ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-৬৪ এবং শেষ পর্ব

0
1083

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৬৪)
রোজীর বাড়িতে ঝটপট আয়োজন। নতুন জামাইয়ের আদর আপ্পায়নে কমতি নেই। তামিম মোটামুটি হেলদি খাবার ছাড়া মুখে নেয়না। তানভীরের মতো চোখ বন্ধ করে সব গিলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। হজমে সমস্যা দেখা দেয়। তার উপর বয়স বাড়ছে। তারুন্য ধরে রাখতে তাকে মেইনটেইন করতে হয়। রোজী কিছুই বুঝছে না তামিম কেনো না খেয়ে পাতে হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে। এদিকে রোজীর মা তামিমের মাথায় হাত বুলিয়ে একটার পর একটা তুলে দিচ্ছে পাতে। তামিম সময় নিয়ে একটু একটু সবজি মুখে পুরছে। পোলাও ছুঁয়েও দেখছে না। রোজী অনেক ক্ষন তামিমকে বুঝতে চেষ্টা করলো। আজকাল যে মানুষ মেইনটেইন করে সেটা মনে পড়লো। রোজী ঝটপট তার মাকে বললো,
‘ মা তুমি এগুলো রাখো। উনাকে দুধ ভাত দাও। ‘
‘ দুধ ভাত?’
রোজীর মা অবাক হয়ে গেলো। চোখ মুখ শক্ত করে বকে দিলো।
‘ বিকাল বেলা কেউ দুধ ভাত খায়?’
‘ ভারী খাবার ও তো কেউ খায়না মা। তোমাকে তো বললাম ই লাঞ্চ করে এসেছি। ‘
‘ তাতে কি? ‘
‘ এই বয়সের ছেলে মেয়ে তোমরা লোহা খেয়ে লোহা হজম করবে। তা না এটুকুন ই খেতে পারছো না? বাবা তুমি শেষ করো তো। শেষ করো। তোমাকে যত্মাতি না করতে পারলে শান্তি পাবোনা। মায়ের মন বুঝই তো বাবা। ‘
তামিম ফিকে হাসলো। ‘ জি মা খাচ্ছি। আপনি ব্যস্ত হবেন না। ‘
‘ আরেকটা রোষ্ট নাও বাবা। ‘
‘ আমি লাগলে নিয়ে খাচ্ছি মা। আপনি প্লিজ অস্থির হবেন না। ‘
তামিম ধীরে সুস্থে সম্পূর্ণ খাবার শেষ করলো। আজ যে তাকে অতিরিক্ত ক্যালরি বার্ন করতে হবে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হাতে সময় ও নেই। রোজী পাশ ঘেঁষে বসলো। দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললো, ‘ ডাক্তারসাহেব একদিন একটু অনিয়ম হলে কিচ্ছুটি হবেনা। ‘
‘ হুম। ‘
‘ উঠোনে পায়চারি করুন। অনেক টা হালকা ফিল করবেন। ‘
‘ হুম। ‘
তামিম ডাইনিং ছেড়ে উঠোনের দিকে এগুলো। রোজী চলে গেলো তার ঘরে। আলমারির উপর থেকে একটা ট্রলি বের করে নিলো। তার কিছু ভালো ভালো জামা কাপড় তুলে নিলো। যদিও জানে না এগুলো লাগবে কিনা। বিয়েতে অনেক শাড়ি পেয়েছে। বিয়ের পরে তো মেয়েরা শাড়িই পড়ে। যদি থ্রিপিচ পড়তে শ্বাশুড়ি এলাও করে তাহলে তো ভাগ্যের ব্যাপার। কমফোর্ট ফিল করবে। গরমে শাড়ি পড়ে যা তা অবস্থা হয়। অবশ্য এখন সে বিরাট প্রাসাদে থাকবে। এসি ফ্যান সবসময় অন ই থাকবে। গরম লাগার উপায় নেই। আগেতো ছিলো বড় বাড়ির ঝি-বাদী হয়ে। সেখানে রান্নাঘর আর চুলোর আগুন ই তার সঙ্গী। সংসারের সমস্ত কাজ,শ্বশুড় শ্বাশুড়ি ননদের কাজটা সহ তাকেই করতে হতো। এখন যে পরিবারে পা দিয়েছে সেই পরিবারেও তার স্থান নড়বড়ে। না জানি কোন স্থানে তাকে রাখা হয়। নিজের ভীত গড়তে কি করবে সে? একমাত্র স্বামীর সাপোর্ট ই তার সঙ্গী। যদি কখনো নিজের কোনো ভুলের কারণে সেই সাপোর্ট হারিয়ে ফেলে? না। রোজী আর ভাবতে চায়না। ঝটপট প্রয়োজনীয় বাকি থাকা জিনিস গুলো ভরে নিলো। লাস্ট বার তুলে নিলো মেডিসিন বক্স। অবশ্য কাপড়ের উপরে নিলো না। দুটো কাপড়ের নিচেই আড়াল করে নিলো। আর কিছু বাকি আছে কিনা চেক করলো। অবশেষে বেরিয়ে এলো রুম থেকে ট্রলি হাতে।‌দরজার সামনে রেখে দিলো যাতে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে আর ভুলে না যায়। ট্রলি হাতে দেখে রোজীর মা এগিয়ে এলো, ‘ কিরে? এখনি চলে যাচ্ছিস? একটু রেস্ট নিয়ে যা। তোর বাবা ভাই বাসায় আসুক। আমি খবর দিয়েছি তো জামাই এসেছে। ঐ এসে পড়লো বলে। ‘
‘ এক্ষুনি যাচ্ছিনা মা। একটু পর বেরোবো।বাবা,ভাই আসুক। সন্ধ্যার আগে বেরোতে হবে। রাতে আবার তাকে হসপিটালে যেতে হবে। ‘
‘ জামাই কোথায় গেলো?’
‘ উঠোনেই তো। পায়চারি করতে গেলো। বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। ‘
রোজীর মা দেখে এলো, ‘ কই? জামাই নেই তো। ‘
‘ উঠোনেই তো গেলো। ‘
রোজী উঠোনে ভালো করে দেখলো। না পেয়ে গেইট ঠেলে বাইরে বেরিয়ে গেলো। তামিমকে দেখা গেলো বড়ই গাছের পাশে। পুকুরের উপর বড়ই গাছ। পোলাপান গাছ থেকে বড় ই পাড়ছে কম ফেলছে বেশি। একদম গিয়ে পড়ছে পুকুরের পানিতে। বড়ই ভেসে উঠতেই বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পাড়ে নিয়ে আসছে । তামিম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। রোজী গিয়ে দাড়াতেই একজন জিজ্ঞেস করে, ‘ রোজীবু হেতি ক্যাডা?’
‘ তোগো দুলাভাই। ‘
‘ এডাই দুলাভাই? দুলাভাই আসসালামু আলাইকুমুস সালাম। ‘
ইয়া লম্বা সালাম। পিচ্ছি ছেলে গাছের উপর বসে তামিমের সাথে কথা বলছে। আপাতত তার বড়ই পাড়া অফ। বয়স কত হবে? এই ছয় সাত বছর। তামিম সালাম নিলো,’ ওয়ালাইকুমুস সালাম।’
‘ দুলাভাই বড়ই দিমু? খাবেন? একটুখানি চুক্কা। তয় বেশিনা। লবণ মরিচ দিয়ে কামড়াইয়ে খাইবেন টেস পাইবেন। ‘
‘ না খাবো না। ‘
রোজী বললো, ‘ চিকু দে তো কয়েকটা পেড়ে। শ্বাউর বাইত লয়ে যামু। ‘
‘ আইচ্ছা বু। ‘
তামিম তাকিয়ে আছে রোজীর দিকে। কি সুন্দর গ্ৰামের ছেলেদের সাথে কথা বলছে ওদের ভাষায়। বাংলা শব্দের জাত পাত করলেও মিষ্টি লাগছে। রোজী আঁচল ধরে দাঁড়ায়। উপর থেকে ছেলেটা বড়ই ফিক্কা ছুটছে সরাসরি আঁচলে এসে পড়ছে। আঁচল ভরে যেতেই তামিম বলে, ‘ এতো নিচ্ছো কেনো? ছেলে গুলোকেও নিতে দাও। কতক্ষন থেকে দাঁড়িয়ে আছে। ‘
‘ আরো কয়েকটা নিয়ে যাবো। লাবিবা আসুক ভর্তা করে খাবো। ‘
তামিম একটা বড়ই পরিষ্কার দেখে তুলে নেয়। পকেটের টিস্যু দিয়ে মুছে কামড় দেয়। নাহ! মজাই আছে। অতটাও টক না।

ফেরার সময় তামিমের শ্বশুড় শ্বাশুড়ী গাড়ি ভর্তি করে তাজা শাক-সবজি দিয়ে দেয়। এগুলো নাকি আবাদের। একদম সার বিষ ফ্রী। গাছের কলা, পুকুরের মাছ, শুকনা বড়ই, চিড়া, মুড়ি। তামিম এতোসব দেখে একদম ই না না করছে। রোজী কিছুই বলছে না। শ্বশুড়বাড়ি খালি হাতে যাবার চেয়ে একদমই অর্গানিক কিছু নিয়ে যাওয়া ভালো। শহরের মানুষের কাছে আবার এসবের দাম বেশী। তামিম ও বাধ্য হয় জোরাজুরি তে নিয়ে যেতে। এতদিন দেখেছে লাবিবার বাড়ি থেকে গাড়ি ভর্তি করে এসব আসতো। তখন তার মায়ের মুখটা একদমই চকচক করতো। তামিমের অবশ্য এই সৌভাগ্য আগে হয়নি। দিতে দিতেই তো সে এই পর্যন্ত। তার কিছু পাওয়া হয়নি। এইযে এতোটা আদর যত্ন! এটাও তো সে পেতো তার ই রোজগারের টাকায়। তখন কোনো ভালোলাগা কাজ করতো না। মনে হতো তারই কেনা খাবার সে খায়। আর আজ যে আদর ভালোবাসা পেলো… একেই বোধহয় বলে জামাই আদর। এই আদর পেতেই জামাইরা যেমন শ্বশুরবাড়িতে আসে শ্বশুড় বাড়ির লোকেরাও তেমন মুখিয়ে থাকে কখন জামাই আসবে আর মন ভরে খাতির যত্ন করবে। তামিমের মনটা ভীষন ভালো হয়ে যায়। রোজীকে নামিয়ে দিয়ে খুশিমনেই আজ চেম্বারে যায়।

গত তিনটি দিন সপ্নের মতো কাটলো লাবিবার সময়। আগের দেখা তানভীর খান আর এখন যাকে বুকে ধারণ করে তাদের মধ্যে প্রচুর ফারাক। কত রকমের পাগলামি যে মানুষটা তাকে নিয়ে করতে পারে! লাবিবা ভুল। তার জানা ভুল। তানভীরের চোখে এই প্রেম সে আগেও দেখেছিলো। শুধু বুঝতে পারেনি। ছুঁতে পারেনি তার গভীরতা। প্রেম! খুব খারাপ একটা নেশা। যে প্রেমে আসক্তি বেশী সেই প্রেমে যন্ত্রনা বেশি। সেই যন্ত্রনার নাম সুখ। সে সুখেই প্রতিনিয়ত নিজেকে শেষ করতে উদ্ধোক্ত হয় নর নারী। লাবিবা গভীর ভাবনা নিয়ে তাকিয়ে থাকে তানভীরের দিকে। প্রশ্ন খুঁজে বেড়ায়। তানভীরকে ভালোবাসার যথেষ্ট কারণ আছে। তানভীর তার স্বামী। ভীষন টানে তার পার্সোনালিটি। অমাইক মানুষটার প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে লাবিবা। যার প্রতিটা আচরণ ই লাবিবার দুর্বলতা। এমন একটা মানুষকে নিজের মানুষ করে পাওয়া প্রতিটা মেয়ের সপ্ন। কিন্তু তানভীর কেনো এতোটা পাগল হলো তার জন্য? তার মতো মেয়ে তো অনেক আছে ধরা ছোঁয়ার ভেতরে। তাকেই কেনো চুজ করলো? লাবিবার ভাবুক চেহারা দেখে তানভীর মিটি মিটি হাসে। লাবিবার ভাবনা তার এরিয়াতেই। এই ভাবনা ভাঙাতে হবে। মাথায় চুমু দিয়ে জানতে চায়,
‘ কি এতো ভাবছে আমার বউটা?’
‘ কেনো বিয়ে করলেন আমায়? আমাকেই কেনো?’
‘ এই এক উঃ আর কতবার দিবো?’
‘ জানিনা। ‘
লাবিবা আনমনা হয়ে গেলো। তানভীর লাবিবার হাতের ভাঁজে হাত ঢুকিয়ে উরুর উপর এনে রাখলো।আঙুলে আঙুল নিয়ে খেলতে খেলতে বলে,
‘ বিয়ে না করলে তুলতুলে বউটাকে অন্যকেউ নিয়ে যেতো না? স্পঞ্জের মিষ্টির মতো বউ। আমার রসগোল্লা!’
লাবিবা মিষ্টি হেসে অন্যদিকে তাকায়। হাতে চা। টঙের দোকানে বসে এই সাত সকালে চা খাবার মজাই আলাদা। কতবার যে বাবার সাথে বসে চা বিস্কুট খেয়েছে হিসেব নেই। কিন্তু আজকের ফিলিংস টা আলাদা।‌ নতুন মানুষ সাথে নতুন জায়গা। কতশত সপ্ন ছিলো এরকম একটা মুহুর্তের। ভালোবাসার মানুষের সাথে ভালোলাগাগুলো উপভোগ করা।

চা শেষ করে তানভীর বিল দিতে গেলো। পেছন ঘুরে দেখে লাবিবা উঠে দাঁড়িয়েছে। পিওরের উড়নাটা টেনে নিলো মাথার উপরে। ওড়না পার হয়ে কোমড়ের উপর ছড়ানো ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। খানিকটা জামা ভিজেও গেছে। তানভীর দ্রুত বিশ দিয়ে এগিয়ে এলো। মৃদু রোদে সচ্ছ সকালে সদ্য গোছল দেওয়া সবুজ থ্রিপিচে বউকে দেখে তানভীর বার বার মুগ্ধ হয়ে তাকাচ্ছে । লাবিবার মাথা নিচু করে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাওয়া দেখে তানভীর নিঃশব্দে হাসে। পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেয়। লাবিবা চোখে চোখ রেখেই গলা জড়িয়ে ধরে। তানভীর গাড়ির দিকে পা বাড়ায়। মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই জিজ্ঞেস করে,
‘ বউটাকে কি অসুস্থ করে দিলাম? ‘
লাবিবা ঝটপট দৃষ্টি নামিয়ে তানভীরের ঘাড়ে মুখ লুকায়।
‘ বিয়ের পর যতদিন যায় ততো নাকি বউ নির্লজ্জ হয়ে উঠে। আমার ক্ষেত্রে উল্টো হচ্ছে কেনো?’
লাবিবা হুট করেই ঘাড়ে আলতো কামড়ে ধরে,
‘ আও! বোকার মতো করছো টাকি? দেখা যাবে তো ঐখানে। ‘
‘ খালি গায়ে থাকলে তো দেখা যাবেই।‌ ঘাড়ে হোক বা বুকে। ‘
‘ যে আঁচড় গুলো দিয়েছো আর উপায় নেই খালি গায়ে থাকার। ‘
‘ ঢেকে ঢুকে চলবেন বুঝছেন? বাড়িতে মা বউ ছাড়া আরো অনেক মহিলা আছে। ‘
‘ ত?’
‘ নজর খুব খারাপ জিনিস। ‘
‘ আমিও তো বলতে পারি এটা। ‘
‘ আমি আপনার জন্য নিজেকে সেফ রেখেছি না? আমার দায়িত্ব শেষ। এবার আপনার দায়িত্ব আমাকে সেফ রাখার। ‘
‘ আমার বউকে তো আমি কোলে কোলে রাখবো।এইভাবে। ‘
‘ আচ্ছা। ‘

লাবিবা বাড়িতে ফিরেই দেখে তার মা,বাবা, ছোটকাকা বসে আছে। লাবিবা গিয়ে একদম বাবার বুকে সেঠিয়ে গেলো। চোখ দুটো বুঝে নিলো। আহ! কি শান্তি। ইসমাইল মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘ ভালো আছে আমার মা?’
‘ জি আব্বু। আমি ভালো। ‘
‘ কতটা দিন তোমায় দেখিনা বাবা। বড্ড মিস করেছি। ‘
‘ আমি টেনশন করেছি। ‘
‘ আরে কিসের টেনশন? ঘুরে এলে তো ভালো কথা। আমরা ভালোই আছি। তোমার কোনো টেনশন নেই। আমাদের নিয়ে টেনশন করতে হবে না । ‘
বাবাকে অস্থির হতে দেখে অবাক হয় লাবিবা। বিরবির করে,’ অসম্ভব! এ আমার আব্বু না। ‘
সাবিনা মেয়েকে ঠেলে পাঠায় ফ্রেস হয়ে আসতে। না খেয়ে না খেয়ে নাকি মুখটা শুকিয়ে ফেলছে।এই এক মায়েদের দোষ। তাঁদের চোখে শুকিয়ে যাওয়া মোটা হোওয়া দুটোই সমান। এক কথাই মুখ থেকে বের হবে,
‘ শুকিয়ে গিয়েছে মেয়েটা। ‘

দুপুরের লাঞ্চ আজ প্রত্যেকের ইং লেট। তার কারণ মেহমান আর তানভীর লাবিবা। রোজী শ্বাশুড়ির হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে। বেশ কয়েকটি রেসিপি করা হচ্ছে। দেড়ি দেখে সাবিনাও বসে থাকলো না। বেইনীর সাথে কাজে হাত লাগালো। বারণ শুনলো না।
সবাই একসাথে বসেছে ডাইনিং এ। ইসমাইল জানালো সে এসেছে মেয়ে আর জামাইকে নিয়ে যেতে। ফিরোজ খান জানালেন তানভীর কাল সকালে চলে যাবে সিঙ্গাপুরে। ফিরে আসুক তারপর মেয়ে আর জামাইকে নিয়ে যাবে।
‘তাহলে লাবিবাকে নিয়ে যেতে চাই। ‘
‘তা নাহয় যাবে। আগে তানভীর বের হয়ে যাক তারপর লাবিবাকে নিয়ে যাবেন। আজ থেকে যান বেয়াই। বেইনী, ছোট বেয়াই আজ আমার বাসায় থেকে কাল যাবেন মেয়েকে নিয়ে। ‘
‘ না বেয়াই তা হয়না।‌বাড়ি খালি যেতে হবে আমাদের। আমি নাহয় কাল এসে মেয়ে নিয়ে যাবো। তানভীর চলে যাবে আসতে তো হবেই। তাহলে সে কথাই রইলো। ‘
ফিরোজ খান রাজি হলেন। সোহানা ইসলাম নতুন আত্মীয়দের ভালো খাতিরদারি করলেন। লাবিবাকে সাবিনা খাইয়ে দিলো। তিনদিন হলো মেয়েকে তুলে খাওয়ায় না। এবার যেনো শান্তি পাচ্ছে। আস্তে আস্তে অভ্যাস করে নিবে।

বিকালে মেহমান চলে যেতেই রোজী নিয়ে এলো বড়ইয়ের ঢালা। রোদে দিয়েছিলো। এখন টেষ্টটা আরো ভালো হয়েছে। জবেদাকে সঙ্গে নিয়ে দুই জা কাঠাল গাছ থেকে মুছি পেরে আনলো। বাহির ঘরে হামনদিস্তায় তেঁতুল আর শুকনো মরিচ, চিনি দিয়ে ভর্তা বানালো। লাবিবা আঙুলে একটু তুলে মুখে পুরেই জবেদাকে বললো, ‘ শিগগিরই বাড়ির সবাইকে এখানে ডেকে আনো। না আসতে চাইলে জোর করে নিয়ে আসবে। এমন মজার ভর্তা নাহলে খাবে কিভাবে?’
‘ ছোট ভাবী! সবাই খাবে কিন্তু বড় ভাইজান খাবেনা। ‘
‘ কেনো?’
‘ বড় ভাইজান কোনদিন টক খায় না।’
অথচ আগের দিন ই তামিম রোজীর থেকে একটা বড়ই খেলো। রোজী বললো, ‘ খাবে। তুমি ডেকে নিয়ে আসো। না আসতে চাইলে বলবে আমি ডেকেছি। ‘
‘ আচ্ছা বড় ভাবী। ‘

অবাক করা বিষয় ফিরোজ খান পর্যন্ত সেই বড়ই‌ ভর্তা খেলো । এবং প্রশংসাও করলো। দুই ছেলে দুই ছেলের বউ স্ত্রীকে নিয়ে বাহিরের ঘরেই কথায় কথায় আড্ডা বসালো। পুরোনো দিনের গল্পে ঢুব দিলো। আহা! সেসব দিন! নানুবাড়িতে কাজিনরা এক হয়ে বড়ই পেড়ে ভর্তা করতো। কাঁঠালকে মুছি ভেবে গাছ সাফাই করতো। শুকনো দিনে পুকুর সেচে মাছ ধরতো। একবার এক কঞ্জুসের বাড়িতে রাতে গেলাম পেয়ারা চুরি করতে। লোকটার উঠোন ভর্তি পেয়ারা গাছ। রাত হলেই লুকিয়ে বসে থাকতো এক কোনে যেনো চোর গেলে সহজেই ধরতে পারে। কাজিনরা মিলে তো গাছে উঠলাম। গাছে বসেই পেয়ারা খাচ্ছি। দুটো খেয়ে দুটো পকেটে ভরেছি। ওমনি দেখি নিচ থেকে টর্চ লাইটের আলো ফেলছে। একদম মুখের উপরে। সবাই তো সাথে সাথে নেমে দৌড়। কিন্তু লোকটা আমার মুখ চিনে ফেলেছে। রাতটা কাটতেই এলো নানুর কাছে বিচার। আমি নাকি তার গাছের পেয়ারা চুরি করেছি। প্রমান হিসেবে পেলো জানালার পাশে পেয়ারার ছাল। ব্যাস। হয়ে গেলো। সেদিন মা যে কি মারটাই না পিঠে দিলো।
সবাই মিলে হেসে খেলে বিকেলটা পার করলো।

রাতে রুমে এসে তানভীর লাবিবাকে ডাকলো। খোঁজ পেলো না। রুম ছেড়ে বারান্দায় যেতেই তাঁকে দেখতে পেলো। মন খারাপ করে অর্ধচাদের দিকে তাকিয়ে আছে । তানভীর গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। গলায় নাক ঘসলো।‌ উমম! আদুরে শব্দ করলো।‌
‘ আমার হাসি খুশি রাণীর মুড অফ কেনো? হুমম?’
লাবিবা মাথা নাড়ালো।কিছু না।
‘ কি হয়েছে আমার বউটার? কি চাও?’
লাবিবা চুপ রইলো। দীর্ঘক্ষন পর একটা শ্বাস ফেললো। তানভীরের চিন্তিত মন অশান্ত হলো। ঝটপট লাবিবাকে ঘুরিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। আবার জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি হয়েছে বলো?’
‘ আপনি কদিনের জন্য যাচ্ছেন?’
এতোক্ষনে বিষয়টা ক্লিয়ার হলো। তানভীর বললো,
‘ সাত কি আট দিনের জন্য। কেনো? য়্যু মিস মি জান?’
‘ আমি কিভাবে থাকবো?’
‘ য়্যু মিস মি! কোনটা মিস করবে? আমাকে? নাকি আমার আদরকে? বলো, বলো!’
লাবিবা ছল ছল চোখে তানভীরের চোখে তাকালো। তানভীরের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। বেচারা মজা লুটছে দেখে লাবিবার চোখ আরো ঝাপসা হয়ে এলো। তানভীরের লাবিবার চোখে জল দেখে হাসি উধাও হয়ে গেলো। লাবিবা তানভীরের হাতের মুঠোয় হাত রেখে চাপা কান্না বাঁধ ভাঙলো। পাগলের মতো বলতে লাগলো,
‘ খান সাহেব! আমি আর কতো আপনাকে ছাড়া থাকবো? তিনটা দিন আপনাকে পেয়ে আবার দূরত্ব! আপনি আমার থেকে দূরে যাবেন না খান সাহেব।‌ ব্যাথা দেন, কষ্ট দেন যা ইচ্ছে করুন আমি সহ্য করে নিবো কিন্তু আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা। আই ফিল আপনি আমাতে মিশে গেছেন। পুরোপুরি মিশে গেছেন। আপনাকে না পেলে আমার পাগল পাগল লাগে। আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। এ কোন যন্ত্রনা আমাকে দেন আপনি? কেনো করেন এমন? আমাকে নিয়ে চলুন না যেখানেই যাবেন। আই প্রমিজ য়্যু একটুও ডিস্টার্ব করবোনা । ‘
কি ছেলেমানুষী আবদার! হাউমাউ করে কাঁদছে লবিবা। তানভীর বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত রাখে।
‘ শান্ত হও লাবিবা। ‘
কিছুক্ষনের মধ্যেই লাবিবা শান্ত হয়। কিন্তু বুক থেকে মাথা তুলে না। তানভীর এই ছেলেমানুষী দেখে ভীষন সুখ অনুভব করে। সে মনে মনে দোয়া করে তার বউটা যেনো সারাজীবন তাকে এভাবেই ভালোবাসে। যাকে বলে একদম পাগলের মতো ভালোবাসা।

( ১ম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি)

২য় পরিচ্ছেদ লিখা শেষ হলে আপলোড করা হবে।