথাব্যথাসহ বেশ কিছু সমস্যায় ভুগছে গুঞ্জন। সমস্যার ব্যাপকতা বুঝতে পেরে চিকিৎসকরা আবারও গুঞ্জনকে মাথার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন। সেই পরীক্ষাতে আবারও ধরা পড়ে টিউমারের অস্তিত্ব।

” চিকিৎসকরা বলেছেন, গুঞ্জনের ব্রেনের টিউমারটি এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়েছেন দ্রুত অস্ত্রোপচার করে ফেলতে। দ্রুত অস্ত্রোপচার করালেও কোনো সম্ভাবনা নেই সুস্থ হয়ে ওঠবে কি না।তবে বাঁচার একটু আশা আছে।”

____

“গুঞ্জনকে হসপিটালে এডমিট করা হলো।বাইরে সবাই বসে আছে।দাদীমা আর মায়া আহমেদ হোটেলে রয়েছেন।মৃন্ময় বাইরে এসে সবাইকে বললো গুঞ্জনের কথা।”

“সবকিছু জানার পর,বোঝার পর মৃন্ময় জেসিকাকে ফোন করলো। ওর পরামর্শ মোতাবেক
মৃন্ময় অস্ত্রোপচারটা সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসাপাতালে করাতে চায়।মৃন্ময় সবাইকে জানালো,চিকিৎসকরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অস্ত্রোপচার করতে বলেছেন। যদিও মস্তিষ্কের টিউমারটি একেবারে খারাপ অবস্থাতে আছে।অপারেশন করা হলে একটু হলেও চান্স আছে বাঁচবার,কিন্তু না করালে…. আর কিছু বলতে পারলো না মৃন্ময়।ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো।”

“জামান সাহেব বললেন,অবস্থা কি ক্রিটিকাল?”

“ইকবাল চৌধুরী বললেন, ‘বায়োপসির মাধ্যমে টিউমারের মাত্রা বোঝা যায়। রিপোর্টগুলো দেখে ডাক্তারদের মনে হচ্ছে এটা বেশ রিস্কের। এ কারণে যতটা দ্রুত সম্ভব অস্ত্রোপচার করাতে হবে।”

“জামান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,সব মিলিয়ে কত খরচ লাগতে পারে?”

“ইকবাল চৌধুরী বললেন,এটা আসলে অপারেশনের পর বায়োপসি করলে জানা যাবে। তবে শুধু মস্তিষ্কের অপারেশনেই ব্যয় হবে ২০-২৫ লাখ টাকা। এর বাইরে কেমো দেওয়াও বাদবাকি খরচসহ ৪০ লাখ টাকার মতো লাগতে পারে।”

“জামান সাহেব বললেন,কিছু মনে না করলে আমি একটা কথা বলবো।মানে এটা আমার একার সিদ্ধান্ত।আপনাদের জানাতে চাই।”

“আনিসা চৌধুরী একটু অবাক হলেন।বললেন সংকোচ না করে বলে ফেলুন।”

“জামান সাহেব বলতে লাগলেন,গুঞ্জনের চিকিৎসা সহ যাবতীয় ব্যয় আমার।আমি আমার মেয়ের জন্য এটুকু করতে চাই।”

“ইকবাল সাহেব মানতে পারলেন না।তিনি বললেন,মেয়ে তো আমাদেরও।আমরা কি মেয়েটার জন্য কিছু করতে পারিনা?”

-“অবশ্যই পারেন।কিন্তু আমি তো মেয়েটার জন্য কোনোদিনও কিছু করতে পারিনি,তাই আজ মেয়ের এই বিপদে আমি যদি ওর জন্য কিছু না করি তাহলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে।”

“ইকবাল সাহেব তাও মানতে নারাজ।তিনি বললেন,আমার বাড়ির বউ,আমার মেয়ের জন্য আমারও তো কিছু করার আছে।দায়িত্ব আছে,তাই না।তবে আপনি চাইলে আমরা দুজন মিলে সব করতে পারি।কিন্তু একা সব করতে আমি আপনাকে দিবো না!”

“জামান সাহেব আর উপায় না পেয়ে রাজি হলেন।আর যা-ই হোক মেয়েটাকে তো সুস্থ করতে হবে!”

“আগামী দিন গুঞ্জনের অপারেশন।”

“গুঞ্জন মৃন্ময়কে জিজ্ঞেস করলো,আচ্ছা কতো টাকা খরচ হবে?”

“মৃন্ময় রাগী গলায় বললো, তোমার তাতে দরকার কি?”

-“বলুন না প্লিজ!”

-“বলবো না।ইনফেক্ট তোমার এসব জানার দরকাই নেই!”

“গুঞ্জন চোখমুখ লাল করে বললো,বলবেন না তাহলে?”

-“না!”

“গুঞ্জন আর কিছু বললো না।চুপ থেকে কিছুক্ষণ পর বলে উঠলো,বলবেনই বা কেন?আমি কে?আমিতো আপনার কেউ না।আপনার কাছ থেকে আমার কোনোকিছু জানার অধিকার নেই।আমি মরি কি বাঁচি তাতেও আপনার কিছু আসবে যাবে না।”

“মৃন্ময় রেগে বললো,এই তুমি এসব ফালতু আর উদ্ভট চিন্তাভাবনা নিয়ে সারাদিন পরে থাকো কেন?তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও?ঠিক আছে তাহলে, বলেই ফল কাটার ধারালো ছুরিটা দিয়ে এক পোচ মেরে হাত কেটে ফেললো!”

“গুঞ্জন এরকমটা কখনোই আশা করেনি।”

“মৃন্ময় বললো, এবার শান্তি হয়েছে তোমার?নাকি আরও কিছু করবো?”

“গুঞ্জন চোখের পানি মুছে বললো,প্লিজ হাতটা বাঁধেন।আমি রক্ত দেখতে পারিনা।প্লিজ!আচ্ছা,আমি আর কিছু বলবো না,কিন্তু আমার কিছু কথা আপনাকে শুনতে হবে,আমি আর কখনো কিছু বলবো না প্রমিজ!”

“মৃন্ময় ভ্রু কুঁচকে বললো, কি কথা?”

-“আগে রক্ত মুছুন।আমি বলবো,কিন্তু আপনি সিনক্রিয়েট করতে পারবেন না,আমার কথা রাখবেন প্রমিজ করুন।”

-“আগে বলো!”

“গুঞ্জনের মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে।তাই তাড়াতাড়ি করে বললো, আপনি আগে প্রমিজ করেন!”

“মৃন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,ঠিক আছে।তারপর কাটা জায়গা মুছে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে সেলোটেপ লাগালো।গুঞ্জনের পাশে গিয়ে বসে ওর হাত দুটো মুঠোবন্দি করে ধরলো।বললো,আমি প্রমিজ করছি তোমার কথা রাখবো।একমাত্র বউ আমার,তাঁর কথা না রাখলে কি চলবে?”

“তখন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের একটা সাজানো গোছানো কেবিনে বসে আছে দুজন।জানালা গলে আসা রোদের টুকরাগুলো আছড়ে পড়ছিলো গুঞ্জনের গায়ে আর মৃন্ময়ের পায়ের কাছে।এখান থেকে দেখা যাচ্ছে সিঙ্গাপুরের নীল আকাশ।দূরের রাস্তায় দেখা যাচ্ছে খেজুর গাছের সারি।মানুষজন গাড়ি চালাচ্ছে নিরবে,কোথাও কোলাহল নেই।পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে গুঞ্জন বলে উঠলো,শুনুন!কাল তো আমার অপারেশন।ধরুন আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায়…”

“মৃন্ময় ঠাস করে উঠে দাঁড়ালো। থমথমে রাগী মুখ নিয়ে তাকালো গুঞ্জনের দিকে।জোরে চিৎকার করে বললো,তুমি আবারও এসব কথা শুরু করেছো?আমার কথার কোনো দামই নেই তোমার কাছে?এতটাই খারাপ আমি?”

“গুঞ্জন মৃদু হাসলো। বেড থেকে টেনে টেনে নিজের দুর্বল শরীরটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।মৃন্ময় হতচকিত হয়ে বললো,তুমি কি সিরিয়াসলি পাগল হয়ে গেলে গুঞ্জন?বেশি সাহস দেখাচ্ছো আজকাল।উঠে দাঁড়ালে কেন তুমি?”

“গুঞ্জন মৃন্ময়কে জড়িয়ে ধরলো।বললো,আপনি আমার কথা শুনছেন না তাহলে আমি কেন শুনবো আপনার কথা? জানেন না,গুঞ্জন কোনো অবলা অসহায় নারী না?সে সবকিছু কর‍তে পারে!”

-“লাইক সিরিয়াসলি গুঞ্জন?”

“গুঞ্জন মুখ তুলে তাকালো।বললো,আমার কথা আপনার শুনতেই হবে।বুঝলেন?এখন বসুন বা দাঁড়িয়ে থাকেন সেটা আপনার ইচ্ছা।কিন্তু আমি বসবো না!”

“মৃন্ময় বললো, ঠিক আছে বলো।কিন্তু আজেবাজে কথা আমি শুনতে চাই না।”

“গুঞ্জন বললো,দেখুন!কাল অপারেশন আমার।যদি বাই চান্স আমার কিছু হয়ে যায় তাহলে প্লিজ আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না।এটা প্রমিজ করুন।”

-“গুঞ্জনননন???”

-“প্লিজ!”

-“আমি জানি না কি করবো,তবে তোমার কিছু হতে পারে না!”

“গুঞ্জন মৃদু হাসলো।”

____________

৪৫.

“আজ গুঞ্জনের অপারেশন।বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠছে গুঞ্জনের।কাল রাতে ও অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো।ডাক্তাররা তাই বেশ চিন্তিত।দুবার বমিও হয়েছে।গুঞ্জনের সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে মৃন্ময়ের জন্য।ছেলেটা কত চেষ্টা করছে গুঞ্জনকে বাঁচানোর, কিন্তু গুঞ্জন জানে এবং মানে ওর সময় দ্রুতই ঘনিয়ে আসছে।খুব কম সময় ওর হাতে।বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশাটাও ক্রমশই ফুরিয়ে আসছে।”

“মৃন্ময় আর অন্যান্যরা চিন্তিত মুখ নিয়ে বসে আছে।দাদীমা গুঞ্জনের কাছে গেলো।তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো।দাদীমা বললো,তুই ভালো হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসিস বাবুটা।তোকে ছাড়া আমাদের বাড়িটা খালি হয়ে যাবে,আমার সাথে সারাদিন কথা বলার লোকটাও থাকবে না।তুই সুস্থ হয়ে ফিরে আসিস বোন।আমি তোর জন্য অপেক্ষা করবো।”

” গুঞ্জনের চোখের পানি ও খুব কষ্টে আটকে রেখেছে। সবার সামনে কান্নাকাটি করে সবার দুশ্চিন্তা আর বাড়াতে চায় না।বললো,আর আমি যদি সুস্থ না ও হই দিদা,তুমি কিন্তু একদম মন খারাপ করবে না।একদিন তো সবাইকেই চলে যেতে হবে তাই না?তো তোমার কাজ হবে, তুমি সবাইকে সামলে রাখবে।”

“দাদীমা কেঁদে উঠলেন।এতো ভালো মেয়েটা কেন জন্মদুঃখীনি ভাগ্য নিয়ে জন্মালো সেটা খোদা জানেন।ক্ষণিকের সুখটা ওর কপালে জুটলো না।”

“মায়া আহমেদ,আনিসা চৌধুরী,জামান সাহেব,ইকবাল চৌধুরী সবাইকে গুঞ্জন একই কথা বললো।আরও বললো,মৃন্ময়কে দেখে রাখতে।ও যেন গুঞ্জনের কিছু হলে ভুল কিছু করে না বসে।শক্ত থাকতে হবে, ভালো থাকতে হবে শুধু গুঞ্জনের জন্য।নইলে গুঞ্জন কখনোই শান্তি পাবেনা।”

“সবার সাথে কথা বলে গুঞ্জন বাসার সবার সাথে কথা বলে নিলো।একপর্যায়ে কথা বলার সময় অনুও কেঁদে দিলো।ওর মিসবিহেভ করার জন্য গুঞ্জনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলো।নিভৃত,হিয়া,আরিশা,নাবিলা ফোনেই কেঁদে উঠলো।”

“অবশেষে গুঞ্জনকে ওটি’তে নেওয়ার জন্য রেডি করা হলো।মৃন্ময় গুঞ্জনকে জড়িয়ে ধরে বললো,আমার কাছে ফিরে আসতে হবে তোমায়।”

“গুঞ্জন বললো,আপনি কিন্তু ভুল কিছু করে বসবেন না।আমার যেকোনো কিছু হয়ে যেতেই পারে,ভেঙ্গে পড়বেন না।আমি তো আপনাকে ভালোবাসি,আপনি ভেঙ্গে পড়লে আমি খুব কষ্ট পাবো।মরেও শান্তি পাবো না।জানেন,আমার খুব ইচ্ছে ছিলো আপনার সাথে একসাথে আবারও বৃষ্টিতে ভিজবো।সেটা মনে হচ্ছে সম্ভব না আজ,তবে আমি খুব করে চাইবো আজ যেন বৃষ্টি হয়।আল্লাহ তায়ালা খুশি হলে নাকি বৃষ্টি নামান।আমিও চাই,আল্লাহ তায়ালা আজ খুশি হয়ে বৃষ্টি নামাক।আর আমাকে সেই বৃষ্টি অনুভব করার তৌফিক দিক।খুব ভালোবাসি আপনাকে, আপনার সাথে কখনো খারাপ বিহেভ করে থাকলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন।”

“মৃন্ময় গুঞ্জনকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরলো।কেঁদে কেঁদে বাচ্চাদের মতো বললো,আজ নিশ্চয়ই বৃষ্টি নামবে আমার বৃষ্টিপ্রিয়া।তুমি কখনো খারাপ কিছু করোনি যে মাফ চাইতে হবে।উল্টো আমাদের উচিৎ তোমার কাছে মাফ চাওয়া।তবুও তুমি আমার কাছে ফিরে এসো গুঞ্জন।আমি প্রতিটা বৃষ্টির দিন তোমার সাথে কাটাতে চাই,ভালোবাসতে চাই।আমি তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসি গুঞ্জন।”

“দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।একটা সময় পরে গুঞ্জনকে স্ট্রেচারে শুয়ানো হলো।ওটি রুমে ঢোকার আগ পর্যন্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো,মৃন্ময়ের দিকে।হাজারো বার মৃন্ময়কে বলেছিলো, আমি ভালোবাসি আপনাকে।ওপারে আমি আপনাকে চাই,আপনার সাথে ওপারে দেখা হবে নিশ্চিত।”

“মৃন্ময় এবং অন্যান্যরা মুখ গম্ভীর করে বসে রইলো। মায়া আহমেদ একটু পরপর কাঁদছেন।সবাই দোয়া করছে মেয়ের জন্য।কিন্তু ওনারা তো জানেন না,কি ঘটে গিয়েছে মেয়েটার জীবনে।”

“কয়েকঘন্টা পরে ডাক্তাররা গম্ভীরমুখে বেরুলেন ওটি থেকে।মৃন্ময়ের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো ওদের দিকে।পা দুটো যেন চলছেই না।খুব করে চাইছে,একটা ভালো খবর শুনবে।”

-“আমরা মিসেস গুঞ্জনকে বাঁচাতে পারিনি মিস্টার মৃন্ময় চৌধুরী!”

“মৃন্ময় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।ও বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে।কি বলবে বা এই মুহূর্তে ওর কি করা উচিৎ বুঝতে পারছে না।কলিজা মোচড় দিয়ে উঠছে।কানে কোনো শব্দ ঢুকছে না।মাথা ভনভন করছে।ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পরিবারের বাকিরা।সবাই স্তব্ধ।কান্না করাটাও ভুলে গিয়েছে।”

“গুঞ্জনকে যখন সবাইকে দেখানোর জন্য নিয়ে আসা হলো তখন মৃন্ময় ওর দিকে তাকালো না।বাকরুদ্ধ মানবের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো।হঠাৎ করে সাদা কাপড়টা সরিয়ে গুঞ্জনের মুখপানে তাকালো মৃন্ময়।হলদে আভা ছড়াচ্ছে সারা মুখ জুড়ে,চোখগুলো বন্ধ।এমন মায়াময় চেহারা এর আগে কখনো, কাউকে দেখেনি মৃন্ময়।হতবুদ্ধি হয়ে মৃন্ময় গুঞ্জনের মুখে হাত বুলিয়ে দিলো।স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই রইলো।কাউকে কিছু বললো না!বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো।ঝুম বৃষ্টি!হসপিটালের করিডোরে ছিঁটকে এসে পড়ছিলো বৃষ্টির ফোঁটা।গুঞ্জন আর মৃন্ময়কে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো।ভালোবাসাময় বৃষ্টি।মৃন্ময়ের কান্নাগুলো এভাবেই হয়তো বৃষ্টির হয়ে পরছিলো।”

“এদিকে দাদীমা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।মায়া আহমেদ বারবার সেন্সলেস হচ্ছে।আনিসা চৌধুরী কান্না করছেন।বাকিরা স্তব্ধ,বিমূঢ়!”

______

“আজ অনেকদিন।গুঞ্জন মারা যাওয়ার অনেকদিন পার হলেও আজও মৃন্ময় কাঁদেনি,কাঁদতে পারেনি।কে দেখবে ওর কান্না?কে দেখবে ওর কষ্ট!আজও গভীর রাতে ও ব্যলকুনিতে বসে থাকে,ভাবে।কেন গুঞ্জনটা ওকে ছেড়ে চলে গেলো আজও বুঝলো না মৃন্ময়।ওকে একা রেখে চলে গিয়ে ও কি শান্তিটা পেলো জানেনা মৃন্ময়।আজও বৃষ্টি নামা রাত গুলোতে মৃন্ময়ের কানে কানে গুঞ্জন এসে বলে যা,’আমি আপনার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাই।ভিজবেন আমার সাথে?আমি শুধু আপনার জন্য চুপিচুপি বৃষ্টি হয়ে নামি গভীর রাতে।আমি বর্ষার কদমফুল হতে চাই,খুঁজবেন আমায় কদমফুলের মাঝে?”

“মৃন্ময় প্রতিরাতে ব্যলকুনিতে নির্ঘুম রাত কাটায়।ভাবে,গুঞ্জনের সাথে কথা বলে।ভালোবাসে যে ওকে,খুব!বৃষ্টিগুলো নামার পর ও তাকিয়ে থাকে সেদিকে,খুঁজে পায় একটি মেয়েকে কবিতার মতো করে!”

‘এই শহরে,রোজ ভোরে রোদ উঠে,
এই শহরে, রোজ দুপুরে বৃষ্টি নামে,
রোজ সন্ধ্যায় বাতাস বয়,
এই শহরে রাত্রি নামলে!
বৃষ্টি আসে চুপিসারে,
আমার জন্য,শুধু একা।
বর্ষার ভেজা কদমফুলের মাঝে
রোজ দেখা পাই, শুধুই তোমার!
তুমি আছো,এ বৃষ্টিদের মাঝে
তুমি আছো সবখানে।
তোমার কথা,
বৃষ্টিদের ফোঁটায় ফোঁটায়।
এই শহরের খোলা পথে,
আমি আজও একলা ভিজি
বৃষ্টি নামার পরে!’

________
সমাপ্ত