বেটারহাফ পর্ব-২০

0
2007

#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi

|পর্ব ২০|

চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো সে। চোখের পানি কিন্তু তার সঙ্গ দিচ্ছে না, সে নিজের মতো বইছে। এক চাপা রাগ আর ক্ষোভ নিয়ে সে উঠে গেলো। হঠাৎ খুব জোরে বর্ষণ শুরু হয়ে গেলো। বৃষ্টি থেমে যায়, সে চুপচাপ দাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করে। বৃষ্টির পানি প্রকৃতের সাথে ওর মনের রাগ টাকে ধুয়ে নিলো। সে ভেবে উঠে, ‘আচ্ছা, রাত্রি আপুর কি দোষ? উনি তো এসব করেন নি,তাহলে আমি অযথা কেনো উনাকে দোষারোপ করছি? উনার সাথে তো আমার থেকেও খারাপ ব্যবহার হয়ে আসছে। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে তো উনার থেকে অনেক সুখে আছি আমি। আর উনি তো এসে আমার সংসার দখল করেন নি, আমি করেছি। তাহলে তো উনার আমার থেকেও বেশি কষ্ট হয়েছে। মাত্র এক মাস খানেকের সম্পর্কে আমার এমন লাগছে,সেখানে তো উনার বছরের সম্পর্ক। কিন্তু আমার ই বা কি দোষ? আমি তো নিজ থেকে আসি নি। আমার পরিস্থিতি এমন ছিলো যে আমি ক্ষণিকের লোভে পড়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, সবাই তো চায় একটা সুন্দর লাইফ, সেখানে আমার চাওয়া টা কি খুব বেশি দোষের ছিলো? মানলাম অন্যের বশে পড়ে আমি অন্য পথে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা কি স্বাভাবিক নয় আমার মতো মেয়েদের জন্য? আমি কি সব জানতাম? তাহলে কী আমার উচিত ছিলো সব চুপচাপ মেনো নেওয়া,কোনো প্রতিবাদ না করা?
‘মেয়েরা প্রতিবাদী হলে মেয়েরাই তাদের দুষমন হয়ে যায়।’
আচ্ছা, আজ থেকে আমি আর আমার কোনো অধিকার চাইবো না আর না উনাদের মাঝে যাবো। সরে যাবো উনাদের জীবন থেকে, সুখে থাকুক। কাল যা হয়েছিলো সেটা কেউ জানবে না, কখনো কেউ জানবে না। মনের মধ্যে দামাচাপা দিয়ে দিলাম সব। আজকের পর আর কেউ জানবে না। ধীরে ধীরে আমি নিজেও সরে যাবো।
আচ্ছা,এসবে আমার দোষ কই? আমি জানতে চাই, কেনো আমার জীবন টা এমন হয়েছে? কেনো?হোয়াই? সব কিছুতেই আমি দোষী?
ইট-সিমেন্টের এই জীবন থেকে হাজারগুন ভালো ছিলো ওই কুড়ে ঘরের জীবন।”

বৃষ্টি ভাবতে ভাবতে এক সময় হাটুগেড়ে বসে পড়ে। কাঁদতে চায় না সে, তবুও চোখ দিয়ে পানি আসছিলো। কি করবে? এ চোখ দুটো যে বড্ড বেহায়া, বড্ড অবাধ্য। ভিজে চুপসে গিয়েছে সে, থরথর করে কাঁপছে, জামা ভিজে শরীরের সাথে মিলে গিয়ে সব স্পষ্ট হয়ে গেছে।

কতক্ষণ এভাবে থাকার পর সে উঠে যায়, চুপচাপ উঠে নিচে নেমে আসলো। ছাদের সিড়ি দিয়ে নামতেই শাশুড়ির সাথে তার দেখা। তার মুখ গম্ভীর, থমথমে। চোখ দুটো ভীষণ ফোলা। মনে হচ্ছে খুব কেঁদেছেন। পুরো মুখে এক রাশ ঘন কালো মেঘ।

–” এমন ভিজে আছো কেনো? এ অসময়ে ছাদে গিয়েছিলে কেনো?”

বৃষ্টি মিনমিন করে কাঁপতে কাঁপতে বলে,–“ছ্ ছাদে ক্ কোনো কাপড় আ্ আছে কি না দ্ দেখতে..!!”

শাহিনুর অতি গম্ভীর গলায় বলেন,–“তাড়াতাড়ি গিয়ে বদলে ফেলো এসব। ঠান্ডা লেগে যাবে।”

বৃষ্টি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,–“হু!” এটুকু বলে সে চলে যেতে লাগলো, শাহিনুর পেছন থেকে তাকে বলে,–” শুনো।”

–“জ্ জ্বি!”

–“আমার রুমে একবার এসো, কিছু কথা ছিলো..!!”

বৃষ্টি আবারো মাথা ঝাঁকালো। চুপচাপ রুমে ডুকলো, আগে একবার চেক করে নিয়েছে, কেউ আছে কি না? কাউকে না দেখে সে শব্দহীন ভাবে ডুকে। দ্রুত একটা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। মাথা মুছতে মুছতে বের হতেই দেখলো সাগর খুব গম্ভীর হয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। চেহারা আঁধার হয়ে আছে। হয়তো কিছু ভাবছে। গভীর কিছু ভাবছে, না হলে বৃষ্টির উপস্থিতি ওর চোখে পড়লো না কেনো?

বৃষ্টি চুপচাপ বের হয়ে গেলো শাশুড়ির রুমের উদ্দেশ্য। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর শাশুড়ি বলে, –” বৃষ্টি, কিছু কথা বলবো। কিছু মনে করবে না তো?”

বৃষ্টি মাথা ঝাঁকালো, সে বলে–“না,কিছু কেনো মনে করবো?”

শাহিনুর অনেক্ষণ চেষ্টা করেও বলতে পারছিলো না। অবশেষে খুব দ্বিধা নিয়ে বলে,
–“সাগর আর তোমার মধ্যে কি কিছু হয়েছিলো?”

বৃষ্টি কিছু টা লজ্জা পায়, তবুও সে কঠোর কন্ঠে বলে –” না, কিছুই হয় নি। আর না কখনো হবে।”

শাহিনুর খুব জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তার তপ্ত শ্বাস বৃষ্টির মুখে এসে লাগলো। বুক থেকে খুব বড় একটা পাথর নেমে গেলো। অনেক টা শান্তি লাগছে তার। বৃষ্টিকে আর কিছু বলেন নি তিনি, তাকে সম্মতি দিয়ে দিলেন চলে যাওয়ার জন্য। তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বলে, –” সন্ধ্যায় সবাই বসার রুমে যেনো বসে। আমি খুব জরুরী কিছু কথা বলবো।”

বৃষ্টি হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে কিছু টা। সে চুপচাপ বের হয়ে গেলো। রাতে সাগর আসার পর সে সব দেখেছে আর শুনেছেও।মা কে কত কি বলেছে সে সব আড়াল থেকে দেখেছে। বৃষ্টির ধারনা শাহিনুর এখন বলবে, সে যেনো চলে যায়। তার ছেলের সুখের জন্য রাত্রিকে উনি আবার ওর সাথে মিলিয়ে দিবেন।

সাগর ড্রাংক ছিলো,সেটা বৃষ্টির বুঝতে একটু কষ্ট হয় নি। আর সে অনেকবার বলেছে, সে মদ খায় নি,বিয়ার খেয়েছে!
বৃষ্টি অনেকবার তাকে বাঁধা দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তার সাথে পেরে উঠে নি। তার মনে কোথাও না কোথাও সাগরকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিলো। তাই সে হাল ছেড়ে দেয়।

আশেপাশে ঘুর ঘুর করে রুমে আসে বৃষ্টি। সাগর এখনো আগের মতো দাড়িয়ে আছে। বৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই সাগরের কাছে গিয়ে দাড়ালো। সাগর কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকালো।

বৃষ্টি মাথা নিচু করে চুপচাপ বলে উঠে,–” আপনাকে সন্ধ্যায় রুমে থাকতে বলেছে আপনার মা। উনি কিছু জরুরী বিষয় আলোচনা করবেন।”

সাগর চুপ করে রইলো। বৃষ্টি চলে যাচ্ছিলো সাগর তার হাত ধরে ফেলে। বৃষ্টি পেছনে ঘুরে তাকায়। দুজনের চোখাচোখি হয়। বৃষ্টির ঠোঁটজোড়া মৃদ্যু কম্পমান। সে বলতে চাইছে,–“কি?কিছু বলবেন?হাত ধরে আছেন কেনো?”
ললাটে কথা আটকে আছে, মুখ দিয়ে সে সেটা বের করতে পারছে না। বৃষ্টি হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে, সাগর তাকে টেনে সোজা দাড় করিয়ে বলে,–“কিছু কথা ছিলো।”

বৃষ্টি কম্পমান ঠোঁটে বলে,–” ক্ কি বলবেন?”

সাগর খুব ছোট মুখ করে বলে,–” রাতে আমাদের মধ্যে কিছু হয়েছিলো তাই না? ”

বৃষ্টি হাত টা ছাড়িয়ে নিলো। সে সরাসরি খুব কড়া গলায় বলে,–” না। কিছুই হয় নি। আপনি মদের নেশায় টাল ছিলেন, বারবার রাত্রি আপু বলছিলেন আমাকে। আমার সাথে অনেকবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কিছু হয় নি।”

সাগর প্রাণভরে নিঃশ্বাস ছাড়লো। দম বন্ধকর পরিস্থিতি হচ্ছিলে এতক্ষণ। কিছুক্ষণ যা হয়েছিলো সেটা ভাবতেই তার মাথা ঘুরে আসছে।

রাত্রি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। আর বলে যে সে কাল রাতে তাকে রুমে দিয়ে চলে গিয়েছিলো। সে যা ভাবছে এমন কিছুই তাদের মধ্যে হয় নি। তারপরেই সে ধাক্কা খায়। মাথায় হাত দিয়ে কতক্ষণ বসে বসে ভাবতেই তার মনে পড়লো, বৃষ্টি তাকে ধাক্কা দিয়েছিলো। এর আগে মা কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছেন। সে কী খুব খারাপ কিছু করেছিলো মায়ের সাথে?
মানে দু দিকের টেনশন মাথা টা চক্কর দিয়ে উঠছিলো। তাই সে বৃষ্টিকে সরাসরি প্রশ্ন করলো যদিও তার মনে হচ্ছে বৃষ্টি মিথ্যা বলছে।

সে বৃষ্টিকে বলে,–” সত্যি তো কিছু হয়নি! ”

বৃষ্টি কিছুটা হেসে বলে,–“হলেও কি হতো? পাপ হয়ে যেতো বুঝি? ”

কথা টা বলে সে চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে আসে সেখান থেকে। সাগর বারবার পেছন থেকে ওকে ডাকতেছিলো কিন্তু সে ফিরে তাকায় নি। চুপচাপ বের হয়ে গেলো।

***

—“কিন্তু স্যার এখন কীভাবে সম্ভব?”

—” আমি জানি না। তুমি কীভবে ম্যানেজ করবে তোমার ব্যাপার।”

—“স্যার আজ তো শুক্রবার। অফ ডে তারপরেও স্কুলে আসতে হবে?”

—” দরকার না পড়লে তো তোমাকে বলতাম না স্যার। কিন্তু কি করবো পরিদর্শক নিজে আমাকে ফোন দিয়েছেন। উনি নাকি কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলে আসবেন, বিশেষ করে তোমার সাথে দেখা করতে।”

—” আমার সাথে? কিন্তু কেনো?”

—” আর, উনার একটা নাতি আছে না? শাফি। ও নাকি তোমাকে দেখতে চায়, বাবাকে প্রচন্ড ভয় পায়। তাই সে তোমার সাথে দেখা করার জন্য দাদুকে বলেছে।”

–“কিন্তু স্যার?”

–” রাত্রি প্লিজ। কোনো কথা শুনতে চাই না। তুমি কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলে হাজির হও। ”

রাত্রি ঠিক আছে স্যার বলে ফোন কেটে দেয়। সে ভীষণ উদ্বিগ্ন আর চিন্তিত। এ বাচ্চা তো কারো সাথেই কথা বলে না, সারাক্ষণ বাঘের মতো থাকে। তাহলে আবার আমার সাথে কেনো দেখা করতে চায়। কাহিনী কি?

সে বিরবির করে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছিলো এমন সময় তার মুখোমুখি হয়ে দাড়ায় বৃষ্টি। দুজনের একসাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। খুব গভীর চাহনী দুজনের! একে অপরের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

চলবে!