বেটারহাফ পর্ব-১৮

0
1972

#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi

| পর্ব ১৮ |

সাগরের কথায় শাহিনুরের দুনিয়া থমকে গেলো। চোখদুটো জলে ভরে উঠলো। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে-সন্তান নিয়ে সংসার করেছে একা একা। এত বছরে সে কম কড়া কথা শুনে নি। কারো অতি মাত্রার কড়া কথাও তার চোখে জল আনতে পারে নি আজ অবধি। আর আজ ছেলের মুখের এমন কথা শুনে তার চোখে জল চলে এসেছে। সাগর যদি আরো একবার এ কথা বলে তাহলে হয়তো সে জল গাল বেয়ে গলা পর্যন্ত নামবে।

তিনি অত্যন্ত শান্ত গলায় বলে,–” সাগর পরে ক্ষমা চাইতে এসো না যেনো। এসবের জন্য আমি কিন্তু কোনোদিন ক্ষমা করবো না।”

সাগর তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলে,–” উদ্ধার করলেন আমায়।”

শাহিনুর চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কলিজা টা জ্বলছে। কেউ হয়তো কলিজা টা ছুরি দিয়ে টুকরো টুকরো করছে। শাহিনুর বেগম বুকে হাত দিলেন। বড় বড় দু-চারটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ মেলে তাকালেন।

সাগর শাহিনুরের দিকে তাকিয়ে বলে,–” সবাই বলতো সৎ মা কোনোদিন আপন হতে পারে না। আমি বুক ফুলিয়ে বলতাম, “কে বলে পারে না আমার মা কে দেখো।” তারা জবাব দিতো,–“উনি তোর চোখে পট্টি পরিয়ে রেখেছে , কোনো একদিন তুই সেটা বুঝবি।” আমি রেগে ওদের সাথে সেখানেই বন্ধুত্ব শেষ করে দেই। কারণ ওরা আমার ফুলের মতো মায়ের নামে বাজে কথা বলতো আমাকে।
অনেক বছরের বন্ধুত্ব ছিলো, সবাই সেদিন বলেছে,”একদিন তুই পস্তাবি!”
আমি আরো রেগে যাই, এরপর আর কোনোদিন ওদের সাথে মিশি নি।

আজ এতবছর পর সবাই আমাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলছে, –‘কিরে বলেছিলাম না পস্তাবি, দেখ কি হাল তোর। পুরো এলাকা হইহই করছে তোর ব্যাপারে। একফোঁটাও তো শান্তি পাচ্ছিস না।’
আমি শুধু শূন্য দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।”

এটুকু বলে সাগর চুপ করে গেলো। গলার স্বর টা কেমন কাঁপছে, কান্না এসে যেতে পারে যে কোনো সময়। সে টলছে।

শাহিনুর অবাক চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘ছেলেকে প্রশ্ন করেছিলো সে কেনো আর তার বন্ধুদের সাথে মিশে না?’
জবাবে সে বলেছিলো,’ ওরা বাজে ছেলে মা।’
তিনি আর সেদিন কোনো প্রশ্ন করে নি। সত্যিই ভেবে নিয়েছিলেন তার কথা।
আজ জানতে পারলো তার জন্য সাগর নিজের বন্ধুত্ব শেষ করে দিয়েছে। রাতদিন যে কাঁদতো সেটা তার জন্য ছিলো?

সাগর হঠাৎ হেসে উঠলো,হেসে হেসেই বলে,–” অবাক করার বিষয় কি ছিলো জানো? আমি যখন চুপচাপ চলে আসছিলাম তখন ওরা আমাকে ধরে ফেলে। সবাই মিলে আমাকে হালকা ভাবে মেরে বুকে জড়িয়ে নিলো।
সবাই মিলে বলতে লাগলো,–“আমরা জানতাম এমন একদিন তোর জীবনে আসবে আসবেই। তুই তো বন্ধুত্ব শেষ করেছিলি আমরা করি নি। আজ তোর এ নিঃসঙ্গ সময়ে আমাদের সঙ্গ প্রয়োজন। তাই সবাই চলে আসলাম।”
আমি এবার আরো অসহায়ের মতো হয়ে গেলাম। জানো কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছিলো?
এ পৃথিবী তে সবচেয়ে বেশি কষ্টকর দুটো জিনিস–এক. কারো সাথে ভুলের পর অনুতপ্তের মুহূর্ত। দুই. খারাপ সময়ে তাদের সহানুভূতি। এ দুটো জিনিস একসাথে হলে খুব পোড়ায়! আমার সাথে তখন দুটোই হয়েছিলো। সেজন্য কষ্টের পাহাড় টা আকাশচুম্বী ছিলো। ওরা যদি মাফ না করে আমাকে আরো কথা শুনাতো তাহলে, বাঁচা যেতো। কিন্তু নিজের কাছেই ছোট হয়ে গিয়েছিলাম তখন। নজর ই মিলাতে পারছিলাম না। চোরের মতো থাকতে হচ্ছিলো। পুরানো ফ্রেন্ডশীপ ফিরে পেয়েছি তবে এখানে আর আমার কোনো দাম নেই, আর না কোনো মূল্য!সবসময় ঝুঁকে চলতে হবে সেখানে। ”

কথা বলতে বলতে সাগর নিচে বসে পড়লো।
শাহিনুর বেগম তার দিকে তাকিয়ে আছে। উনার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
ছেলের মুখ বরাবর বসে পড়লেন তিনি। নাকে তার অদ্ভুত, বাজে গন্ধ ভেসে আসছে। দুবার শুকতেই তিনি বুঝলেন তার ছেলের মুখ থেকে আসছে। বুঝতে বাকি রইলো না কিসের গন্ধ।

সাগরের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন করলেন,–“সাগর তুমি মদ খেয়েছো?”

জবাবে সাগর হেসে হেসে বলে,–” না তো, আমি বিয়ার খেয়েছি। জানো ওরা কেউ আমাকে দিতে চাইছিলো না, আমি জোর করে নিয়ে খেয়েছিলাম। ”

শাহিনুর আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
ছিঃ, শেষ পর্যন্ত তার ছেলের এত অধঃপতন হয়েছে তার জন্য? বুকটা বারবার এমন কেঁপে উঠছে কেনো। নিজেকে জগন্যতম মা মনে হচ্ছে তার। কষ্টে ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে।

এজন্যই তো সে বলে, ছেলে কীভাবে তাকে এত কথা বলতে পারে। তিনি জানেন,সাগর স্বাভাবিকভাবে থাকলে জীবনেও এসব কিছুই বলতো না। মা কে খুব শ্রদ্ধা করে সে।
শাহিনুর এতক্ষণে নিঃশব্দে কাঁদলেও এবার শব্দ করে কেঁদে দিলো। আওয়াজ টা যেনো অন্য কারো কানে না যায় তাই সে মুখে শাড়ির আঁচল টা গুজে ধরলেন।

রাত্রি রুমের দরজা টা খুলে বের হয়ে দেখলো তার স্বামী নিচে বসে আছে আর শাশুড়ি কাঁদছেন। চারপাশের অবস্থা খুব বাজে।
এমন দৃশ্য দেখতেই তার মাথা টা হালকা নাড়া দিয়ে উঠলো। সে দৌড়ে এসে শাশুড়ির সামনে বসে বলে,–“কী হয়েছে মা?”
রাত্রির কন্ঠ ঘুম জড়ানো, মাত্রই তার ঘুম ভেঙ্গেছে।
সাগর রাত্রিকে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে গেলো। সে রাত্রির মুখে,বাহুতে হাতিয়ে বলে,–“তুমি ঠিক আছো? বারবার কেনো নিজেকে মেরে ফেলতে চাও?আরেকবার এমন কিছু করতে চাইলে আমি নিজে তোমায় মেরে তারপর নিজেও মরে যাবো।”
রাত্রি বিব্রতবোধ করে উঠলো। সাগর কী বলছে এসব?আর এমন দূর্গন্ধ কেনো আসছে?
সে প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে শাশুড়ির দিকে তাকালো।
শাহিনুর কোনো কথা না বলে দ্রুত উঠে নিজের রুমের দিকে চলে যেতে লাগলো।

রাত্রি হতবাক হয়ে দুদিকে তাকাতে লাগলো। সাগর টলমল করে উঠে রাত্রিকে জড়িয়ে ধরলো। রাত্রি চমকে নিজের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখলো সাগর তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। সে তাকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিতে চাইলে, সাগর বলে উঠে,–” আমাকে ছেড়ে যেও না নাহলে মরে যাবো। আমার আত্নার মৃত্যু আরো আগে হয়ে গেছে। তুমি যদি ছেড়ে দাও তাহলে দেহের মৃত্যু ও হয়ে যাবে।”
রাত্রি দ্বিগুন চমকে গেলো। সাগরের কথা শুনতে স্পষ্ট না হলেও তার বুঝতে কষ্ট হয় নি। সে চুপ করে রইলো। সাগর উল্টাপাল্টা বকবক করছে। রাত্রি হতভম্ভ হয়ে গেলো।
সে বুঝতে কারছে না,ঘুম থেকে উঠে কি তার মাথা শূন্য হয়ে গিয়েছে নাকি?

–“কিসব উল্টাপাল্টা বলছেন আপনি?”

সাগর মুখ খুলতেই রাত্রির নাকে গন্ধ টা এসে ধাক্কা লাগলো।

–“আপনার মুখ থেকে কিসের দূর্গন্ধ আসছে? মদ খেয়েছেন?”

–” না, বিয়ার খেয়েছি।”

–” ছিঃ, আপনি এসব ছাইপাশ খেয়েছেন?আবার সেটা গর্ব করে বলছেন। এমনভাবে বলছেন যেনো অমৃত পান করছেন।”

সাগর হেসে চুপ করে রাত্রির বুকে মাথা পেতে রইলো। রাত্রি হালকা কেঁপে উঠলো। কেমন অসার লাগছে তার শরীর। কয়েক মুহূর্ত সেও চোখ বন্ধ করে সাগরের সাথে তাল মিলিয়ে চুপ করে অনুভব করলো।

২৩.

চারপাশ রোদের আলোয় ঝলমল করছে। রুমজুড়ে আলোর ছড়াছড়ি। রোদের
আলো জানালা ভেদ করে সাগরের মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো।
হালকা হালকা ভাবে সে চোখ মেলে তাকালো। মাথা টা প্রচন্ড ব্যাথা করছে।বিছনায় বসেই মাথ্যায় হাত দিলো।
সকাল পেরিয়ে দুপুর শুরু হচ্ছে। বড্ড বেলা হয়ে গিয়েছে। চোখ তুলে
দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছে।
সে হতভম্ভ হয়ে গেলো, এত বেলা অবধি সে ঘুমিয়েছে। কেউ তাকে ডাকে নি আর সে নিজেই বা কেনো উঠতে পারে নি?
বিছানা থেকে নামতেছিলো তখন সে দেখলো সে পোশাকবিহীন কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে আছে।

সে এবার আরো হতবাক হয়ে গিয়েছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে নিজের রুমেই আছে, রুমে আর কেউ ই নেই।

দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে বিরবির করে বলে উঠে,–” কী হয়েছে? আমি তো বন্ধুদের সাথে ছিলাম, এরপর, এরপর? কী হয়েছে?”

চলবে!