ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি পর্ব-৪৭

0
900

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে: সারা মেহেক

৪৭

আদ্রিশের বড় খালার আদেশ মোতাবেক সকাল সকাল শাড়ী পরার জন্য উঠে পরে লেগেছি আমি। প্রথমে থ্রিপিস পরে রুম থেকে বের হলে বড় খালা বেশ কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেন। এজন্য আবারো রুমে এসে শাড়ী পরায় ব্যস্ত হয়ে উঠলাম আমি।
শাড়ীতে প্রথম প্যাচ দেওয়ার পর আদ্রিশ চুপিচুপি রাইসা ভাবীকে রুমে ডেকে আনলেন আমাকে শাড়ী পরিয়ে দেওয়ার জন্য।
রাইসা ভাবী এসে অতিদ্রুততার সহিত আমাকে শাড়ী পরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। পরে আমি বিছানায় বসে বসে শাড়ীর কুঁচিগুলো ঠিক করতে লাগলাম। হঠাৎ আদ্রিশ রুমে ঢুকে বললেন,
” শাড়ী পরা কমপ্লিট?”

আমি কুঁচির উপর দৃষ্টি রেখে বললাম,
” প্রায় কমপ্লিট। এই তো…কুঁচি ঠিক করে আঁচল ঠিক করলেই শেষ।”

আদ্রিশ আমার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বললেন,
” দাও, আমি কুঁচি ঠিক করে দিচ্ছি।” এই বলে উনি কুঁচিতে হাত দিলেন। আমি উনার হাত সরিয়ে বললাম,
” আপনার হেল্প লাগবে না৷ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে প্রায়।”

” যা বাকি আছে তাই করি। আর তোমাকে একটা কবিতা শোনাই।”

আমি কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললাম,
” এখন!”

” হুম এখন। কেনো? তোমার সমস্যা আছে?”

” না মানে…কোনো সমস্যা নেই। ”

” ভালো। এবার আমার কাজ করতে দাও আমাকে। ” এই বলে উনি আমার কুঁচি ঠিক করতে লাগলেন। কয়েক সেকেন্ড বাদে বললেন,
“শাড়ীতে তোমাকে ফুটন্ত
পদ্ম ফুলের মত লাগে।
শাড়ীতে তোমাকে শিশির
ভেজা ঘাসের বিন্দুর মত লাগে।
শাড়ীতে তোমাকে ভোরের
অলির মত লাগে।
শাড়ীতে তোমাকে গোধুলির
শীতল হাওয়ার মত লাগে।
শাড়ীতে তোমাকে বিকেল বেলার
সূর্য ডুবা কিরণের মত লাগে।
শাড়ীতে তোমাকে মধু আহরনের
ফুলের মত লাগে।
শাড়ীতে তোমাকে পূর্ণ
বাঙালী নারীর মত লাগে।
আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর নারী
যাকে শাড়িতে এত মুগ্ধ করেছে।( কবিতাটি Chadni Akter আপু লিখেছেন। 😍😍)

কবিতা শেষ করে আদ্রিশ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিলেন। আমি এখনো উনার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে আছি। অসম্ভব সুন্দর কবিতাটি উনার কণ্ঠে আরো বেশি আকর্ষণীয় শোনালো। অন্যকেউ এ কবিতাটি বললে হয়তো আমার বেশি ভালো লাগতো না। কারণ আদ্রিশ মানেই অনন্য, আদ্রিশ মানেই মুগ্ধতায় পূর্ণ এক ভালোবাসার মানুষ, আদ্রিশ মানেই ঠোঁটের কোনে মনোমুগ্ধকর সেই হাসি!
আদ্রিশ আমার শাড়ী ঠিক করে পাশে বসে পরলেন। আমি উনার দিকে ফিরে উনার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাস করলাম,
” মাত্রই কবিতাটা বানালেন?”

আদ্রিশ মুচকি হেসে বললেন,
” যেদিন তুমি প্রথম শাড়ী পরে আমার সামনে এসেছিলে সেদিন।”
এই বলে উনি এগিয়ে এসে আমার কপালে গভীর একটা চুমু দিয়ে বললেন,
” সেদিন তোমার প্রেমের আরেক দফা মাতাল হয়েছিলাম আমি। সেদিন তোমার মধ্যে অদ্ভুত এক মুগ্ধতা বিরাজ করছিলো। একদম পরিপূর্ণ নারী রূপ পেয়েছিলে তুমি। আজও সেদিনকার মত কোনো অংশে কম দেখাচ্ছো না৷ ”

আমি আদ্রিশকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই দরজায় ছোট মামি নক করে বললেন,
” মিম, আদ্রিশ দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে আসো। বড় আপা টের পেলে এ নিয়ে আবার কথা শোনাতে পারে।”

ছোট মামির কথা শুনে সতর্ক হয়ে গেলাম আমি। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে নিলাম। আদ্রিশ কিছু বলার আগেই হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।

.

বড় মামি, ছোট মামি, আম্মু আর আমার দুই খালামনি মিলে আজকে দুপুরের খাবারের জন্য রান্নাবান্না করছে। আমার আর আদ্রিশের জন্য সব রান্নাই বেশি বেশি করে করছে। কারণ ঢাকায় যাওয়ার পরপরই তো আর রান্না সম্ভব নয়। সবকিছু গোছগাছ করতে করতেই প্রায় এক সপ্তাহ পার হয়ে যাবে।
আমি, রাইসা ভাবী আর নদী রান্নার কাজে টুকটাক সাহায্য করেছিলাম। আপাতত আমরা তিনজন রাইসা ভাবীর রুমে বসে আছি। তিনজনে মিলে একটু গল্পগুজব করবো, এই আশায়।

আমাদের গল্পের মাঝে রাইসা ভাবী হঠাৎ প্রশ্ন করলেন,
“ফিউচার প্ল্যানিং কি তোমাদের?”

আমি মুচকি হেসে বললাম,
” আপাতত ঢাকায় গিয়ে ভালোমতো সেটেল হওয়াটাই ফিউচার প্ল্যানিং এর মধ্যে পরে। একা হাতে সংসার সামলানো বেশ কষ্টকর। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে সেটাই করতে হবে আমাকে। আবার এক সপ্তাহ পর ক্লাসও তো শুরু হয়ে যাবে। আদ্রিশও হসপিটালের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে৷ তখন…..”

ভাবী আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো,
” আরে আরে, ওসব প্ল্যানিং কে শুনতে চাচ্ছে। এসব তো আমরা সবাই জানি৷ আমি জানতে চাচ্ছি তোমরা বেবি নেওয়ার কি প্ল্যানিং করেছো?”

ভাবীর এহেন প্রশ্নে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। চোখ বড় বড় করে ভাবীর দিকে তাকাতেই ভাবী ফিক করে হেসে ফেললেন। আমি আমতাআমতা করে বললাম,
” ভাবী….বিয়ের মাত্র একদিন হলো। এখনই বেবি নেওয়ার প্ল্যানিং কিভাবে……”

আমার কথায় রাইসা ভাবী আর নদী একত্রে হেসে উঠলো। রাইসা ভাবী বললেন,
” এতো অবাক হওয়ার কি আছে? বৈবাহিক জীবনে বাচ্চা নেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। আমি আর পলাশ বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যেই এসব বিষয়ে কথাবার্তা শেষ করেছিলাম। কারণ, বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে স্বামী স্ত্রী দুজনের আলাদা মতামত থাকতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুজনের মতই এক। এখন…..একেক দম্পতির একেক ইচ্ছা থাকে। কেউ চায়, বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই বাচ্চা নিতে। আবার কেউ চায় বিয়ের কয়েক বছর পর বাচ্চা নিতে। হুটহাট প্ল্যানিং ছাড়া বাচ্চা নিতে কয়জনই বা চায় বলো? অবশ্য প্ল্যানিং করার পরও সব আল্লাহর হাতে থাকে। আল্লাহ যখন চায়, তখনই একজন দম্পতি বাবা মা হওয়ার সুখ লাভ করে। কিন্তু প্ল্যানিং তো সবাই করে। ঠিক না?”

রাইসা ভাবীর কথা প্রত্যুত্তরে আমি কিছু বলার আগেই নদী বলে উঠলো,
” মুহিবও আমাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাস করেছিলো। আমি বললাম, ‘আপনার যেটা ইচ্ছা।’ তো মুুহিব বললো, ‘বিয়ের ২/১ বছর যাক। তারপর বেবি নেওয়ার ট্রাই করবো।’ আমি উনার কথা শুনে মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম৷ এ কথাবার্তার মাধ্যমেই আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং আরেকটু ভালো হয়। ”

রাইসা ভাবী নদীর কথার সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
” ঠিক বলেছো। আর মিম…..তোমার আর আদ্রিশের আন্ডারস্ট্যান্ডিং তো ভালোই। এ বিষয়ে কোনো কথাবার্তা হয়নি?”

এই দুজনের যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তায় আমি চুপসে গেলাম। খানিকটা ইতস্তত বোধ করে বললাম,
” বিয়ের মাত্র একদিন হলো। এখনো বাচ্চার ব্যাপারে কোনো কথাবার্তাই হয়নি। আমার মনে হয়, একটু বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে যায় এসব ব্যাপারে কথা বলা। আর কয়দিন যাক, তারপর নাহয়……”

রাইসা ভাবী খানিকটা অবাক হয়ে বললেন,
” তুমি হুট করে কন্সিভ করে ফেললে!”

” এমন পরিস্থিতি আসবে না আশা করি। যদিও আমাদের মাঝে এ ব্যাপারে কোনো কথাবার্তা হয়নি। তারপরও আমি অন্ততঃ এটুকু চাই যে, আমার এমবিবিএস শেষ হলে তারপর বাচ্চা নিবো। পড়ার মাঝে বাচ্চা নেওয়া মোটেও উচিত হবে না, আমার এমনটা মনে হয়। কারণ এতে পড়ার প্রেশারটা বাচ্চার উপরও পড়বে। তখন কোনো সমস্যা হলে?
এসব আমার কথা। আদ্রিশের মনের কথা জানি না৷ তবে আমার মনে হয়, উনি আমার পক্ষেই থাকবেন।”

নদী হয়তো কিছু বলতে চাইছিলো। তবে রান্নাঘর থেকে বড় মামির ডাক পরায় সে নিজের কথা শুরু করতে পারলো না। আমরাও আর কথা বাড়াতে পারলাম না৷ কারণ, বড় মামি আমাকে আর রাইসা ভাবীকেও নদীর সাথে ডেকে পাঠালেন।

.

অটোতে উঠার জন্য আদ্রিশ দাঁড়িয়ে আছেন। এদিকে আমি মনমতো কান্না করে চলছি। সবাইকে জড়িয়ে ধরে কান্না করার পরও আমি কোনোমতেই শান্তি পাচ্ছি না। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার। কান্না করতে করতে গলা এমন শুকিয়ে এসেছে যে ঠিকমতো কথাই বলতে পারছি না আমি। হয়তো আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছে রাইসা ভাবী। এজন্য সে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো আমার জন্য। ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ হতে হতেই আমার কান্না কিছুটা থেমে গেলো। আমি এবার রীতিমতো ফুঁপাতে লাগলাম। আব্বু আর মামা এক প্রকার জোর করে আমাকে অটোতে উঠিয়ে দিলেন। আদ্রিশও আমার পিছুপিছু চুপচাপ উঠে পরলেন।
আমি আর আদ্রিশ পিছনে বসে আছি আর আব্বু এবং মামা ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আছে। আমার কান্নার গতি তখন কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু ফুঁপানো কমেনি। আদ্রিশ আমার বাম হাতটা নিজের দু হাতের মুঠোয় ভরে শক্ত করে আটকে রাখলেন। হয়তো এর মাধ্যমে উনি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
কয়েক সেকেন্ডের মাঝে অটো ছেড়ে দিতেই আমি অটোর পিছন হতে বাড়ির দিকে তাকালাম। আম্মু আর আভা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। এই দুজনের কান্না দেখে আমার থেমে যাওয়া কান্না আবারো শুরু হলো। তবে এবার জোরে জোরে কান্না করছি না, একদম নিঃশব্দে কান্না করছি আমি।

.

দীর্ঘ ৬ঘণ্টা জার্নি শেষে রাত দশটায় আমরা দুজনে ঢাকা শহরে অবস্থিত ছোট্ট দু’রুমে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলাম। সেখানে আমাদের জন্য যে এমন একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো তা জানা ছিলো না আমাদের কারোর।

আমাকে আর আদ্রিশকে বাসস্ট্যান্ড থেকে পিক করতে আসেন আদ্রিশের দুই বন্ধু। সেখানেই তাদের সাথে ছোট্ট করে পরিচয় হয় আমার। তাদের দুজনের মধ্যে একজনের নাম নাইম এবং অপর জনের নাম সাগর। দুজনেই আদ্রিশের ব্যাচমেট।

আমাদের বাসায় পৌঁছানোর পর ড্রইংরুমে আদ্রিশের আরো দুই বন্ধু এবং তাদের একজনের ওয়াইফ অপেক্ষা করছিলো। তারা সবাই মিলে বাসার ড্রইংরুমটা বেশ সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছেন আমাদের জন্য৷ যদিও সেখানে কোনো সোফা নেই। আপাতত তিন চেয়ারের ছোট একটা ডাইনিং টেবিল আনা হয়েছে। সেই ডাইনিং টেবিলকে ঘিরেই যত ডেকোরেশন।
রেস্টুরেন্ট থেকে আনা কয়েক পদের খাবার-দাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে ডাইনিং এ। আর এ ডাইনিং টেবিলের সামনের দেয়ালেই ‘Welcome Home’ লেখা একটা কাগজ টাঙানো হয়েছে।

আদ্রিশ আর আমি সকল ডেকোরেশন দেখে কিছুক্ষণের জন্য থ বনে ছিলাম। পরে হুঁশ ফিরে আসতেই আদ্রিশ সবাইকে একত্রে ধন্যবাদ জানায়। এরপর একে একে উনি উনার বাকি দুই বন্ধু এবং বন্ধুর এক ওয়াইফকে পরিচয় করিয়ে দেন আমার সাথে। উনার বাকি দুই বন্ধুর মধ্যে একজন হলেন জায়েদ এবং অপরজন হলেন সাকিব। জায়েদ ভাইয়ার বউ হলেন বৃষ্টি আপু। কথায় কথায় জানতে পারলাম জায়েদ ভাইয়া উনাদের ব্যাচমেট নয়, বরং উনাদের থেকে তিন ইয়ারের সিনিয়র। উনাদের পরিচয় মেডিকেল থেকেই। তখন থেকেই জায়েদ ভাইয়া উনাদের বড় ভাই সাথে বন্ধু বলে পরিচিত হয়।

কিছুক্ষণ কথাবার্তা শেষে আমাদের দুজনকে ফ্রেশ হতে রুমে পাঠিয়ে দেন সবাই। ডাইনিং থেকে হেঁটে রুমে প্রবেশ করার সাথে সাথেই আমার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো। পুরো রুম বাসর ঘরের মত করে সাজানো! আদ্রিশও হয়তো এমন কিছু আশা করেননি৷ এজন্য নাইম ভাইয়াকে ডেকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাস করলেন,
” এসব কি?”

নাইম ভাইয়া এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আদ্রিশের পিঠে চাপড় মেরে বললেন,
” দোস্ত, এবার বাসরটা সেরেই ফেল।”

নাইম ভাইয়ার কথা শুনে লজ্জায় গুটিয়ে এলাম আমি।

®সারা মেহেক

#চলবে