ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি পর্ব-৪৮

0
928

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৪৮

নাইম ভাইয়ার কথায় আদ্রিশ আমার দিকে আড়চোখে তাকালেন। আমিও উনার দিকে আড়চোখে চেয়ে ছিলাম বলে উনার তাকিয়ে থাকাটাও চট করে ধরে ফেলি।

আদ্রিশ, নাইম ভাইয়াকে কি যেনো বলে ড্রইংরুমে পাঠিয়ে দিলেন। নাইম ভাইয়া চলে যেতেই আদ্রিশ রুমের দরজা আটকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” কিছু মনে করো না ওর কথায়। ফ্রেন্ড….বুঝোই তো……”

আমি হালকা হেসে বললাম,
” মনে করার কিছু নেই। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

” তুমি আগে যাও।”

” আমার একটু সময় লাগবে। আপনি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বাইরে সবাই সময় দিন। আমি তো তা পারবো না। এজন্য বলছি।”

” আচ্ছা যাচ্ছি। ” এই বলে আদ্রিশ পরনের শার্ট খুলতে লাগলেন। আমি পরনের বোরকা খুলে ট্রলি থেকে তোয়ালে বের করে আদ্রিশের দিকে এগিয়ে দিলাম। উনি তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুম যেতেই আমি রুমে থাকা ছোট একটা কাপড় দিয়ে আলমারির তাকগুলো মুছে নিলাম। নতুন নতুন আলমারিতে বার্নিশের গন্ধ এখনো বেশ তীব্র।

আলমারি মুছে একে একে আদ্রিশের সব কাপড় রেখে আমার কাপড়গুলোও রেখে দিলাম। ততক্ষণে আদ্রিশ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসেছেন। আমাকে আলমারি গুছাতে দেখে ইশারায় বললেন ফ্রেশ হয়ে নিতে। আমিও দেরি না করে তোয়ালে আর এক সেট থ্রিপিছ নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলাম।

আদ্রিশের সব বন্ধুরা বেরিয়ে গিয়েছে আধ ঘণ্টা হলো। খাওয়াদাওয়া শেষে ঘণ্টাখানেক গল্পগুজব করেই সবাই চলে গিয়েছে৷ আদ্রিশ তাদের এগিয়ে দিতে বাসার নিচে গিয়েছে পাঁচ -দশ মিনিট হলো। রাত বারোটার সময় পুরো বাসায় একা পাঁচ-দশ মিনিট কাটানো আমার জন্য একটু ভয়ংকর বটে। ভূতের ভয় না, অন্য কিছুর ভয়। সে অন্য কিছুই বা কি সেটা জানি না। তবে ভয় করছে সেটা বুঝতে পারছি।

আরো পাঁচ মিনিট পার হওয়ার পরপরই আদ্রিশ বাসায় চলে আসেন। উনি বাসায় ঢুকার পরপরই বাসার প্রধান দরজা বেশ ভালোভাবে বন্ধ করে দিলাম আমি। দরজা আটকে উনার দিকে ফিরতেই দেখি, উনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি ব্যাপার? এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?”

আদ্রিশ মুচকি হেসে বললেন,
” একটা কাজ করতে।”

” কি কাজ?”

আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই আদ্রিশ আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন। উনার এহেন কাজে আমি ভড়কে গেলাম। সাথে সাথে জিজ্ঞাস করলাম,
” আমাকে কোল থেকে নামান। পরে যাবো তো। ভয় করছে। যদি আপনার হাত স্লিপ করে তাহলে?”

আদ্রিশ প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে হালকা হেসে দিলেন। ড্রইংরুমের সুইচবোর্ডের কাছে এসে আমাকে বললেন,
” উইদাউট এনি কোয়েশ্চেন, রুমের লাইটটা অফ করে দাও।”

আমি বাধ্য মেয়ের মত আদ্রিশের কথা শুনে রুমে লাইট লাইট অফ করে দিলাম। রুম অন্ধকার হতেই আদ্রিশ আমাকে নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে এলেন।
কোনো কথাবার্তা ছাড়াই আমাকে কোল থেকে নামিয়ে তিনি ফ্লোরে বসে পরলেন। আমাকে ইশারা করতে আমিও উনার পাশে বসে পরলাম।

বেডরুমের লাইট অফ থাকার পরও রুমে অবস্থিত মোমবাতির আলোয় বারান্দা অল্পবিস্তর আলোকিত হয়ে আছে। সেই আলোতেই আমি আর আদ্রিশ পাশাপাশি বসে একে অপরের হাতে হাতে গুঁজে রাতের আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। কুচকুচে কালো রঙের আকাশটা রূপালি চাঁদের প্রভাবে গাঢ় ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে। সেই চাঁদের আশেপাশে এবং বেশ খানিকটা দূরত্বে অনেকগুলো তারা মিটিমিটি করে জ্বলছে।

আমি আদ্রিশের কাঁধে মাথা রেখে বললাম,
” আচ্ছা? একদম চুপচাপ রাতের আকাশ দেখতে আপনার বোরিং লাগছে না?”

আদ্রিশ আমার হাতটা আরো একটু শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,
” অনেকক্ষণ একা থাকলে হয়তো বোরিং লাগতো। কিন্তু পাশে মিশমিশ থাকায় সে বোরিংনেস ফিল হচ্ছে না৷ উল্টো আরো ভালো লাগছে।”

” আচ্ছা? আমাকে খুশি করার জন্য বললেন এমনটা?”

” মোটেও না। যা সত্য তাই বললাম। একদম মন থেকে। আমার মনে হয়, এটা সবার ক্ষেত্রেই হয়। ”

” গুড গুড। আপনার মনে হওয়াটা হয়তো সত্যি আবার হয়তো মিথ্যা।” এই বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবারো বললাম,
” জানেন? রাতের আকাশের এই একলা চাঁদ আর মিটিমিটি করা তারাগুলো দেখলে তাদের ছুঁয়ে দিতে মন চায়। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এদেরকে ছুঁয়ে দিলে আমার হাতে হয়তো রূপালি রঙ লেগে যাবে। ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য হবে, ঠিক না?”

আদ্রিশ ধীর স্বরে বললেন,
” হুম। অনুভূতিটাই অন্যরকম হবে তখন।”

আমি এর প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না। ফলে আবারো, আমাদের মাঝে নিরবতা বিরাজ করলো। হঠাৎ আদ্রিশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,
” এই মিশমিশ, ঐ যে দেখো তারা মুভ করছে।”
এই বলে উনি দ্রুততার সহিত আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন। বারান্দার গ্রিলের কাছে এসে সামনের আকাশের দিকে হাত তুলে বললেন,
” ঐ যে দেখো, তারা চলছে। দেখতে পারছো?”

আদ্রিশের হাত বরাবর তাকিয়েই দেখতে পেলাম, একটা তারা ধীরেধীরে তার সামনের তারা’র কাছে যাচ্ছে। বিষয়টা বেশ উপভোগ্য। এর আগেও বেশ ক’বার খেয়াল করেছি এটা। তারাদের চলাচল প্রথম দেখায় আমার মামাতো বোন। গ্রামের খোলা আকাশের নিচে আরো স্পষ্ট আর সুন্দর দেখায় তারাদের এ চলাচলের দৃশ্যটা।

আমি আর আদ্রিশ কয়েক মিনিট যাবত তারা’র চলাচল দেখলাম। হঠাৎ আদ্রিশ আমার পাশ থেকে সরে পিছনে দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। উনার এ স্পর্শে বরাবরেই মতোই কেঁপে উঠলাম আমি। বুকের ভেতরটাও ধক্ করে উঠলো। শ্বাস প্রশ্বাসের গতিও কিছুটা ধীর হয়ে এলো। আদ্রিশ এসব বুঝেও না বুঝার ভান করে আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন,
” এর আগে কখনো দেখেছো এটা?”

আমি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
” হুম দেখেছি। ”

আদ্রিশ এর প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না। উল্টো বলে বসলেন,
” তোমার মতামতের সাথে আমি একমত।”

আমি কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাস করলাম,
” কোন মতামত?”

” ঐ যে বেবি নেওয়ার ব্যাপারে।”

আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম,
” আপনি সেখানে ছিলেন?”

” হুম। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। তোমার প্ল্যানিংটা ঠিক আছে। আমিও এটাই চাচ্ছিলাম। কারণ এতো পড়ালেখার চাপে বেবি নেওয়ার কথা চিন্তা করা মানেই প্রেশারে পরা। এর মধ্যে যদি বেবি হয়েও যায়, তখন তোমাদের দুজনের শরীরের উপরই এর প্রভাব পড়বে। যেটা আমি মোটেও চাইনা। ”

এই বলে আদ্রিশ চুপ হয়ে গেলেন। এদিকে আমি প্রত্যুত্তরে কিছু না বললেও মনে মনে বেশ খুশি হলাম এই ভেবে যে, আদ্রিশও আমার সাথে একমত। মনে মনে একটু সন্দেহ থাকলেও এখন তা পুরোপুরি দূর হয়ে গিয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আদ্রিশকে জিজ্ঞাস করলাম,
” আপনি ঢাকায় থাকার সময় একটা প্রশ্ন করেছিলাম। সেটা মনে আছে?”

” কোন প্রশ্ন?”

আমি বিনা সংকোচে বলে দিলাম,
” ঐ যে, আপনাকে জিজ্ঞাস করেছিলাম, আপনি যে আমাকে ভালোবাসেন তা কবে থেকে জানতে পারলেন?”

আদ্রিশ খানিকক্ষণ ভেবে বললেন,
” উমম….কবে থেকে সেটা জানি না৷ তোমার প্রতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালোলাগা থেকেই আমার ভালোবাসা শুরু। প্রথমদিন থেকেই তোমাকে ভালো লাগে। খুব ভালো লেগেছিলো সেটা বলবো না। ঐ যে, প্রথম দেখায় প্রতিটা মানুষের প্রতি যেমন একটু ভালোলাগা কাজ করে তেমনটা হয়েছিলো। এরপর, দিন যত যায় তোমার প্রতি সে ভালোলাগাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। তোমার প্রতি প্রতিটা অনুভূতি তীব্র হতে থাকে। পরে, একদিন বুঝতে পারলাম এই অনুভূতিকেই ভালোবাসা বলে।”

এই বলে উনি আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। এরপর আমার কপালে গভীরভাবে নিজের অধর স্পর্শ করিয়ে বললেন,
” আমি নিজেই আমার এ অনুভূতিগুলোর উপর অবাক হয়েছিলাম। শিওর ছিলাম না যে, তোমাকে আদৌ ভালোবাসি কি না৷ মনে হচ্ছিলো, শুধু ভালোলাগা আছে তোমার প্রতি৷ তারপরও মনকে বুঝ দিচ্ছিলাম এই বলে যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তবে এ বুঝ দেওয়াটা একদম খাতায় কলমে সত্য প্রমাণিত হয় সেদিন, যেদিন তুমি আমার থেকে দূরে চলে গিয়েছিলে। দীর্ঘ তিন সপ্তাহ তোমার থেকে দূরে থেকে তোমার প্রতি তীব্র ভালোবাসা অনুভব করেছি আমি। সেই অনুভূতিটা একদিকে যেমন কষ্টের ছিলো, অপরদিকে ঠিক তেমনই সুখকর ছিলো। কারণ, আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমি ঠিক কতোটা ভালোবাসি তোমাকে। ”

এই বলে আদ্রিশ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু আমি লজ্জায় উনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। উনিও আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
” আমার জীবনের প্রথম আর শেষ ভালোবাসা তুমি। আমার জীবনের প্রথম আর শেষ ভালোলাগা তুমি। আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ মোহ তুমি৷ কি এক অদ্ভুত জালে ফাঁসিয়ে দিয়েছো আমাকে, যেখান থেকে বের হওয়ার সাধ্য আমার নেই! কি এক মায়া, কি এক মোহ! সবকিছুই অদ্ভুত।
অদ্ভুত তোমার এ ভালোবাসা। অদ্ভুত তোমার এ নেশা। ”

আদ্রিশের প্রতিটা কথায় মুগ্ধ হচ্ছি আমি৷ উনার মুগ্ধতায় জড়ানো কথা শুনে উনার প্রতি ভালোবাসা, সম্মান আরো এক ধাপ বেড়ে গেলো। বিশেষ করে উনার হৃৎস্পন্দন! এ মধুর শব্দ আমাকে আরো একবার উনার প্রেমে ফেলে দিচ্ছে। অদ্ভুত!

কিছুক্ষণ বাদে, হঠাৎ করে আদ্রিশ প্রশ্ন করলেন,
” এই যে, আমি আমার প্রতিটা অনুভূতির কথা তোমার সামনে জাহির করি। অথচ তুমি আমাকে তোমার অনুভূতির কথা কিছুই বলো না। তোমার ভালোবাসা, ভালোলাগা কিছুই জানি না আমি।”

আদ্রিশের কথাবার্তা শুনে উনার বুকের উপর থেকে চট করে মাথা তুললাম আমি। অভিমানী কণ্ঠে বললাম,
” আপনার প্রতি কোনো অনুভূতি না থাকলে কি আমি বিয়ে করতাম আপনাকে?”

উনি আমার কথার জবাব না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলতে লাগলেন,
” এমনও হতে পারে, তোমার মনে অন্য কেউ আছে……”

আদ্রিশের কথায় হুট করে উনার উপর রাগ হলো আমার। উনার বুকে কয়েকটা কিল মেরে বললাম,
” আপনি খুব খারাপ৷ আমার উপর এমন সন্দেহ! ভালো ভালো। হ্যা, আমার মনে অন্য কেউ আছে। সেই থাকবে সবসময়। আর আপনি তার ব্যাপারে কখনও জানতে পারবেন না।” এই বলে আমি চলে যেতে নিলাম। কিন্তু আদ্রিশ আমাকে যেতে দিলেন না। আমাকে শক্ত করে ধরে আগের জায়গায় এনে বললেন,
” এতো রাগ কেনো তোমার মধ্যে হুম? আমারও যদি এতো রাগ উঠে যায় হুটহাট তখন সংসার করবো কি করে বলো?”

আমি অন্যদিকে ফিরে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,
” করতে হবে না সংসার।”

আদ্রিশ আমাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
” খবরদার এসব কথা বলবে না। তুমি সংসার করতে না চাইলেও তোমাকে দিয়ে জোর করে সংসার করাবো। তবুও তোমাকে অন্য কারোর হতে দিবো না বা একা থাকতে দিবো না। দুনিয়ার যা খুশি তাই করো, তোমাকে এই আদ্রিশের সাথেই সংসার করতে হবে। মাইন্ড ইট মিশমিশ। ”

উনার এমন অধিকার ফলানোর কথাবার্তা শুনে আমি উনার দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইলাম। কয়েক সেকেন্ড পর বললাম,
” আমাকে এ ধরণের কথাবার্তা বলে আর রাগাবেন না কখনো। ওকে?”

আদ্রিশ মুচকি হেসে বললেন,
” উঁহু , নট ওকে। আমাকে তোমার মনের কথা জানাতে হবে। তারপর আমি তোমার কথা মানবো।”

আমি হালকা হেসে বললাম,
” আচ্ছা? যদি না বলি তাহলে?”

” তোমাকে সবসময় রাগাবো এভাবে। ”

” আচ্ছা বলছি। ”

আমার কথা শোনামাত্রই আদ্রিশের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস দেখতে পেলাম। আমি কিছুক্ষণ উনার এ উচ্ছ্বসিত ভাবটা উপভোগ করে বললাম,
” আপনার মত অতোটা সুন্দরভাবে আমি আমার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারিনা৷ তবে এক কথায় বলতে গেলে…….আপনাকে খুব ভালোবাসি আমি। নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি আপনাকে। আমার প্রথম এবং শেষ প্রেম আপনি। ”
এই বলে লজ্জায় উনাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। ফিসফিস করে বললাম,
” আমার প্রতিটা ভালোলাগার অনুভূতির শুরু এবং শেষ আপনি৷ আপনাকে খুব ভালোবাসি আদ্রিশ। খুব খুব খুব ভালোবাসি……… ”

আদ্রিশ কোনো কথা বললেন না। নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। হঠাৎ আমার মাথা নিজের বুকের উপর থেকে তুলে নিয়ে বললেন,
” তোমার এ ভালোবাসা আজ প্রত্যক্ষভাবে দেখতে চাই আমি। তোমার ভালোবাসায় ডুবে যেতে চাই আমি। সাথে নিজের ভালোবাসার অনুভূতিগুলোও দেখাতে চাই তোমাকে। আজ রাতটা কি আমায় দিবে?”

আদ্রিশের এহেন প্রস্তাবে আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। কারণ এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সাধ্য আমার নেই।
কয়েক সেকেন্ড পরেই আদ্রিশ আমাকে আবারো পাঁজাকোলা করে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালেন।

.

সকালের উষ্ণ মিষ্টি রোদ চোখেমুখে পড়তেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম আমি। ঘুম থেকে উঠতেই যে আওয়াজটা সর্বপ্রথম আমার কানে ভেসে এলো তা হলো, ছোট্ট কিছু পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ। অত্যন্ত মিষ্টি স্বরের সে আওয়াজ মনের গভীর থেকে উপলব্ধি করলেই শীতল এক অনুভূতিতে হৃদয় জুড়িয়ে যায়। তবে পাখির এ মিষ্টি আওয়াজ ঢাকা শহরের গাড়ীর হর্ণের আওয়াজের সামনে টিকতে পারলো না। হঠাৎ ট্রাকের গমগমে আওয়াজে কান চেপে ধরলাম আমি। তৎক্ষনাৎ বিরক্তিতে ভ্রুজোড়া কুঁচকে এলো আমার।
আশেপাশে একটু নজর বুলিয়ে উঠতে নিলেই আদ্রিশ হাতের ভারে আবারো তার বুকে মাথা রাখলাম আমি। তবে কিছুক্ষণের মাঝেই আস্তেধীরে উনার হাতটা আমার উপর থেকে সরিয়ে উনার বুকের উপর থেকে মাথা উঠালাম আমি। সময় দেখার জন্য পাশ ফিরে ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিন অন করলাম আমি।
সময় এখন সাতটা পাঁচ। আজকে দশটার মধ্যে আদ্রিশকে হসপিটালে যেতে হবে। ঢাকার জ্যামে আটটার মধ্যে রওনা না দিলে দশটার মধ্যে হসপিটালে পৌঁছা কখনও সম্ভব নয়। এজন্য আমি আদ্রিশের দিকে ফিরে উনাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি উঠলেন। এমনকি সামান্য হেলদোলও দেখলাম না উনার মধ্যে। এভাবে কয়েকবার ধাক্কানোর পর আমি উনার কানের কাছে গিয়ে একটু জোরালো স্বরে বললাম,
” এই যে মিস্টার……আজকে না আপনার হসপিটালের জয়েনিং ডেট? সকাল সাতটা বাজে অলরেডি। দশটার মধ্যে হসপিটালে যেতে হবে তো? ”

আমার কথা শুনে আদ্রিশের ঘুম ভাঙলো ঠিকই। তবে উনি উঠলেন না। বরং আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললেন,
” পাঁচ মিনিট এভাবে থাকবো। তারপর উঠবো। আর একটা কথা বললেই এই সময় কিন্তু বাড়বে।”

আদ্রিশের কথার প্রত্যুত্তরে দু একটা কথা বলার মনমানসিকতা থাকলেও উনার শেষের বাক্যে সে মনমানসিকতা মূহুর্তেই উবে গেলো। অগত্যাই উনার বুকে মাথা রেখে পাঁচ মিনিট শুয়ে রইলাম আমি।

.

রুমের ছোট্ট ড্রেসিং টেবিলটার সামনে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছেন আদ্রিশ। আর আমি চুপচাপ উনার প্রতিটা কাজ গভীর মনযোগ দিয়ে দেখছি।
শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে উনি বললেন,
” কালকে রাতে এতো দেখার পরও মন ভরেনি তোমার?”

মূহুর্তেই লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলাম আমি। তা দেখে উনি শব্দ করে হেসে বললেন,
” আরে আরে…. মাথা নামিয়ে নিলে কেনো? তুমি আমাকে এভাবে দেখবে না তো কে দেখবে শুনি?”

আমি প্রত্যুত্তরে কিছুই বললাম না। বরং সেখান থেকে উঠে এসে উনার এপ্রোন আর স্টেথোস্কোপটা নিয়ে এলাম। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে উনাকে ওসব দিতে দিতে বললাম,
” কখন আসবেন আপনি?”

আদ্রিশ আমার হাত থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বলল,
” বিকেলের মধ্যেই চলে আসবো হয়তো। তুমি রেডি থেকো?”

” কেনো?”

” কেনো আবার? বই কিনতে যেতে হবে না?”

” ওহ হ্যা। তাইতো।”

” আমি এসে একটু রেস্ট নিয়েই তোমাকে নিয়ে বেরিয়ে পরবো। ওকে?”

” ওকে? আচ্ছা শুনুন না…..”

আদ্রিশ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
” জ্বি বলুন না……”

আমি দুঃখী ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বললাম,
” সারাদিন একা একা কি করবো আমি?”

” আমার বইগুলো ঘাটাঘাটি করবে। ঘুমাবে, খাবে…ব্যস সময় শেষ।”

আদ্রিশের কথা শুনে আমি একটা ভেঙচি কাটলাম। তা দেখে আদ্রিশ হালকা হেসে আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
” একটু বই নিয়ে থাকো। তাহলে সময় কোনদিক দিয়ে চলে যাবে টেরই পাবে না।”

আমি প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। আদ্রিশ পুরোপুরি রেডি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে হাতের ইশারায় ‘বাই’ বলে গেলেন। আমিও অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাত নাড়িয়ে দিলাম।

®সারা মেহেক

#চলবে