বেটারহাফ পর্ব-১৯

0
2085

#বেটারহাফ
#নিশাত_তাসনিম_নিশি

| পর্ব ১৯ |

দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে বিরবির করে বলে উঠে,–” কী হয়েছে? আমি তো বন্ধুদের সাথে ছিলাম, এরপর, এরপর? কী হয়েছে?”

কিছু মনে করতে না পেরে সে উঠে গেলো। ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতেই দেখলো বড় ভাবী ফিহাকে খাইয়ে দিচ্ছে। তাকে দেখে সোহাগী প্লেটে নাস্তা বেড়ে দিলেন। সাগর চুপচাপ খেতে বসে যায়। মাথ্যা টেনশনে ফেটে যাচ্ছে, কেমন ঝিমঝিম করছে। প্রতিটা রগে রগে টান অনুভব করছে,এত যন্ত্রণা করছে কেনো?

–“ভাবী, কড়া লিকারে এক কাপ দুধ চাও দাও তো।”

–“পাঁচ টা মিনিট ওয়েট করো, ফিহাকে খাওয়াচ্ছি। আমি এখন নড়লে ও পালিয়ে যাবে।”

সাগর চুপ করে রইলো। নাস্তা আর মুখে দিলো না, প্লেট ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে গেলো।

–“সাগর কই যাচ্ছো? দাড়াও। আমার হয়ে গেছে তো।”

–” আমি খাবো না ভাবি। আপনি ফিহাকে খাওয়ান, ও নেমে যাচ্ছে।”

সোহাগী আবার পিঁছিয়ে গিয়ে ফিহাকে ধরলো। মেয়েটাকে খাওয়াতে গেলে যত জ্বালা দেখা দেয়। আর এদিকে উনি, দুই বউ থাকতেও আমার সাথে ধারাধারি করে। আরে ভাই দেখছোস ই তো বাচ্চা খাওয়াচ্ছি দুই মিনিট অপেক্ষা করলে কি হতো? না রাগ দেখিয়ে উঠে গেলো। তাতে আমার কি হয়ে গেলো?
শুধু উনাদের রাগ,আমাদের নাই।

আপন মনে সোহাগী মিনমিন করে ফিহাকে খাওয়াতে লাগলো। ফিহা খেতে চাইলো না, মুখ থেকে বের করে দিলো। ব্যাস! আগুনে যেনো ঘি ঢেলে দিলো। চপাস চপাস করে ফিহার দুই গালে দুই থাপ্পর বসিয়ে দিলো।

ফিহা কেঁদে উঠলো। যার প্রতিধ্বনি তরঙ্গের মতো সাগরের কানে বেজে উঠলো। সে দাড়িয়ে গেলো, বড় বড় দুটো নিঃশ্বাস ফেলে বাহিরের দিকে হাটা দিলো। ভাবী তার রাগ ভাতিজির উপর তুলেছে বুঝতে অসুবিধা হয় নি তার। কিছু বলার নেই, চুপচাপ সে বেরিয়ে গেলো।

আজ সারা বাড়ী নিশ্চুপ। কোথাও থেকে কোনো শব্দ আসছে না। সাগর বাহিরে থেকে হালকা কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে ঘরে ফিরে আসলো। কারো কোনো শব্দ নেই। কি ব্যাপার! সবাই কোথাও চলে গিয়েছে নাকি? এখনো কেউ ঘুম থেকেই উঠে নি।

চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের পাকঘরের দিকে গেলো সে। কারণ সেখান থেকেই প্লেট-চামচের ঘষাঘষির টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে।
সেখানে গিয়ে দেখলো, রাত্রি সবজি কাটছে, বড় ভাবী প্লেট-বাটি ধুচ্ছে।
বৃষ্টি আশেপাশে কোথাও নেই। সেটা তার ভাবনায় আর আসলো না।

রাত্রির দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে সাগর।
–“রাত্রি এখন বাড়ীতে?কিন্তু কেনো?আজ স্কুলে গেলো না কেনো?তার মানে কি সে কাল তার সাথেই কিছু করেছে? কারন মাথায় হালকা হালকা স্মৃতি আসছে যে রাত্রি তাকে জড়িয়ে ধরে ফ্লোরে বসেছিলো।”
রাত্রি তার দিকে তাকাচ্ছে না। তার মানে সন্দেহ টা ঠিক। তার মনের ভেতর এক তৃপ্তি চলে আসলো । সে ভাবে, রাত্রি হয়তো রাগ করবে তার সাথে কথা বলতে চাইবে না। কাল যা করেছে সেটা তো অন্যায়। তার সাথে আলাদা কথা বলতে হবে। তাই সে রাত্রিকে উদ্দেশ্য করে বলে, —” আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে রুমে আসো। কড়া লিকারে!”

এ বলে সে চলে যায়। রাত্রি তার কথা শুনেও শুনলো না। নিজের মতো কাজ করতে লাগলো। সেটা দেখে সোহাগী তাড়া দিয়ে বলে,–“কি হলো রাত্রি? শুনছো না, জামাইরে চা দিতে বলেছে।”

–“শুনেছি ভাবি। সবজি টা কেটে নেই। আর অল্প একটু সবজি রয়েছে।”

–” রাখো তোমার সবজি। আগে চা দিয়ে আসো না হলে রাগ তুঙ্গে উঠবে। একটু আগে আমার উপরে রাগ করে চলে গিয়েছে না খেয়ে। এখন তুমি দেরী করলে আরো কাহিনী হবে, তোমার কাটার দরকার নেই আমি কাটবো।”

–” কি বলেন ভাবী। এখন তো সময় পাই না, আজ শুক্রবার বলে একটু কাজ করতে পারছি।”

–“পরে এসে কইরো। আগে গিয়ে তোমার জামাইরে ঠান্ডা করো নাহলে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিবে।”

রাত্রি তাচ্ছিল্য করে বলে,–” আমার জামাই…!!!!”

সোহাগী কথা টা শুনলো,তবুও চুপ করে রইলো। রাত্রি উঠে গিয়ে চা বানাতে লেগে পড়লো। সে ইচ্ছে করেই চাপাতা বেশি দিলো। কড়া লিকার বলেছে তাই না? দাড়াও খাওয়াচ্ছি। এক দানাও তো চিনি দিবো না দেখি খাও কিভাবে?

চা টা ঢেলে নিলো মগে। মগ নিয়ে পা বাড়াতেই ভাবলো, বেশি কড়া হয়ে গেলো না? এত দুধ দেওয়ার পরেও কালার টা কালছে! তাই চামচের মাথা দিয়ে হালকা চিনি নিয়ে নাড়ালো।

রুমে আসতেই দেখলো সাগর জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে। উত্তরমূখী বাতাস জানালা দিয়ে এসে ঢেউ খেলছে তার চুল নিয়ে। আর সে চোখ বন্ধ করে সেটা উপভোগ করছে।

রাত্রি চা টা নিয়ে এসে সাগরের সামনে শব্দ করে রাখলো।

সাগর চোখ মেলে তাকালো। রাত্রির চোখমুখে স্পষ্ট রাগ আর বিরক্তির আভাস। তার মনের ধারনা এবার তীব্র হয়ে গেলো। রাত্রি চলে যেতে নিচ্ছিলো, সে তার হাত ধরে আটকে ফেলে। রাত্রি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে পেছনে ঘুরে তাকালো। সাগর ওকে টান মেরে বাহু বন্ধনে আটকে নিলো।

–“কি সমস্যা? এভাবে টানাটানি করছেন কেনো?”

–” সমস্যা হলো তুমি।”

–” আমি? কি করেছি আমি? ফাজলামি করেন? ছাড়ুন। আমাকে ধরবেন না, ঘেন্না লাগে।”

সাগর চপচাপ রাত্রির ছুটোছুটি দেখছে। এবার সে আর ধারনা করলো না,পুরোপুরি নিশ্চিত সে।

–” সরি। আসলে রাতে আমি কন্ট্রোলে ছিলাম না। আই ওয়াজ ড্রাংক। রিয়েলি ভেরি সরি। আমি না ইচ্ছে করে কিছু করতে চাই নি।”

রাত্রি ভ্রু বাকালো। রাতের জন্য সরি মানে? যদি বলতো এত দিনের জন্য সরি,তাহলে মানতাম কিন্তু হাইলাইট করে কাল রাত উচ্চারণ করলো কেনো?
দোষ করেছে মায়ের সাথে আর সরি বলছে আমাকে? মা তো কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিলো তার মানে নিশ্চই উনি নির্ঘাত কিছু বলেছেন। আমি তো উনার উপর রেগে ছিলাম তাই বুক থেকে সরিয়ে টেনে টেনে তার রুমে দিয়ে এসেছি। তাহলে আমাকে সরি বলছে কেনো রাতের জন্য?

রাত্রি রেগে বলে,–“ছাড়ুন আমাকে। আপনার নব ঢং দেখলে গা জ্বলে। ”

সাগর ওকে চুপ করাতে পারছে না দেখে আচমকা গলায় মুখ গুজে বলে, –” আই নো লাস্ট নাইট ওয়াজ ভেরী বিউটিফুল!আই উইশ আই ওয়াজ ইন মাই সেন্স!”

ছাদ থেকে মাত্রই বৃষ্টি নেমে এসেছে। ঘরে ডুকতে যাবে এমন সময় স্বামীকে তার প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে এমনভাবে দেখে তার পা থেমে যায়।

চুপিচুপি সে দিকে তাকিয়ে পিছু হাটতে লাগলো। উজ্জ্বল আকাশে সাতার কাটা পূর্নিমার চাঁদের মতো ছিলো গত রাত। সে ভেবেছিলো রাতের পর থেকে তার সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। সাগর তাকে মেনে নিবে, আর কোনো বাঁধা আসবে না সম্পর্কে। তার মনে এক ফালি আশা জমেছিলো। শব্দবিহীন পা ফেলে সে দৌড়ে চলে যেতে লাগলো ছাঁদের দিকে।

আকাশ টা বদলে গেছে। কালো কালো খন্ড মেঘ পুরো আকাশে জমে আছে। একটু আগে কি কড়া রোদ ছিলো!আর এখন সেটা তলিয়ে গেলো কালো মেঘের ভেলার নিচে। চারপাশ শোঁ শোঁ বাতাস বইছে খুব জোরে জোরে। মনে হচ্ছে খুব বড় না হলেও ছোটখাটো ঝড় বইবে।

প্রকৃতি আজ এমন রূপ ধারন করলো কেনো? একটু আগেও তো ঝকঝকে ফকফকে পরিষ্কার আকাশ ছিলো। মনে হচ্ছে, আশার আলো জ্বলে উঠতেই নিভে গিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় প্রকৃতির সাথে মানুষের মনের টান রয়েছে।

বৃষ্টি হাটু গেড়ে বসে আছে। দৃষ্টি তার কালো আকাশের দিকে। চোখ দিয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। গাল বেয়ে হাতের উপর পড়তেই তার সম্মতি ফিরে আসলো।

অশ্রুফোঁটা ছুঁয়ে বলে,–” আমার কান্না আসছে কেনো? কার জন্য কাঁদছি? নিয়তির উপর নাকি নিজের অসহায়ত্বের উপর? কাঁদবো না আমি। একদম কাঁদবো না। ওরা কি পেয়েছে? আমি কি মানুষ নয়? শুধু শুধু নাটক করছে সবাই মিলে আমার সাথে। ”

চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো সে। চোখের পানি কিন্তু তার সঙ্গ দিচ্ছে না, সে নিজের মতো বইছে।

চলবে!