বৌপ্রিয়া পর্ব-০৬

0
389

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৬|

কুসুম লজ্জামিশ্রিত পায়ে বসার ঘরে এসে থামে। পা দুটো থমকে আছে, যেন এক্ষুনি হাঁটু ভে”ঙে নিচে গড়াবে। চোখের সামনে উচ্ছাস বসে আছে। উষা কুসুমকে এনে উচ্ছাসের পাশে বসাল। উচ্ছাস আড়চোখে একবার কুসুমকে দেখেই সঙ্গেসঙ্গে চোখ সরাল। হালুয়ার বাটি টেবিলে রেখে টিশার্ট টেনেটুনে উঠে দাঁড়াল। কুসুমের মা বাঁধা দিয়ে বললেন,

‘ উঠছিস কেন? চা খেয়ে যাবি। বস। ‘

উচ্ছাস খালামনির দিকে চেয়ে বেশ তাড়া দেখিয়ে বলে,

‘ খালামনি, অলরেডি ১ টা বেজে গেছে। আধা ঘন্টার মধ্যে হসপিটাল না পৌঁছাতে পারলে, আমার খবর করে দেবে ওরা। আজই কি সব জামাই আদর করে ফেলবে? আরেকদিন এসে খাব, ঘুরব, আর তোমার একেকটা স্পেশাল রেসিপি ট্রাই করব। কিন্তু আজ যেতে হবে। বুঝো প্লিজ। ‘

সাহেদার মন নরম হল বোধহয়। মাথা নেড়ে সায় জানালেও মনেমনে বোনের ছেলেকে নিজের নতুন রেসিপি মসলা চা বানিয়ে খাওয়ার ইচ্ছেটা মাটি হয়েছে দেখে আফসোসও হল বেশ। উচ্ছাস কুসুমের দিকে চেয়ে বলল,

‘ চলো কুসুম। ‘

কুসুম তাড়াহীন পায়ে উঠে দাঁড়াল। মায়ের থেকে বিদায় নিতে গেলে সাহেদা উচ্ছাসের অগোচরে মেয়ের কানে কিছু ভালো ভালো কথা ঢেলে দিলেন। কুসুম মিনমিন করে মাথা দুলাল মায়ের কথায়। উচ্ছাস ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছে। গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে কুসুমের। কুসুম বেরিয়ে এল। গাড়ির পেছন সিটে বসতে চাইলে উচ্ছাস ড্রাইভিং সিট থেকে বলে,

‘ সামনে এসে বসো, কুসুম। ‘

এমনিতেই কুসুম লজ্জা এবং অস্বস্থিতে আধখান হয়ে গেছে। এখন অব্দি উচ্ছাসের দিকে চোখ তুলে চাইতে পারছে না। সারা অঙ্গ যেন জমে যাচ্ছে। আর এখন নাকি উচ্ছাসের পাশে বসবে! কুসুম মানা করল না অবশ্য। উচ্ছাসের পাশের সিটে বসল। উচ্ছাস গাড়ি চালু করে বলল,

‘ সিট বেল্ট লাগিয়ে নাও। ‘

কুসুম সিটবেল্ট লাগিয়ে আবারও চুপ করে থাকল। উচ্ছাস বলল,

‘ অস্বস্থি হচ্ছে? জানালা খুলে দেব? ‘

‘ খুলে দিন। ‘

উচ্ছাস গাড়ির এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিল। সঙ্গেসঙ্গে বাতাস বয়ে গেল কুসুমের গা বেয়ে। কুসুমের চুল এলোমেলো হল। আরামে চোখ বুজে এল কুসুমের। কুসুমের কোমড় অব্দি লম্বা এবং ঘন চুল। কপালের সামনে কয়েকটা চুল কেটে রাখা। সেসব বেবি হেয়ারগুলো বারবার কুসুমের চোখে নাকে ঢুকে যাচ্ছে। বাতাসের কারণে চুল বড্ড জ্বালাচ্ছে কুসুমকে। তাই কুসুম চুলগুলো হাতখোঁপা করে নিল। বেবী হেয়ারগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকে দিল। আসার সময় উষা কয়েকটা ক্লিপ কুসুমের পার্সে রেখে দিয়েছে। সেগুলো এখন ভালোভাবেই কাজে লেগে গেল। কুসুমকে এতক্ষন চুপ থাকতে দেখে উচ্ছাসের ভ্রু কুঁচকে গেল। কুসুমের দিকে না চেয়েই সে বলল,

‘ একটু আগের ঘটনার জন্যে আ’ম সরি। আমি সত্যিই কিছু দেখিনি। দেখার আগেই চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। তুমি এমন অস্বস্থিতে ভুগো না। স্বাভাবিক থাকো। আর আমি তো পরপুরুষ নই। এত হ্যাজিটেশন ফিল করো না, কুসুম। ‘

আবার সেই পুরোনো কথা মনে পরলে কুসুমের গাল গরম হয়ে যায়। হাত দুটো বেয়ে ঘাম ছুটে। কুসুম জানলার দিকে চেয়ে মৃদু শ্বর বলে,

‘ আমি স্বাভাবিক আছি। ‘

উচ্ছাসকে এবার শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে দেখা গেল। মেয়েটা বড্ড ছোট এবং ইমম্যাচিয়র। এমন একটা মেয়েকে নিয়ে উচ্ছাস সারাজীবন কি করে কাটাবে? উচ্ছাস চিন্তা করে।
______________________
কুসুম খালার বাড়িতে প্রায় দুই বছর পর পা রাখল। এতদিনে বাসাটা আগের মতই আছে। একটুও বদলে যায়নি। তবে বাড়ি দেখে মনে হচ্ছে বাড়িটা নতুন করে রং করা হয়েছে। এবার সম্পূর্ন বাড়ি সাদা রঙ করা হয়েছে। আগে সবুজ আর অফ হুয়াইট রং করা ছিল। তবে আগের থেকে এখন বাড়িটা দেখতে বেশি ভালো লাগছে। সাদা রঙের দু তলা বাড়ি চোখে লাগছে খুব। কুসুম বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। উচ্ছাস গাড়ি পার্ক করে নিজেও কুসুমের সঙ্গে বাড়িতে প্রবেশ করল। কুসুমকে দেখে উচ্ছাসদের বাড়িতে রীতিমত হইচই লেগে গেল। উচ্ছাসের চাচাতো বোনেরা দৌঁড়ে এসে কুসুমকে ঝাপটে ধরল। কুসুম এদের হঠাৎ জড়িয়ে ধরায় টাল সামলাতে না পেরে পেছনে পরে যাচ্ছিল। উচ্ছাস কুসুমের পেছনে মোবাইলে কথা বলে আসছিল। কুসুমকে পরে যেতে দেখে সঙ্গেসঙ্গে কুসুমের হাত টেনে ধরে সোজা করে। বোনদের দিকে চেয়ে বলে,

‘ আস্তে, পরে যাবে ও। ‘

উচ্ছাসের বোনরা সরি বলে কুসুমকে নিয়ে বসায় সোফায়। কুসুম এতক্ষণ মাথা নত করে বসে ছিল। শিউলি আর খালামনিকে খুঁজছে ও। শিউলির সঙ্গে কুসুমের বেশ ভাব। তাদের রোজ ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। শিউলি কি বাসায় নেই? অবশেষে খালামনি এলেন এবার। কুসুমের পাশে বসে বললেন,

‘ কতদিন পর এলি কুসুম। তোর মায়েরও কত নিয়ম। খালার বাড়িতে আসবি, এতে এত নিয়ম মানার কি আছে। কেমন আছিস? খেয়েছিস কিছু? এই সায়মা কয়েকটা ফল কেটে নিয়ে আয়। শরবতও আনিস। ‘

উচ্ছাসের চাচাতো বোন সায়মা উঠে চলে গেল রান্নাঘরে। বাকিরা এখনো কুসুমকে ঘিরে বসে আছে। কুসুমকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এদের সবার সঙ্গেও কুসুমের ভাব ছিল। কিন্তু কুসুম এই দুই বছর এই বাড়িতে না আসায় এদের সঙ্গে ততটা কথা হত না। তবে উচ্ছাসের সকল বোন খুব মিশুকে। কুসুমের সঙ্গে ছোট বেলা থেকেই তাদের জমেছে খুব।

কুসুম খালামনির দিকে তাকাল। মৃদু হেসে বলল,

‘ আমি খেয়ে এসেছি, খালামনি। ‘

উচ্ছাসের মা এসব শুনতে নারাজ। কতদিন পর আদরের বোনের মেয়ে তাদের বাড়িতে এসেছে। ছোটবেলা থেকেই কুসুমকে খুব স্নেহ করতেন পারুল। কুসুমের দিকে তাকালে তার রাগ গলে যেত। কুসুমের নরম দেহ কোলে তুলে তিনি নিজ হাতে তাকে খাইয়ে-পরিয়ে দিতেন। কুসুমের প্রতি এত স্নেহই তাকে নিজের ছেলের বউ করতে আগ্রহী করে তুলে। তাই তো তার মায়া আদর কুসুমের বয়স তোয়াক্কা করেনি। টানা এক মাস ধরে বোনকে লাগাতার অনুরোধ করতে থাকলেন কুসুমের হাত পাবার জন্যে। শেষ অব্দি তার অনুরোধ ফেলতে পারেন না কুসুমের মা। কুসুমের বয়সকে তারা উপেক্ষা করে উচ্ছাসের সঙ্গে কুসুমের বিয়ে ঠিক করেন। বিয়ে ঠিক হবার পর কুসুমদের বাড়ির রেওয়াজ অনুসারে কুসুমকে বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি আসতে নিষেধ করে দেন কুসুমের মা। এই নিয়ে বোনের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন উচ্ছাসের মা পারুল। তবে যাই হোক! বিয়েটা শেষ অব্দি হয়েছে এতেই তিনি খুশি, আনন্দিত।

সায়মা একটা ট্রে’তে করে ফল আর শরবত নিয়ে এলো সবার জন্যে। কুসুম একটা ফল হাতে নিয়ে তাতে কামড় বসায়। উচ্ছাস পাশের সোফায় বসে মোবাইলে কিছু একটা দেখছে। পারুল ছেলেকে বলেন,

‘ তুই বের হবি উচ্ছাস? ‘

উচ্ছাস ফোন থেকে মাথা তুলে মায়ের দিকে চায়। বলে,

‘ হ্যাঁ, শরবত খেয়েই বের হব। হসপিটালে যেতে হবে। ‘

পারুল রেগে যান। বলেন,

‘ মানে? তোকে বলেছিলাম না আজ ছুটি নিতে। কাল চলে যাবি, আজও তোর হসপিটাল করা লাগে? ‘

উচ্ছাস শরবত একটানে খেয়ে শেষ করে গ্লাস রেখে উঠে দাঁড়ায়। টিশার্টের উপর এপ্রোন পড়ে মায়ের দিকে চেয়ে বলে,

‘ কিছু ফাইল পেন্ডিং আছে। সেগুলো আনতে হবে। দুপুরের খাবার আগেই এসে যাব। রাগ করো না,আম্মা। ‘

উচ্ছাস মোবাইলে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যায়। কুসুম উচ্ছাসের যাবার দিকে বিবশ নজরে চেয়ে থাকে।

#চলবে