বেটারহাফ পর্ব-১৩

0
1916

#বেটারহাফ
#নিশাত_তাসনিম_নিশি

|পর্ব ১৩ |

সম্পূর্ণ বিষয়টা এড়িয়ে বলে,–” আসলে মা, আমি নিজের যোগ্যতায় কিছু করতে চাই।”

শাহিনুর বেগম আর কিছু বললেন না। সকাল সকাল রাত্রি বের হয়েছিলো বাড়ীর পাশের প্রাইমারি স্কুলে। স্কুলের হেডমাস্টার শশুড়ের বন্ধু ছিলো। অনার্স পাশ সার্টিফিকেট গুলো নিয়ে রাত্রি গিয়েছিলো স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে জয়েন করার জন্য। হেডমাস্টারের সাথে আগে একবার যোগাযোগ হয়েছিলো, তখন তিনি তাকে বলেছিলেন যোগদান করার জন্য। সে সময় রাত্রি এত ভাবে নি, না করে দিয়েছিলো। শাশুড়ি দিবে না ভেবে। কিন্তু এবার সে ভাবলো এ ঘরে তার আর মূল্য নেই, যে কোনো সময় হয়তো তাকে চলে যেতে বলবে। তাই নিজের বাঁচার জন্য একটা চাকরীর ব্যবস্থা করলো সে। অবাক করার ব্যাপার ছিলো শাহিনুর বেগম দ্বিমত করে নি। রাত্রির ধারনা, সেদিন শাশুড়িকে নিজের কষ্টের কথাগুলো বলায় উনার মন কিছুটা নরম হয়েছে তার জন্য।

তাছাড়া স্কুলে চাকরী করলে তার দুটো অভাব পূরন হবে। এক স্কুলের বাচ্চাগুলোকে নিজের বাচ্চার মতো পালবে,তাহলে হয়তো বাচ্চার অভাব টা কিছু কমবে তার জন্য। দ্বিতীয়ত তার সময়গুলোও কেটে যাবে। এ দুটো চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছ।

শাশুড়ি কে অনেক করুন সুরে বলে রাজি করিয়েছে সে। শাহিনুর বেগম ও ভাবলেন, ঘরে থাকলে তার জন্যই ঝামেলা যত কম থাকবে ততই ভালো তার সংসারের জন্য। সাগর বারবার রাত্রির কাছে আসতে চাইবে আর বৃষ্টি ও রাত্রিকে মানতে পারবে না, শুধু শুধু ঝামেলা।
কিন্তু তিনি সেটা রাত্রিকে বুঝতে দেয় নি। তিনি এমন ভান করলেন যেনো রাত্রির অনুরোধে তিনি রাজি হয়েছেন।

★★★

ঘন্টাখানেক থেকে পানির উপর হাঁটছে সাগর আর বৃষ্টি। সাগর প্যান্টের নিচ খানিকটা ফোল্ড করে রেখেছে, মাহি তাদের থেকে অনেকটা দূরে দূরে হাঁটছে। জাফলং জায়গা টা বেশ সুন্দর। আশেপাশে অনেক মানুষ। পানির ভেতরের পাথর গুলোর উপর শেওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। বৃষ্টি উরু হয়ে বসে সেই পাথরগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। তার কাছে এ জিনিস অনেক মজার লাগছে। ছোট ছোট সাদা পাথর গুলো কুড়িয়ে নিচ্ছিলো সে। জীবনে কখনো সে দেখে নি এসব,তাই স্মৃতি হিসেবে রাখতেই সে এসব নিচ্ছে। হঠাৎ তার পাশ দিয়ে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে যাচ্ছিলো কম বয়সী একটা ছেলে।

হাওয়াই মিঠাই বৃষ্টি খুব প্রিয়। ছোট বেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় বাবা তাকে প্রথম কিনে দিয়েছিলে, সে থেকেই এ জিনিস টা তার খুব পছন্দের। সব কিছু ভুলে সে বাচ্চাদের মতো বায়না করে ফেলে হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার জন্য। সাগর অবাক হয়ে যায় তার কান্ডে তবুও কিছু বলে না। সে ছেলেটাকে দাড় করিয়ে দু প্যাকেট কিনে দেয় বৃষ্টি আর মাহিকে।

সারাদিন ঘুরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে তারা। মাহি এসেই রুমে ঠাস করে শুয়ে পড়ে, তার এখন ঘুম প্রয়োজন। কাল রাতে একদম ঘুম হয় নি। ম্যাথা টা ধরে আছে তার, গা গুলাচ্ছে। সে বেশ বুঝলো তার শরীর এখন আরাম চাচ্ছে।

বৃষ্টি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে দেখে সাগর বাহিরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে। হঠাৎ তার সকালের কথা মনে পড়লো। সে হাতের টাওয়াল টেবিলের উপর রেখে এসে সাগরকে বলে,—” আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

সাগর বৃষ্টির দিকে তাকায়। তারপর আগের মতো বাহিরে দৃষ্টি ফেলে বলে,–” আমি জানি কী কথা।”

বৃষ্টি অবাক হয়ে বলে,—“আপনি জানেন? কী বলেন তো?”

–“আমার মায়ের বিষয় জানতে চাইছো,তাই তো?”

—“ফুফি আপনাকে বলেছে?”

–“হু।”

বৃষ্টি পাশের চেয়ার টা টেনে সাগর সামনে নিয়ে এসে বসলো। সাগর ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়।

–“তাহলে আমাকে বলেন। আমি জানতে চাই।”

কয়েক সেকেন্ড নিরব রইলো সাগর। এরপর সে সব বলে বৃষ্টিকে। সব শুনে বৃষ্টি হা হয়ে রইলো। সাগর আর কথা বললো না, বিছানায় গিয়ে একপাশ হয়ে শুয়ে পড়লো।

বৃষ্টিও কিছুক্ষণ পর এসে শুয়ে পড়লো। অনেক্ষণ তাদের মধ্যে নিরবতা বিরাজ করলো। কয়েক মুহূর্ত পর বৃষ্টি এপাশ ফিরে সাগরকে বলে,—“আপনি রাত্রি আপুকে খুব ভালোবাসেন, তাই না?”

সাগর নিশ্চুপ। বৃষ্টি আবারো প্রশ্ন করে,–” আপনাদের লাভ ম্যারেজ ছিলো, তাই না?”

সাগর এবারো জবাব দিলো না। বৃষ্টি আবারো বলে,–” আমাকে কী বলা যায়?”

সাগর ওদিকে শুয়েই হালকা আওয়াজ করে বলে,–” হু।”

সাগর বলে,–“আমি তোমাকে সংক্ষেপে বলবো, মনোযোগ দিয়ে শুনবা।”

বৃষ্টি অধির আগ্রহ নিয়ে বসে যায় শুনার জন্য। তার ভেতর কেমন খচখচ করছে এসব জানার জন্য। সাগর আধ শোয়া হয়ে বসে পড়ে বিছানায়।

গভীর আবেগ নিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,–“রাত্রিকে আমি প্রথম দেখি বিয়ের অনুষ্ঠানে।বন্ধুর ভাইয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম আমি, সেখানেই দেখা। অবাক করার বিষয় কি ছিলো জানো? রাত্রি নিজেই পাত্রি ছিলো। খুব সাধারনভাবে রাত্রি সেজেছিলো তাই আমি বুঝতে পারি নি। আমার বন্ধু আর আমি আগেই চলে এসেছিলাম বিয়েতে। আমরা ডিরেক্ট কলেজ থেকে গিয়েছিলাম সেজন্য।বরযাত্রীর সাথে আমরা যাই নি। আমার বন্ধুর নাম শাকিল। তার কাছে শুনেছিলাম, মেয়েদের অবস্থা নাকি তেমন ভালো না। মেয়ের বাবা নাকি যে কেনো সময় মরে যেতে পারেন,তাই তিনি মরার আগে মেয়েকে সুখী দেখতে চান। শাকিলের বাবার নাকি মেয়ের বাবার পুরানো বন্ধু ছিলো সেজন্য শাকিলের বড় ভাইয়ের সাথে উনি বিয়ে টা ঠিক করেন। সেদিন বরযাত্রী তো এসেছিলো কিন্তু বর আসে নি। সে পালিয়ে গিয়েছিলো তার প্রেমিকার সাথে। শাকিলের ভাই তার বাবাকে খুব ভয় পেতো, তবুও দুবার মুখ ফুটে না করেছিলো কিন্তু তার বাবা মানে নি। তাই সে পালিয়ে যায়। বন্ধুর ভাই পালিয়ে যাওয়ায় বন্ধুর উপর দায়িত্ব এসে পড়ে বিয়ের। কিন্তু আমার বন্ধু এ বিয়ে করতে একদম নারাজ! তার কারন হলো আমাদের ব্যাচমেইট সূচির সাথে ওর তিন বছরের রিলেশন। আগেই বলি, রাত্রির বাবা হার্টের পেশেন্ট, ধাক্কা উনি সামলাতে পারবেন না তাই অগত্যা বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে বিয়ে টা আমাকেই করতে হয়েছিলো। রাত্রির বাবা, আমার কাছে অনুরোধ করেছিলেন তার মেয়েকে জেনো দেখে রাখি, আমিও উনাকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি উনার মেয়ের খেয়াল রাখবো। তখন অনেক কাহিনী হয়েছিলো। বিয়ের দিন মা মেনে নিয়েছিলো রাত্রিকে তবে মনে খুব আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু এরপরের দিন যখন ওর পরিবার সম্পর্কে শুনেন তখন থেকেই কেনো যেনো মা বিয়েটা মানতে নারাজ। কোনোভাবেই উনাকে রাজি করানো যাচ্ছিলো না। উনি মানবেন ই না, আমি জানি না কেনো!
অবশেষে রাত্রিকে মানার জন্য মা আমাকে কয়েকটা শর্ত দেন সেগুলো এমন, “এরপর থেকে যেনো আমি আমার মায়ের প্রতিটা কথা পালন করি। মা যদি উঠতে বলে আমি বিনা বাক্যে উঠে যাবো। ” উপায়ন্তর না পেয়ে আমি মার সাথে ওয়াদাবদ্ধ হই, এরপরেই উনি রাত্রিকে মেনে নিয়েছিলেন।”

সাগরের কথা শেষ করে কিছুক্ষণ চুপ করে যায়। এরপর দম নিয়ে আবারো বলে উঠে,–“জানো,রাত্রি মেয়ে টা না একদম নিরব স্বভাবের। বুক ফাটবে তবুও মুখ ফুটে কিছু বলবে না। মা কোনো এক অদ্ভুত কারণেই তাকে সহ্য করতে পারতেন না। অনেক অন্যায়-অবিচার করতেন। যা আমার চোখে পড়তো।আমি সব দেখেও কিছু বলতে পারতাম না তার কারণ হলো আমি ওয়াদাবদ্ধ ছিলাম। তুমি হয়তো বলবে তাহলে চলে যাই নি কেনো রাত্রিকে নিয়ে কোথাও! তাহলে বলি, আমার ছোট বোনের খুব কম বয়সে বাবা মারা গিয়েছিলেন। মা পারতেন অন্য সংসার করতেন, আমার মায়ের বয়স কিন্তু তখন খুব কম ছিলো। কিন্তু শুধুমাত্র আমার কারণে তিনি এমন কিছুই করেন নি। সবাই বিয়ে দিতে চাইলেও তিনি আমাকে ছেড়ে বিয়ে কখনোই করবেন না। অদ্ভুত কারণে উনার আমার প্রতি অধিক টান। আমি অনেক বড় হওয়ার পরেও মা আমাকে খাইয়ে দিতেন,আমার সাথে ঘুমাতেন। যে মা আমার জন্য সব করতেন সে মাকে আমি অন্য কয়েকদিনের পরিচয়ের মেয়ের জন্য ছেড়ে দিতাম? ”

বৃষ্টি নিরব। সাগর হালকা হেসে বললাম,–“বাদ দাও। মূল কথায় আসি, মাকে অনেক প্রশ্ন করতাম আমি, উনি রাত্রিকে কেনো পছন্দ করে না, তিনি সবসময় এ বিষয় এড়িয়ে যেতেন। কখনো এর জবাব দেন নি। এদিকে রাত্রির সবকিছু আমার ভালো লাগতে শুরু করে, ওর প্রতি আলাদা টান অনুভব করতাম। ও নিজেও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। রাত্রিকে ভালো আমি বিয়ের পর বেসেছিলাম। আমি জানি না ওর প্রতি আমার ফিলিংস দায়িত্ব নাকি ভালোবাসা ? তবে ওর জন্য সব করতে পারি আমি। এই যে দ্বিতীয় বিয়ে সেটাও ওর জন্যই করেছি। তোমাকে বিয়ে করার আগের রাতে ও আমার হাত ধরে শক্ত কন্ঠে বলেছিলো,–” সাগর, আপনি আমার স্বামী, আমি আপনার স্ত্রী। আমি কখনো মা হতে পারবো না, আপনাকে বাবার সুখ দিতে পারবো না। আমার খুঁত তাই আমি বিষয়টা মেনে নিবো, আপনার ভালোবাসা আমি তাই আপনি মেনে নিবেন। কিন্তু আপনার মা মেনে নিবে না, উনি যেহেতু দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চাইছেন তাই আপনার করা উচিত। অন্তত আমাদের সুখের জন্য হলেও করা উচিত। ওই বাচ্চা কি শুধু আপনার অন্য স্ত্রীকে মা ডাকবে? ও কী আমাকে ডাকবে না? আপনার সন্তান মানেই আমার সন্তান। কেউ যখন আমার দিকে আঙ্গুল তুলবে তখন আমি বুক ফুলিয়ে বলবো এই দেখে আমার বাচ্চা। আমার কষ্ট লাগব করতে হলেও বিয়ে করতে হবে। তাই আমার অনুরোধ আপনি দ্বিতীয় বিয়ে তে রাজি হোন। ”

ও আরো অনেক কিছু বলেছিলো। আমি জানি রাত্রির মুখের কথা এসব হলেও মনের কথা এগুলো ছিলো না। ওর গলা ভীষণ কাঁপছিলো, আমাকে শক্ত করে ধরেছিলো। ও হয়তো প্রচন্ড ভয় পাচ্ছিলো। ও জানে বিয়ে টা আমাকে করতেই হতো,তাই ও নিজ থেকেই রাজি হয়ে গিয়েছিলো। আমার কিছু করার ছিলো না বাধ্য হয়েই তোমাকে বিয়ে করেছিলাম।”

সাগর কথাগুলো বলেই চুপ করে রইলো। তার পুরানো সবকিছু মনে পড়ে গেলো। না চাইতেও চোখ দুটো ভিজে উঠছে তার। এই মুহূর্তে রাত্রির কথা ভীষণ মনে পড়ছে। মেয়েটা খুব অভিমানী! সে কোনো ভুল করলেই অভিমান করে মুখ টা ফুলিয়ে রাখতো। বেশিরভাগ সময় তার অভিমান হলে সে কথা বলা বন্ধ করে দিতো। বেশ খানেক সময় কথা বলতো না যতক্ষণ না তার রাগ ভাঙ্গবে। অবশ্য তার রাগ কেউ ভাঙ্গাতো না, সে নিজেই নিজেকে বুঝ দিয়ে নিজের রাগ ভাঙ্গাতো।

চলবে!
রিচেক করি নি। জানি, পর্ব অনেক আ-গোছালো,অনুভূতিহীন।তাই,আগেই ক্ষমাপ্রার্থী।