বেটারহাফ পর্ব-৩০

0
2831

#বেটারহাফ
nishat Tasnim Nishi

|পর্ব_৩০|

সাগরের মুখ টা মলিন হয়ে যায়। বুক টা ছেৎ করে ওঠে। রাত্রি কি এর মধ্যে ওর বাবার সাথে যোগাযোগ করে নি? ওর তো ফোন আছে। স্কুল থেকেও তো এসে দেখা করতে পারতো। তাহলে সে যোগাযোগ করে নি কেনো? হোয়াই? সাগর তো ভেবেছে রাত্রি তার বাবার সাথে যোগাযোগ করে। হঠাৎ করেই সাগর কথা শুন্যতায় ভুগতে লাগলো। এমন সময় বৃষ্টি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সাগরের পাশে দাড়ালো।

সে এসেই বলে,–“আমি কখন থেকে আপনাকে ডাকছি জ্বি বলছেন না কেনো?”

সাগর সোজা স্তম্ভের মতো দাড়িয়ে রইলো। তার মুখে কোনো কথা নেই। রায়হান বৃষ্টির দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায়। তার মাথায় চলছে ও কে?

তিনি সাগরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির দিকে ইশারা করে বললেন,–“ও কে? তোমাকে কেনো খুঁজছে?”

সাগর নিশ্চুপ। তার মুখে কোনো কথা নেই। রাত্রির বাবা এবার আরো একবার প্রশ্ন করলেন। সাগরের এবার রাত্রিকে সকালে বলা কথা মনে পড়ে। সে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো। মিনমিন করে বলে,–“ও বৃষ্টি। আমার ওয়াইফ!”

সাগরের কথা শুনতেই রায়হানের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। হতভম্ভ দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকালেন। বৃষ্টিকে বারবার পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। বৃষ্টিও কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে এর আগে কখনো দেখে নি রায়হানকে। চোখমুখে কৌতুহল নিয়ে সাগরের দিকে তাকালো সে। সাগর তার চোখের ভাষা বুঝতে পারলো,তাই সে খুব ছোট আওয়াজ করে বলে,’উনি রাত্রির বাবা।’

বৃষ্টি সেটা শুনতে পেলো না। সে কপালে ভাজ ফেলে চেয়ে রইলো সাগরের দিকে আবার শুনার জন্য। সাগর এবার আরেকটু জোরে বলতেই সে শুনতে পেলো।

বৃষ্টি হন্তদন্ত হয়ে রায়হানের পা ধরে সালাম করতে নিলো– রায়হান সাথে সাথে সরে গেলো। বৃষ্টি একটু অবাক হলো, সে হালকা হেসে মুখে সালাম দিলো। রায়হান বৃষ্টির দিকে না তাকিয়ে সাগরের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,–“আমার মেয়ে কই?”

সাগর মাথা নিচু করে রইলো।বুক ঢিপঢিপ করছে তার ভয়ে। রায়হানের চোখে মুখে রাগ এবার স্পষ্ট দেখা দিলো। সে বুঝলো সাগর মোটেই মজা করছে না।

সাগর কিছু বলছে না দেখে, বৃষ্টি বলে,–“আঙ্কেল আসুন আগে আমরা বউ দেখে আসি। পরে এসব নিয়ে নাহয় কথা বলিবেন।”

রায়হান বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ধমকে বলে উঠে,–” চুপপপ।”

বৃষ্টি সহ আশেপাশের মানুষজন কেঁপে ওঠে তার ধমকে। বৃষ্টি তাকাতেই তিনি বলে,–“আমার মেয়ের খবর নেই আর আমি বিয়ে খেতে যাবো?”

বৃষ্টি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,—” ন্ না। আমি স্ সেটা ব্ বলি ন্ নি তো। ”

রায়হান তার কথা শুনে যেনো তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। সে তার দিকে তেড়ে গিয়ে বলে,–“একদম কথা বলবা না। আমার মেয়ের সংসার শেষ করে এসে আবার আমাকেই বুঝাচ্ছো? তোমাদের মতো মেয়েদের না খুব চেনা। দেখে তো বুঝা ই যাচ্ছে থার্ড ক্লাস শ্রেনির মেয়ে। নিশ্চয়ই শরীর দেখিয়ে আমার মেয়ের জামাইকে বশ করেছো? ছিঃ, তোমাদের মতো মেয়েদের কি বিন্দু পরিমান লজ্জা নেই? নিজের কাছে কি সামান্য পরিমাণ খারাপ ও লাগে না অন্যের সংসার ভাঙ্গতে? ”

বৃষ্টি চুপ করে মাথা নিচু করে আছে। সবাই তার দিকে চেয়ে আছে। অপমানে চোখে জল চিকচিক করছে। সাগর কিছু বলছে না, সে শুধু চেয়ে আছে বৃষ্টির দিকে।

রায়হানের মেজাজ খুব বাজে ভাবে বিগড়ে গিয়েছে। সে বৃষ্টির পাশে থু থু ফেলে বলে,–” তোমাদের দেখলে আমার ঘেন্না লাগে।কি আর পারো তোমরা? চোখের জল আর ইজ্জত বিসর্জন দিয়েই তো পর পুরুষদের হাত করো। তোমরা কি আসলেই নারী?কীভাবে পারো আরেকজনের সংসার নষ্ট করতে? এসব শুধু ফ্যামিলির শিক্ষার অভাবে হয়ে থাকে। নষ্টা মেয়ে কোথাকার।”

বৃষ্টি চোখ তুলে তাকায় রায়হানের দিকে। চোখের জল গাল বেয়ে গলায় নেমে গিয়েছে। শেষের কথা টা যেনো তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তার বলতে ইচ্ছা করলো, ” কি বলছেন এসব?কিসের সাথে কিসের কথা? আপনি পাগলের মতো এসব কি বকছেন?”

সে কথা টা মুখ দিয়ে না বের করে সাগরের দিকে তাকালো। সাগর তখনও বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। তাই বৃষ্টি চুপ করে গেলো। মাথা নিচু করে সব হজম করার চেষ্টা করলো।

রায়হান বলে,’ তোমাদের মতো মেয়েদের পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার নেই। মরে যাওয়,,,,, ”

তার পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে সাগর কষিয়ে চড় মারলো বৃষ্টির গালে।

রায়হান সহ উপস্থিত সবার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেলো। বৃষ্টি আকস্মিক কান্ডে হতবাক হয়ে যায়। সে গালে হাত দিয়ে তাকাতেই সে বলে,”আশা করি এ থাপ্পরের পর তোমার শিক্ষা হবে।”

এটুকু বলেই সে অনুষ্ঠান ছেড়ে দিয়ে গাড়ীর দিকে হাটা দিলো। বৃষ্টি বাদে বাকি সবাই হতভম্ভ হয়ে দাড়িয়ে রইলো।

রায়হান সাগরের চলে যাওয়া দেখে সে ওকে পিছন থেকে ডাকতে লাগলো।

বৃষ্টির দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাতেই বৃষ্টি বলে,–“এতক্ষণ আপনার যা ইচ্ছা হয়েছে তাই বলেছেন। বিনা কিছু জিজ্ঞাস করেই আমাকে উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়েছেন।

আপনি বলেছেন আমি আপনার মেয়ের জামাইকে হাতিয়ে নিয়েছি।
আমার প্রশ্ন আপনার মেয়ের জামাই কি বাজারের কোনো পন্য নাকি যে, যে ব্যক্তি চওড়া দাম দিতে পারবে সে নিয়ে যেতে পারবে?
আপনার জামাই কি এতই বোকা যে সে এসব বুঝবে না?
ছেলে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে শুনে আপনি ফট করেই তার দ্বিতীয় বউ এর দোষ দিলেন। অথচ যে বিয়ে করেছে তার কোনো দোষ নেই। সে নিষ্পাপ দুধের বাচ্চা তাকে চকলেট দিয়ে ভুলিয়ে এসব করানো হয়েছে? তাই না? আপনাদের ধারনা দ্বিতীয় বিয়ে মানেই দ্বিতীয় বউ এর চক্রান্ত। কেনো বলেন তো? ছেলের কি কোনো দোষ নেই? সব দোষ কেনো মেয়েদের দেন?
ডিবোর্স/ একাধিক বিবাহ, এসব শুনলেই সবার আগে বলেন যে মেয়ের দোষ, মেয়ে ভালো না। ছেলে যদি এতই ভালো হয় তাহলে তো সে ওই খারাপ মেয়ের সাথে সংসার করতেই পারে। তাহলে তারা কেনো করে না?

শুনেন, বিয়ে তো মেয়ে আর একা একা করতে পারে না,সেখানে ছেলের পূর্ণ মতামতের দরকার হয়। তাই দয়া করে কিছু না জেনে, না বুঝে, অর্ধেক কথা শুনে কিছু বলবেন না। সব টা শুনে তারপর বলবেন। আর আপনি কেমন বাপ যে মেয়ের খবর ও রাখেন না?”

বৃষ্টি আর তার দিকে তাকালো না, সে সোজা হেটে চলে যায় গাড়ীর দিকে। আজ অনেকদিন পর সে মন খুলে কথা বলতে পেরেছে। সে শেষ গলা উঁচু করে কথা বলেছিলো রাত্রির সাথে। এরপর তো সাগরের নির্মম অত্যাচারের পর আর কোনো জবাব দেয় নি। তার ভেতরের যেটুকু পরিমাণ সাহস ছিলো সেটা গায়েব হয়ে গিয়েছিলো। সাগর তাকে সেদিনের ব্যবহারের জন্য যেদিন ‘সরি’ শব্দটা বলেছিলো সেদিন আরো কয়েকটা কথা বলেছিলো। মূখ্য কথা হলো, “সে জেনো এরপর থেকে কেউ কিছু বললে বিপরীত কথা বলে।”

বৃষ্টি তখন মাথা নিচু করেছিলো। সাগর সেটা দেখে হুট করেই চড় বসিয়ে বলেছিলো, যদি কিছু না বলে এভাবে থাকো তাহলে আমিও তোমাকে ঠিক এভাবেই মনে করিয়ে দিবো।

চড় টা সেদিন অবশ্য ধীরেই দিয়েছিলো। পরে আবার রাত্রির জোরাজুরিতে সে ওই চড়ের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলো। আজ কিন্তু সেদিনের মতো ধীরে মারে নি,খুব জোরেই মেরেছিলো। যার জন্য তার গাল টা এখন জ্বলছে। বৃষ্টি গাড়ীতে ডুকে ঠিকমতো না বসতেই কেঁদে দেয়। সাগর তার দিকে ঘুরে তাকায় নি। তার গাড়ীর সামনে এসে বর আর কনে দাড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো। সাগর গম্ভীর মুখেই তাদের বলে,–“এখন কিছু আবদার করিস না। নাহলে আমার দ্বারা খুব খারাপ কিছু হয়ে যাবে।”

তারা দুজন আর কিছু বললো না। এদিকে রায়হান তো ওদের গাড়ীর দিকে সাগরকে চেঁচিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো। সাগর সেদিকে তাকালো না। প্রচন্ড বেগে গাড়ী চালালো বাড়ীর উদ্দেশ্য। বৃষ্টি বসে ফিকরে কাঁদছে, লজ্জায় সেখানে কাঁদতে পারে নি,কিন্তু এখন আর সে নিজেকে আটকাতে পারছে না। রাগ আর জেদ দুটোই তার মধ্যে দেখা দিলো।

রায়হান ও সি এন জি নিয়ে ওদের পেছন পেছন যেতে লাগলো। মেয়ের জন্য মনটা বড্ড কাঁদছে। সে কেনো যে মেয়ের অনুরোধে এতদিন খবর নেয় নি তার খুব আফসোস হচ্ছে। সাগরের উপর মনে মনে সে এত টা বছর ঋণি ছিলো। সাগরকে নিয়ে তার খুব গর্ব হতো। কিন্তু আজ তার সাগরের প্রতি খুব পরিমাণ ঘৃণা কাজ করছে।

রাত্রির প্রতি তাহলে তার আর কোনো অনুভূতি নেই। তার মেয়েটার কথা একটি বারও ভাবলো না? দ্বিতীয় বউ নিয়ে তাহলে বেশ খুশি আছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ে করেছে কেনো? তার মেয়ের কি খারাপ কিছু হয়েছে নাকি?
রাত্রির বাবা বুকে হাত দিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। বুকে ব্যাথা করছে তার। তিনি তো হার্ট পেশেন্ট।

বাড়ীতে এসেই সাগর আর বৃষ্টি কিছুক্ষণ চুপ করে সোফায় বসেছিলো, সাগর যখন
উপরের দিকে উঠতে লাগলো। রায়হান তখনই এসে পৌঁছায়।

সে এসেই তার মেয়েকে ডাকতে লাগলো। মেয়েকে দেখার জন্য মনটা বড্ড ব্যাকুল হয়ে আছে। এদিকে ওসব শুনে মেয়ের জন্য চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাচ্ছে।

রায়হানের আওয়াজ পেয়ে সাগর থেমে যায়। সে জানতো যে রায়হান ঠিকই আসবে। আর সে এটাই চেয়েছে যে সে যেনো আসে। সে চায় রায়হান যেনো সবকিছুর মুখোমুখি হোক। তিনি যেনো তার মেয়ের মুখেই সব শুনেন। সবার সামনে যেনো সব আলোচনা হয়। তাই সে তখন এভাবে চলে আসে।

এদিকে চিল্লাফাল্লার আওয়াজ পেয়ে শাহিনুর নিচে নেমে আসে। তার কাছে কন্ঠসর টা অন্যরকম লাগছে। কে হতে পারে?

সিড়ির মাথায় আসতেই রাত্রির বাবার দিকে তার চোখ পড়লো। রায়হান তখন উপরের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। দুজনের দৃষ্টি বরাবর হয়ে গেলো। শাহিনুরের পা যেনো অসার হয়ে গেলো। রায়হান হা করে তাকিয়ে আছে, তার কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

এদিকে নিজে নিকে বকবক করতে করতে বাড়ীতে ডুকতে লাগলো রাত্রি। আজ মেজাজ টা বড্ড খারাপ। টিউশনি করানোর সময় এক মহিলা তাকে বলে যে,”তার নাকি ভাগ্য খুব ভালো। তার বাচ্চা হয় না,স্বামী বাচ্চার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করা সত্ত্বেও তাকে বাড়ী রেখেছে। এমন নাকি কপাল ওয়ালা কয়েকজনের সাথে হয়।” সে শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। তার মানে সে ফেলনা বস্তুু, তাকে ফেলে দেওয়া উচিত ছিলো? নিজের প্রতি তার খুব খারাপ লেগেছিলো। খুব অবাক ও হয়েছিলো যখন দেখলো তার মতো একজন মহিলা ই তাকে বলেছে কথা টা। তাই সে আর মনোযোগ দিয়ে পড়াতে পারে নি। ডিপ্রেশন মাথায় চড়ে বসেছিলো। এজন্য হাফ ক্লাস করিয়ে ছুটি নিয়ে চলে আসে।

বাড়ীতে ডুকেই নিজের বাবাকে দেখে হতবাক হয়ে যায় সে। সে তাকে যখন ডাকতে নিচ্ছিলো তখন দেখলো তার শাশুড়ি আর বাবা একে অপরের দিকে চেয়ে আছে। মুহূর্তেই তার সেদিনের সব কথা মনে পড়ে যায়।

রাত্রি খুব কঠোর কন্ঠে বলে,–” বাবাআ।”
এরপর একটু থেমে বলে,তুমি এখানে?”

রাত্রির আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই সবার হুশ ফিরে আসলো। রায়হান নিজের মেয়েকে দেখে বিষ্ময় আর খুশিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছে। মা নামক মধুর ডাক দিয়েই ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। রাত্রি মুখে অবাকতার ছাপ। সে কপালে ভাজ ফেলে নিজেও জড়িয়ে ধরলো।

—“মা,তুই ঠিক আছিস? কই গিয়েছিলি? আর তোর স্বামী নাকি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে ওই মেয়েকে? এসব সত্যি নাকি?”

রায়হান অনবরত প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। রাত্রি চুপ করে ছিলো, ধীর কন্ঠেই বলে যে হ্যা এসব সত্য।

মেয়ের কথা শুনা মাত্রই সে অসাড় হয়ে যায়। শরীরে জড়তা এসে ভীড় জমায়।
রায়হানের হঠাৎ শাহিনুরের কথা মনে পড়ে, সে ঘুরে তাকায় তার দিকে।

শাহিনুর খুব স্বাভাবিকভাবে পা ফেলে নিচে নামছে। সবাই নিশ্চুপ শুধুমাত্র তার হাটার আওয়াজের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সে নিচে নেমে এসে রায়হানের মুখোমুখি দাড়ালো।

চলবে