ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-১+২

0
1297

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(১)
‘প্রিন্সিপাল স্যার থার্ড ইয়ারের একটি মেয়েকে ডেকে পাঠিয়েছেন ম্যাম।’
‘তানভীর খান?’
‘জি ম্যাম।’
অফিসিয়াল পেপারে গুরুত্বপূর্ণ একটি আর্টিকেল দেখছিলো নিতু ইসলাম। হাতের কলমটা টেবিলে রেখে সরাসরি পিয়নের দিকে চোখ রেখে প্রশ্ন করে নিতু ইসলাম। উত্তর আসতেই ঠোঁট দুটো ‘চ’ আকৃতির হয়ে যায়। তানভীর কোন স্টুডেন্টকে কেনো ডেকে পাঠাবে? তাও আবার তার ডিপার্টমেন্টের! কিছু হলে তাকেই বলতে জানাতো। ডেকে পাঠালো কেনো হঠাৎ? নিশ্চয় কোন বড়সড় ব্যপার !
‘ কি নাম?’
‘ লাবিবা ম্যাম। ‘
নিতু ইসলামের মুখাকৃতি আগেই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবে নামটা তাকে এতোটাই চমকালো যে ভ্রু দুটো কুঁচকে বক্রাকৃতি ধারণ করলো। নাম তার লাবিবা। লাবিবা অর্থ জ্ঞানী,চালাক হলেও আদতে সে একজন কিউট, আবেগী এবং ইন্টারেস্টিং একটা চরিত্র,কখনো কখনো আবার উড়নচন্ডী। তার এই স্বভাব গুলোর সম্পর্কে গত তিন বছর ধরেই একটু একটু করে অবগত হয়েছেন নিতু ইসলাম। ডিপার্টমেন্টের হ্যাড হবার সুবিধার্থে সিনসিয়ার গার্ডিয়ানরা প্রথমে তার সাথেই কথা বলতে আসে। সেই সুবাধে ইসমাইল মন্ডলও এসেছিলেন মেয়েকে নিয়ে তার কাছে। পর পর কয়েকবার এসেছেন এখানে। বছর খানেক লাবিবাকে স্ট্যাটিস্টিক্স ও দেখিয়ে দিয়েছেন আলাদা ভাবে উনার অনুরোধ রাখতে। হটাৎ করে তানভীর ই বা কেনো ডেকে পাঠালো তাকে? মেয়েটাকি কোন অঘটন ঘটালো? আদতে এই মুহূর্তে লাবিবাকে নিয়ে অঘটন ছাড়া অন্য কিছু মাথায় আসছেনা । সব সময় না হলে অঘটন ঘটন পটিয়সী বলা যায় এই মেয়েকে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। চোখ থেকে পাওয়ারফুল চশমাটা নামিয়ে হাক ছাড়লো,
‘ মিলন…এই মিলন? ‘
ফর্ম ফিলাপ চলছে। মিলন পেপারস জমা নিচ্ছিলো। চ্যায়ারম্যান ম্যামের ডাকে তাড়াহুড়ো করে গুছিয়ে বিভাগীয় প্রধানের অফিসে ছুটলো।
‘ ম্যাম ডেকেছিলেন?’
‘ হ্যা। এক্সাম হলে গিয়ে লাবিবাকে বলো এখনি এক বার প্রিন্সিপালের রুমে যেতে। ‘
সামনে প্রিন্সিপালের পিয়নকে দেখে মিলনের একটু বিরক্ত ই লাগলো। পিয়নকে দিয়ে ডেকে পাঠালেই তো চলতো। শুধু শুধু তাকে হয়রানি করানো। এক্সাম হলের দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিলো।
‘ এই লাবিবা কে? ‘ লাবিবার সময় নেই দাঁড়ানোর। সে ডান হাত দিয়ে লিখছে তাই বাম হাত তুললো।‌ মিলন দেখে অস্ফুটে উচ্চারণ করলো,
‘ ওহ!’
লাবিবার এই শব্দটুকু ভালো লাগলো না। লেখা বাদ দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সাথে সাথে প্রশ্নপত্রটা উড়ে সামনের বেঞ্চের নিচে গিয়ে পড়লো। লাবিবাকে বলতে হলোনা। নাকিব দেখা মাত্রই তুলে দিলো। লাবিবা সেদিকে আর গুরুত্ব দিলোনা। মিলনকে বললো,
‘ মামা! আপনি মাসে কতবার আমার নাম ভুলে যান? ‘
‘ ঐতো আর কি মনে থাকে না।’
‘ আমি কাল ই আপনার জন্য কমপ্লেন মেমোরি চার্জার নিয়ে আসবো। হাজার টাকার একটা নোট দেন। দাম দিয়ে যা থাকবে বাকিটা আমার টিপস।’
মিলন জোরপূর্বক হাসলো। বললো,
‘ আগে প্রিন্সিপালের রুম থেকে ঘুরে আসো মা। তোমার ডাক পড়েছে। ‘
‘ কেনো? ‘
‘ জানিনা। পিয়নের সাথে যাও। ‘
লাবিবা গার্ডকৃত স্যারের দিকে তাকায়। স্যাররা তাকে আশ্বস্ত করে,
‘তুমি যাও দেখা করে আসো। তোমার বাকি এক্সাম নেবার ব্যবস্থা করা হবে। ‘

লাবিবা পিয়নের পিছু পিছু গেলো। পিয়ন আগে প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকলো তারপর লাবিবা। ভেতরে স্যাররা ব্যতীত আরো তিনজন । লাবিবা তাদের চেনে না। একজন কম বয়সী এবং দুইজন মধ্যবয়সী। নাস্তা দেওয়া হয়েছে সবাইকে। খাওয়া দাওয়া দেখে লাবিবা একপাশে গিয়ে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়ালো। মনে মনে ভাবলো, ভুল সময়ে এন্ট্রি নিয়েছে। আরেকটু পরে এলেই হতো।
‘ তোমার নাম ই লাবিবা?’
লাবিবা মুচকি হেসে বলে,
‘ জি স্যার।’
‘ বিয়ে হয়েছে তোমার?’
‘ না স্যার। হলে তো দাওয়াত পেতেন।’
প্রিন্সিপাল ভ্রু জোড়া কপালে তুলে ইন্টারেস্টিং একটা এক্সপ্রেশন দিলেন।কথাটা একদমি বাড়তি কথা। এই স্টুডেন্ট এর সাথে এতোটা সুসম্পর্ক নয় যে বিয়ে হলে কলেজ স্টাফ কে দাওয়াত করবে। তার উপর এই প্রিন্সিপাল স্যার! স্টুডেন্টসরা জমের মতো ভয় পায়। অথচ ভয় পাবার মতো ব্যপার দু চার বারের বেশি ঘটেনি। কলেজ পুকুরে দু বছর আগেও সন্ধ্যার পর প্রেমিক প্রেমিকার আড্ডা বসতো। অনৈতিক কাজ কারবারও হতো। একবার প্রিন্সিপাল স্যার যে খেলা দেখালো! এক জুটিকে ধরে পিঠে চাবুক মারলো তো মারলোই তাঁদের বিয়েও দিয়ে দিলো। যদিও মেয়েটা বিবাহিত ছিলো! তার স্বামীই ক্লাসমেটের সাথে স্ত্রীর পরকিয়া সম্পর্কে প্রিন্সিপালের নিকট নালিশ দিয়েছিলো। তারপর একবার তো ভি.সির সাথে প্রবলেম হলো। কী জানি এমন হলো প্রিন্সিপালের জন্য ভি.সি এই কলেজের আঙিনাই ছেড়ে দিলো। আরো কতো ঘটনা! এই মুহূর্তে লাবিবার মনে পড়ছেনা।

অচেনা মধ্যবয়স্কদের একজন জিজ্ঞেস করল ,
‘ তোমার বাসা কোথায়? ‘
‘ মেলান্দহ।’
‘ কয় ভাইবোন তোমরা?’
‘ উমম আমি একাই।’
‘ বাবা কি করেন?’
এইবার লাবিবার ভয় হতে লাগলো। হুটহাট এভাবে প্রশ্ন করার মানে কি?পরিচয় জেনে ধরে নিয়ে যাবে নাতো? মুক্তিপণ চাইবে? কতো?
লাবিবার মুখটা শুকিয়ে গেলো। ভেতরের ভয়টা চেহারায় ফুটে উঠলো। কম বয়সী যুবক বিষয়টা খেয়াল করে বললো,
‘ হেই! তুমি কি ভয় পাচ্ছো? ‘
তানভীর মাথা নাড়ালো। সিরিয়াস মুডে বললো,
‘ থার্ড ইয়ারে পড়ে ভয় কিসের? এতো বড় মেয়ে!’
কিন্তু লাবিবা ভয় পাচ্ছে। ঠোঁট দুটো স্পাউট করে চেপে রেখেছে। দেখতে লাগছে বেশ।যুবক মুচকি হাসলো। তানভীর লাবিবার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ লাবিবা তুমি ভয় পেও না। আমি তোমার একটা পিক্স নিবো। টেনশন নিও না এই পিক্স কোথাও যাবেনা। আমি তোমার সাথে এই ব্যাপারে পরে কথা বলবো। ‘
আবার পিক্স! বড় কোন ডিলারের হাতে যাচ্ছে নাতো? খবরের কাগজে একের পর এক কুকর্মের নিউজ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এখানে তো স্যার আছেন।স্যার তো উনাদের সাথে যুক্ত থাকার কথা না। এতো গুলো মানুষের মধ্যমনি লাবিবা আর স্যারকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলেন না।

এক্সাম শেষে লাবিবার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিলো নাকিব, স্মৃতি, উর্মিলা। লাবিবাকে ঘিরে ধরলো।
‘এই প্রিন্সিপাল তোকে কেনো ডাকলোরে? কি বললো?’
‘নাম ধাম পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। তারপর ছবিও নিলো একটা। অচেনা তিনটা লোক ও ছিলো।’
নাকিব হাসতে লাগলো।
‘ দোস্ত তু তো গায়া! এর আগেও স্যার দুইটা বিয়ে পরিয়েছে আর এই কলেজেই। এরা তো খোঁজে স্মার্ট মাইয়া। জাহাঙ্গীর স্যার কি বলে শুনসনাই? সুন্দরী মেয়ে খুঁজে রে সুন্দরী মাইয়া। ‘
‘ হয়তো কেউ তোর কথা বলছে বা দেখতে আসছে সেজন্য ডেকে নিছে। হতে পারে না? কোন সিনিয়র ভাই যে তোকে দেখেছে তারপর বাসা থেকে লোক পাঠিয়েছে আবার এমন ও হতে পারে প্রিন্সিপালের পরিচিত সেজন্যই স্যারের মাধ্যমে ব্যাপারটা এগিয়ে নিচ্ছে। বাসায় তো খবর যাবে। শুনে জানাস কি অবস্থা?’
লাবিবা মুচকি হাসে। মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘আরে না। আব্বু আমাকে এখন কখনোই বিয়ে দিবে না। ‘

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(২)
বুট জুতোর আওয়াজ তুলে খান বাড়িতে প্রবেশ করে তানভীর। কানে ফোনটা একহাতে চেপে রেখেছে। আরেক হাতে গিফট বক্স । সেন্টার টেবিলের উপর বক্সটা রেখেই সিঁড়িতে পা চালায়। দুতলার কর্ণারের রুমটা তার। বৃহৎ,ওয়েল ডেকোরেট তবে এই মুহূর্তে অগোছালো। প্রকৃত একজন গোছানো পুরুষ হলেও কলেজে যাবার আগে না চাইতেও রুমটা অগোছালো হয়ে যায়। নিজের ড্রেস আপ নিয়ে তার বেশ কনফিউশন! পোশাকেই পায় তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। নিজের কাছে নিজেকে পারফেক্ট না দেখানো অব্দি ড্রয়িংরুমে পা রাখার ব্যক্তি তিনি নন । রুমটা এখনো গোছানো হয়নি। বিছানায় ফোনটা ছুঁড়ে দিয়ে প্যান্টটা একটু উপরে তুলে এককোণায় বসে। উবু হয়ে এক পায়ের জুতো খুলে গলা বাড়িয়ে ডাকে, ‘ মম _মম_ হুয়্যার য়্যা য়্যু ? বেডরুম টা গুছিয়ে দিয়ে যাও প্লিজ।’

কফি হাতে প্রবেশ করেন সোহানা ইসলাম। ছেলেকে দেখেই কিচেনে গিয়েছিলো কফি করতে। সারা দিনের স্ট্রেস নিয়ে বাইরে থেকে আসার পর তানভীরের মাথাটা খুব ধরে। আজ জবেদাও নেই যে কফি নিয়ে ছুটবে। তানভীর হাতে কাপটা নেয়। ধোঁয়া উঠা কফিতে সিপ দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ জবেদা কোথায় মম? আজ এখনো আমার ড্রেস গুলো গুছিয়ে রাখেনি। ‘
‘ জবেদা ছুটি তে গেছে। আসতে তিন-চার দিন লেট হবে। তুমি ড্রেস গুলো এভাবে না ছড়ালেই তো পারো বাবা। ‘
‘ হাতে একদমি সময় থাকে না। তাড়াহুড়ো তে পসিবল না।’
‘ কতবার বলি আমাকে ডাকবে। তুমি তো কথাই শোনো না। ‘
‘ মম তোমার ড্রেস সেন্স এতোটাও পারফেক্ট না। ‘
সোহানা মুচকি হাসে। ভাজ করে ড্রেসগুলো কাবার্ডে রেখে বলে,
‘ যার ড্রেস সেন্স পারফেক্ট হয় তাকেও তো নিয়ে আসছো না। তাহলে তো এতোটা পেরেশান হতে হয়না।’ সোহানার দিকে ঘাড় ঘুরায় তানভীর। এক ভ্রু উপরে ঠোঁট টা ‘চ’ আকৃতি করে তাকায়। কথার মানে টা বুঝে উঠতেই গলা ঝাড়া দেয়। কাপে ফের সিপ দিয়ে উঠে বারান্দায় চলে যায়।

ডিনারে ফ্যামিলির সবাই একসাথে ডাইনিং এ বসে। নিতু ইসলাম কে দেখে সৌজন্য হাসে তানভীর। জিজ্ঞেস করে,’কখন এসেছো খালামনি? ‘
‘ এইতো কিছুক্ষণ। তোমার সাথে কথা আছে। দু দিন থেকে ট্রাই করছি। তোমাকে তো আজকাল পাওয়াই যাচ্ছে না। ‘
নিতু ইসলামের চোখে মুখে হতাশা। তৎক্ষণাৎ ফিরোজ খানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ দুলাভাই। তোমার ছেলে দুটো যে দিন কে দিন এতোটা বেপারোয়া হয়ে উঠছে তুমি কেনো কিছু বলছোনা?’
ফিরোজ খান শশা স্লাইজে কামড় দিয়ে নিতু ইসলামের দিকে তাকায়। হাতের উপর আরেক হাত ভাজ রেখে ফিচেল হাসে।
‘ কিসের কথা বলছো তুমি নিতু? আমিতো কিছু দেখতে পারছি না। ওরা ছেলে মানুষ বাইরেই তো থাকবে।বাসায় ওদের কি কাজ?’
‘ তাহলে আপনি কেনো বাসায় থাকেন দুলাভাই? এতোবড় রাজনৈতিক ব্যক্তি হয়েও কাজের ফাঁকে সময় পেলেই তো আপনার বাসায় আসাই চাই। ‘
‘ বাসায় আমার একটা বউ আছে নিতু যা তোমার দুই ভাগিনার নাই। বাসায় রাখতে চাইলে পারলে বউ আনাও।সেটাতো আর পারছো না। ‘
ফিরোজ খানের সোজাসাপ্টা জবাব। দুই ছেলের সামনে এভাবে কোন বাবাই বলতে পারেনা। কিন্তু ফিরোজ খান বলতে পারে। ছেলেদের সাথে এতোকাল যাবৎ মেপে মেপে কথা বললেও বাহিরের ছোটা মুখটা এখন ঘরেও চলে। তারজন্য দায়ী তার দুই ছেলে। নিতু ইসলাম বিরক্তি মুখে তামিমের দিকে তাকায়। অতঃপর তানভীরের দিকে। তানভীর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এড়িয়ে গেলেও তামিম পারে না। তাড়াতাড়ি এখান থেকে উঠার জন্য গপাগপ খাবার মুখে দিতে থাকে। খালামনির নজর যে এখনো তার দিকে সেটা বেশ বুঝতে পারছে। নিতু ইসলাম রাগন্নিত গলায় প্রশ্ন করে,
‘ তোমাদের এই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত কি কোনদিন পাল্টাবেনা? সমস্যা কি তোমার তানভীর?’
তানভীর নিতু ইসলামের দিকে না তাকিয়ে ফিরোজ খানের দিকে তাকায়। ফিরোজ খান খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে। তানভীরের উত্তর শোনার অপেক্ষা করছে। গম্ভীর দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড সেদিকে লক্ষ্য করে তানভীর ফের খাবারে মন দেয়। মুহুর্তেই খাবার টেবিলে নীরবতা বয়ে চলে। রুদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি হবার আগেই সোহানা ইসলাম গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
‘ আগে আমি তামিমের বিয়েটা দিয়ে নিই তারপরেই তানভীরের বিয়ে নিয়ে ভাববো। নিতু আমাদের তামিম বিয়ের জন্য রাজী হয়েছে। তবে একটু সময় লাগবে। ‘
নিতু ইসলাম প্রসস্ত হাসে।
‘ তামিম? তা মেয়ের পড়াশোনা শেষ করার উদ্দেশ্যে নাকি? কিসে এখন? ‘
তামিম যে লজ্জা থেকে এড়িয়ে যাবার জন্য এতোক্ষণ ধরে উঠার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে অবশেষে যুদ্ধ শেষ না হতেই পরাজিত হয়ে গেলো। ফিরোজ খানের মুখেও চওড়া হাসি। সোহানাকে জিজ্ঞেস করে,
‘ আমার ছেলের অবশেষে কাউকে মনে ধরেছে এ খবর আমাকে আগে জানানো হলো না কেনো? যাই হোক এখন যেহেতু জানিয়েছো খুশির খবর। সবাইকে মিষ্টি মুখ করাও। তামিম? ইয়াং ম্যান?’
বাবার মুখের দিকে তামিমের মুখটা শুকিয়ে গেছে। কি উত্তর দিবে সে? সোহানা বললো,
‘ তোমাকে জানাবো কীভাবে? সুখবর টাতো ছেলে আজ সকালেই আমাকে দিলো। তোমরা তো আর কেউ সারাদিন বাসায় ছিলে না।’
নিতু ইসলাম বললো,
‘ তামিম? তুমি অবশেষে বিয়ে করতে চাইছো শুনে খুশি হলাম। কিন্তু সময় কেনো চাইছো বাবা? যদি পড়াশোনা জনিত কোনো ব্যাপার থাকে তাহলে ওয়েট করার কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের ফ্যামিলিতে সবাই উচ্চ শিক্ষিত। চাকরী করতে চাইলে তাতেও বাঁধা নেই। তোমার বয়সটাও তো বসে থাকার নয়। পুরোনো কাসুন্দি ছেড়ে এবার নিজের দিকে একটু চোখ মেলে তাকাও। আমরা তোমার ভালো চাই। তুমি যে নতুন করে আবার জীবন শুরু করতে চাইছো এতে আমরা সবাই হ্যাপি। বাই দ‌্যা ওয়ে তুমি কি অনেক জুনিয়র কাউকে পছন্দ করেছো? তোমাদের এজ ডিস্টেন্স কেমন হবে?’
‘ উমমমমম.. খালামনি আমি এখনো কনফার্ম হয়নি। একটু সময় দাও তোমাদের অবশ্যই আপডেট জানাবো।’
‘ সিওর।’

ডিনার শেষে যে যার রুমে যাবার সময় তানভীর তামিমকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ কনগ্ৰাচুলেশনস ভাই।’
তামিম অন্যমনষ্ক ছিলো বিধায় তানভীরের হটাৎ জড়িয়ে ধরায় হকচকিয়ে যায়। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে তানভীরের কাঁধে হাত রাখে।
‘ ভাই কি কোন বিষয়ে টেন্সট? ‘
‘ হু?’
‘কি হয়েছে?’
‘ পরে বলবো। ‘
‘ জানা থাকুক অন্তত।’
তামিম কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলে,
‘ ফ্লোরা ব্যাক করতে চায়। ‘
‘ ঘাটের জল খাওয়া শেষ? ‘
‘ ইনটেশন কি বুঝতে পারছি না।’
‘ ভেবে দেখো। হেল্প লাগলে বলো।’
‘ হুম।’

তানভীরের রুমে নিতু ইসলামের আগমন। তানভীর বিছানায় নিতু ইসলামকে বসতে বলে। নিতু ইসলাম বিছানায় না বসে রুম জুড়ে দুবার পায়চারি করে বিনে গিয়ে বসে। নিতু ইসলামের গতি খেয়াল করে তানভীর জিজ্ঞেস করে,
‘ খালামনি তুমি কি কোন ব্যাপারে টেন্সট? সিরিয়াস কিছু?’
‘ উহু। শুনলাম জবেদের ছেলের জন্য কলেজে মেয়ে দেখা হচ্ছে। তুমি আবার মধ্যম ব্যক্তি হয়ে কাজটা করছো। মেয়েটা আমার স্টুডেন্ট। ‘
‘ ও আচ্ছা। উনারা আমার অফিসে সরাসরি আসলো। যেহেতু মুখ চেনা আবার নানু বাড়ির এলাকার লোক পরিচয় টাও দিলো। তারপর জানালো যে একটা মেয়ের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে এসেছে । কথায় কথায় ডেকে পাঠালাম তোমাকে আর বলা হয়ে উঠেনি। তো রেজাল্ট হলো যে মেয়ে উনাদের পছন্দ হয়েছে। ছেলে ছুটি পাচ্ছে আগামী মাসের পাঁচ তারিখ। ছেলে এলে সরাসরি দেখা দেখি করে বিয়ে ঠিক করে ফেলবে।আমাকে অনুরোধ করলো ব্যপারটা কাছাকাছি নিয়ে আসতে। ‘
‘ কিন্তু বাবা আমার মনে হয়না এই বিয়েটা হওয়া উচিত।জবেদের ফ্যামিলি লাবিবার জন্য পারফেক্ট নয়। ‘
‘ কেনো খালামনি? ফাহাদ ওয়েল ইডুকেডেট। ইঞ্জিনিয়ার। গভমেন্ট জব। যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। গুড লুকিং। ফ্যামিলির ফিনিন্সিয়াল দিকটাও ওয়েল। লাবিবার ফ্যামিলি থেকে বেটার। সব দিক থেকেই পারফেক্ট। তাছাড়া আমার জানা মতে ফাহাদের আদার্স কোন বেড রেকর্ড নেই। সামান্য সিগারেট পর্যন্ত ধরে দেখে না। আমি যেহেতু হেল্প করছি দুই ফ্যামিলির সবটা জেনেই করছি। তাহলে প্রব্লেমটা কোথায়?’

‘ তুমি হয়তো দেখছো উচ্চবিত্ত পরিবার,হ্যান্ডসাম চরিত্রবান ছেলে লাবিবার জন্য পারফেক্ট। কিন্তু আমি বলবো জাবেদের বংশে সব পুরুষ ই ওয়েল ইডুকেডেট, ভালো ভালো পোষ্ট এ জব করে কিন্তু বাড়ির বউরা একদমি তা নয়। সে বংশের বউরা একেকজন সুন্দরী মেয়েরাই হয় কিন্তু বছর ঘুরতেই সেই সৌন্দর্যের ভাটা পড়ে। আমাদের দেশের মানুষ শিক্ষিত হলেও পুরোনো রেওয়াজ এখনো কিছু পরিবারে দাপিয়ে চলছে। সেই বংশের বউদের বিয়ের পর পরই লেখাপড়া ছাড়তে হয়। তাঁদের জীবন মানে ঘর সংসার বাচ্চা সামলানো। একেকটা ফ্যামিলিতে বউরাই বাড়ির সকল কাজ করে থাকে। ছুটা বুয়া পর্যন্ত রাখা হয়না। বাড়িতে বউ নামে কাজের মেয়ে নিয়ে যায়। তাদের নিজেদের বলতে কিছু থাকে না। টাইমলি খাবারের তদারকিটাও কেউ করে না। যদি বলো এখন তো যুবকদের মেন্টালিটি চেঞ্জ হতে পারে…গত বছর ই জাবেদের বড় ভাইয়ের ছেলেকে বিয়ে করানো হলো। বউটা ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়তো। ওর আর ভার্সিটির মুখ দেখা হলো না। অথচ হাজব্যান্ড আই পি এস অফিসার। প্রব্লেমটা হলো লাবিবাকে নিয়ে। আগে তার সম্পর্কে ক্লিয়ার করি। লাবিবা তিন বছর থেকে আমার স্টুডেন্ট। মায়াবী পুতুলের মতো একটা মেয়ে। তাকে দেখে সবাই বলবে চুপচাপ শান্ত শিষ্ট প্রকৃতপক্ষে এই মেয়ে লেজ বিশিষ্ট। ডিপার্টমেন্টে তাকে লেইট লাবিবা বলে সবাই চেনে। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। ভীষণ আদুরে। সুযোগ মাত্র আলসে। নয়টা পঁয়তাল্লিশের ক্লাসগুলো কন্টিনিউয়াসলি মিস করে যায়। সাড়ে দশটার আগে কখনোই কলেজে আসতে পারে না। কারণ তার ঘুম ভেঙেছে নয়টা কি সাড়ে নয়টা। যেদিন একটু আগে উঠবে সেদিন মাথা ব্যথায় চোখ তুলতে পারে না। একবার হলো কি? ক্লাসে গভীর ঘুমে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। আমি রাউন্ড দিতে গিয়ে দেখি এই পরে যাবে যাবে অবস্থা। ক্লাসে যে একজন এভাবে ঘুমুচ্ছে প্রফেসরের কোন খেয়াল ই নেই। ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। য়্যা য়্যু স্লিপিং? ও চটপট স্বীকার করে নিলো, ইয়েস ম্যাম। রাতে ঘুমাওনি? বিয়ে হয়েছে তোমার? ও বললো, রাতে ঘুম কম হয় ম্যাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর কোন সমস্যা? ও বললো ভীষণ মাথা ব্যথা। কি বলবো? কঠিন হয়ে বললাম তুমি যেহেতু ক্লাসে আছো ক্লাস করার ইচ্ছা থাকলে চেষ্টা করো নাহলে ‌বাইরে গিয়ে ঘুমাও । বাইরে রোদ ঘুমাতে পারবোনা। থ্যাংকস ম্যাম এখানেই ঘুমাই। বলতে দেড়ি উঠে দাঁড়াতে দেড়ি নেই। ছয়টা ডেস্ক পটাপট এক করে শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করার আগে আমাকে বলে চোখ বন্ধ করলো গুড নাইট ম্যাম। আমি ডিপার্টমেন্টাল হেড আমাকে বিন্দু মাত্র ভয় পেলো না। এতো বেয়াদবি আমি সহ্য করতে পারলাম না। পরবর্তীতে নিজেই বোকা বনে গেলাম। কারণ সে যে বেয়াদবি টা করলো কিন্তু বেয়াদবি টা ঠিক কোনটা সে জানেই না। তার বাবা এসে পরে আমার সাথে ব্যপারটা ক্লিয়ার না করলে জানতেই পারতাম না। তার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো। বাড়িতে সময় দিতে পারলো না। বাড়িতেও ফিরলো না। লাবিবাকে নিজেই নিজের কাজ, নিজের রান্না করতে হলো। দুদিনেই মেয়েটা হাত কেটে নখ উপড়িয়ে পা কেটে বসে রইলো। ক্লাস টেস্ট দিতে এসেছে আমিতো তার হাত মুখ পা দেখে অবাক। কি অবস্থা করেছে। শুকনো মুখটা দেখে জিজ্ঞেস করতেই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো। পুরো একদিন না খেয়ে মেয়েটা। পরে তাঁকে আমার বাড়িতে নিয়ে গেলাম। হসপিটালে ওর মাকে দেখতে গেলাম। ওর বাবা তো হসপিটালেই থাকে। দৌড়া দৌড়িতে যা তা অবস্থা। উনাকে বলে ছয়দিন লাবিবাকে আমার বাড়িতেই রাখলাম। সাথে ওর ট্রিটমেন্ট ও করালাম। এই ছয়দিন মেয়েটাকে দেখে যা বুঝলাম মেয়েটা মুড অনুযায়ী প্রচুর কথা বলে, ভীষণ চতুর, প্রচন্ড জেদী, আদর পেলে একদম গলে যায়। একদমি ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। একটু অবহেলা নিতে পারে না। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়ে যায়। অদ্ভুত ছন্নছাড়া ব্যপার গুলোও তার মধ্যে দেখা যায়। বৃষ্টিতে ভিজে আইসক্রিম খেয়ে এই মেয়ের ঠান্ডা লাগে না অথচ দুই তিন ঘন্টা আগুনের সামনে থাকলেই ঠান্ডা লেগে যায়। রোদ বৃষ্টি দূর্বলতা তাকে জ্বরে আক্রান্ত করতে পারে না অথচ কারো হাতে একটা চড় খেলেই জ্বরে দুই তিন দিন বিছানা ছাড়তে পারে না। টানা পাঁচদিন একবার কলেজে এলো না। আমি তার বাবাকে ফোন করলাম। জানালো লাবিবা নাকি হসপিটালে। ভাদ্র মাসের গরমে গিয়েছিলো চরে এক আত্ত্বীয়ের মৃত্যু খবর শুনে। নিয়ম আছে তিন দিনের আগে ফেরা যায়না। দুই দিনেই এম্বুলেস এ করে ওকে হসপিটালে ভর্তি করাতে হলো। অতিরিক্ত গরমে গায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। চামড়ায় লাল ছোপ ছোপ দাগ উঠেছে। কী অবস্থা! এরকম একটা মেয়ে ঐ ফ্যামিলিতে কিভাবে সংসার করবে?’

সবটা শুনে তানভীর কী বলবে বুঝে পেলো না। কপাল কুঁচকে নিতু ইসলামের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বললো,
‘ খালামনি…সব ফ্যামিলি তো এক না। যে ফ্যামিলিতেই যাক না কেনো মেয়েটা কি সংসার করবেনা?এটাতো স্কিপ করতে পারবেনা।’
‘ কি বলতো! কিছু কিছু মেয়েরা হচ্ছে ফুলের মতো। তাদের যত্ন নিয়ে পাউডার মেশানো পানি ভর্তি ফুলদানি তে ঠান্ডা পরিবেশে রাখতে হয়। তবেই বেশি সময় তরতাজা থাকে। বেশী সময় তার সুগন্ধ, সৌন্দর্য উপভোগ করা পাওয়া যায়। বুঝতে পেরেছো বাবা? ‘
‘ জি খালামনি। ‘
‘ লাবিবা তার বাবা মার একমাত্র ভবিষ্যৎ। একমাত্র অবলম্বন। তারা নিশ্চয় তাঁদের মেয়েকে যতটা ভালো রেখেছে তার থেকেও যেনো তাদের মেয়ে জামাই ভালো রাখে সেটাই চাইবে। তাইতো ছেলে পছন্দ করেছে ইঞ্জিনিয়ার,চরিত্রবান। ভেতরের ব্যপারটাতো আর হাইলাইট করছেনা। যেহেতু মধ্যম স্তরে আছো এদিক থেকে সেদিক হলে নিজেকে অপরাধী মনে হবে। ভেবে দেখো। গুড নাইট বাবা। ঘুমিয়ে পড়ো দেড়ি করো না। ‘
‘ জি খালামনি। ‘

নিতু ইসলাম চলে যায়। তানভীর বিছানা ছেড়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। কপালে পড়ে গভীর চিন্তার ছাপ। কিছুক্ষণ ঠান্ডায় বসে রুমে চলে আসে। বালিশের পাশ থেকে সেলফোনটা তুলে নেয়। গ্যালারিতে ঢুকতেই দৃশ্যমান হয় হিজাবে আবৃত গোল একখানা মায়াবী মুখ। হরিণ টানা চোখ, আদুরে গাল, তুলিতে আঁকা থুতনি, ছোট্ট দু ফালি ঠোট তার ডানপাশে গাঢ় কালো তিল! তানভীরের চোখে ভেসে উঠে অফিসে সেই ভীতু চোখে তাকানো। বার বার নিজেকে সংকোচন। নাকের ডগায় ছুঁইয়ে দেওয়া লজ্জা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাল্কা কেঁপে কেঁপে উঠা। অসস্তিতে পায়ের নখে খুঁটানো লাল কার্পেট।
হালকা হাসে তানভীর। ফিসফিসিয়ে নামটা উচ্চারণ করে,
‘ লাবিবা!’

চলবে ___

®লাবিবা তানহা এলিজা