বৌপ্রিয়া পর্ব-০৯

0
369

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৯|

তীব্র গরমে ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত কুসুম। ক্লান্তি যেন মাথায় চড়ে বসেছে। গা অত্যন্ত ম্যাজম্যাজ করছে। কুসুম দু কাঁধে দু বেনুনি দুলিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসে। সঙ্গে কুসুমের বান্ধুবি সেঁজুতি। কুসুম সেঁজুতির সঙ্গে আসন্ন পরীক্ষা নিয়ে কথা বলতে বলতে বাসার দিকে এগুচ্ছিল। হঠাৎ কুসুমকে পেছন থেকে ডাক দেয় শুভ। কুসুম ভ্রু কুঁচকে শুভর দিকে তাকায়। শুভ কুসুমের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। বেশ কদিন ধরে সে কুসুমের পেছনে পরে আছে। কুসুমের সঙ্গে প্রেম করাই যেন গর ধর্ম হয়ে গেছে। কুসুমকে চিঠিপত্র, ফুল এসব দিয়ে ভুলানোর চেষ্টাও করা হয়েছে কয়েকবার। তবে কুসুম বরাবরই তাকে এড়িয়ে গেছে। কুসুম এবারেও এড়িয়ে যেতে চাইল। তবে শুভ ততক্ষণে কুসুমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেঁজুতি শুভকে একপল দেখে কুসুমের কানে কানে বলল,

‘ যখন বিরিয়ানির মধ্যে এলাচি কা*মড়ে পরে, তখন আমরা কি করি কুমকুম? ‘

কুসুম বোকার মত ফিসফিস করে বলে, ‘ কি? ‘

সেঁজুতি বিরক্ত হল। ধাম করে কুসুমের মাথায় ভয়াবহ চাপড় দিয়ে বলল, ‘ গাধার বাচ্চা। আমরা এলাচি ছুঁড়ে ফেলে দেই। এটাও জানিস না? ‘

কুসুম মাথায় হাত ঘষে বিড়বিড় করে, ‘ হ্যাঁ,তাইতো। ‘

সেঁজুতি আবারও ফিসফিস করে বলে, ‘ এবার দেখ এই অশুভকে কি করি আমি। চোখ মেলে থাকবি। পলক ফেলবি না। এখন মজাদার নাটক হবে। খলনায়িকা হব আমি। জাস্ট সি। ‘

কুসুম সত্য সত্য চোখে মেলে বড়বড় চোখে সেঁজুতির কাজ দেখে যায়। শুভ এগিয়ে আসতে চায় কুসুমের দিকে। সেঁজুতি পথ আটকে দাড়ায়। শুভ কাতর কণ্ঠে বলে,

‘ দেখ সুজি, কুসুমের সঙ্গে আমার অনেক দরকারি কথা আছে। সরে দাঁড়া। ‘

সেঁজুতি তার স্কুল ইউনিফর্ম এর কলার ঝাঁকায়। দম্ভ নিয়ে বলে,

‘ কুমকুম এখন ব্যস্ত। পরে কথা বলবে। ফুট এখন। ‘

শুভ তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। সেঁজুতিকে পাশ কাটিয়ে কুসুমের দিকে চেয়ে বলে, ‘ আই লাভ ইউ কুসুম। দেখ, তোর জন্যে আমি আমার হাত কে*টে ফেলেছি। এই দেখ, দেখ। হাতে এখনো র*ক্তের দাগ আছে। ‘

শুভ তার স্কুল ড্রেসের হাতা উঠিয়ে বাম হাতের কব্জি কুসুমকে দেখায়। কুসুম আঁ*তকে উঠে। সত্য সত্য কা*টা শুভর হাত। ব্যান্ডেজের উপর র*ক্তের দাগ। কুসুমকে কথা বলতে না দিয়েই সেঁজুতি বলে,

‘ এটা ছাগলের র*ক্ত। বোকা পাইসিস আমাদের? ‘

শুভ এবার যেন আরো অসহায় হয়ে পরে। গতকাল রাতে সে বুক ভর্তি সাহস সঞ্চয় করে চোখ বুজে কব্জিতে ছু*রি দিয়ে এক টান দিয়েছে। ফিনকি দিয়ে র*ক্তও পরেছে। ব্য*থায় এখনো কব্জি জায়গাটা টনটন করছে। আর তারা বলে কি না, এটা ছাগলের রক্ত? এত ব্যথা তাহলে কার জন্যে সহ্য করল শুভ? পা*ষাণ মেয়ে। শুভ ছলছল চোখে বলে,

‘ এটা আমারই র*ক্ত। আমি সত্যি বলছি। বিশ্বাস না হলে আমার মায়েরে জিজ্ঞেস করতে পারিস। ‘

সেঁজুতি ধমকে উঠে, ‘ আরে রাখ ব্যাটা তোর আবেগের কথা। কুসুম তোর সঙ্গে প্রেম করতে পারবে না। কুসুমের হাত পা বাঁধা। ‘

শুভ অবাক হয়ে কুসুমের হাতের দিকে চায়। বোকার মত বলে,

‘ হাত পা তো খোলাই আছে। ‘

সেঁজুতি এবার যেন রেগে যায়। কটমট করে বলে,

‘ ওই ব্যাটা বে*য়াক্কলের বাচ্চা। কুসুমের হাত পা বাঁধা মানে সেই বাঁধা না। সম্পর্কের দড়ি দিয়ে বাঁধা। সোজা বাংলায় কুসুমের বিয়ে হয়ে গেছে। তোর মত পুচকু ছেলের জন্যে কুসুম বসে থাকবে নাকি? তার বিয়ে হয়েছে ডাক্তার বাবুর সাথে। বুঝসস? এখন ফুটে যা। কুইক। ‘

শুভর মাথা যেন চক্কর দিয়ে উঠে। কুসুম দাঁত দিয়ে ঠোঁট কেটে আহম্মকের মত দাঁড়িয়ে থাকে। সে এই বিয়ের কথা এতদিন লুকিয়ে এসেছে। কাউকে জানতে দেয়নি। আর আজ এই মুখ পাতলা সুজির বাচ্চা শুভকে জানিয়ে দিয়েছে। এখন সবাই জেনে যেতে মাত্র কয়েক মিনিট। কুসুম সেঁজুতির পিঠে ঘু*ষি দিয়ে বলে,

‘ সুজির বাচ্চা, সব ফাঁস করছিস কেন? ‘

সেঁজুতি হাত দিয়ে ইশারা করে কুসুমকে চুপ থাকতে বলে। শুভ সেঁজুতির কথা বিশ্বাস করে না। মাথা কাত করে কুসুমকে জিজ্ঞেস করে, ‘ সত্যি কুসুম? তোমার বিয়ে হয়ে গেছে? ‘

কুসুম কি আর বলবে? মিথ্যা তো আর বলতে পারবে না। তাই অগ্যতা কুসুম মাথা হেলায়, ‘ হ্যাঁ। ‘

শুভর বুকে যেন কেউ খা*মচি দিয়ে ধরে রাখে। সে টালমাটাল কণ্ঠে বলে, ‘ কবে হয়েছে বিয়ে? ‘

কুসুম মিনমিন করে উত্তর দেয়, ‘ এক সপ্তাহ আগে। ‘

শুভ বলে,’ এত ছোট বয়সে বিয়ে করে ফেললে? পরে যদি এই বিয়ে নিয়ে আফসোস কর? ‘

কুসুমের বুক ধড়ফড় করে উঠে। কুসুম কথা বলে না। হাঁসফাঁস করে অন্যদিকে চেয়ে বসে। শুভ আর কি বলবে? কুসুমের দিকে একপল অসহায় চোখে চেয়েও চলে আসে সেখান থেকে। সেঁজুতি এবার কুসুমের দিকে চেয়ে দম্ভ করে বলে,

‘ কেমন দিলাম, কুমকুম? ‘

কুসুম কথা বলে না। চুপচাপ হাটা শুরু করে। সেঁজুতি পথ পেরিয়ে আচমকা বলে,

‘ এই কুমকুম, কাল না তোর জন্মদিন গেল? ডাক্তার বাবু কি দিল গিফট? ‘

কুসুম বেজায় মন খারাপ করে। জন্মদিন উপলক্ষে কুসুম আর কিছুই চায়নি। শুধু চেয়েছিল, উচ্ছ্বাস ভাই একবার কল করবে। জন্মদিনের শুভেচ্ছা না জানাক, একবার ‘ ভালো আছো, কুসুম? ‘
জিজ্ঞেস করবে! না, সে কিছুই করেনি। না একটা ফোনকল, না একটা শুভেচ্ছা বার্তা, আর নাইবা কোনো গিফট। সে তো বিদেশ যাবার পর একবারও কুসুমের খোঁজ নেয়নি। হয়তো এত এত বিদেশি নারীর কারণে কুসুমের মত ছোট্ট নারীকে ভুলেই বসেছে। কে জানে তার মনে কি চলছে? সেঁজুতি কুসুমের কথা বলার অপেক্ষা করে না। বরং নিজের মত করেই বলতে থাকে,

‘ জানিস, সজীব আমাকে আমার লাস্ট জন্মদিনে একটা ইয়া বড় টেডি বিয়ার গিফট করেছে। পুতুলটা কি মোলায়েম জানিস? হাত দিলেই যেন হাত দেবে যায়। আমি তো রোজ এটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই। ‘

কুসুমের মন এবার আরো খারাপ হতে শুরু করে। এই বিয়ে সে কেন করল? কেন বয়সের আনন্দ বোঝার আগেই বিয়ে নামক জঞ্জালে জড়িয়ে পরল? মা কেন কুসুমকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে এতবড় দায়িত্ত্ব কাঁধে চাপিয়ে দিল? সবাই কেন কুসুমকে বোঝার চেষ্টা করল না? সবাই সবার মত চলছে। অথচ কুসুমের মনের তুফান কেউ বুঝতে চাইল না। কেউই না। এমনকি উচ্ছ্বাস ভাইও না।
_______________________
সারাপথ কুসুম কান্না আটকে বসে থাকলেও বাসায় এসেই আর কান্না দমাতে পারেনি। রান্নাঘরে মায়ের কাছে এসেই মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। সাহেদা মেয়ের আচমকা কান্না দেখে হতভম্ব হয়ে যান। চুলোর আগুন দ্রুত নিভিয়ে মেয়ের দিকে ফেরেন। কুসুমের ঘামে ভেজা কান্নামাখা মুখ বড্ড আদুরে লাগছে। সাহেদা মেয়ের মাথা দুহাতে তুলে কণ্ঠে আদর ঢেলে বলেন,

‘ কুসুম, কাঁদছিস কেন মা? স্কুলে কেউ কিছু বলেছে? কি হয়েছে? মাকে বল। ‘

কুসুম মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে মিশে যায়। কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দেয়,

‘ আমাকে এত ছোট বয়সে কেন বিয়ে দিলে মা? আমার এই বিয়ে ভালো লাগছে না। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না, মা। কিচ্ছু না। ‘

সাহেদা আঁতকে উঠেন মেয়ের কথায়। বিয়ের অল্পদিনেই মেয়ে এসব কি বলছে? উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কি ঝামেলা হয়েছে? সাহেদার মা’সুলভ বুকের ভেতরটা কেউ যেন খা*মচে ধরে রাখে। মেয়ের কান্নায় ভয় জমে যায় মনের ভেতর। তবে কি বোনের কথায় অল্প বয়সে মেয়ে বিয়ে দিয়ে ভুল কিছু করে বসলেন তিনি?

#চলবে