ভালোবাসি তারে
৩৫.
হাসপাতালের কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছে নিঝুম। কিছু ফাইলে সাইন করা জরুরি ছিল। আপাতত সেগুলোই করছে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল নিঝুমের। স্নিগ্ধর কল! কাজ করতে করতে কল রিসিভ করে ব্যস্ত গলায় বলল নিঝুম,
— “হ্যাঁ, বল।”
ওপাশ থেকে স্নিগ্ধর চিন্তিত গলা,
— “কোথায় তুই?”
— “হাসপাতালে। কেন?”
স্নিগ্ধ খানিকক্ষণ চুপ থাকে। আমতা আমতা করে বলে,
— “বাসায় ঝামেলা হয়েছে। একটু তাড়াতাড়ি আয়।”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “কি ঝামেলা? আমি তো ব্যস্ত আছি। তুই সামলে নেয় না যা ঝামেলা হয়েছে। আমার আসতে দেড়ি হবে।”
— “না। তোকেই লাগবে।”
নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “ঘটনা কি বেশি গুরুতর?”
— “হ্যাঁ।”
— “অপেক্ষা কর। আসছি!”
কল কেটে দেয় স্নিগ্ধ। নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফোন রেখে কাজের গতি আরো বারিয়ে দেয়। কিছু ভালো লাগছে না নিঝুমের। মনটা কেমন অশান্ত, অশান্ত লাগছে। এমন কেন হচ্ছে?
১০
বিয়ের জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশটা ভীষণ থমথমে। সবার মুখে গম্ভীর ভাব। নিঝুম ক্ষীপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে ফ্লোরের দিকে। হাত মুঠ করে রেখেছে। বার কয়েক বার ঘন ঘন নিশ্বাস নিলো সে। শান্ত রাখার চেষ্টা করল নিজেকে। তবুও পারছে না। মেজাজ গরম হচ্ছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শাখাওয়াত শেখকে বলল নিঝুম,
— “বাহিরে ঝুমকে নিয়ে কি বলা হচ্ছে আব্বু? ঝুম কোথায়?”
শাখাওয়াত শেখ নিশ্চুপ। নিঝুম জবাবের আশায় তাকিয়ে আছে৷ সে জানে না ঠিক কি হয়েছে ঝুমের সঙ্গে। তবে আশেপাশের লোকেদের মুখে হালকা গুঞ্জন শুনতে পেয়েছিল। তাদের সবার মুখে একই কথা – ‘জমিদারের ছেলেকে ফাঁসিয়েছে মাস্টারের মেয়ে।’ যা যথেষ্ট ছিল নিঝুমকে রাগাতে!
শাখাওয়াত শেখ কিছু না বলায় নিঝুম এবার শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
— “আব্বু? ঝুম কোথায়?”
শাখাওয়াত শেখ হতাশ গলায় বললেন,
— “চলে গেছে।”
কথাটা ঠিক ভালো লাগল না নিঝুমের। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ভেতরটা। সবাইকে অসহ্য লাগছে। কপালে দু’আঙ্গুল ঘেঁষে কিছুক্ষণ চুপ থাকে নিঝুম। মাথা বড্ড ব্যথা করছে তার। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে স্থির কণ্ঠে বলে,
— “কেন চলে গেছে? কি করেছ ওর সঙ্গে?”
শাখাওয়াত শেখ জবাব দিতে পারলেন না। এবারো চুপ রইলেন। মনোয়ারা শেখ মনে মনে ঝুমের নামে কিছু কথা বানিয়ে নিলেন। পর মুহুর্তে সেগুলো বলতে নিলেই নিঝুমের উঁচু গলা,
— “একদম মিথ্যে বলবে না ফুফি।”
মনোয়ারা শেখ যেন একটু ভয় পেলেন। পরক্ষণেই সেটা আড়াল করে কণ্ঠে তেজ নিয়ে বললেন,
— “আমি কেন মিথ্যা বলব? আমি তোরে ভয় পাই নাকি?”
একটু থেমে বেশ গর্ব নিয়ে আবার বলেন,
— “আমি বের করে দিয়েছি মেয়েটাকে।”
নিঝুমের চোখের তীক্ষ্ণতা প্রখর হয়। রাগে জ্বলজ্বল করে উঠে চোখ জোড়া। কিন্তু কিছু বলে না। মনোয়ারা শেখ আবার বলেন,
— “দেখ নিঝুম! আমি জানি তুই ওই মেয়েকে পছন্দ করিস। কিন্তু ওই মেয়ে তোর জন্য পার্ফেক্ট না। নিম্ন মধ্যবিত্ত বুঝিসই তো! এরা লোভী হয়। টাকার জন্য এসেছে তোর কাছে। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, আরো ভালো ঘরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিবো তোর। কিন্তু ওরকম নষ্টা মেয়ের…!”
মনোয়ারা শেখের কথা শেষ হবার পূর্বেই আচমকা উঠে দাঁড়ায় নিঝুম। চোয়াল শক্ত করে ক্ষীপ্ত গলায় বলে উঠে,
— “আপনি আমার গার্জিয়ান নন ফুফি। নিজেকে সবার বাড়ির কর্তা ভাবার ভুল ধারণা ভুলেও আমার সামনে দেখাতে আসবেন না। অন্য কেউ শুনলেও আমি আপনার কথা কখনোই শুনবো না।”
বলেই শাখাওয়াত শেখের দিকে তাকালো নিঝুম। প্রশ্ন করল,
— “তুমি কিছু বলবে আব্বু?”
তিনি হাসলেন। হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
— “আলম সাহেবের বাসায় যাবি না?”
আর কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করল না নিঝুম। দ্রুত বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।
রাগে শরীর কাঁপছে নিঝুমের। সে সহজে রাগে না। অথচ রাগলে, রাগ দমাতে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে। হাত দিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ সজোড়ে একটা বারি দেয় নিঝুম। তবুও রাগ না কমলে পানির বোতল জানালা গলিয়ে পাশের ঝোপঝাড়ে ছুঁড়ে মারে। এসি চালু করে গায়ের এপ্রোনটা খুলে রেখে দেয় পেছনের সীটে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে রয়। খানিকটা শান্ত হতেই গাড়ি স্টার্ট দেয় ঝুমের বাসার উদ্দেশ্যে।
___________________
সোফার মাঝখানে গম্ভীর মুখে বসে আছেন আলম খান। মিসেস শ্রেয়া ডাইনিংটেবিলে বসে কাঁদছেন। ঝুম সেই কখন থেকে রুমের দরজা আটকে বসে আছে। বললেও দরজা খুলছে না। মিসেস শ্রেয়ার চিন্তা হচ্ছে। এমনিতে যতই বকা দেন না কেন! ঝুমকে প্রচন্ড ভালোবাসেন তিনি। যা তার রাগের কারণে কারো সামনে প্রকাশ পায় না।
সদর দরজায় কারো কারাঘাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। নিলয় দরজা খুলতেই দেখল, উসখুস অবস্থায় নিঝুম দাঁড়িয়ে। নিলয়কে দেখে মলিন হাসলো নিঝুম। ভেতর থেকে আলম খান গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
— “কে এসেছে নিলয়?”
বলতে বলতে নিজেই সদর দরজার কাছে এগিয়ে এলেন তিনি। নিঝুমকে থেকে থমকে গেলেন। রেগে গেলেন খানিকটা। তবে প্রকাশ করলেন না। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
— “এখানে কেন এসেছো?”
জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিঁজিয়ে নিলো নিঝুম। নম্র গলায় বলল,
— “আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল মাস্টার আঙ্কেল।”
আলম খান কি বলবেন ভেবে পেলেন না। নিঝুমকে তিনি ভালোভাবে চিনেন। যথেষ্ট ভদ্র নিঝুম। কিন্তু এতকিছুর পর নিঝুমের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। আবার মনে হচ্ছে নিঝুমের কথাটাও শোনা প্রয়োজন। সাত-পাঁচ ভেবে আলম খান অনুমতি দিয়ে বললেন,
— “ভেতরে আসো।”
নিঝুম মনে মনে খুশি হলো। আলম খানের মুখোমুখি সোফায় বসল সে। ম্লান হেসে বলল,
— “ভালো আছেন মাস্টার আঙ্কেল?”
শুনে রেগে যাওয়ার কথা আলম খানের। কিন্তু আশ্চর্য! তার ভেতরটা কেমন শীতলতায় ভরে গেছে। নিঝুমের সঙ্গে কোনো কালেই রেগে ছিলেন না তিনি। অথচ, এই কৃত্রিম রাগটা সবচেয়ে বেশি নিঝুমের উপরই দেখাতে চাইছেন আলম খান। গম্ভীর গলায় তিনি বললেন,
— “কি চাও সরাসরি বলো।”
এক-দু সেকেন্ড চুপ থাকে নিঝুম। অপরাধী গলায় বলে,
— “আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি আঙ্কেল।”
— “তোমার কি মনে হয়, এতকিছুর পর আমি তোমাকে ক্ষমা করব?”
নিঝুম শান্ত চাহনিতে তাকালো আলম খানের দিকে। কণ্ঠে শীতলতা এনে বলল,
— “আমি জানি আমার ফুফি যা করেছে তা ক্ষমার যোগ্য নয়। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র ফুফির ক্ষেত্রে। আমি যদি সে সময় উপস্থিত থাকতাম ইনশাল্লাহ এমন কিছুই হতে দিতাম না। আঙ্কেল, আমাকে প্লীজ আর একটা সুযোগ দিন। কথা দিচ্ছি, ঝুমকে কখনো কষ্ট পেতে দেব না।”
আলম খান কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। নিঝুম মাথা নিচু করে অপেক্ষা করছে আলম খানের জবাবের। মনে মনে ঝুমকে একটা বার দেখার প্রবল তাড়নায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ কেমন দহন? নিঝুমকে ছারখার করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
মিসেস শ্রেয়া এতক্ষণে বললেন,
— “নিঝুম বাবা, আমার মেয়েটা সেই তোমার বাসা থেকে আসার পর যে রুমের দরজা বন্ধ করেছে, এখনও খুলছে না। ভেতর থেকে কোনো সারাশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি একটু দেখো না কি হয়েছে।”
অনুরোধ করে বললেন মিসেস শ্রেয়া। সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো নিঝুম। ব্যস্ত পায়ে ঝুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজায় মৃদু কারাঘাত করে ডাকলো ঝুমকে,
— “ঝুম?”
ঝুম নিশ্চুপ। নিঝুম আবার ডাকলো,
— “ঝুম? দরজা খুলো। আমি এসেছি। তোমার ডাক্তার।”
তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে গেল। সামনে দাঁড়ানো ঝুমকে দেখে নির্বাক হয়ে গেল নিঝুম। এলোমেলো চুল আর কান্নারত মুখটা দেখে নিঝুম তার বুকের পাশটায় সূক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করল। ঝুম সিক্ত নয়নে ভাঙ্গা গলায় ডাকলো,
— “ডাক্তার।”
নিঝুম বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মিসেস শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে ম্লান কণ্ঠে বলল,
— “আমাকে দশ মিনিট ঝুমের সঙ্গে কথা বলতে অনুমতি দিবেন আন্টি?”
যেন একরাশ মায়া নিয়ে বলল নিঝুম। মিসেস শ্রেয়া মানা করতে পারলেন না। অবুঝের মতো অনুমতি দিয়ে দিলেন। আলম খান গম্ভীর মুখে চেয়ে চেয়ে দেখলেন সবটা। কিছুই বললেন না।
ঝুমের রুমে ঢুকে দরজা ভিড়িয়ে দিলো নিঝুম। কিছুক্ষণ ঝুমের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জড়িয়ে ধরল ঝুমকে। ঝুমকে চমকে উঠল। ঘাড়ে নিঝুমের ঘন নিশ্বাসের স্পর্শ পেল স্পষ্ট। এবং সঙ্গে সঙ্গেই নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো ঝুম। ঝুমের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিঝুম বলল,
— “কাঁদবে না ঝুম। তোমার কান্না আমার সহ্য হয় না।”
আহ্লাদ পেয়ে ঝুমের কান্নার গতি আরো বাড়ে। নাক টেনে বলে,
— “আপনি আপনাকে ছাড়া বাঁচবো না ডাক্তার। আমাকে আপনার কাছে নিয়ে যান। সারাজীবনের জন্য!”
ঝুমকে ছেড়ে সামান্য দূরে দাঁড়ালো নিঝুম। দু’হাতের বুড়ো আঙুলে চোখের পানিগুলো মুছে, চোখের দু’পাতায় চুমু খেল। ফিসফিসিয়ে বলল,
— “ভালোবাসি।”
____________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia