বৌপ্রিয়া পর্ব-১১

0
489

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |১১|

কুসুমের বয়স এখন ১৮ বছর। দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা চলছে তার। গায়ে গতরে পরিপূর্ন রমণীকে দেখলে যে কারো চোখ ঝলমলিয়ে উঠবে। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সামনাসামনি কথা না হোক! ফোনকলে কথা বলেই দুজনের সম্পর্ক আগের চেয়ে বেশ সহজ হয়ে এসেছে। উচ্ছ্বাসের এ মাসের শেষের দিকে দেশে আসার কথা ছিল।
উচ্ছ্বাসের দেশে আসা নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে দারুন আমেজ দেখা যাচ্ছে। কুসুমের পরীক্ষা শেষ হলেই ধুমধাম করে বিয়ের কথা পাকা করা হবে। কুদুমের বাসায় সর্বদা উচ্ছ্বাসের জয়গান চলে। ছেলেটা বিদেশে গিয়ে কত কষ্ট করে ভবিষ্যৎ গড়ছে, পরিশ্রমী ছেলে, তার কোনো তুলনা হয় না শুনতে শুনতে কুসুমের জীবন প্রায় অতিষ্ট! কুসুম বসার ঘরের সোফার টেবিলে বসে অঙ্ক কষছিল। টেবিলের উপর এক গ্লাস কোক রাখা। কোকের গ্লাসে পরপর চুমুক দিচ্ছে এবং অঙ্ক করছে। একটু পর ইব্রাহিম এসে বসে কুসুমের পাশের সোফায়। রিমোট হাতে নিয়ে টিভিটা চালু করে খেলা দেখতে বসে। খেলার শব্দে কুসুম বিরক্ত হয়। বই বন্ধ করে ভাইকে বলে,

‘ টিভির আওয়াজ কমাও, ভাই। পড়ছি আমি। ‘

ইব্রাহিম আড়চোখে কুসুমের দিকে তাকায়। পরপরই মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,

‘ পড়াশোনা করে কি দুনিয়া উদ্ধার করে দিয়েছিস? যা, নিজের ঘরে গিয়ে পড়। ‘

কুসুম ভাইয়ের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকায়। রেগে কপাল ফাটছে তার। কুসুমের মা সাহেদা পাশে বসে জামা সেলাই করছেন। কুসুম মায়ের দিকে চেয়ে মুখ ফুলিয়ে বলে,

‘ মা, তুমি কিছু বলবে ভাইকে? খামোকা আমার সঙ্গে ঝগড়া করছে। টিভির সাউন্ড একটু কমালে কি হয়? টিভির সামনেই তো বসে আছে। ‘

সাহেদা ছেলেকে চোখ রাঙায়। মৃদু শাসন করার উদ্দেশ্যে বলেন,

‘ কুসুম পড়ছে না? সাউন্ড কমাও। ‘

ইব্রাহিম সাউন্ড একটু কমিয়ে মাথা চুলকে খেলা দেখায় মনোযোগ দেয়। হঠাৎ সাহেদা প্রশ্ন করেন,

‘ উচ্ছ্বাস কবে আসছে কিছু জানিস, ইব্রাহিম? ‘

ইব্রাহিম খেলা দেখায় মনযোগ দিয়ে উত্তর দেয়,

‘ এ মাসের শেষে। ২৬ অথবা ২৭ তারিখের দিকে। ওর থিসিস শেষ করতে যতদিন লাগে আরকি। ‘

সাহেদা আশ্বস্ত হোন। কুসুমের দিকে চেয়ে বলেন,

‘ কুসুম তোর পরীক্ষা যেন কবে শেষ? ‘

কুসুম উত্তর দেয়, ‘ ১৮ তারিখ। ‘

সাহেদা শান্তির নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘ যাক, উচ্ছ্বাস আসার আগেই তোর পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। ছেলেটা এতদিন পর আসছে। তোর পরীক্ষা থাকলে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যায়। ‘

মায়ের কথা শুনে কুসুমের ভীষন অদ্ভুত লাগছে। সবাই শুধু উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কথা ওর সামনে বলে কেন? কুসুমের কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয় এসব শুনলে। কুসুম আর থাকে না বসার ঘরে। বই খাতা নিয়ে উঠে পরে টেবিল থেকে। হনহন করে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে পেছন থেকে সাহেদা ডেকে উঠেন,

‘ কই যাস? ‘

কুসুম যেতে যেতে উত্তর দেয়, ‘ নিজের ঘরে পড়তে যাচ্ছি। ভাইয়ের টিভির শব্দে আমার কান জ্বলছে। ‘
__________________________
কুসুমের পরীক্ষার আজ শেষ দিন ছিল। পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বেরুতেই পেছন থেকে সেঁজুতি ডেকে উঠে। কুসুম ব্যাগ কাধে নিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। সেঁজুতি দৌঁড়ে আসে কুসুমের দিকে। কুসুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। কুসুম মৃদু হেসে বলে,

‘ এক্সাম কেমন হলো তোর? ‘

সেঁজুতি বলল, ‘ ছয় মার্ক ছেড়ে এসেছি। ‘

কুসুম চেঁচায়, ‘ ছয় মার্ক? ‘

সেঁজুতি হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভান করে বলে,

‘ এমন অবাক হচ্ছিস কেন? মাত্র ছয় মার্ক ছেড়ে এসেছি। পুরো খাতা নয়! ‘

কুসুম শান্ত হয়। পরীক্ষায় প্রশ্ন ছেড়ে আসা সেঁজুতির নিত্যদিনের ব্যাপার। এ নতুন নয়! কুসুম হাটা শুরু করে। সেঁজুতি পাশে হাঁটছে। সেঁজুতি একসময় প্রশ্ন করে,

‘ তোর জামাই কবে আসছে রে? ‘

কুসুম থতমত খেয়ে যায় এমন প্রশ্নে। নিজের লজ্জার দামামা সামলে উত্তর দেয়, ‘ ২৬ তারিখ। ‘
‘ এ মাসের? ‘
‘ হু! ‘

সেঁজুতি কুসুমের পিঠে মৃদু হাতে থাপ্পড় দিয়ে বলে,

‘ তাহলে তো ইদ লেগে গেল তোমার কুমকুম। ‘

কুসুম চোখ রাঙিয়ে তাকায়, ‘ কোনো ইদ ফিদ না বুঝলি। সোজা হাট। ‘

সেঁজুতি হাসে। কুসুম সেঁজুতির হাসি দেখে লজ্জায় কেমন ঝিম ধীরে যায়। ইশ! বিয়ে না করেই এরা যা লজ্জা দিচ্ছে কুসুমকে। বিয়ে করলে কুসুমকে এরা বোধহয় লজ্জা দিয়ে মেরেই ফেলবে।
__________________________
কুসুম বাড়ি এসে দেখে সবার মন খারাপ। ইব্রাহিম ভাইয়া কুসুমের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যাচ্ছেন। মা কি কথা বলবেন বলবেন করেই দ্বিধা নিয়ে বলতে পারছেন না। কুসুম ভাবল একবার জিজ্ঞেস করবে তাদের। উষা আপা কুসুমের ঘরে আসলে কুসুম পেটের কথা পেটে না রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করেই বসে,

‘ আপা, কিছু কি হয়েছে? বাড়ির সবার এত মন খারাপ কেন? ‘

উষা কুসুমের পাশে এসে বসে। কুসুম সবে গোসল করে বেরিয়েছে। চুলে টাওয়াল পেঁচানো। উষা কুসুমের চুলের টাওয়াল খুলে তার চুল মুছে দিতে থাকে। বলে,

‘ আমি কারণ বললে তুই আবার রাগ করবি না তো? ‘

কুসুম চিন্তিত হয়। আস্তে করে বলে, ‘ না করব না। এবার বলো তো কি হয়েছে। এত ঘুরাচ্ছ কেন কথা? ‘

‘ উচ্ছ্বাস এ মাসে আসছে না। ডিসেম্বরে আসবে। মানে আরো ৭ মাস পর। ‘

কুসুম তাজ্জব বনে যায়। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের সঙ্গে কালকেও কথা হয়েছে। কুসুমকে সে বলেছে, ২৬ তারিখ আসবে। এরইমধ্যে এই কথা পাল্টে গেল কিভাবে? কুসুম অবিশ্বাস নিয়ে বলে,

‘ তুমি মিথ্যা বলছ, তাইনা আপা? ‘

উষা কুসুমের চুল আঁচড়ে দিয়ে বলে,

‘ আমি মিথ্যা বলছি না। একটু আগে উচ্ছ্বাস ইব্রাহিম ভাইকে ফোন করে বলেছে এটা। ওর থিসিস কমপ্লিট হয়নি। রিজেক্ট করে দিয়েছে। সেটা কমপ্লিট করতে আসতে আসতে আরও ছয় মাস লেগে যাবে। সে বারবার ইব্রাহিম ভাইয়ের কাছে সরিও বলেছে। বলেছে তোকে বুঝিয়ে বলতে। তুই রাগ করবি সে জানে। রাতে কল করে সে তোকে বুঝিয়ে বলবে বলেছে। ‘

কুসুমের চোখের কোণে জল জমে যায়। এতটা বছর অপেক্ষা করার পর আজ সে কি না বলছে, আরো সাত মাস পর আসবে? পাষাণ লোক! এমন পাষাণ লোকের সঙ্গে কুসুমের কোনো কথা থাকতে পারে না। রাতে কল করুক না! কুসুম মোটেও তার কল ধরবে না। পা/ষাণ, পা/ষাণ, পা/ষাণ!

এইজন্যেই বোধহয় গতকাল উচ্ছ্বাস ভাই বারবার কুসুমকে বলেছিল,
তার আসতে দেরি হলেও হতে পারে। কুসুম যেন মন খারাপ না করে। সে বিদেশের মাটিতে নিজের ইচ্ছেই পরে নেই। বাধ্য হয়ে এখানে আছে। যত দ্রুত দেশে আসা যায়, সে সেই চেষ্টাই করবে। তাহলে এজন্যে কথাগুলো বলেছিল সে!

উষা কুসুমের কাঁধে হাত রাখে। কাঁধে চাপ দিয়ে বলে,

‘ মন খারাপ করিস না, হুঁ? চল কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে যাবি। এক্সাম দিয়ে টায়ার্ড নিশ্চয়ই! ‘

কুসুম উত্তর দেয়, ‘ তুমি ভাত রেডি করো আমি আসছি। ‘

উষা চলে যায়। কুসুম ফোন হাতে নেয়। রাগান্বিত হয়ে শেষবারের মত উচ্ছ্বাসের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে মেসেজ করে,

‘ আপনার আর দেশে আসার দরকার নেই। বিদেশেই বিয়ে করে সেটেল হয়ে যান। দেশে কেউ আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে না। পাষাণ লোক! ‘

মেসেজ করেই ফোন বন্ধ করে রেখে দেয় কুসুম। এখন সে কল দিলে মরে গেলেও কুসুম আর ফোন ধরবে না। শাস্তি পাক সে!
_________________________
রাতে সাহেদা কুসুমকে নিজের ঘরে ডেকে নিলেন। কুসুম মায়ের ঘরে এসে দেখে মায়ের বিছানার উপর অনেক শাড়ি স্তূপ করে রাখা। সাহেদা মেয়ের গায়ে একটি শাড়ি পরখ করে দেখলেন। কুসুমের শ্যামলা গায়ে শাড়িটা দারুন মানাচ্ছে। কুসুমের শাড়ি দেখে বলল,

‘ এটা কার শাড়ি মা? ‘

‘ তোর। ‘

‘ আমার? আমি শাড়ি পড়তে পারি না। জানো না তুমি? ‘

‘ পড়তে হবে। আজ থেকে শাড়ি পড়া শিখতে হবে তোর। উচ্ছাস আসছে। তোকে কদিনের মাথায় তুলে নিয়ে যাবে তারা। বৌ হয়ে শাড়ি পড়বি না? ‘

কদিন পরই উঠিয়ে নিয়ে যাবে শুনে কুসুমের বুক ধ্বক করে উঠে। নতুন সংসার জীবনের কথা শুনে কুসুম কেমন ভয়ে মিইয়ে যায়। কুসুম নাছোড়বান্দার মত করে বলে,

‘ তুলে নিয়ে যাবে মানে? আমি যাব না। ‘

কুসুমের ভেজা কণ্ঠ শুনে বুকের ভেতর কেমন মুচড়ে উঠল সাহেদার। তিনি মেয়ের কপালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বললেন,

‘ বিয়ে হয়েছে এখন তো তুলে নিবেই। ভয় পাচ্ছিস কেন? উচ্ছ্বাস খুব ভালো ছেলে। জানিস তো ওকে তুই। ‘

‘ কিছু জানিনা আমি। তার কথা আপাতত আমার সামনে বলবে না।’

কুসুমের কণ্ঠে রাগের আঁচ দেখে সাহেদা মৃদু হাসেন। ব্লাউজ, পেটিকোট মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন,

‘ আচ্ছা, বলছি না। এখন যা, দু কাপড় পড়ে আয়। শাড়িটা পরিয়ে দেই। দেখি কেমন মানায় তোকে। ‘

কুসুম ব্লাউজ, পেটিকোট নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। সাহেদা মেয়ের যাবার দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

#চলবে