ভালোবাসি তারে
২৭.
ঝুম ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একহাতে খাঁমচে ধরেছে নিঝুমের হাত। নিঝুম হালকা ব্যথা পাচ্ছে। কিন্তু কিছু বলছে না। তার দৃষ্টি আপাতত সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে। সিগারেট খেতে খেতে খয়েরী শার্ট পরিহিত লোকটা দাম্ভিক কণ্ঠে বলে উঠে,
— “তোরা কারা? এইহানে কি করস? আগে তো দেহি নাই এ গেরামে।”
নিঝুম চোখে চোখ রেখে গম্ভীর ভাবে কিছু একটা ভাবলো। পরক্ষণেই হেসে বলল,
— “আমরা পাশের গ্রাম থেকে এসেছি চাচা। বৃষ্টির কারণে এখানে আটকে পরেছি। আপনাদের এখানে কি কোনো থাকার জায়গা আছে? ওর আবার বৃষ্টিতে এর্লাজি আছে তো। ভিঁজলেই জ্বর এসে যাবে। তাই সাহায্যের প্রয়োজন একটু। করলে ঋণী থাকবো।”
লোকগুলো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একে অপরের মুখ চাওয়া – চাওয়ি করতে লাগলো। লোকগুলোর একজন সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল এবার,
— “তোমরা কি জামাই-বউ? নাম কি?”
নিঝুম মুখের হাসি প্রসস্থ করে বলল,
— “জ্বী। আমি ডাক্তার নিঝুম শেখ। আর ও আমার বউ ঝুম তাবাস্সুম।”
চমকে গেল ঝুম। বড়সড় চোখে নিঝুমের দিকে তাকালো। নিঝুম নির্বিবাক। তার দৃষ্টি সামনের লোকগুলোর দিকে নিবদ্ধ। লোকগুলো তখনো সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। বোঝা যাচ্ছে, নিঝুমের কথা ঠিক বিশ্বাস করে নি তারা। এবার ঝুমকে প্রশ্ন করল লোকটি,
— “এই মাইয়া? ছ্যাড়ার লগে কি তোমার বিয়া হইছে? তুমি কি হের বউ? দেহো সত্যি কইরা কইবা।”
ঝুম ফাঁকা ঢোক গিলল। আড়চোখে নিঝুমকে দেখল সে। নিঝুম শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে। ঝুম মনে সাহস জোগালো। তরতর করে বলে উঠল,
— “জ-জ্বী আ… আমি উনার বউ।”
কথাটা যেন প্রতিধ্বনি হয়ে প্রবেশ করল নিঝুমের কানে। ঠোঁটের কোণে প্রখর হাসি ফুটে উঠল তার। চোখও যেন হেসে উঠল সেই সঙ্গে! সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো কিছুক্ষণ চুপ রইল। পরপরই সিগারেট খাওয়া রত ব্যক্তি একটু হেসে বলল,
— “জামাই-বউ হইলে তো আর সমস্যা নাই। ডাক্তার মানুষ বইলা তোমাগো কথা বিশ্বাস করলুম। আহো, তোমাগো থাকার জায়গা দেহাইতাসি।”
বলতে বলতেই একটা ছাতা এগিয়ে দিলো লোকটা। নিঝুম হাতে নিলো সেই ছাতা। ঝুম পিট পিট করে চাইলো নিঝুমের দিকে। একটু আগের ভয় আর এখনের লজ্জা মিলে এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে তার। এবং তা আরো প্রখর হয়, যখন এক ছাতার নিচে পাশাপাশি হাঁটছিল তারা। আলতো ভাবে বাহুতে বাহু বারি খাচ্ছিল।
ঝুমের বরাবরই বৃষ্টি অপছন্দ। এর মূল কারণ হয়তো ঝুমের এলার্জি। নিঝুম বেশ সতর্কভাবে ঝুমকে আগলে রেখেছে। যেন বৃষ্টির পানি ছুঁতে না পারে তাকে। অথচ ঝুমের বৃষ্টিতে ভিঁজতে ইচ্ছে করছে আজ। তীব্র ইচ্ছায় নিঝুমকে বলতে মন চাইছে,
— “ডাক্তার? বৃষ্টির পানিতে নিজেকে হারাতে ইচ্ছে করছে আমার। আপনি কি আমার সঙ্গে হারাবেন?”
__________________
টিনের চালের একটা পুরোনো বাড়ির বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে নিঝুম আর ঝুম। এখন অনেকটাই বৃষ্টি কমে গেছে। নেই বললেই চলে। মাটির কাপে চা খেতে খেতে ঝুম ভাঙ্গা গলায় বলল,
— “আমাদের এখন ফিরে যাওয়ার উচিত ডাক্তার। একটু পর নিলয়ের স্কুলের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবে। আমাকে না পেলে নিলয় ভয় পাবে।”
ঝুমের ভাঙ্গা গলা শুনে নিঝুম ভ্রু কুঁচকাল। দৃঢ় গলায় বলল,
— “ঠান্ডা লেগে গেছে দেখছি। চা টা পুরো শেষ করো তারপর যাবো। আর হ্যাঁ, বাসায় যেয়ে প্রথমে প্যারাসিটামল খাবে। তারপর ঘুম। মনে থাকবে?”
ঝুম বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। নিঝুম অপেক্ষা করতে থাকে ঝুমের চা শেষ হওয়ার। চা পান করা শেষ হতেই ঝুমকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় নিঝুম। বারান্দার একপাশে একজন বয়স্ক মহিলা বসে সবজি কাঁটছিলেন। তিনি বললেন,
— “তোমরা কি চইলা যাইতাছো নাকি? আরেকটু থাকতা।”
নিঝুম হালকা হেসে উত্তর দেয়,
— “অন্য কোনোদিন থাকবো দাদী। আজকে একটু কাজ ছিল। তাহলে আসি? নিজের খেয়াল রাখবেন।”
জবাবে মহিলা শুধু দাঁত বিহীন মাড়ি দেখিয়ে হাসলেন। মহিলাকে ভীষণ সুন্দর লাগছিল তখন। যেন সমস্ত নূর উনার চেহারায়ই বিদ্যমান। তার হাসি দেখে ঝুমও খানিকটা হাসলো। নিঝুম তার হাত শক্ত করে ধরতেই ঝুমের শরীরটা একটু কেঁপে উঠে। পলক ফেলে নিঝুমের দিকে জিজ্ঞাসু চাহনিতে তাকায় সে। নিঝুম হাসোজ্জল ভাবে বলল,
— “চলো।”
২
মিসেস শ্রেয়া এখন অনেকটাই সুস্থ। দুপুরের রান্না করছিলেন তিনি। কেননা, দুপুর হয়ে গেছে প্রায়। এ সময় কে যেন দরজায় কড়া নাড়ে। তিনি ভেবে নিলেন, হয়তো ঝুম আর নিলয় এসেছে। নিজ মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন মিসেস শ্রেয়া,
— “ছেলে-মেয়ে হয়েছে এক! একটার থেকে একটা কম না। এতক্ষণ লাগে নাকি ইস্কুল থেকে আসতে? আজকে ইচ্ছা মতো বকবো ওগুলোকে। দেখি আর এমন কিভাবে দেড়ি করে আসে!”
বলতে বলতেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন মিসেস শ্রেয়া। এবং পরপরই দরজা খুলে সামনে তাকাতেই বোকা বনে গেলেন যেন। নিঝুম ঝুমকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই নিলয় দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে নিজ মায়ের দিকে। মিসেস শ্রেয়া কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে রইলেন। পরক্ষণেই ব্যগ্র হয়ে বলে উঠলেন তিনি,
— “নি-নিঝুম বাবা? আমার… আমার মেয়েটার কি হয়েছে? ও এভাবে অজ্ঞান হয়ে আছে কেন?”
নিঝুম মিসেস শ্রেয়ার ব্যগ্রতা দেখে আস্বস্ত ভাবে নরম সুরে বলল,
— “উত্তেজিত হবেন না আন্টি। ও ঠিক আছে। বৃষ্টির পানি শরীরে লাগায় জ্বর এসেছে মাত্র।”
মিসেস শ্রেয়া শুনলেন না। নিঝুমকে ভেতরে ঢুকতে দিয়ে আহাজারি করে উঠলেন,
— “মেয়ে আমার বৃষ্টির পানি একদম সয্য করতে পারে না। কে বলেছিল এই মেয়েকে বৃষ্টিতে ভিঁজতে? সকালে ছাতা নিতে বলেছিলাম। তবুও নেয় নি। আমার কথা শুনে কে?”
নিঝুম মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করল এর জন্য। ওর জন্যই তো এমন হলো। ও যদি ঝুমকে নিয়ে ঘুরতে বের না হতো তাহলে হয়তো এমন কিছুই হতো না। ভেবে তপ্ত নিশ্বাস ফেলল নিঝুম।
ঝুমের রুমে আগে কখনো ঢুকে নি নিঝুম। চারপাশটা একবার দেখে নিলো সে। ঝুম বেশ গোছালো। পুরো রুম জুড়ে বিভিন্ন রঙ বেরঙের মরিচ বাতি লাগানো। একপাশের দেওয়ালে নিলয় আর ঝুমের কিছু ছবির ফ্রেম টাঙানো আছে। যার মধ্যে একটায় ঝুম শাড়ি পড়ে পুকুর পাড়ে বসে আছে। পানির সাথে একটু একটু করে বারি খাচ্ছে ঝুমের পা। সেদিকে কিছু পলক তাকিয়ে রইল নিঝুম। তারপর বিছানায় ঝুমকে শুইয়ে দিলো। একটা ছোটখাটো পাস্টিকের চেয়ার টেনে বসল ঝুমের পাশে। একবার দরজার দিকে উঁকি দিলো৷ মিসেস শ্রেয়া রান্নাঘরে লাল চা বানাচ্ছেন। নিঝুম বলেছে ঝুমের জ্ঞান একটু পরেই ফিরবে। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন জ্ঞান ফিরলে ঝুম প্রথমে লাল চা খেলেই নাকি পুরোপুরি সুস্থ হবে। মিসেস শ্রেয়ার কথা ভেবে নিঝুম একটু হাসল।
হঠাৎ ঝুমের মুখের দিকে তাকিয়ে নিঝুম থমকে গেল। ঝুমের ফ্যাকাসে মুখ আর শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট দেখে বুক কেঁপে উঠলো তার। মনে পড়ে গেল, অতিরিক্ত জ্বরে ঝুম নিঝুমের বুকে অজ্ঞান হয়ে ঢোলে পড়ার সেই মুহুর্তটা। নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কি মনে করে উঠে দাঁড়ালো সে। ঝুমের মুখপানে ঝুঁকলো খানিকটা। আলতো করে অথচ গভীর ভাবে কপালে ছুঁইয়ে দিলো নিজের অধর জোড়া।
তারপর প্রায় সাথে সাথে সরে দাঁড়ালো নিঝুম। ঝুমের টেবিলের মাঝ বরাবর রাখা নিঝুমের আঁকা স্কেচটা সহজেই নজর কাড়লো তার। নিঝুম এগিয়ে গেল সেদিকে। স্কেচটা হাতে নিলো। নিঝুম স্কেচের একপাশে লিখেছিল, ‘আমার লজ্জাবতী।’
আর তার নিচেই গুটিগুটি অক্ষরে ঝুম লিখেছে, ‘এবং আপনি আমার নির্লজ্জ ডাক্তার।’
পড়ে নিঝুম হেসে দিলো। সেই সঙ্গে হেসে উঠল নিঝুমের চোখজোড়া।
________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia