ভালোবাসার রংবদল পর্ব-০৮

0
426

#ভালোবাসার_রংবদল
#পর্বঃ৮
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আমি আমার শুভ্রতাকে কখনো আপনাদের কাছে দিবো না। আপনারা এখন আসতে পারেন।”

আব্বুর মুখে এমন কথা শুনে মধ্যবয়স্ক লোক কিছুটা খেপে গিয়ে বললেন-

—”এটা কেমন কথা বললে শুভ? ভুলে যেওনা আমি শুভ্রতার মামা হই।”

আব্বু একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন-

—”আজ খুব অধিকার নিয়ে এসেছেন দেখছি!! খুব ভালো তবে এই বিশ বছরে আপনি বা আপনার বোন আমার শুভ্রতার খোঁজ খবর কখনো নিতে এসেছেন বলে তো মনে পরছে না!! আর আপনার বোন কেমন মা যে কি-না নিজের মেয়ের কাছেই পরিচয় জানতে চায়!!”

পাশ থেকে কালো জ্যাকেট পরা একটা সুদর্শন যুবক বসা থেকে উঠে দাড়ালো। শ্যামবর্ণ দেখতে, চোখ গুলো বেশ বড় খানিকটা মেয়েলি রকমের বড়বড় চোখের পলক। গালে চাপ দাড়ি আর বড়বড় চুল গুলো কিছুটা ঢেউ খেলানো। বেশ ভদ্রতার সাথে বললেন-

—”আংকেল আমি মানছি আপনাদের সাথে খুব খারাপ হয়েছে তবে এখানে আমার তো কোনো দোষ নেই। ওনাদের ভুলের শাস্তি আমাকে কেন দিচ্ছেন!!”

ছেলেটার কথা শুনে মনে হচ্ছে উনিই আমাকে চিরকুট দিয়েছেন। তাহলে কি উনি আমার মামাতো ভাই!!
আব্বু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন-

—”আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না আইয়ান। তবে এই বিয়ে হওয়া সম্ভব না আর আমার শুভ্রতাও কখনো রাজি হবে না এই সম্পর্কের জন্য। আমি আমার মেয়েকে খুব ভালো করে চিনি।”

ছেলেটার পাশে বসা মহিলাটা বললেন-

—”শুভ্রতা কোথায় ভাই? ওকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। আইয়ান বললো শুভ্রতা নাকি অনেক বড় হয়ে গেছে।”

আমি এবার সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে আব্বুকে উদ্দেশ্য করে বললাম-

—”আব্বু আদ্র ভাইয়া এসেছে তোমার সাথে আর দিদুমনির সাথে দেখা করতে।”

ড্রয়িং রুমে সবার দৃষ্টি এখন আমার দিকে। খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। সোফা থেকে উঠে এসে মহিলাটা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কিছুটা সময় পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন-

—”কেমন আছো শুভ্রতা? আমাদের চিনতে পেরেছো??”

আমি স্বাভাবিক ভাবেই বললাম-

—”আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আন্টি। আমি আপনাদের সবার ছবিই দেখেছি আব্বুর কাছে।”

মহিলাটা একটু খুশি হয়ে বললেন-

—”চিনতে যখন পেরেছো তাহলে আন্টি কেন বলছো!! আমি তোমার মামানি হই।”

—”আব্বু আর দিদুমনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। মামা-মামি এমনকি আম্মুও নেই তাই এসব ডেকে আমি অভ্যস্ত না।”

আমার কাছে এমন কথা হয়তো ওনারা কেউ আশা করেনি। তাই ওনাদের মুখের হাসি নিমিষেই গম্ভীর রূপে পরিনত হয়ে গেলো। তবে আইয়ান ছেলেটা কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ছেলেটার মধ্যে কেমন যেন অদ্ভুত রকমের চাহনি। মায়াবিনী নামটা আমাকে না দিয়ে ওনাকে দিলে হয়তো বেশ মানানসই হতো। আব্বু আদ্র ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

—”আদ্র এদিকে আসো। ওনারা হচ্ছে শুভ্রতার নানার বাড়ির লোক। ওর মামা,মামি আর মামাতো ভাই আইয়ান।”

আদ্র ভাইকে এক এক করে সবার পরিচয় দিলেন। আদ্র ভাই মুচকি হেসে সবাইকে সালাম দেওয়ার পর আব্বু বললেন-

—”ওর নাম আদ্রিয়ান। আমার হবু মেয়ের জামাই।”

আব্বুর কথা শুনে আমি অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেছি। মনে হচ্ছে এই মাত্র আকাশ থেকে পরলাম। চোখ গুলো বড়বড় করে তাকিয়ে আছি আব্বু আর আদ্র‍ ভাইয়ের দিকে। ওনাদের তো স্বাভাবিকই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আব্বু এটা কি বললেন!! হবু মেয়ের জামাই মানে কি?? বিয়ে কবে ঠিক হলো আমাদের??? মাথার মধ্যে হাজার প্রশ্ন কিলবিল করছে।

“আচ্ছা আমরা এখন আসি। ভালো থাকিস শুভ্রতা।”

বয়স্ক লোক মানে আমার মামা আমার কাছে এসে এই কথা বললেন। আমি শুধু মাথা নাড়ালাম।আইয়ান আর ওনার বাবা মা কিছুটা নিরাশ হয়ে চলে গেলেন। আমি এখনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

—”কিরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তুই না বললেও আদ্র আমাকে বলে দিয়েছে তোরা একে অপরকে পছন্দ করিস কিন্তু তুই নাকি ভয়ে আমাকে বলতে পারছিস না। তাই দু’দিন আগে আদ্র এসে আমাকে সব বলে দিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই আদ্র ওর বাবা-মাকে নিয়ে আসবে বিয়ের কথা বলতে।”

আব্বুর কথা শুনে আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি আব্বু দিকে। ওনার কোনো কথাই তো আমি বুঝতে পারছি না। কি বলছে এইসব!! আদ্র ভাইয়ের দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখলাম উনি ঠোঁট চেপে হাসছেন। আব্বু আমার হাত ধরে পাশে বসিয়ে অভিমানের সুরে বললেন-

—”আমি কি কখনো তোকে বকা দিয়েছি শুভ্রা?? সব সময় তোর সাথে ফ্রেন্ডলি ব্যবহার করেছি তবুও কেন তুই আমাকে সব কথা বলিস না বল তো। তোরা একে অপরকে পছন্দ করিস এটা আমাকে বললেই পারতি আমি কি তোদের বাধা দিতাম নাকি!! অবশ্যই তোর পছন্দের গুরুত্ব দিতাম।”

এখন আমি কি বলবো?? উফফফফ প্রচুর রাগ হচ্ছে আদ্র ভাইয়ের উপর। রাগে জ্বলজ্বল করে ওনার দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। ইচ্ছে করছে ওনাকে আস্ত গিলে ফেলি অসভ্য একটা।
আমি নিম্ন স্বরে আব্বুকে বললাম-

—”আসলে আব্বু আমি এসব কিছুই জানতাম না। আর আমি তো নিজেই এখনো সিউর না আমি আদ্র ভাইকে পছন্দ করি কি না তাই তোমাকে এখনো কিছু বলিনি। আদ্র ভাই কেন এতো সাহসিকতা নিয়ে তোমাকে এইসব বলেছে সেটা আমি জানি না।”

—”আংকেল তুমি নিশ্চয়ই সব কিছু বুঝতে পারো তাই না??”

আদ্র‍ ভাই বেশ ভাব নিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলেন আব্বুকে। আমার আব্বুও তাল মিলিয়ে বললেন-

—”অবশ্যই বুঝতে পারি। ছোট থেকে বড় করেছি ওকে। শুভ্রতা নিজেকেও এতটা বুঝতে পারে না যতটা আমি ওকে বুঝতে পারি।”

এবার আমার রাগ তরতর করে বেড়ে গেল। রাগী কন্ঠে বললাম-

—”চুপ করবা তোমরা দুজন না-কি আমি চলে যাবো!!”

—”হয়েছে ঝগড়া করতে হবে না এখন। তোরা থাক আমি তোদের দিদুমনিকে ডেকে আনছি। ফুপি হয়তো ঘুমিয়ে আছে।”

কথাটা বলেই আব্বু ভিতরে চলে গেলেন। আদ্র ভাই আমার পাশে বসে কিছুটা সামনে এসে বললেন-

—”কি যেন বলছিলে শুভি একটু আগে!!”

আমি কিছুটা ভড়কে গিয়ে আমতাআমতা করে বললাম-

—”কই কিছুই তো বলিনি আমি।”

আদ্র আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে মুখোমুখি হয়ে বললেন-

—”আমাকে ভালোবাস কি না তুমি সিউর না তাই তো?? ওকে আমি সিউর করে দিচ্ছি তোমাকে।”

উনি আমার একদম কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন-

—”আমাকে যদি ভালোই না বাসতে তাহলে ওই মাঝরাতে আমার বুকে মুখ গুজে দিয়ে এতো শান্তিতে ঘুমাতে পারতে না।”

ওনার এমন কথায় আমি লজ্জায় নুয়ে পরলাম। উনি আবারও বলে উঠলেন-

—”আমাকে যদি ভালোই না বাসো তাহলে এই মুহুর্তে তোমার এতটা কাছে আসাতে লজ্জা নয় বরং রাগ করতে। আমাকে ভালোবাসো বলেই তুমি এই মুহূর্তে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছো। ভালোবাসার রংবদল হচ্ছে শুভি।”

ওনার বলা প্রতিটা কথা সত্যি সেটা আমি জানি। আমি এটাও জানি আমি ওনাকে ভালোবাসি। আদ্র ভাই দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলেন দিদুমনির রুমে। আমি এখনো থ মেরে বসে আছি। আসলেই কি ভালোবসার রংবদল হচ্ছে!!”

————————

“দীপ্ত তুই জানতি তোর ভাই আব্বুকে বিয়ের কথা বলে গেছে??”

—”হ্যাঁ জানতাম তো কি হয়েছে।”

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথাটা বললো দীপ্ত। ওর কথায় আমি ক্ষিপ্ত হয়ে বললাম-

—”এসবের কথা তুই আমাকে আগে বললি না কেন?”

—”আরও অনেক কিছুই আছে যা তুই জানিস না শুভ্রতা।”

আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

—”মানে?? আর কি কি জানি না??”

—”চিরকুটের ঘটনার পরের দিনই ভাইয়া বাসায় তোর কথা বলে। তোকে পছন্দ করে আর তোকে বিয়ে করতে চায় তা-ও আবার খুব তাড়াতাড়ি। এই কথা শুনে আমি আর আব্বু খুশি হলেও আম্মু খুব রেগে গিয়েছিল। আম্মু ভাইয়ার জন্য রূপাকে ঠিক করে রেখেছিলেন তাই।”

—”রূপা কে?”

—”আরে ভুলে গেছিস নাকি আমার খালাতো বোন রূপা। আম্মু আর ওনার বোনের না-কি ইচ্ছে ছিলো তাদের ছেলে মেয়ের বিয়ে দিবে বড় হলে। ভাইয়া এই কথা শুনে প্রচন্ড রাগারাগি করে আর আব্বুও অনেক বুঝিয়েছে আম্মুকে তাই আম্মু বাধ্য হয়ে ভাইয়ার কথায় রাজি হন।”

এইসব শুনে আমি খুব চমকে গেলাম। আমাকে নিয়ে আদ্র ভাই এতো ঝামেলা করছেন!! আর আন্টি নিশ্চয়ই আমাকে ভুল ভাবছেন!!
আমি মলিন কন্ঠে দীপ্তকে বললাম-

—”দোস্ত আন্টি নিশ্চয়ই আমার উপর রেগে আছে তাই না?? উনি হয়তো ভাবছে সব কিছু আমার জন্য হয়েছে।”

—”চিন্তা করিস না শুভ্রতা। এখন হয়তো একটু রেগে আছে তবে তুই তো জানিস আম্মু তোকে কতটা ভালোবাসে। নিশ্চয়ই সব রাগ কমে যাবে অল্প কিছুদিনে।”

আমি চুপ করে আছি কিছু না বলেই ফোন রেখে দিলাম। মনে মনে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। ভালোবাসা হয়তো আবারও রংবদলাবে!!!

চলবে….