বেটারহাফ পর্ব-২৪+২৫ +২৬

0
2295

#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi

| পর্ব ২৪ |

বাহিরে থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বারান্দার জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখলো বৃষ্টি রুমের টেবিলের ওপর মাথা রেখে বসে কাঁদছে। বৃষ্টিকে সে প্রায় ই কান্না করতে দেখে, কিন্তু কিছু বলতে পারে না। সে নিরুপায়!

টান টান হয়ে কয়েকটা নিশ্বাস ছাড়লো সে। অর্ধ খাওয়া সিগারেট টা ফেলে দিয়ে রুমে চলে আসলো। বৃষ্টি তখন চুপ করে উঠে গিয়ে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। কোনো কথা না বলে সেও বৃষ্টির পাশে শুয়ে পড়লো। সে জানে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ঘুমাতে আসবে বৃষ্টি বসে থাকবে। সাগর শুয়ে পড়তেই বৃষ্টি ঘুরে ওকে জড়িয়ে ধরলো। সাগর কিছু বললো না। সে চোখ বন্ধ করে রইলো। ঘুমের মাসি আসুক,এসে তাকে ছুঁয়ে দিক। যাতে তার সব ক্লান্তি, চিন্তা আর হতাশা দূর হয়ে শান্তির ঘুম নামবে।

রৌদ্রজ্জ্বল দিন!আকাশে সূর্যের আলোর মেলা বসেছে।বাতাসকে গায়েব করে সূর্য নিজের উত্তাপ দিয়ে ঘেরা করে আছে পুরো এলাকা। পিচ ডালা রাস্তা গরমে উত্তপ্ত হয়ে আছে, লোকজন ঘেমে একাকার। ভ্যাপসা গরমে রাত্রি প্রায় পুরো ঘেমে গিয়েছে। একটু পরপর কপালের ঘাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ফেলছে সে। ঘন্টাখানেক থেকে বসে অপেক্ষা করছে সে। গরমে অস্বস্তি হলেও মুখে তার প্রশস্ত হাসি বিরাজমান। আজ তার জীবনে খুব বড় একটা খুশির দিন। শাওন আজ তাকে শাফিকে দিয়ে দিবে। জীবনে একসাথে এত খুশি আসছে যে সে ভেবেই কুল পাচ্ছে না সে কি আদৌ এসবের যোগ্য?
অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে শাওন বের হয়ে আসলো। লিগ্যাল কাগজ পত্র নিয়ে রাত্রির সামনে এসে দাড়ালো। শাওন চলে যাবে হাতে গোনা কয়েকদিন পর। তাই সে যাবার আগে কাগজ পত্র করে দিয়ে যাচ্ছে।
রাত্রি পেপার টা হাতে নিলো, চোখে তার অশ্রু। এ যে খুশির জল, শাওন বুঝতে পারছে। তার ছেলে সুখে থাকবে, খুব সুখে থাকবে তার অন্তর বলছে। ছেলের জীবনের জন্য এমন কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। ছেলে একটা ভালো জীবন পাক সেজন্য রাত্রির কাছে তাকে দিয়ে দেওয়ার কঠিন চিন্তা করেছে সে।
বিদেশে রাত-বিরাতে মদ খেয়ে টাল হয়ে পড়ে থাকে, মাঝে মাঝে কাজের চাপে কয়েকদিন বাড়ী ফিরে আসতে পারে না। তার জীবনের সুতো টা ছিঁড়ে গেছে। তাই সে এমন বেপরোয়া। নিজের জীবনের যেখানে ঠিক নেই, সেখানে সে এটুকু একটা বাচ্চা নিয়ে কীভাবে এত দূরদেশে একা থাকবে।তার অনুপস্থিতিতে ছেলেটার সাথে তো খুব খারাপ কিছুও হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া কয়েকদিন আগে তার টাইফয়েড সেরেছে। ছেলেটা এমনিতেই খুব রোগা-পাতলা। তাই সে ছেলের সুস্থ,স্বাভাবিক জীবনের জন্য রাত্রিকেই তার বেস্ট অপশন মনে হয়েছে। আর যেহেতু শাফি তাকেই মা বলে জানে তাই বিশেষ অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

রাত্রি পেপার টা হাতে নিয়ে শাওনের সামনে এনে বলে, –” ও সত্যিই আজ থেকে আমার ছেলে?”
–“হু।”
—” তিন সত্যি?”
–“তিন সত্যি।”
–” আপনি কথা দিয়েছেন ওকে কখনও আমার থেকে কেড়ে নিবেন না,তাই না?”
–“এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না?”
–” আপনার বাবা যদি কখনো ওকে জোর করে নিয়ে যেত চান?”

শাওন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। এ নিয়ে সে হাজার বারের মতো রাত্রিকে বুঝিয়েছে যে সে বা তার বাবা কখনোই তার থেকে শাফিকে কেড়ে নিবে না। শুধু উনারা মাঝে মাঝে খোঁজ নিবেন। শাফির দাদু মাঝে মাঝে দু-একবার দেখাও করবেন। উনারা সবাই মিলে অনেক আলোচনার পর এ সিদ্ধান্তে এসেছেন। এত বুঝিয়ে বলার পরেও রাত্রি মানছে না। সে শুধু বলে, ‘আমি জানি, বড় হয়ে গেলে আপনারা ওকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে যাবেন।’
এত বুঝানোর পরেও রাত্রি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।

শাওন ক্লান্ত গলায় বলে,–” দুই মাসের বেশি চলছে শাফির আর আমার সাথে আপনার দেখা হওয়ার। এতদিনেও কি আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না যে সত্যিই দিবো কিনা? ”

—“বিশ্বাস তো হচ্ছে। কিন্তু আমার মন মানছে না। কেউ কেনো তার ছেলেকে অন্য কাউকে এত সহজে দিয়ে দিবে? শুধু মাত্র ভালো থাকার জন্য সেটা কি আদৌ বিশ্বাসের মতো কথা?”

—” দেখেন আপু সবাই যে এক হবে এমন তো নয়। আমার আর আপনার স্বামীর মধ্যেই দেখুন, কত তফাৎ! আমার স্ত্রী পৃথিবীতে না থাকা স্বত্ত্বেও আমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করছি না। আর আপনার স্বামী, আপনি থাকা স্বত্ত্বেও দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেলেছেন। দুঃখিত আপনার স্বামীর কথা বলেছি,না হলে আপনি বুঝতেন না।”

—” এটার সাথে ওটার মিল কীভাবে হলো? ”

—” মিল অমিলের প্রশ্ন নয় আপু। আমি বলতে চাইছি ব্যক্তিত্বের কথা। এই যে প্রত্যেক টা মানুষ স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচারণ সব দিক দিয়ে আলাদা। তাই আপনি নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করতে পারেন যে, আমি আমার ছেলের ভালো থাকার জন্য তাকে অন্য কাউকে দিয়ে দিতে পারি।
সত্যি কথা বলতে আপু আপনি রুহির বড় বোন সেজন্যই আমি শাফিকে আপনার কাছে দিচ্ছি। কারন আমার পূর্ণ ধারনা আপনি আমার ছেলেকে আমার থেকেও বেশি আদর ভালোবাসা যত্নে বড় করবেন।”

—” আপনি আমাকে এতটা বিশ্বাস করছেন কেনো সেটা আমি জানি না আর জানতেও চাই না। আমি আপনার প্রতি কৃতঘ্ন রইলাম, এত মূল্যবান রত্ন আমাকে দেওয়ার জন্য। আপনাকে আরেকটা বিষয় ক্লিয়ার করে জানিয়ে দিতে চাই, শাফি যেহেতু আজ থেকে আমার বাচ্চা তাই আজকের পর ওর কোনো দায়িত্ব ই আপনার রইলো না সব আমার। আপনি যে ওর জন্য মাসে মাসে টাকা পাঠানোর কথা বলছেন সেটা বাতিল করে দিন আমি কোনো টাকা নিবো না।”

শাওন হাসলো,সে জানতো রাত্রি এমন টাই বলবে। রাত্রি সম্পর্কে তার অনেক খোঁজ নেওয়া। তার হাতে যদি সময় থাকতো তাহলে সে রাত্রিকে ওখান থেকে বের করে আনতো। কিন্তু তা সম্ভব নয়, এক তো তার হাতে সময় নেই, দুই রাত্রি আসতে চাইবে না কারন সে তার স্বামীকে অন্ধের মতো ভালোবাসে।

শাওন গম্ভীর কন্ঠে বলে,–” আপনি টাকা ব্যবহার করেন আর না করেন তা আমার জানার বিষয় নয়। আমি আমার ছেলের জন্য টাকা পাঠাবো। মাস শেষে আপনার এক্যাউন্টে ওর জন্য টাকা পৌঁছে যাবে। আমি এ নিয়ে অযথা তর্কে জড়াতে চাই না।”

রাত্রি কোনো কথা বললো না। পেপার টা ব্যাগে ভরে নিয়ে শাওনকে বলে,–” আচ্ছা, তাহলে এখন আমার ছেলেকে আমি নিয়ে যেতে পারি?”
শাওন অবাক হলো,তবে মুখে প্রকাশ করলো না। বেশ লাগলো তার, একদিনেই এত অধিকার। ছেলেকে নিয়ে তার আর চিন্তা রইলো না। এবার সে শান্তিতে কবরের ঘুম ঘুমাতে পারবে।

—” আপু,আমি ওকে আপনার কাছে আজ থেকে এক সপ্তাহ পর পাঠিয়ে দিবো। কারন এক সপ্তাহ পর আমি চলে যাবো। তাই যাবার আগে আমি চাই এ পুরো সপ্তাহ টা আমার ছেলের সাথে কাটাতে।”

রাত্রি কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। বহু ক্লান্তি নিয়ে বাড়ী ফিরলো সে। এত টা দিনে সে একবারও ঘরের কোনো জিনিসের প্রতি খবর রাখে নি। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত স্কুল এরপর শাফির সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বাড়ী ফিরে আসতো, এসে মাঝে মাঝে খেতো না হলে ঘুমিয়ে পড়তো। শুক্রবার পুরো দিন শাফির বাড়ীতে তার সাথে থাকতো । বাড়ীর প্রতিটা মানুষ তার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করে কারন সাগর সবাইকে খুব সাবধান করে দিয়েছে যে তার বউ যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে থাকুক। তাই সবাই ওই কথা ধরে পড়ে আছে। সাগর সকালে চলে যায় অফিসে আর রাতে ফিরে আসে। সে কারো কোনো খবর নিচ্ছে না। রাত্রির উপর তার কঠিন অভিমান জমে গিয়েছে, পর পর দুটো দিন সে তাকে আবার সেই ছেলের সাথে দেখেছে। রাত্রির উপর সেই দিন থেকে তার প্রচুর রাগ আর অভিমান জন্ম নিয়েছে।
তাই সে এখন বেপরোয়া ভাবে চলে। মন চাইলে বাড়ীতে আসে নাহলে আসে না।অফিসে কাজ বলে থেকে যায়।
মায়ের সামনে ভুলে পড়ে গেলে সে ক্লান্ত বলে চলে যায়।
শাহিনুর মনে মনে ভাবেন তার ছেলে আর ছেলের বউ কে হারিকেন দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। ঘরে ওদের দেখা
ই মিলে না। তিনিও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। সবকিছুর জন্য শুধু তিনি নিজেকে দায়ী মনে করে। তার জেদের কারণে সব ধ্বংস হয়ে আছে।
নানান টেনশন আর ডিপ্রেশনে উনার দিনকাল যাচ্ছে। নাওয়া -খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন।
শরীর টা কেমন শুকিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তার মন বড্ড কু ডাকছে কয়েক টা দিন থেকেই। সিদ্ধান্ত নিয়েছে,–” ছেলেকে সে তার সব প্রশ্নের জবাব দিবে।”
সে কয়েকটা দিন থেকেই ছেলেকে খোঁজ করছে কিন্তু কোনো খবর পাচ্ছে না। সাগর যখন বাড়ীতে আসে তখন তিনি ঘুমে থাকেন আর সাগরের আসার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। তাই সে ঠিক সময় তাকে পায় না। ‘সাগর তো তাকে বলেছে বৃষ্টিকে সে সুখে রাখবে সাথে রাত্রিকেও। দুজনকেই তাদের ইচ্ছামতো চলতে দিবে। কেউ যদি তাকে ছেড়ে দিতে চায় তাহলে সে চুপচাপ মেনে নিবে। ‘

বৃষ্টির সাথে তার সম্পর্ক অনেক টা স্বাভাবিক। সাধারন স্বামী-স্ত্রীর মতোই সম্পর্ক। সাগর সেদিন রাতেই বৃষ্টির কান্নামাখা মুখ দেখে বলেছে,–” তুমি চাইলে চলে যেতো পারো। ”

বৃষ্টি হতবাক দৃষ্টিতে তাকালো। সাগরের শান্তশিষ্ট কথা তার ভেতরে ভয়ানক ঝড় তুলে দিলো।
সে ঝড় টা সাগরের উপর রাগের মাধ্যমে দেখালো।
রাগে চিৎকার করে বলে,—” চলে যাওয়া এত সহজ? আমি কুমারী মেয়ে হওয়া স্বত্ত্বেও বিবাহিত ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে। সেখানে ডিবোর্সী হওয়ার পর আমার জীবন বুঝি আরো সুখী হবে? আমার কি অবিবাহিত ছেলের সাথে বিয়ে হবে? বরং আপনার বাড়ীর থেকেও খারাপ কোথাও হয়তো আমার ঠাঁই হবে।”

সাগর চুপ করে রইলো। সে জানে বৃষ্টি যা বলছে তার এক বিন্দুও মিথ্যা নয়। নিম্নবিত্ত মেয়েদের ভালো জায়গায় বিয়ে হওয়াই কষ্টসাধ্য, সেখানে ডিবোর্সী!!

সাগর গম্ভীর গলায় বলে,—“তাহলে তুমি কি চাও? সারাজীবন এভাবে কি কেঁদে কেঁদে থাকতে চাও?”

বৃষ্টি এবার ঠান্ডা কন্ঠে বলে —“আমি কি চাই সেটা আপনি ভালো করেই জানেন।”

—“আরেকবার ভেবে দেখো, সারাজীবন কি পারবে আমার অন্য স্ত্রীর সাথে মানিয়ে চলতে? তুমি আমার জীবন দ্বিতীয়জন, তাই আমি কখনোই প্রথমজনকে ছাড়তে পারবো না।”

—“আমি আপনাকে তো একবারও আপুকে ছাড়ার কথা বলি নি। আমি বলেছি আপনি উনার মতো আমাকে সম্মান আর ভালোবাসা দিবেন। এমন কেনো?উনার জায়গা আপনার কাছে বেশি, উনার প্রাধান্য বেশি আর আমি মূল্যহীন! আমি চাই যে আমাকেও উনার মতো মর্যাদা দেওয়া হোক!”

—“তুমি কখনো ওর জায়গা নিতে পারবে না।”

—“সেটা আমার ব্যাপার। আর আমি আপুর মতো হতেও চাই না,আমি যেমন আছি ভালো আছি। আমি শুধু প্রাপ্য সম্মান চাইছি।”

সাগর জবাব দিলো না। সেদিন থেকেই বৃষ্টি আর সাগরের সম্পর্ক অন্য রকম হয়ে যায়। সাগর বৃষ্টি আর রাত্রির সাথে স্বাভাবিক আচরন করে। তার বন্ধুরা তাকে বলে,, ‘বিয়ে তো করেছোসসই তাহলে এখন এসব ভেবে কি লাভ? বিয়ে করার আগে তো জানতিই যে তােকে বৃষ্টির সাথে থাকতে হবে। এখন এসব মনে আনার কোনো লজিক ই নেই। বরং এসব ভাবা ন্যাকামি!’

সাগর ও সেটাই ভাবে তার তো এখন এসব ভেবে সত্যি লাভ নেই। তাকে তো সংসার করতেই হবে দুজনের সাথে।

সাগর আজ অনেক আগেই রাতে ফিরে আসলো। বৃষ্টি বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। সাগর তাকে দেখে হকচকিয়ে যায়।

—‘কি হয়েছে? তুমি এমন করছো কেনো? ”

সাগরের আওয়াজ পেয়ে বৃষ্টি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। পেটে হাত দিয়ে কাঁদছে সে। সাগর বৃষ্টির অঙ্গে হাত রাখতেই বৃষ্টি তাকে ধরে কেঁদে উঠলো। বৃষ্টির কান্না দেখে সে আরো অস্থির হয়ে পড়লো।
সে অস্থির কন্ঠে সবাইকে ডাকতে লাগলো। সাগরে চিল্লানো শুনে রাত্রির ঘুম ছুটে গেলো, সে প্রায় দৌড়ে চলে আসলো ওদের রুমে। এক এক করে ঘরের প্রায় প্রতেকটা সদস্য এসে যায়।
চলবে!

#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi

|পর্ব ২৫|

সাগরের আওয়াজ পেয়ে বৃষ্টি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। পেটে হাত দিয়ে কাঁদছে সে। সাগর বৃষ্টির অঙ্গে হাত রাখতেই বৃষ্টি তাকে ধরে কেঁদে উঠলো। বৃষ্টির কান্না দেখে সে আরো অস্থির হয়ে পড়লো।
সে অস্থির কন্ঠে সবাইকে ডাকতে লাগলো। সাগরে চিল্লানো শুনে রাত্রির ঘুম ছুটে গেলো, সে প্রায় দৌড়ে চলে আসলো ওদের রুমে। এক এক করে ঘরের প্রায় প্রতেকটা সদস্য এসে যায়।

বৃষ্টির ব্যাথা বেড়েই যাচ্ছিলো, সে পেটে হাত চেপে চোখমুখ খিঁচে কান্না করছিলো। প্রত্যেকে হতবাক হয়ে বৃষ্টিকে প্রশ্ন করছিলো। বৃষ্টি দু-তিনবার গলগল করে বমি করে দিলো। সাগর আর রাত্রি দুজনে একসাথে এগিয়ে এসে ওকে ধরলো। দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো, সাগর চোখ সরিয়ে বৃষ্টিকে ধরে বসলো। বৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে ওর বুকে মাথা রাখলো।

সাগর সোহেলকে উদ্দেশ্য করে বলে,–” ভাইয়া, পিয়মকে কল করো! বলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে যেনো ডাক্তার নিয়ে আমার ঘরে এসে পৌঁছায়।”

সোহেল, সাগরের ফোন টা নিতেই সে বলে,–” ভাইয়া, কুইক। ও এখনো পথেই আছে।”

সোহেল দ্রুত নাম্বার ডায়াল করলো। রাত্রি পানি নিয়ে আসলো বৃষ্টিকে খাওয়ানোর জন্য। সাগর ওর হাত থেকে নিয়ে নিজে খাওয়াতে লাগলো। এতে রাত্রি কিছুটা কষ্ট পেলো তবে প্রকাশ করলো না। সে হালকা দূরে গিয়ে দাড়ালো। এক দৃষ্টিতে সাগরের দিকে চেয়ে রইলো সে।
_____________

—“কি হয়েছে ডাক্তার? বিশেষ কোনো সমস্যা?”

—“সিরিয়াস কিছু নয়। উনার ফুড পয়জনিং হয়েছে। বাজে কিছু খেয়েছেন বোধ হয়। যার ফলে উনি এত টা উইক হয়েছে।”

—” আর ইউ সিরিয়াস ডক্টর?”

–“জ্বি একশ পার্সেন্ট।”

—“কিন্তু কীভাবে?কারন ও গত কয়েকদিন নয় বরং গত কয়েক মাস থেকেই বাহিরের কিছুই খায় নি। ”

—“কিন্তু রিপোর্ট তো বলছে উনি দুদিনের বাসি, পঁচা খাবার খেয়েছেন। আর এটা খুব আনহেল্থি শরীরের জন্য! ”

সাগর কিছুকৃষণ চুপ করে রইলো। এরপর নিজের সাথে হিসেব মিলিয়ে বলে,
—“আচ্ছা,ঠিক আছে ডক্টর। আমি দেখছি। আপনি কাল না হয় এসে আরেকবার চেক আপ করিয়ে যেয়েন।”

–” ওকে,মিস্টার চৌধুরী। আমি চেষ্টা করবো যথাসময়ে আসার।পেশেন্টের খেয়াল রাখবেন।”

সাগর হু বলে ফোন কেটে দিলো। বারান্দা থেকে ফিরে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো কাপড় নিয়ে। অফিস থেকে আসার পর এখনও চেঞ্জ করে নি সে। বৃষ্টিকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে শেষ। পিয়ম ডাক্তারকে নিয়ে এসেছিলো মিনিট দশকের মধ্যেই। সে হলো সাগরের পি এ। সাগরকে ভাই বলে সম্বোধন করে। ভার্সিটি লাইফে ও সাগরের জুনিয়র ছিলো। এলাকার বলে সাগর নিজেই ওর চাকরীর টা জোগাড় করে দিয়েছে।
ডাক্তার হালকা-পাতলা ট্রিটমেন্ট করে কিছু সেম্পোল নিয়ে যাই ক্লিনিকে টেস্টিং এর জন্য। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই তিনি সব রিপোর্ট সাগরকে জানান।

ওয়াশরুম থেকে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বের হয়ে গেলো সে। ব্ল্যাক টাউজার, আর নেভি ব্লু টি-শার্ট। সামনের চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। মুখ টা স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে! সাগর হাতের তোয়ালে টা ছুঁড়ে মারলো আলনার দিকে।

পুরো রুম ফাঁকা! সবাই সবার রুমে চলে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। বৃষ্টি চোখ বন্ধ করে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। মুখ টা শুকিয়ে কালো হয় আছে! দেখেই বুঝা যাচ্ছে ক্লান্ত সে।

সাগর ওর পাশে বসলো। গভীর ভাবে ওকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। দু সেকেন্ডের মধ্যেই বৃষ্টি চোখ খুলে ওর দিকে তাকালো, কারন ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিলো ~’কেউ ওকে দেখছে।’

সাগর রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি কাঁচুমাচু হয়ে ওর দিকে তাকালো। সে বুঝে উঠছে না, এভাবে তাকাচ্ছে কেনো তার দিকে? সে কি কিছু করেছে নাকি?

সাগর গম্ভীর কন্ঠে বলে,
—“তুমি আমাকে না বলে বাহিরে গিয়েছো কেনো?”

—” কীহ? কই,আমি বাহিরে যাই নি তো।”

সাগর রাগী গলায় বলে,–“মিথ্যা বলছো কেনো?”

—” সত্যি কথাই বলছি আমি বাহিরে যাই নি।”

কথা টা বলে আবার তাচ্ছিল্য করে বলে,” এ বাড়ী তে কি আমার এত স্বাধীনতা আছে নাকি?”

সাগর ওর সামনে পিজ্জার প্যাকেট টা রেখে বলে, —“তাহলে এটা কই থেকে আসলো?”

বৃষ্টি ভ্রু কুচকে তাকালো। তারপর মনে পড়া ভঙ্গিতে বলে,–” এটা তো রাত্রি আপু এনেছিলো। ”

সাগর শান্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। সাগর বলে, —“তোমার এসব খেতে ইচ্ছে করেছে সেটা আমাকে না বলে রাত্রিকে কেনো বলেছো? আমি কি তোমার ভরণপোষণ পূরন করতে পারবো না?”

—“আপনি ভু্ল ভাবছেন। আসলে এটা আপু এনেছিলো উনার জন্য। পরশু ফ্রিজে রাখার পর উনি ভুলে গিয়েছেন, পরে আমি উনাকে দেখাতেই বলে,’উনার নাকি খেতে ইচ্ছা করছে না।’ আমি বলেছি তাহলে আমি খেয়ে ফেলি? আসলে আমার না এটা খাওয়ার খুব শখ। আমি শুধু শুনেছিলাম, কখনও খাই নি তাই। পরে আপু বলেছে ‘আমি যেনো খেয়ে নেই।'”

–“ও বললো, আর তুমি খেয়ে নিলে?”

বৃষ্টি কাঁচুমাচু হয়ে বসলো। সে মিনমিন গলায় বলে,–” এটা খাওয়ার জন্য আমার খুব শখ ছিলো।”

—“খাওয়ার সময় একটুও টক লাগে নি?”

বৃষ্টি ছোট মুখ করে বলে,–“লেগেছিলো তো।”

—“তাও,খেয়েছো? বুঝো নি ওটা পঁচা খাবার?”

—” আমি কি জানতাম নাকি? আমি ভেবেছি এটার টেস্ট মনে হয় এমন ই হয়।”

সাগর রেগে গেলো। ওর দিকে তেড়ে এসেও থেমে গেলো। দাঁত চেপে বলে,–“এবার মিটেছে তোমার শখ?”

বৃষ্টি মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। সাগর রেগে ওখান থেকে উঠে বাহিরে চলে গেলো। রুম থেকে দু কদম বাহিরে যেতেই ওর ফোন বেজে উঠলো। সাগর তাকিয়ে দেখলো রনি, ওর ফ্রেন্ড ফোন করেছে।

ফোন রিসিভ করে কানের কাছে নিতেই ওপাশ থেকে অস্থির হওয়া কন্ঠ ভেসে আসলো।

—” ওই,তোর বউকে কি তুই ডিবোর্স দিয়ে দিয়েছিস?”

ফোনের ওপাশ থেকে এমন কথা শুনে সাগর থমকে যায়। হাত টা কেপে আলগা হয়ে উঠলো। সে ফোনটা শক্ত করে ধরে বললো,–” কি যা তা বলছিস?”

–“আরে আমি যা তা কই বলছি। সত্য কথা বলছি বলেই এমন লাগছে।”

সাগর থমথমে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
—“প্যাঁচানো বন্ধ করে সোজা কথা বল।”

—” সোজা কথা? ওকে শোন, তোর বউকে দেখলাম, এক ছেলের হাত ধরে রেজেস্ট্রি অফিসের সামনে দাড়িয়ে হাটাহাটি করছে। দুজনেই খুব হাসিখুশি ভাবে কথা বলছিলো। তোর বউয়ের হাতে একটা পেপার দেখেছিলাম। বোধ হয় ছেলেটাকে ও বিয়ে করে ফেলেছে রে। কারন আমার ধারনা ওটা বিয়ের কাগজ ছিলো। যাই হোক এটা বল, ওকে ডিবোর্স দিয়েছিস কবে? আমাদের জানালি না তো।”

সাগরের চোখমুখ শক্ত হয়ে গিয়েছে। হাত-পা ভীষণ কাঁপছে। ও কি বলছে? সাগর নিজেকে যথাসম্ভব ঠান্ডা করে বলে,–” তুই ওখানে কেনো গিয়েছিস?”

রনি গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে,–” আর বলিস না, বাবার আড়াইলের পাশের জমি টা নিয়ে ঝামেলা চলছিলো। ওটার কাগজ আনতেই গিয়েছিলাম। তখন ভাবীকে দেখেছি, আমি উনার পাশে কতক্ষণ দাড়িয়েছিলাম। কিন্তু উনি আমার দিকে তাকান ই নি। তাই চলে আসলাম, আসলে আমার নিজ থেকে কথা বলতে শরম করছিলো।”

সাগর চুপ করে সব শুনছে। সাগরের নিরবতা দেখে ও বলে,–” এবার তো বল কি হয়েছে তোদের মধ্যে?ওকে ছেড়ে দিয়েছিস কেনো?”

সাগর কান থেকে ফোন টা আলগা করে নিলো। চুপচাপ ফোন টা কেটে। রাত্রির রুমের সামনে গিয়ে দাড়ালো। দু-তিনবার নক করতেই রাত্রি দরজা টা খুলে দেয়। সাগরকে দেখে ও ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। শাড়ী টা ভালোমতে গায়ে জড়িয়ে নিলো। সাগর কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ও বলে, —” বৃষ্টির কি আবার কিছু হয়েছে? আমি আসবো?”

সাগরর কোনো জবাব দিলো না, ও রাত্রিকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকলো। আজ কতদিন পর ও এ রুমে এসেছে তার ঠিক নেই। কিন্তু ওর মনে হচ্চে ও কয়েকবছর পর রুম টায় এসেছে। সব কিছু পরিবর্তন হয়ে আছে। রুমে বেশ দামী জিনিসপত্র রয়েছে। সে হেটে হেটে সব দেখছে।

রাত্রি তাকে এভাবে ঘুরের ঘুরে সবকিছু দেখতে দেখে ভ্রু কুচকালো। এদিকে যে সে এতবার প্রশ্ন করে যাচ্ছে তার কোনো জবাব দিচ্ছে না সাগর।

সে আবার বলে,—” কি হলো বলছো না কেনো?”

সাগর বলে,–” ও এখন সুস্থ আছে। ঘুমুচ্ছে।”

রাত্রি বলে,–“ওহ। ঘুমুচ্ছে বলেই কি এখন আমার কাছে এসেছেন?”

সাগর ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,

—” বাহ, বেশ সুন্দর করেই রুম সাজিয়েছো। ওই ফুলদানী টা বেশ চকচক করছে। মনে হচ্ছে অনেক দামী। কত নিয়েছে এটা?”

রাত্রি ফুলদানীর দিকে তাকালো। তার মুখে কিছুটা হাসি ফুটে ওঠলো। এটা তার খুব প্রিয়। কারন শাফি তাকে দিয়েছে। রাত্রি ফুলদানী টা ছুঁয়ে বলে, –” এটা কিনি নি। কেউ একজন দিয়েছে আমাকে?”

সাগর বেশ মনোযোগ দিয়ে রাত্রিকো পর্যবেক্ষণ করলো। সে পাল্টা প্রশ্ন করলো,–“তা কে দিয়েছে?”

রাত্রি দুষ্টু হেসে বলে,—“বলা যাবে না। সিক্রেট।”

সাগর চোখমুখ শক্ত করে ওর মুখপানে চাইলো। হঠাৎ অতিরিক্ত রাগ উঠে গেলো। রাত্রির একদম কাছে এসে ওকে ওয়ালের সাথে চেপে ধরলো। আচমকা এমন হওয়ায় রাত্রি হকচকিয়ে যায়।

সাগর তেজী গলায় বলে,—” আজ তুমি রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়েছিলে?”

রাত্রি থতমত খেয়ে যায় ওর প্রশ্নে। তারপর আমতা আমতা করে বলে,–” আমি বলতেছি বিষয়টা,,,”

সাগর অতন্ত রাগ নিয়ে বলে,– জাস্ট হ্যা অথবা না বলো। এতকিছু শুনতে চাই না।”

–” আরে আগে,,”

সাগর দাঁত চেপে বলে,
—“আমি বলেছি শুধু হ্যা অথবা না বলো!”

রাত্রি আবার কিছু বলতে নিচ্ছিলো কিন্তু সাগরের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলে নি। সে চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে বলে,–“হ্যা,কিন্তু,,”

চলবে!

#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi
|পর্ব ২৬|

—“আমি বলেছি শুধু হ্যা অথবা না বলতে!”

রাত্রি আবার কিছু বলতে নিচ্ছিলো কিন্তু সাগরের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলে নি। সে চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে বলে,–“হ্যা,কিন্তু,,”

রাত্রির পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে সাগর কঠিন মুখে বলে,–” সাথে একটা ছেলেও ছিলো?”

রাত্রি মাথা নাড়ালো। সে বলতে নিচ্ছিলো কিছু তার আগেই সাগর চোখ গরম করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,–“চুপ! একটা কথাও বলবা না। নাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

রাত্রি ভয় পেয়ে চুপ করে যায়। সাগর রেগে ওকে আবার ওয়ালের সাথে চেপে ধরলো, রাত্রি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে ওর দিকে তাকাতেই ওকে ছেড়ে দূরে সরে গেলো সাগর।পুরো রুম এলোমেলো করে ও রাত্রির ফোন খুঁজতে লাগলো।

—” আরে,আমার কথা তো শুনুন। আপনি রুম নষ্ট করছেন কেনো? কি খুঁজছেন আমাকে বলেন।”

সাগর রাত্রির কথা কানে না নিয়ে ফোন খুঁজায় ব্যস্ত হয়ে রইলো। টেবিলের পাশ থেকে ফোন টা এনেই রাত্রির সামনে নিয়ে এসে বলে,—” নাও, এক্ষুণি ফোন দাও। আর বলো তুমি এ বিয়ে মানো না।”

রাত্রি তব্দা খেয়ে যায় সাগরের কথায়। সে বিষ্ময় নিয়ে বলে,–” কিসের বিয়ে? কার বিয়ে?”

সাগর দাঁত চেপে বলে,–“একদম ঢং করবা না। সরাসরি ফোন দিয়ে বলবা তুমি এ বিয়ে মানো না। ছেলে যদি বেশি নাচানাচি করে তাহলে ডিবোর্সের এপ্লাই করো।”

—” কিসের বিয়ে আর কিসের ডিবোর্স?”

রাগে সাগরের নাকের ডগা লাল হয়ে গেলো। রেগে বলে,–” একদম, অভিনয় করবা না। সেদিন যে ছেলের সাথে গাড়ী করে বাড়ীতে এসেছে, হাত ধরেছো, চুমু খেয়েছো তার কথা বলছি।”

রাত্রি ছোট ছোট চোখ করে মনে করার চেষ্টা করলো। সাগর ওর দিকে কঠিন দৃষ্টি ফেলে বলে,–“চুপচাপ ওকে ডিবোর্স দিবি। রিলেশন করেছিস মেনেছি! ওর সাথে রাত-বিরাতে বাড়ীর বাহিরে ছিলি কিছু বলি নি। কিন্তু বিয়ে? নেভার, আমি কখনোই মানবো না। তোকে মেরে ফেলবো তবুও অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিবো না। হোয়াট দ্যা হেল? আমার বউ তুই, আমি তালাক না দিতে তুই আরেকজনকে কীভাবে বিয়ে করতে পারিস?”

রাত্রি এবার রেগে গেলো। কিসব আবোলতাবোল বলছে ওর নামে? আর ওর সাথে তুই-তুকারি করছে কেনো? এতে তার বেশ রাগ হলো।

সে জানে না, সাগর কি বলছে? কার কথা বলছে! তবুও
সে উল্টো রাগ দেখিয়ে বলে,–” ভালো করেছি বিয়ে করেছি। যাকে করেছি ভালো করেছি। আপনিও তো আমার স্বামী হওয়া স্বত্বে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করেছেন। আমার সামনে অন্য মেয়ের সাথে সংসার করছেন তাহলে আমি করলেই দোষ কেনো?”

সাগর এবার আরো রেগে গেলো। সে রাত্রির বাহু জোরে চেপে ধরে বলে,–” তুমি যার সাথে ইচ্ছা থাকো। যেখানে ইচ্ছা যাও। বাট অন্য কাউকে বিয়ে কেনো করবে? তুমি ওই ছেলের সাথে থেকেছো,শুয়েছো সব করেছো। আমি কিছু বলেছি? না বলিনি।
কিন্তু বিয়ে করে চলে যাবা? এটা আমি সাগর কখনোই মানতে পারবো না। ছেলেটাকে বলো ভালোই ভালোই তোমাকে যেনো তালাক দিয়ে দেয় নাহলে আমি এমন কিছু করে বসবো যার জন্য তাকে বহুত প্রস্তাতে হবে।”

রাত্রি চোখ কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে ফুলছে। এসব হাবিজাবি কি বলছে? রাগে শরীর রি রি করছে। মনে মনে বলে নিজে খারাপ বলে সবাইকেও কি তার মতো মনে করছে নাকি?

রাত্রি তাচ্ছিল্যেরর সুরে বলে, –” বউয়ের চিন্তায় কি পাগল হয়ে গিয়েছেন নাকি? না মানে বউ অসুস্থ হয়েছে বলেই কি এসব আবোলতাবোল আমার নামে বলছেন?”

সাগর চোখ গরম করে ওর দিকে তাকায়! রাত্রি পাত্তা দিলো না! সে বলে,–” এভাবে তাকালে আমি ভয় পেয়ে দমে যাবো না! আপনি এত দিন এত মাস আমার সাথে সংসার করেছেন আমি কেমন সেটা ভালো করেই জানেন! এরপরেও নিজের মনমতো যা নয় তা আমার নামে চাপিয়ে দিচ্ছেন। যে আওয়াজ করে কথা বলেছেন আমার মনে হচ্ছে এই এলাকা কি পাশের এলাকারর মানুষ ও শুনেছে। আপনার উদ্দেশ্য আমি বুঝেছি আপনি চান আমি যেনো অপমানিত হয়ে লজ্জিত চেহারা নিয়ে এ বাড়ী ছেড়ে দেই। আর আপনি আপনার নতুন কচি বউয়ের সাথে সুখে সংসার করতে পারেন। তাই না?”

রাত্রির কথা শুনে সাগরের পুরো শরীর নাড়া দিয়ে উঠলো। ছিঃ, কি জঘন্য চিন্তা!

সাগর শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।
খুব শান্ত স্বরে বলে,
—“তুমি আমাকে এতটা নিচ মনে করো?তোমাকে অপবাদ দিয়ে বের করে দিতে চাই আমি? আমাকে এমন মনে হয় তোমার?”

রাত্রি ওর পাল্টা প্রশ্ন করে,—“তাহলে আপনার কীভাবে মনে হলো আমি অন্য ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেছি? অন্য ছেলের সাথে রাত দিন কাটিয়েছি?”

—” তোমার বিষয় আর আমার বিষয় টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি নিজ চোখে দেখেছি, নিজ কানে শুনেছি। আমার টা তুমি আন্দাজে ঢিল মারছো। কিন্তু আমার সমস্যা এটা নয়, আমার সমস্যা হলো তুমি অন্য কাউকে বিয়ে কেনো করবা? ”

রাত্রি বলে,–” কেনো আমি কি বিয়ে করতে পারি না? আপনি তো বিয়ে করেছেন আমি কিছু বলেছি? তাহলে আমি কেনো পারবো না?”

সাগর কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। রাত্রিকে খুব সহজ আর স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, ওকে একদম অস্বাভাবিক লাগছে না! সাগর একটু হাসলো। হুট করে রাত্রির সামনে এসে দাড়িয়ে যায়।

সাগর তার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
—” তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাও?”

রাত্রি হালকা আওয়াজ করে বলে,–“হু!”

সাগর তৎক্ষণাৎ সরে আসলো। ওর থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে কঠিন আওয়াজ করে বলে, –” ঠিক আছে বিয়ে করো। তার আগে আমাকে মেরে ফেলো। কারন তোমাকে বিয়ে আমার লাশের উপরে দিয়ে করতে হবে। যতদিন আমি বেঁচে আছি ততদিন তোমার বিয়ে অন্য কোথাও সম্ভব নয়। তবে তুমি চাইলে তার কাছে রাত-দিন থাকতে পারো আমার সমস্যা নেই, কিন্তু দিনশেষে তোমাকে আমারই হতে হবে। কারন তুমি আমার বিবি। আমার অর্ধাঙ্গী,আমার বউ, আমার ওয়াইফ,আমার বেটারহাফ! বেঁচে থাকতে, আমি ছাড়া এ অধিকার তোমার জীবনে অন্য কোনো পুরুষ পাবে না। তাই অন্য কারো সাথে সংসার করার আগে আমাকে মেরে ফেলো।”

রাত্রি হতবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলো। সে কল্পনাও করে নি সাগর এতটা সিরিয়াস হয়ে যাবে। সাগর এখনো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রাত্রি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে ওর মুখ পানে চেয়ে ছিলো।
ওদের মধ্যে অনেক্ষণ নিরবতা রইলো। দুজনে চুপচাপ একে অপরের নিঃশ্বাস শুনছিলো। রাত টা কেটে যায় গভীর আঁধারের ভীড়ে!

নতুন আলো আর উদ্যম নিয়ে সকালের সূর্য উঁকি দিলো। ঊষার আলোয় চারপাশ রঙ্গিন হয়ে আছে। পাখিরা কিচিরমিচির ডাকছে,তাজা হাওয়া দক্ষিণ দিক হতে প্রবল বেবে বইছে। গাছপালা এদিক ওদিক হেলেদুলে নাচছে।

এক অন্যরকম সকাল হলো রাত্রির জন্য। সে উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙ্গতে লাগলো। বিছানা থেকে নামতে নিচ্ছিলো তখন অনুভব করলো ওকে কেউ ধরে রেখেছে। পেছনে ফিরে সাগরকে ওর জামা ধরে থাকতে দেখে রেগে গেলো।

সে রেগে ওকে ধাক্কা দিয়ে বলে,–” লুচু লোক। ছাড়ুন, আমাকে! কি বেহাল অবস্থা করেছেন আমার। শুধু মাত্র আপনার জন্য এ গরমে আজ আমাকে ফুলহাতার জামাকাপড় পড়তে হবে। ছাড়ুন! ”

রাত্রির ধাক্কায় সাগর এক চুলও নড়েনি। এতে সে বেশ বিরক্ত হলো। তাকে নাড়াতে পারবে না জেনেও কেনো ধাক্কা দিয়ে শুধু শুধু শক্তি অপচয় করছে?
ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে,– ফ্রেশ হয়ে গিয়ে বৃষ্টিকে একবার দেখে এসে আপডেট নিউজ জানাও আমাকে। কুইক! ”

—” আমার আর কাজ নেই আপনার কলিজার কাছে যাওয়ার। এর থেকে বরং আপনি যান। যেখানে আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াতে বিশ্বাস করেন না সেখানে ওর কাছে একা পাঠিয়ে দিচ্ছেন? ভয় করছে না?”

সাগর খুব বিরক্তি নিয়ে ওর কথা শুনলো। সে চোখ বন্ধ রেখেই বলে,–” বেশি কথা বলবা না। ওর এ অবস্থা তোমার জন্যই হয়েছে। ওকে বাসি,নষ্ট পিজ্জা কে খেতে দিয়েছে?”

–” আমি খেতে দিয়েছি মানে কি? ও শখ করে খেতে চেয়েছিলো এখন আমি বারন করলে আবার কি মনে করতো। তাই আমি বারন করি নি।”

–” হ্যা জানি। ওটা ও কখনো খায় নি, তাই চেয়েছিলো। এ কথাটা শুনে রাতে সাথে সাথে আমি সাত প্যাকেট ওর্ডার দিয়েছিলাম। কি জানি খেয়েছে কি না? ”

রাত্রি বলে,–“বাহ, ভালো তো। বউ খেতে চেয়েছে একসাথে সাত প্যাকেট। আরো কয়েক প্যাকেট নিয়ে আসতেন!”

সাগর বিরক্তি নিয়ে বলে,–“আমি খুব ক্লান্ত, তোমার সাথে এখন অযথা বকবক করতে পারবো না। প্লিজ গিয়ে ওকে একবার দেখে আসো!”

–“হ্যা যাচ্ছি যাচ্ছি। আর কত কি যে আমাকে করতে হবে!”

রাত্রির কথাগুলো যে রসিকতার ছিলো তা টের পেয়েছে সাগর। সে ঘুমের মধ্যেই হালকা হাসলো। মেয়েরা কত ধরনের ঢং, কত তালে কথা বলতে জানে। তার বউকে না দেখলে সে জানতোই না ।

চলবে!