#বেটারহাফ
#নিশাত_তাসনিম_নিশি
| পর্ব ১৭ |
শাফি ছোট ছোট চোখ করে দুজনের দিকে তাকাচ্ছে, সে বুঝতে পারছে না কী বলছে উনারা! তবে এটুকু বুঝেছে ওর সম্পর্কেই বলছে না হলে দুজনে বারবার ওর দিকে তাকাতো না।
সে বিরক্তিকর মুখ করে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা কখন যে আসবে?
রাত্রি এগিয়ে এসে ওকে কোলে নিলো আদর করার জন্য। বাচ্চা টাকে দেখে ওর ভেতর মমতাবোধ জেগে উঠলো। ইশশ! মা হওয়ার অনুভূতি টা বুঝি খুব দামী যে স্রষ্টা তাকে তার স্বাধ গ্রহণ করতে দিলেন না? এ জগতের নিয়ম এমন কেনো? কেউ বাচ্চা পায় না, তো কেউ মা পায় না।
শাফি গম্ভীর কন্ঠে বলে,–“ডোন্ট ডেয়ার টু কিস মি!”
রাত্রি বড়বড় চোখ করে তাকালো। কি ডেয়ারিং বাচ্চা গো। এত কম বয়সে পটরপটর ইংলিশ বলতেছে।
সে মাত্রই কিসি দিতে যাচ্ছিলো, নিজেকে থামিয়ে নিয়ে বলে,–” না,না। বাবা আমি কিস করতে ছিলাম না তো। তোমাকে কোলে নিতে যাচ্ছিলাম।”
শাফি এমনভাবে তাকালো রাত্রির মনে হলো ও চোখ দিয়ে বলছে, ‘মিথ্যা কেনো বলছো?মিথ্যা কথা আমি পছন্দ করি না।’
শাফি কি আসলেও সেটা বুঝিয়েছে কিনা রাত্রি জানে না। তবে সে যে মিথ্যা বলেছে তা বাচ্চাটা ধরে ফেলেছে এটা ভালোই বুঝলো।
রাত্রি ওকে কোলে নিয়ে টেবিলে বসিয়ে দিলো। তার মুখের ভাবমূর্তির তেমন পরিবর্তন হলো না সে গম্ভীর মুখে বসে রইলো।
রাত্রি চট করে বুদ্ধি বের করলো ওকে খুশি করার। সে ব্যাগ থেকে পাঁচ টাকা দামের ডেইরী মিল্ক বের করে ওর সামনে ধরে বলে,–“এটা কে নিবে?”
রাত্রির মন-মুখ উৎফুল্লু হয়ে আছে, সে জানে শাফি এখন ঝাঁপিয়ে পড়ে বলবে,–“আমি নিবো।” মনে মনে একটা ভাব নিয়ে নিলো সে।
শাফি চুপ করে রইলো। রাত্রির মন টা ভেঙ্গে গেলো। সে ভাবলো হয়তো ওকে কেউ আগে এভাবে চকলেট দেয় নি তাই সে বুঝে নাই।
তাই সে বলে,–“এটা শাফি নিবে।ইয়েএএ!!”
শাফি ভ্রু কুচকে চকলেটের দিকে তাকালো, এরপর সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে বলে,–“নো!নেভার।”
রাত্রি অবাক হয়ে বলে–“কেনো?”
শাফি গম্ভীর কন্ঠে বলে,–” বিকজ ইট’স আন-হাইজেনিক ফর হেল্থ!”
রাত্রি আরো অবাক হয়ে গেলো। সে সচেতন চোখে আশেপাশে তাকালো। প্রিন্সিপ্যাল নিজের কাজে ব্যস্ত, বাকি টিচার রা এখনো আসে নি। সে ফুশ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।ভাগ্যিস কেউ দেখে নি,নাহলে স্কুলে মান-ইজ্জত শেষ।
–“আচ্ছা, আচ্ছা। চুপচুপ কাউকে আবার বইলো না ম্যাম আমাদের আন-হাইজেনিক খাবার দেয়। নাহলে আমার চাকরী ওখানেই শেষ! তুমি না ভালো ছেলে, কাউকে বলবা না ঠিক আছে? তোমার বাবা আর দাদু কে তো একদম ই না।”
এ বলে রাত্রি চকলেট টা ফটাফট ব্যাগে ভরে নিতেই শাওন এসে ডুকলো। সে দেখলো তার ছেলে ক্লাস টিচারের সামনে বসে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। শাওন মনে হলো খুব বড় ঝাঁটকা খেলো। তার ছেলে হেসেছে? বুকের মধ্যে ধুকধুক করে উঠলো। আজ কতদিন পর ছেলেকে হাসতে দেখেছে।
শাওন এগিয়ে যাচ্ছিলো তার দিকে। শাফি তাকে দেখে আগের মতো হয়ে গেলো। চুপচাপ নেমে যেতে লাগলো।
–“আরে,আরে।নামছো কেনো?পড়ে যাবে তো।কই যাবা আমাকে বলো আমি নিয়ে যাবো।”
শাফি কোনো জবাব না দিয়ে নেমে যেতে লাগলো। রাত্রি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওকে নামাতে লাগলো। কী ছেলের পাল্লায় পড়লো? এর থেকে তো দশটা দুষ্টু বাচ্চা ভালো। যে কথা বলবে।
প্রিন্সিপ্যাল শাওনকে দেখে অস্থির হয়ে গেলো।
আসুন, আসুন, বসুন বলতে বলতেই শেষ তিনি। শাওন বলে,–“স্যার পরে বসবো। তাছাড়া ছেলেকে পার্মানেন্ট এখানেই ভর্তি করাবো। আমি বাবার সাথে স্কুলের ব্যাপারে কথা বলেছি উনি বলেছেন এ স্কুলে আরেকটা দালান করার জন্য এপ্লাই করবেন তিনি। আর বাবা নিশ্চই আমাদের ব্যাপারে সব বলেছেন, তাই আশা করি আমার ছেলের প্রতি সর্বোচ্চ যত্ন নেওয়া হবে।”
শাওনের কথায় তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন। চোখমুখে খুশির ঝিলিক।
শাওন এসে শাফির হাত ধরে বলে,–” চলো বাবা!”
রাত্রি চোখ তুলে তার দিকে তাকাতেই সে থ্যাংকস বলে চলে যেতে লাগলো। রাত্রি ভ্রু কুচকে তাকালো তাদের দিকে, থ্যাংকস কেনো বললো? সে তাকিয়ে আছে তখন শাফি হাত উঠিয়ে বাই বলে চলে যেতে লাগলো।
রাত্রির মুখ খুশিতে ভরে উঠলো,সে এক গাল হেসে নিজেও বিদায় জানালো। ইশশ কি কিউট বাচ্চা! এমন বাচ্চা যদি তারও হতো, তাহলে খুব কি ক্ষতি হতো?
মুখে বিষণ্ণতার ছায়া নেমে আসতেই সে আবারো প্লাস্টিকের হাসি ঝুঁলিয়ে নিলো মুখে।
প্রিন্সিপ্যাল অতিরিক্ত খুশি হয়ে বলে,–“তুমি এ স্কুলের লক্ষী!তুমি ভাগ্যের প্রদীপ! দেখো, স্কুলে আসতেই কত কি হতে লাগলো। তুমি যার ভাগ্যে যাবে সে খুব ভাগ্যবান হবে। ”
রাত্রি চমকে উনার দিকে তাকালো। এদিকে অতিরিক্ত খুশির ঠেলায় কি বলতে কি বলে ফেলেছেন প্রিন্সিপ্যাল বুঝে উঠতে পারেন নি। তিনি কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গিয়েছেন।
রাত্রি তার যাওয়ার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অনুভব করলো উনার কথাগুলো তার কলিজায় লাগছে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে!
মানুষের বেখেয়ালি কথাগুলো অন্যকে সত্যিই মরণ যন্ত্রণা দিতে পারে।
সারাদিন ক্লাস করে অনেক দেরীতে বাড়ী ফিরে রাত্রি। খুব ক্লান্ত সে। এত এত খাটুনি তার শরীর মানছে না। এবার স্কুলের প্রথম বেতন পেলে সে মাসে যাতায়াতের জন্য আলাদা কিছু টাকা রেখে দিবে যাতে সে সেগুলো দিয়ে যাওয়া-আসা করতে পারে। এত দূর হেটে যাওয়া আসা করতে করতে তার হাত-পা ব্যাথা হয়ে যায়।
রুমে এসেই ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুমে চোখ দুটো ভার হয়ে আসছে।
২১.
নিস্তব্ধ রজনী! চারপাশ অন্ধকারে ঢাকা। পাশের বাগান থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের ডাক ভেসে আসছে। আশপাশের পরিবেশ টা কেমন ভূতুড়ে হয়ে আছে। ঘরের প্রত্যেক টা মানুষ নিজ নিজ কামরায় রয়েছে। কোথাও কোনো কোলাহল নেই।
সিগারেট হাতে নিয়ে রাত্রির রুমে দুবার টোকা মারলো সাগর। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো রেসপন্স আসছে না। সাগর আরো একবার টোকা মেরে রাত্রিকে ডাকলো। কিন্তু ভেতর থেকে সে কোনো জবাব দিলো না।
শাহিনুর নিজের রুমে যেতে নিচ্ছিলেন তখন দেখলেন সাগর রাত্রির রুমের সামনে। তিনি হনহন করে সাগরের সামনে গিয়ে বলে,–“তোমাকে কি বলেছিলাম আমি? বলেছি না ওর থেকে দূরে থাকতে।”
সাগর উনার কথার পাত্তা দিলো না সে আরো জোরে জোরে ধাক্কাতে লাগলো। মেজাজ বাজে ভাবে বিগড়ে গেলো তার।
শাহিনুর আবার কথা বলতে নিচ্ছিলো সে কঠোর কন্ঠে বলে,–“মা, এখান থেকে চলে যাও। নাহলে আই সোয়ার আমি খুব খারাপ কিছু করে ফেলবো। ”
শাহিনুর আবারো ফোসফোস করে “সাগর” বলে কিছু বলতে নিচ্ছিলেন তখন সাগর পাশের টেবিলে রাখা ফুলদানী টা হাতে নিয়ে ঠাস করে ফ্লোরে ছুড়ে মারলো আর চেঁচিয়ে বলে উঠে,–“মা, আমি তোমাকে যেতে বলেছি না?”
শাহিনুর বুঝলো ছেলে তার খুব রেগে গিয়েছে। তাও রাত্রির উপর হয়তো। সাগর সহজে রাগে না, কিন্তু রাগলে সে কার সাথে কিসের সম্পর্ক সব ভুলে যায়। কিন্তু কেনো রেগে আছে? রাত্রি আবার কি করেছে?
শাহিনুর বেগম আদেশের সুরে বলে,–” সাগর তুমি আমাকে কথা দিয়,,,!!”
পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই সাগর দরজায় খুব জোরে লাথি মারলো। মূলত রাগ টা দরজার উপর তুললো সে।
সে জোরে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো,–” হ্যা জানি আমি, আমি আপনাকে কথা দিয়েছি, মিসেস শাহিনুর বেগম যে আপনি রাত্রিকে মেনে নিলে আপনার সব কথা মেনে চলবো। কিন্তু যার জন্য কথা দিয়েছি সেই যদি না থাকে তাহলে আমি আপনার কথা কেনো রাখবো মিসেস শাহিনুর বেগম। ”
–“সাগর তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকছো কেনো? আমি তোমার মা !”
সাগর মা বলে হা হা হা করে হেসে উঠলো।
গলা উঁচু করে বলে,
–” মা নয়, সৎ মা। স্টেপ মাদার!”
চলবে!