ভালোবাসি তারে
২৮.
কাঁথা গায়ে বিছানার মাঝ বরাবর বসে আছে ঝুম। সব কিছু বিভীষিকা লাগছে তার কাছে। জ্বরের কারণে দু’দিন পড়াতে যেতে পারে নি ঝুম। এটুকু সময়ে নিঝুমের সঙ্গে তার দেখা কিংবা কথা কিছুই হয় নি। তবে নিলয় থেকে শুনেছে ঝুম, নিঝুম নাকি আলম খানকে ফোন করে তার কথা জিজ্ঞেস করেছিল এ দু’দিন। কিন্তু নিঝুম তো ঝুমকেও ফোন করতে পারতো। তাহলে করল না কেন? একটু কি ঝুমের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয় নি নিঝুমের? ঝুম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আলম খানকে দেখে নিলো একবার। মৃদু গলায় বলল,
— “কিছু বলবেন আব্বা?”
আলম খান নিঃশব্দে বসলেন তার পাশে। চুলে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন,
— “তোর শরীর এখন কেমন আছে মা?”
— “অনেকটাই ভালো।”
আলম খান কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। পরক্ষণেই অনুরোধের সুরে বললেন,
— “আমার একটা কথা রাখবি ঝুম?”
নিজ বাবার অনুরোধী কণ্ঠ শুনে বিস্মিত হলো ঝুম। বিস্ময় নিয়ে বলল,
— “এভাবে বলছেন কেন আব্বা? কি কথা রাখতে হবে বলুন।”
আলম খান হাঁসফাঁস করছেন। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন বারংবার। তাঁকে এমন করতে দেখে ঝুমের ভ্রু কুঁচকে গেল। বলল,
— “কি হয়েছে আব্বা?”
আলম খান আবারো ঝুমের চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। আমতা আমতা করে বললেন,
— “আসলে… তোর বিয়ে ঠিক করেছি আমি ঝুম। ছেলে নাকি তোকে তোর ভার্সিটিতে প্রথম দেখে পছন্দ করে ফেলেছে। ছেলে দেখতে – শুনতে ভালো। ভালো চাকরী করে। পরিবারও ভালো। তুই সুখে থাকবি।”
ঝুম স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কণ্ঠনালি থেকে স্বর বেরুচ্ছে না তার। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আলম খান একটু থেমে আবার বললেন,
— “কালকে তোকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। তোর কি কোনো আপত্তি আছে?”
রান্নাঘর থেকে মিসেস শ্রেয়ার উঁচানো গলা শোনা গেল।
— “তোমার মেয়ের আপত্তি থাকলেই কি আর না থাকলেই কি? ওকে জানানোর দরকার ছিল জানিয়ে দিয়েছো। আবার এতকিছু জিজ্ঞেস করতে হবে কেন?”
ঝুম চুপচাপ শুনলো পুরো কথা। তার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। তবুও স্বাভাবিক রইল সে। শান্ত স্বরে আলম খানকে বলল,
— “আমার আপত্তি আছে আব্বা। আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই না। আপনিই তো বলেছিলেন আমাকে খুব করে পড়াবেন। তাহলে এখন এমন কথা কেন বলছেন আব্বা?”
ঝুম খেয়াল করল আলম খানের চোখে পানি। তিনি করুণ গলায় বললেন,
— “আমার কিছু করার নেই মা। বুড়ো হচ্ছি! কয়েকদিন পর চাকরী চলে যাবে। তুই তো বুঝিস, আমাদের কত আর্থিক সমস্যা। তোকে যদি এখন বিয়ে না দেই, পরে হয়তো..! বোঝার চেষ্টা কর মা।”
ঝুম ক্ষণিকের জন্য উত্তেজিত হয়ে পরল। কাঁথা সরিয়ে ঠিক হয়ে বসল। ব্যগ্র গলায় বলল,
— “আব্বা, প্লীজ বোঝার চেষ্টা করুন। আমি এখন বিয়ে করব না। আমার… আমার ওই ছেলে পছন্দ না।”
রান্নাঘর থেকে এবার সয়ং মিসেস শ্রেয়া এসে হাজির হলেন রুমে। কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— “তুই কি ছেলেটাকে দেখেছিস যে বলছিস পছন্দ না?”
এমতাবস্থায় ঝুম কিছু বলতে পারে না। চুপচাপ রয়। সে তো দেখে নি ছেলেটাকে। মিসেস শ্রেয়া আবার বললেন,
— “দেখিস নি তো? তাহলে এত কথা কিসের? আমাদের জন্য কি তোর একটুও দয়া-মায়া নেই? আমাদের অবস্থা দেখেছিস? আমরা কি তোর খারাপ চাচ্ছি? বিয়ে করতে বলেছি করবি। এমন তো না যে তোর পছন্দের কেউ আছে। আছে নাকি?”
ঝুমে এবারো নিশ্চুপ। অথচ ভেতরটা অশান্ত তার। মন চাইছে, চিৎকার করে বলতে, ‘আমি নিঝুমকে ভালোবাসি আম্মা। উনাকে বিয়ে করতে চাই। তোমরা প্লীজ আমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিও না। আমি শেষ হয়ে যাবো আম্মা। একদম শেষ হয়ে যাবো!’
কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। কিচ্ছুটি না। শুধু চুপচাপ বসে সহ্য করছে সব! মিসেস শ্রেয়া শক্ত গলায় বললেন,
— “তোকে কালকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে, ঠিকাঠাক ভাবে তৈরি হয়ে থাকবি। বলতে যেন না হয়।”
যাওয়ার আগে আলম খান তৃতীয় বারের মতো ঝুমের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন। ঝুম তখনো নির্বাক। অথচ বুক কষ্টে পুড়ে যাচ্ছে তার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাঁদছে না। ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে শুধু। যথা সম্ভব কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। ফলসরুপ চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে ঝুমের। কান্নার পাশাপাশি রাগ আর জেদও মাথায় চড়ে বসেছে যেন। বিছানার চাদর খাঁমছে ধরে নিচের দিকে চেয়ে রইল ঝুম। ঝুমের একটু দূরুত্বে নিলয় দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। ফ্যালফ্যাল করে দেখছে বোনকে।
৩
দুপুর পেরিয়ে আকাশের বুকে বিকালের আভা ফুটে উঠেছে। ঝুম এলোমেলো পায়ে জমিদার বাড়ির ভেতর ঢুকছে। সে এখনো অনেকটাই অসুস্থ। আজকে পড়াতে আসতো না ঝুম। কিন্তু না এসেই বা কি করত? বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। কান্না পাচ্ছিল প্রচুর।
ধীর পায়ে জমিদার বাড়ির ভেতরে ঢুকলো ঝুম। সোফায় মিসেস সানজিদা বসে ছিলেন। তিনি দিব্যি হেসে তাকে নিজের পাশে বসালেন। স্নেহ ভরা গলায় বললেন,
— “কেমন আছিস ঝুম মা? জ্বর কমেছে তোর?”
ঝুম নিচু স্বরে বলে,
— “জ্বী আন্টি।”
মিসেস সানজিদা হালকা হেসে আগ্রহী কণ্ঠে বললেন,
— “তোকে তো বলা হয় নি! আর তিনদিন পর মেঘলার বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। তুই কিন্তু বিয়ের আগের দিন বাসায় চলে আসবি। আমাকে কাজে সাহায্য করবি। বুঝলি?”
ঝুমের মনটা যেন একটু ভালো হলো। মুচকি হেসে সে জবাব দিল,
— “অবশ্যই আন্টি।”
আরো কিছুক্ষণ গল্প করে নিধাকে পড়াতে উপরে চলে গেল ঝুম। পড়ার রুমে যাওয়ার সময় হঠাৎ মনোয়ারা শেখের সঙ্গে মুখোমুখি হলো সে। ঝুম সালাম দিলো। তিনিও উত্তর দিলেন তিরিক্ষ মেজাজে। ঝুম চুপচাপ তার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই মনোয়ারা শেখ ঝুমের কানের কাছে ক্ষীপ্ত গলায়, মৃদু ভাবে বলে উঠলেন,
— “লজ্জা থাকা উচিত।”
পরপরই গটগট করে নিচে নেমে গেলেন তিনি। ঝুম থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। নিজেকে কেমন পাগল, পাগল লাগছে তার। অনুভূতি শূণ্য মনে হচ্ছে!
___________________
ক্ষুণ্ণ মনে নিধাকে অল্প একটু পড়িয়ে ছুটি দিয়ে দিলো ঝুম। ক্লান্ত পায়ে পড়ার রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেল নিঝুমকে। মাত্র হাসপাতাল থেকে এসেছে সে। হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে ব্যস্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। নিঝুমকে দেখে ঝুমের কান্না ভেতর থেকে উপচে পড়তে চাইলো যেন। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পরল। নিঝুম হঠাৎ তাকালো ঝুমের দিকে। চোখাচোখি হতেই চিরচেনা হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে এগিয়ে এলো ঝুমের দিকে। কাছাকাছি আসতেই প্রশ্ন করল,
— “ঝুমময় পিচ্চি, কেমন আছো?”
সঙ্গে সঙ্গে একরাশ অভিমান এসে জুড়ে বসল ঝুমের সমস্ত শরীর জুড়ে। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। হালকা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলল,
— “সেটা জেনে আপনি কি করবেন? আপনি তো অনেক ব্যস্ত মানুষ!”
নিঝুম হেসে বলল,
— “আমি ব্যস্ত মানুষ?”
ঝুম জবাব দিলো না। খানিকবাদ পর ঝুমের নাক টানার শব্দ এলো। নিঝুমের ভ্রু কুঁচকে গেল। প্রশ্ন করল,
— “কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
ঝুম কাঁপা গলায় বলতে চাইলো,
— “আমি.. আমি..!”
বলতে বলতেই মৃদু শব্দ করে কেঁদে উঠল ঝুম। সকাল থেকে এখন অব্দি হওয়া সব ঘটনায় তিক্ত হয়ে উঠেছে সে। কান্না গলা পাকিয়ে যাচ্ছে তার। যা নিঝুমকে দেখে আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। এবং সবশেষে ঝুম নিজেকে আর আটকে রাখতে পারে নি। নিঝুমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে। আচমকা এমন হওয়ায় নিঝুম দু’কদম পিছিয়ে যায়। পরক্ষণেই ঝুমের পিঠে আলতো ভাবে হাত রাখে। জিজ্ঞেস করে,
— “কি হয়েছে ঝুম? কাঁদছো কেন? আমাকে বলো।”
ঝুম নিশ্চুপ। ফুঁফিয়ে কাঁদছে সে। নিঝুম আপাদস্ত আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ আছে কি-না। পরপরই কোলে তুলে নিলো ঝুমকে। ঝুম চমকে উঠল। লজ্জা পেলো অনেকটা। কিন্তু কান্নার জন্য লজ্জা প্রশ্রয় পাচ্ছে না। মিলিয়ে যাচ্ছে।
নিঝুম ঝুমকে তার রুমে নিয়ে গেলো। সোফায় বসিয়ে নিজে হাঁটু গেড়ে বসল ঝুমের সামনা সামনি। নরম স্বরে আবারো জিজ্ঞেস করল,
— “কাঁদছো কেন?”
ঝুম তখনো ফুঁফাচ্ছে। কথা বলছে না। নিঝুম এবার ঝুমের দু’হাতের মাঝে নিজের দু’হাত রাখলো। একরাশ অনুভূতির সঙ্গে বলল,
— “আমাকে বলবে না ঝুম?”
ঝুম টলমলে চোখে তাকালো নিঝুমের দিকে। লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল,
— “আমি অসুস্থ ছিলাম। তবুও আপনি আমাকে একবারও ফোন দেননি কেন? জানেন? আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি।”
নিঝুম নিঃশব্দে হেসে উঠল। ঝুমের নাক টেনে বলল,
— “এই সামান্য ব্যাপারে কেউ কাঁদে? নিজের মূল্যবান চোখের মুক্তাগুলো কেন অপচয় করছ?”
ঝুমের হঠাৎ যেন কি হয়। নিঝুমের বুকে মাথা ঠেকিয়ে জোড়ে কেঁদে দেয় সে। নিঝুম বুঝতে পারে না ঝুমের কি হয়েছে। এত সামান্য ব্যাপারে কাঁদার কি আছে? নিঝুম তপ্ত নিশ্বাস ফেলল। আলতো হাতে ঝুমের চুলে হাত বুলাতে লাগলো। ঠিক তখনই ঝুম আটকে আসা কণ্ঠে কাঁপা গলায় বলে উঠে,
— “আ-আব্বা আমার ব-বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে ডাক্তার। কালকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। আমি চাই না বিয়ে করতে ডাক্তার। আমি একদমই চাই না! আপনি কিছু করুন না ডাক্তার। প্লীজ..!”
নিঝুম নির্বিবাক শুনে মাত্র। ঝুমের চুলে হাত বুলানো রত তার হাতটা নিমিষেই স্থির হয়ে যায়। নিঝুম ঝুমের মুখপানে নিষ্পলক চেয়ে রয় শুধু। কিছু বলতে পারে না।
___________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia