ভালোবাসি তারে
২৪.
গ্রামের মানুষের কাছে বাড়িটা জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিত হলেও এর আসল নাম ‘মধ্যাহ্নবেলার নীড়।’ নামটা শাখাওয়াত শেখ বহু শখ করে রেখেছিলেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় গ্রামের অধিকাংশই এ নাম জানে না। এমন কি ঝুমও না। আজ খেয়াল হলো তার। গেটের একপাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গাছপালার এককোণে একঝলক নামটা দেখতে পায় সে। মিসেস সানজিদার কাছে জিজ্ঞেস করতেই তিনি এর ব্যাখ্যা দেন। তারও নাকি নামটা পছন্দ নয়। কিন্তু কেন? ঝুমের তো বেশ পছন্দ হয়েছে নামটা।
আচ্ছা, নিঝুমের কেমন লাগে নামটা? নিঝুমকে একবার জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো ঝুমের। আজ শুক্রবার। নিধার পরীক্ষা আছে বিধায় ঝুম পড়াতে এসেছে। নিঝুমেরও তো হাসপাতালে কত কাজ! শুক্রবার হলে কি? নিঝুম তো বাসায় নেই। ভেতর থেকে এমন ভাবনা মস্তিষ্কে আসতেই মনটা খানিকটা বিষণ্ণ হয়ে গেল তার। নিঝুম এখন ব্যস্ত মানুষ। তার দেখা কি সহজে পাওয়া যাবে! বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ঝুমের।
ধীর পায়ে পড়ার রুমে যেতে লাগলো ঝুম। সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় মনোয়ারা শেখের মুখোমুখি হলো সে। প্রতিবারের মতো তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঝুমের দিকে তাকিয়ে। তবে আজ প্রথম ঝুমের সাথে কথা বললেন। বেশ কর্কশ কণ্ঠে।
— “তুমি এখানে কি করছো? আজ না শুক্রবার?”
ঝুম হকচকিয়ে যায়। মহিলার আচরণ বেশ রুক্ষ। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তিনি ঝুমকে অপছন্দ করেন। ঝুম বুঝতে পারে সেটা। হালকা হাসার চেষ্টা করে ঝুম বলল,
— “আসলে, নিধার পরীক্ষা চলছে তো। তাই আসা।”
মনোয়ারা শেখ জবাব দিলেন না। ঝুম পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও তিনি নিশ্চুপ। এতে অবশ্যক ঝুমের কোনো চিন্তা সেই। সে তার মতোই এগোচ্ছে। তবে নিঝুমের রুমের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে যায় ঝুম। দরজা খোলা। রুমের ভেতর কেউ নেই। একদম ফাঁকা! বহুদিন হলো নিঝুমের রুমে ঢোকে না ঝুম। আজকে একটু রুমের ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। উফ! ইচ্ছেটা দমাতে পারছে না সে। ইচ্ছেটা তীব্র হচ্ছে। ঝুম আপাদস্ত সিঁড়ির দিকটা দেখে নিল। না! মনোয়ারা শেখ নেই। তিনি সম্ভবত রান্নাঘরে। এই সুযোগে ঝুমও নিঝুমের রুমে ঢুকে পড়ে।
নিঝুমের রুমটা আজ একটু অগোছালো। কাঠের টেবিলটায় রঙ,তুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গ্লাসের পানিটুকু বিভিন্ন রঙের সংস্পর্শে এসে রঙহীন পানিকে কালো করে তুলেছে। টেবিলের একপাশে বেশ অযত্নে রাখা হয়েছে সেটি। যেন এখনই পড়ে যাবে। আর… আর সবচেয়ে বিস্ময়কর কিংবা চমকে দেওয়ার মতো জিনিস হলো ঝুমের সামনে রাখা ক্যানভাসটা। সাদা কাগজটিতে রঙ তুলি দিয়ে নিপুণ ভাবে আঁকা হয়েছে ঝুমের লজ্জা মাখা মুখ। বিস্ময়ে ঝুমের ঠোঁট হালকার চেয়েও বেশি ফাঁক হয়ে যায়। সে তাকিয়েই রয় ক্যানভাসটির দিকে। চিত্রের একপাশে কিছু একটা লিখা দেখতে পায় ঝুম। ছাপসা ও অস্পষ্ট ভাবে। ক্যানভাসটার দিকে এগিয়ে গেল ঝুম। কাছাকাছি আসতেই বুঝতে পারলো, সেখানে লিখা, ‘আমার লজ্জাবতী।’
ঝুম এবার সত্যি সত্যি লজ্জা পাচ্ছে। গাল ভারী ভারী হয়ে উঠছে তার। কাঁপা হাতে লিখাটা ছুঁয়ে দেখতে চাইলো ঝুম। তবে ব্যর্থ হলো। লিখাটা ছোঁয়ার আগেই পেছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠে কেউ ডেকে উঠল তাকে,
— “ঝুম?”
ঝুমের শরীর দ্বিগুণ ভাবে কেঁপে উঠল এবার। পেছন ফিরে নিঝুমকে দেখে আরেক দফা চমকে উঠল। নিঝুম স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করল,
— “আজকে এখানে এলে যে? কোনো বিশেষ কাজে?”
ঝুম মাথা নত করে ফেলল। কাঁপা গলায় বলল,
— “নিধার পরীক্ষা কালকে। তাই..!”
— “আন্টি এখন কেমন আছেন?”
— “আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”
ঝুম বারবার আড়চোখে পেন্টিংটা দেখছে। নিঝুমের চোখে পড়ে সেটা। হেসে এগিয়ে যায় ক্যানভাসটার দিকে। পেন্টিংটা দেখিয়ে বলে,
— “কেমন হয়েছে আঁকা, ঝুম? ভালো এঁকেছি না?”
ঝুম মনে মনে রেগে গেল। নিঝুম যে ইচ্ছে করে বলছে, তা বুঝতে বাকি নেই তার। নিজেকে সামলে ঝুম ধীর গলায় বলল,
— “সুন্দর।”
নিঝুম ভারী অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
— “শুধুই সুন্দর?”
ঝুম আমতা আমতা করে বলল,
— “অসম্ভব সুন্দর।”
নিঝুম এবার শব্দ করে হেসে উঠল।
ঝুম এতক্ষণে খেয়াল করল নিঝুম মাত্র গোসল করে এসেছে। চুল মোছা শেষে চেয়ারের এককোণে রেখে দিয়েছে তোয়ালে। পরনে তার কালো রঙের থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট আর ধূসর গেঞ্জি। ভেঁজা চুলগুলো কপালে পড়ে আছে। দেখতে দারুণ লাগছে! নিঝুমকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে ঝুম ভাবে, নিঝুম গোসল করল কখন? যদি করেও থাকে, তাহলে বেরুলো কখন? ঝুম তো দরজা খোলার আওয়াজ পায় নি। পরক্ষণেই ভাবনাটা মাথা থেকে ছেঁড়ে ফেলল ঝুম। প্রশ্ন করল,
— “ডাক্তার? আপনার তো এখন হাসপাতালে থাকার কথা। আজ কি যান নি সেখানে?”
— “গিয়েছি। আবার ছুটি নিয়ে চলেও এসেছি।”
— “ছুটি নিয়েছেন কেন?”
ঝুমের উত্তেজনা দেখে নিঝুম মজা করে বলল,
— “কারণ তোমার আন্টি বলেছেন আজকে তিনি আমাকে নিয়ে শপিংয়ে যেতে চান। আর এটাও বলেছেন, আমি যদি আজকে তাকে নিয়ে না যাই, তবে তিনি আমাকে বাসায়ই ঢুকতে দেবেন না। বাহিরে দাঁড় করিয়ে মশার কামড় খাওয়াবেন। বুঝতে পেরেছো কত ডেঞ্জেরাস তোমার আন্টি?”
ঝুম সশব্দে হেসে দেয়। জিজ্ঞেস করে,
— “আচ্ছা, ‘মধ্যাহ্নবেলার নীড়’ নামটা আপনার কেমন লাগে?”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “আমাদের বাড়ির নামটার কথা বলছো?”
— “হ্যাঁ।”
— “অতটাও ভালো লাগে না।”
এবার ঝুম ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকায়। যাকে জিজ্ঞেস করে, তারই নাকি নামটা ভালো লাগে না। কেন লাগে না? এত সুন্দর নামটা কারো পছন্দ না হয় কিভাবে? ঝুম কপট রাগ নিয়ে বলল,
— “কেন ভালো লাগে না আপনার?”
নিঝুমের নির্বিকার কণ্ঠ,
— “নামটা অর্থবিহীন মনে হয় আমার। সচরাচর দুপুরে কি কেউ নীড়ে ফেরে?”
কথাটা যুক্তিগত মনে হলো ঝুমের। চুপ রইলো সে। কিছু একটা ভাবতে লাগলো। তখনই নিঝুম কোমল গলায় বলল,
— “ঝুম? দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমার পাশে বসো।”
ঝুক নিঝুমের দিকে তাকায়। নিজ জায়গা থেকে নড়ে না এক বিন্দুও। নিঝুম একটু জোড়ে বলে,
— “ঝুম? বসতে বলেছি আমি।”
এবং তৎক্ষণাৎ ঝুম নিঝুমের পাশে বসে পড়ে। অনেকটা দূরুত্ব রেখে। ঝুম মাথা নত করে আছে। তবুও স্পষ্ট বুঝতে পারছে নিঝুম তার দিকে তাকিয়ে। আচ্ছা, এভাবে তাকিয়ে থাকার কি আছে। নিঝুম কি বুঝতে পারছে না ঝুম লজ্জা পাচ্ছে? হঠাৎ নিঝুম ঝুমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। ঝুম ভড়কে যায়। আর্তনাদ করে উঠে,
— “কি করছেন?”
নিঝুম মৃদু ভাবে বলে,
— “শুয়েছি।”
— “আপনি আমার কোলে শুয়েছেন।”
— “জানি।”
— “তো, উঠুন।”
নিঝুম জবাব দেয় না। ঝুম উশখুশ করতে শুরু করে। বলে,
— “দেখুন। বাসায় অনেকজন আছে। এভাবে দেখলে সমস্যা হবে। প্লীজ উঠুন।”
নিঝুম তবুও নিরুত্তর। কিছুক্ষণ পর নিঝুমের ঘনঘন নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় ঝুম। এত তাড়াতাড়ি কিভাবে ঘুমাতে পারে একটা মানুষ? ঝুম ভেবে পায় না। আচমকা কারো এদিকে আসার শব্দ শুনে ঝুম। দরজাও খোলা। ঝুম ভয় পেয়ে যায়। এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। নিঝুমকে জোড় হাতে ঠেলে, ঠেলে ডাকতে শুরু করে সে। নিঝুম ঘুমু ঘুমু চোখে বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই ঝুম উত্তেজিত গলায় বলে উঠে,
— “ডাক্তার, কেউ আসছে। প্লীজ উঠুন।”
নিঝুম ধীরে,সুস্থে উঠে বসে। এবং তখনই রুমের ভেতর প্রবেশ করে স্নিগ্ধ। ঝুম আর নিঝুমকে পাশাপাশি বসে থাকে থেকে হকচকিয়ে যায়। গলা খাঁকড়ি দিয়ে তড়িৎ গতিতে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। ঝুম ক্ষীপ্ত চোখে তাকায় নিঝুমের দিকে। আর নিঝুম! সে শব্দ করে হেসে উঠে মাত্র।
___________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
~রি-চেক করি নি। ভুল-ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।