ভালোবাসি তারে
১৮.
আকাশের অবস্থা মনোমুগ্ধকর। এ আবহাওয়ায় কলেজে যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না ঝুমের। কলেজ যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হলেও কলেজে যায় নি সে। নদীর পাড়ে বসে মুহুর্তটা উপভোগ করেছে। হাতের কাছে থাকা দূর্বাঘাসগুলো একটু পর পর ছিঁড়ে নদীর পানিতে ফেলছে ঝুম। গুণগুণ করে গান গাইছে। প্রকৃতির সঙ্গে, সঙ্গে ঝুমের মনটাও আজ ভীষণ ভালো। কোনো কারণ ছাড়াই ভালো! নদীর তীর ঘেষে চলা পানিগুলো হাতের পাতা দিয়ে ছুঁয়ে দিলো ঝুম। পানিগুলো বেশ শীতল, ঠান্ডা ও আরামদায়ক! আশেপাশে কোথাও কোয়েল আছে হয়তো। কোয়েলের মিষ্টি সুরে ডাকা, ‘কুহু’ ‘কুহু’ শুনে ঝুমের মুখে হাসি ফুটে উঠে। এমন সময় চেনা পরিচিত কারো ডাক শুনতে পায় ঝুম। পেছন ফিরতেই নিধাকে দেখতে পায়। সরু রাস্তা ভেদ করে দৌড়ে ঝুমের কাছে আসছে নিধা। তার পেছনেই নিঝুম, স্নিগ্ধ, স্নেহা আর স্নিধা।
ঝুমের কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়ায় নিধা। হাসি-মুখে জিজ্ঞেস করে,
— “ম্যাম? আপনি এখানে?”
ততক্ষণে সবাই কাছাকাছি এসে গেছে। সবার দিকে অবাক চাহনিতে একপলক তাকালো ঝুম। নিঝুমের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে ফেলল। ধীর গলায় আমতা আমতা করে বলল,
— “এমনি এসেছিলাম। তোমরা এখানে কি করছ?”
নিধা দাঁত বের করে হেসে বলল,
— “ঘুরতে এসেছি সবাই। ভালো হয়েছে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে। তুমিও চলো, আমাদের সঙ্গে ঘুরবে।”
ঝুমের খুব ইচ্ছে করছে নিঝুমের সঙ্গে ঘুরতে। তার সঙ্গে একটু কথা বলতে। কিন্তু, নিঝুমের সেদিনের করা ব্যবহারে ঝুমের প্রচুর অভিমান হয়েছে। মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে সে। মুখ মলিন করে ঝুম বলল,
— “অন্য কোনো দিন ঘুরব নিধা? এখন তোমরা তোমরা ঘুরো।”
স্নিগ্ধ আর স্নেহা দ্বিমত করে। স্নেহা জোড় গলায় বলে,
— “কালকেও তুমি অন্যদিন গল্প করবে বলে এক্সকিউজ দিয়েছো ঝুম। আজকে আর না। আমাদের মন রাখার জন্য হলেও অনতত মানা করো না।”
ঝুম আমতা আমতা করতে শুরু করে। তার অস্বস্তি হচ্ছে। নার্ভাস লাগছে প্রচুর। ঝুম আগের ন্যায় আবার বলল,
— “আ-আমি… আমি আপনার কথা রাখতে..!”
কথা শেষ করতে পারে না ঝুম। নিঝুম প্যান্টের পকেটে হাত রেখে সটান হয়ে দাঁড়িয়ছে তার সামনে। ব্যস! ঝুমের কথা বন্ধ! গলায় আটকে যায় শব্দগুলো। নিঝুম বেশ গাম্ভীর্য ভাবে বলে,
— “আমাদের সঙ্গে ঘুরতে চলো ঝুম।”
যেন নিঝুম ঝুমকে আদেশ করছে। অদৃশ্য এক অধিকার নিয়ে কথা বলছে সে। অদৃশ্য অধিকারের মায়াজালে আটকে ঝুম আর মানা করতে পারে না। তবে মুখেও কিছু বলে না। চুপ থাকে। ঝুমের নিশ্চুপ থাকা দেখে নিঝুম এবার সামনে এগোতে, এগোতে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
— “ঝুম যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে। দাঁড়িয়ে না থেকে সবাই এখন হাঁটতে শুরু কর!”
সবাই বিস্ময় নিয়ে তাকায় ঝুমের দিকে। তারা এত বলার পরও ঝুম রাজী হয় নি, অথচ নিঝুম বলতেই রাজী হয়ে গেল? ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না কেউ। তবে এ বিষয়ে কিছু বলেও নি। চুপচাপ নিঝুমের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করে। ঝুম বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অস্বস্তি কমানোর চেষ্টা করে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, ‘সবাই এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল কেন?’ উত্তর খোঁজার সময় পায় না ঝুম। সবার পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করে।
______________________________
সবাই আগে আগে হাঁটছে। নিঝুম আর ঝুম একটু পিছিয়ে আছে। পাশাপাশি হাঁটছে তারা। ঝুম মাথা নত করে আছে। নিঝুমের সাথে সাথে হাঁটতে প্রচুর লজ্জা করছে ঝুমের। তবে তার চেয়ে অধিক ভালো লাগছে নিঝুমের সঙ্গ পেয়ে। ঝুম আড়চোখে নিঝুমের নীলাভ চোখের দিকে তাকায়। প্রায় অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকে। নিঝুম হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠে,
— “কি দেখছো?”
ঝুম হকচকিয়ে যায়। দ্রুত বলে,
— “ক-কিছু, কিছু না তো।”
ঝুমের উত্তর শুনে নিঝুম হালকা হাসে। ঝুম হাসির কারণ খুঁজে পায় না। শুধু নিঝুমের অসাধারণ হাসিটার দিকে সর্তক চোখে তাকিয়ে থাকে। নিঝুম ডেকে উঠে,
— “ঝুম?”
— “হু?”
প্রথমেই কিছু বলে না নিঝুম। কিছুক্ষম চুপ থাকে। বড় একটা নিশ্বাস ফেলে মৌনতা ভেঙ্গে বলে,
— “কিছু না।”
এ পর্যায়ে ঝুমের ভ্রুঁ কুঁচকে যায়। জিজ্ঞেস করে,
— “এটা কেমন কথা?”
নিঝুম নিঃশব্দে হেসে বলে,
— “এমন কথা!”
ঝুমের ভ্রু আরো কুঁচকে যায়। নিঝুমের কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করে। পরক্ষণেই নিঝুমের হাসি দেখে নিজেও হেসে ফেলে।
ঝুম এবং নিঝুমের একটু সামনেই স্নিগ্ধ হাঁটছিল। তাদের পেছনে দেখে স্নিগ্ধ বলল,
— “ঝুম? তোমরা এত পেছনে কেন? সামনে এসো!”
হঠাৎ কথা বলায় ঝুম চমকে যায়। স্নিগ্ধর হাসি মাখা মুখ দেখে সে-ও মুচকি হাসে। সামনে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ হতেই হাতে টান অনুভব করে। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, নিঝুম তার হাত ধরে আছে। শক্ত থেকে শক্ত ভাবে। যেন, যেতে মানা করছে ঝুমকে। প্রবল অনুভূতিতে ঝুমের সারা শরীর শিরশির করে উঠে। হাত, পা কেঁপে উঠছে একটু পরপর। তৎক্ষণাৎ হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। নিঝুম হাত ছাড়ে না। বরং স্নিগ্ধকে বলে,
— “তোরা হাঁট! ও আসছে!”
অদ্ভুদ ভাবে স্নিগ্ধ আর কিছু বলে না। সামনে ফিরে যায়। নিঝুম তখনো হাত ধরে আছে। ঝুম বরফ হয়ে গেছে যেন। কাঁপা গলায় সে বলে,
— “হাত ছাড়ুন।”
নিঝুম ঝুমের হাত টেনে হাঁটা শুরু করে। ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করে,
— “অনুরোধ করছো? মনে হচ্ছে না তো।”
ঝুম অসহায় চোখে তাকায়। অনুরোধ করে বলে,
— “প্লীজ, নিঝুম ভাইয়া! হাতটা ছেড়ে দিন।”
‘নিঝুম ভাইয়া’ কথাটা ঠিক ভালো লাগে নি নিঝুমের। নাক কুঁচকে ফেলে সে। বিরক্ত হয়। বিরক্ত সহিত কণ্ঠে বলে,
— “সুন্দর করে বলো।”
ঝুম বুঝে পায় না নিঝুম কেন এমন করছে। নিঝুমের স্পর্শ তার ভালো লাগলেও আশেপাশে মানুষ থাকায় অস্বস্তি লাগছে। ঝুম কিছুক্ষণ ভেবে কথা গুঁছিয়ে নেয়। ধীর গলায় বলে,
— “ডাক্তার? এখানে অনেক মানুষজন। না বুঝে শুনে খারাপ ভাববে আপনাকে।”
এমতাবস্থায় নিঝুম ছেড়ে দেয় হাত। ছাড়ার যথেষ্ট কারণও আছে। তাদের একটু দূরত্বে কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। যদিও তারা এখনো তাদের দিকে খেয়াল করে নি, কিন্তু যদি হাতে হাত রেখে হাঁটতে দেখে, তাহলে নির্ঘাত পুরো গ্রামে বাজে কথা রটাবে তাদের নামে। এসব ভেবেই নিঝুম হাত ছেড়ে দিয়েছে। নতুবা হাত ছাড়তো না সে। কেন যেন ঝুমের হাত ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না তার। এমন ইচ্ছের সঠিক ব্যাখ্যা না জানলেও কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে নিঝুম। তবে অস্পষ্ট ভাবে!
______________________________
সরু রাস্তার চারপাশে গাছগাছালিতে ভরপুর। ঠিক মাথার উপরে সূর্যের তপ্ত আলো তীর্যক ভাবে বিরাজ করেছে। প্রচন্ড গরমে ঘর্মান্ত সবাই। অথচ সবাই মিলে একজোট হয়ে এখনো ঘুরে ঘুরে দেখছে পুরো গ্রামটা। হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠছে তারা। ঝুম একপাশ থেকে সেসব দেখছে। প্রতিবারের মতো নিঝুমের হাসি মাখা মুখটাও চোখ এড়োই নি তার। সব মিলিয়ে বেশ খুশি সে।
হঠাৎ নিঝুমের হাত ঝাঁকিয়ে নিধা বলে উঠে,
— “ভাইয়ু? দেখো ওগুলো কি সুন্দর ফুল! ওগুলোর নাম কি?”
— “কাঠগোলাপ।”
এটা শুনে স্নেহা বলে উঠে,
— “সেটা তো জানি নিঝুম। তুই এক কাজ কর। ফুলগুলো আমাদের জন্য পেরে আন।”
নিধাও সায় দেয়,
— “ভাইয়ু, আমার জন্যও এনো।”
নিঝুম কিছুক্ষণ ভাবে। একবার ঝুমের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই নিধাকে বলে,
— “দাঁড়া এখানে।”
নিঝুম কাঠগোলাপ গাছটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গাছটা ছোট হওয়ায় একটা হাত উঁচাতেই নিচু ডালে থাকা কাঠগোলাপগুলো নাগাল পেয়ে যায় নিঝুম। একসাথে কয়েকটা কাঠগোলাপ পেড়ে আনে। প্রথমে এক এক করে স্নেহা, স্নিধা আর নিধাকে একটা করে কাঠগোলাপ দিয়ে সবার শেষে ঝুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। হালকা হেসে হাতে থাকা সর্বশেষ ফুলটি এগিয়ে দিয়ে বলে,
— “তোমার জন্যে।”
ঝুমের হৃদপিন্ড থেমে যায় যেন। সব কিছু একমুহুর্তের জন্য থমকে যায়। চোখ তুলে নিঝুমকে একবার দেখে নেয় সে। নিঝুমের ঘর্মান্ত মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। অপুর্ব লাগছে দেখতে। একাধারে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করছে তার। মনে মনে নিঝুমকে প্রশ্ন করে ঝুম,
— “আপনি এত সুন্দর কেন ডাক্তার?”
_______________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা