ভালোবাসি বলেই তো পর্ব-০৫

0
1004

#ভালোবাসি_বলেই_তো ♥️
লেখিকা – #আদ্রিয়া_রাওনাফ
পর্ব – ৫

রাত ৩ টা ২০ মিনিট ,

পূর্ণতা কখন থেকে বিছানায় শুয়ে একবার ডান কাতে ঘুমাতে চেষ্টা করছে তো একবার বাম কাতে । একবার মাথা বালিশের নিচে দিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করছে তো আরেকবার উপুর হয়ে । কিন্তু কোনো ভাবেই ঘুম আসছে না ।

মাথার মধ্যে বার বার সেই এক‌ই গান আর এক‌ই ফেস রিয়েক্ট গুলো নাড়া দিচ্ছে ,

“Kuch to hai tujhse raabta ♥️ , ♥️kuch to hai tujhse raabta ”

পূর্ণতা ঘুমাতে ব্যর্থ হয়ে উঠে বসে বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো । আকাশে চাঁদ ও নেই , যে দেখতে দেখতে হয় তো এক সময় ঘুমিয়ে পড়বে ।

পূর্ণতা অসহায়ের মতো আবার রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসল । কি করে সময় পার করবে ভেবে না পেয়ে বীর বির করতে লাগলো ,

– ফোনটাও ঐ শাকচুন্নি টা নিয়ে নিয়েছে , ফোন টা থাকলেও তো নিউজ ফিডটা ঘুরে দেখতে পারতাম । ধুর !! ভালো লাগেনা ।

ঐ শাকচুন্নির হবু এমন কেন !! একজন থাকতে আরেকজনের ঘুম নষ্ট করে ??

এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে হলো,

“আরে , আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম । ভাইয়া তো আমার জন্য শুটকি ইয়ে মানে চকলেটস এনেছে । সেগুলো খেতে খেতেই সকাল হয়ে যাবে । ”
এই ভেবে মুচকি হেসে বক্স থেকে চকলেট বের করে খেতে বসলো পূর্ণতা ।

আবরন এক ঘুম দিয়ে মাঝ রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে আবার জেগে উঠলো ।

ওর শরীর টা ঘামে পুরো ভিজে গিয়েছে । এসি চলছে তবুও এত ঘাম দেখে এসির রিমোটটা হাতে নিয়ে Temperature ১৭ ডিগ্ৰি করে দিল ।

তারপর কপালের ঘাম মুছে মনে মনে ভাবতে লাগলো ,

– হঠাৎ এমন স্বপ্ন কেন দেখলাম !! ভার্সিটিতে যেখানে সবাই আমাকে ভয় পায় সেখানে পূর্ণতা আমার সাথে এরকম বিহেইভ করছে !! ওকে তো আমার বাসায় দেখলাম !! ও আমাকে দিয়ে ঘর মুছাচ্ছে , কাপড় কাচাচ্ছে আরো কত কি !! এমন ভাবে বলছিল যেন ও আমার “ব‌উ” লাগে , ওর কথা না শুনলে ও এই বাসা থেকে প‌ই প‌ই করে বেরিয়ে যাবে !!

আল্লাহ !! এ কোন পূর্বাভাস ??
নাহ , ওকে এখন থেকেই টাইট দিয়ে রাখতে হবে ।

হঠাৎ এসব কথা চিন্তা করতে করতে নিজেই ভাবতে লাগলো ,

– আমি পূর্ণতা কে নিয়ে এত কেন ভাবছি ?? আর ওকে টাইট দিয়ে আমি কেন রাখতে যাবো !! ধুর , এসব কি চিন্তা করছি হঠাৎ করে ?? না, এখন মাথা ব্যথা করছে ।

নিজের রুম থেকে বের হয়ে আবরন আধিরা আনজুমের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল । দরজায় টোকা দিয়ে ডাকতে লাগল ,

– আম্মু , আম্মু !! দরজা টা খোল !!

২ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে দরজা না খোলায় গলার জোর আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে ডাকলো ,

– আধিরা আনজুম , ও আধিরা আনজুম !! দরজাটা খোল !!

লাইনটা শেষ করতেই আধিরা আনজুম দরজা খুলে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে বললেন ,

– তুই এত রাতে এভাবে কেন ডাকছিস ? কিছু হয়েছে !

– মাথা ব্যথা করছে । চুল গুলো টেনে দেবে চলো !!
এই বলে মায়ের হাত ধরে টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেল আবরন । তারপর মাকে নিজের বিছানায় বসিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো । আধিরা আনজুম চুল টেনে দিতে দিতে বললেন ,

– আর কত পাগলামি করবি বলতো ? মাঝরাতে কেউ এভাবে মাথা টিপে দিতে রুম থেকে টেনে আনে !!

– আমি আনি । এখন বলো , “বাবা কোথায় ? ”

– তোর বাবা তো চট্টগ্রামের অফিসে গিয়েছে , ঐখানে নাকি নতুন ফার্ম হাউজটা কমপ্লিট হয়ে গিয়েছে । সেটার উদ্বোধন ছিল । তাই আসতে পারে নি ।

– ওওও । আচ্ছা , মা তোমাকে বাবা কিভাবে বিয়ে করেছিল ?

– হঠাৎ এই প্রশ্ন ? আগে তো কত বার বলতে চেয়েছি , তুই তো বলতি যে ‘ এসব জেনে তোর কাজ নেই ‘ । আর আজ নিজে জানতে চাইছিস ?? কাহিনী কি বলতো ?

– আগে তুমি বলো !! বাবার সাথে তোমার কি করে পরিচয় ??

– তোর বাবা শাদমান চৌধুরী বিশাল বড় লোকের ছেলে । তাই তখন ভার্সিটিতে তাকে সবাই তোয়াজ করে চলতো । আমি যখন ভার্সিটিতে প্রথম এডমিশন নিই , তোর বাবা তখন ৪র্থ বর্ষের ছাত্র । আমি যখন ভার্সিটিতে যেতাম , দেখতাম সব মেয়েরা তোর বাবার পিছু পিছু ঘোরে , আর তোর বাবা কাউকে পাত্তা দিত না , খুব ইগো নিয়ে চলতো । তাই আমি জিদ নিয়ে তোর বাবার দিকে ফিরিয়েও তাকাতাম না । কেউ তার বিষয়ে কোনো কথা বলতে শুরু করলেও আমি তাদের এড়িয়ে চলতাম । কারন , আমার কথা হচ্ছে সে তো কাউকে পাত্তা দেয় না , তাহলে তার পিছনে ঘুরে সময় নষ্ট করে কি কোনো লাভ আছে !!

তো হঠাৎ একদিন তোর বাবা তার দলবল কে দিয়ে আমাকে তার রুমে ডেকে পাঠায় । আমি ও নির্ভয়ে সেখানে যাই । যাওয়ার পর সে আমাকে থাকতে বলে বাকি সকলকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলে । আমি তবুও মন থেকে সাহস হারাইনি ।

তারপর , সে আমাকে বলল ,

– কি মনে করো নিজেকে ? বিশ্ব সুন্দরী ?? এখানকার সব মেয়েরা আমার জন্য পাগল , আর তুমি আমাকে না দেখার ভান করে হেঁটে চলে যাও !! কি সমস্যা তোমার ?? এত কিসের ইগো !!

আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম ,

– সেইম প্রশ্ন আপনার জন্য আমার !! কিসের এতো ইগো আপনার ! বাবা কোটিপতি বলে সবার মাথা খাবেন নাকি ? বুঝলাম ভার্সিটির সব মেয়েরা আপনার জন্য পাগল , কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে হয় তো বুঝবেন যে সবাই আপনার পাশাপাশি আপনার টাকার জন্য ও পাগল !! সবাইকে নিয়ে গিয়ে পাবনায় ফ্রি ট্রিটমেন্ট এর ব্যবস্থা করুন । আপনার বাবার তো আবার টাকার অভাব নেই !!

আর আপনার মতো বড় লোকদের দিকে আমি ফিরেও তাকাই না ।

এই বলে আমি সেদিন বাসায় চলে আসি ।

এরপর থেকে তোর বাবার মাথা খুলল আর সে কিছুদিন পর থেকে আমাকে ফলো করতে শুরু করল । এতদিন তার পেছনে সবাই ঘুরতো আর এখন সে উল্টো আমার পেছনে ঘুরে । ব্যাপারটা প্রথমে আমার কাছে হাস্যকর মনে হলেও পরে তোর বাবার এই ভার্সিটি থেকে চলে যাওয়ার পরেও যখন দেখতাম সে ভার্সিটির বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে , তখন বুঝলাম যে সে হয়তো আমার সাথে কথা বলতে চায় । তাই একদিন আগ্ৰহ দেখিয়ে নিজেই গিয়েছিলাম তার সাথে কথা বলতে যে কি সমস্যা ??

সে কি কান্ড জানিস না , তোর বাবার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়েছিল , সে আমার হাত ধরে বলল যে সে আমাকে ভালোবাসে । আমিই নাকি তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে দিয়েছি , হ্যান ত্যান কত কিছু !!
আমি সেদিন শুধু তার কথা শুনেছিলাম । তাকে কিছুই বলি নি । কিন্তু পরেরদিন সকালে দেখি সে আমার বাড়িতে তার ফ্যামিলি নিয়ে হাজির । পরে তোর খালার কাছে শুনলাম তারা নাকি প্রস্তাব নিয়ে এসেছে তাদের ছেলের জন্য । তারপর আরকি !! করেই নিলাম বিয়েটা , তবে সত্যি বলতে আমি তোর বাবাকে আগের থেকেই ভালোবাসতাম , কিন্তু কখনো তা প্রকাশ করি নি ।

এই বলে আধিরা আনজুম থামলেন । আবরন মুচকি হেসে বলল ,

– মেয়েরা বুঝি এমন‌ই চাপা হয় !!

– হ্যা , হয় । তবে আজকালকার মেয়েরা এমন খুব ক‌ম‌ই হয় ।

– তাই নাকি !! তাহলে তো ……

আধিরা আনজুম চোখ বড় করে বললেন ,

– তাহলে কি ? বল , চুপ করে গেলি যে ?

– আগে বলো , আমি ছেলে হিসেবে কেমন ?

– তুই তো তোর বাবর বিপরীত !! নিজের নামের সাথে কোনোদিন “চৌধুরী” লাগাস নি । সব জায়গায় তোকে শাহরিদ আহনাফ আবরন নামেই চিনে । আর ইগো তো তোর মধ্যে নেই ই , আর সবাইকে ই সাহায্য করিস আবার ভুল করলে শাসন ও করিস !! কিন্তু …

– কিন্তু কি আম্মু ?

– কিন্তু আজ পর্যন্ত কাউকে নিজের মনে জায়গা দিতে পারলি না । মানে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসলি না ।

আবরন উঠে বসে বলল ,

– আম্মু , কাউকে ভালোবাসলে কিভাবে বুঝবো যে তাকে আমি ভালোবাসি ?

– কেন ! কাউকে ভালোবাসিস নাকি !!

– সেটাই তো জানতে চাচ্ছি , ভালোবাসার লক্ষ‍ন কি ?

– আমার এক্সপেরিয়েন্স থেকে বলি তোকে ,

ভালোবাসলে সবার প্রথম ফিল হবে সে তোর আশে পাশে থাকলে তোর ভালো লাগে ,না থাকলে তাকে একটু দেখার জন্য মনটা কেমন যেন করবে !
রাতে ঘুম হবে না , মাথার মধ্যে তাকে নিয়ে সব স্মৃতি ঘুরপাক খাবে । ঘুমালেও তাকে স্বপ্নে দেখার সম্ভাবনা ৮০% …. তার ছোট খাটো বিষয়ে নিজের অনিচ্ছায় কেয়ার করা , তাকে কেউ কিছু বললে খারাপ লাগা , তাকে মন খারাপ করতে দেখলে কষ্ট লাগা । তাকে হাসি খুশি দেখলে নিজের স্বস্তি লাগা ইত্যাদি ইত্যাদি । আরো অনেক লক্ষন আছে । ভালোবাসার লক্ষন বলে শেষ করা যাবে না ।

এই বলে আধিরা আনজুম হাসলেন ।

আবরন বলল ,
– ভালোবাসলে মনে হয় মানুষ একটু পাগল পাগল ও হয়ে যায় !!

এই বলে দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগল । আধিরা আনজুম ও হাসলেন । তারপর বললেন , আরেকটু পর আজান দিয়ে দিবে । নামাজ টা পড়ে একবারে ঘুমাস । আমি গেলাম ।

আধিরা আনজুম চলে যেতেই আবরন দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় বসে ভাবলো ,

– তাহলে কি আমার পূর্ণতা কে ভালো লাগে ! যা , ই হোক । ওকে জ্বালাতে ভালোই লেগেছে গত কাল । আরো জ্বালাবো ।

এই ভেবে মুচকি হেসে আরো কিছু ভাবতে লাগল ।

………………………………………………..

সকাল ১০ টা ,

জিব্রান পূর্ণতা কে নিয়ে মিরপুর ১০ এ যাচ্ছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে । সেখানে কারাতি তে পূর্ণতা কে আজ ভর্তি করিয়ে দেবে ।

বাইকে করে যেতে ২০-৩০ মিনিটের রাস্তা যদি জ্যাম না থাকে । পূর্ণতা বলল ,

– এত দূরে আসতে হবে প্রতিদিন ??

– দূর কোথায় ! এর চেয়ে কাছে আর কারাতি দোজো নেই ।

সেখানে পৌঁছে খোঁজ নিয়ে দেখলো সপ্তাহে ৬ দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় । সকাল ১০টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত আছে , আবার বিকেল ৪টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত ও আছে । জিব্রান পূর্ণতার সুবিধা অনুযায়ী ওকে বিকেলের ব্যাচে ভর্তি করিয়ে দিল ।

……………………………………………….

মিরপুর থেকে ফিরে এসে শাওয়ার নিয়ে পূর্ণতা ছাদে গিয়ে জিব্রানের ফোন দিয়ে প্রেনাকে কল দিল ,

– জানিস , আমাকে ভাইয়া কারাতিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে !!

– ওয়াহ ! তাহলে তো ভালোই হলো !! রাস্তা ঘাটে কেউ ঝামেলা করলে এক ঘুষি মেরে উড়িয়ে দিতে পারবি ।

– কিন্তু আমার তো একা যেতে কেমন কেমন যেন লাগবে ! তুই ও ভর্তি হয়ে যা না !!

– আম্মু জীবনেও রাজি হবে না । বলবে এসব শিখে কাজ নেই । পড়াশোনায় মন দে ।

– কে বলেছে কাজ নেই ? এই যুগে সেল্ফ ডিফেন্স খুব জরুরী ।

– হ্যা , তা তো দেখছি ই । তোর তো বড় ভাই আছে , আর এখন তো হিরোও আছে । তোকে এমনিতেই চোখে চোখে রাখবে !

– ভাই আছে বুঝলাম ! হিরোটা আবার কে !!

– কেন ! জানিস না মনে হয় ?? কাল রাতে হিরো কি সুন্দর হিরোইন এর জন্য গান গাইলো !

এই বলে প্রেনা হিহি করে হাসতে লাগলো !!

– ধুর !! আবার তুই শুরু করলি !! কাল রাতে ঐ লোকটার জ্বালায় ঘুমুতে পারি নি এমনিতেই !! এক রাতে আমার চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে ।

– সিরিয়াসলি ?? তার মিনে সামথিং সামথিং হ্যা ??

– নো , নাথিং নাথিং । উনি একটা কুফা !

– বলিস কি কেন ?

– কারন , উনার সাথে ধাক্কা খেয়েই প্রথমদিন পড়ে গিয়েছি , আবার কালকে উনার কথা শুনেই ফুচকা গিলতে পারি নি , আবার কাল রাতে উনার জন্যই ঘুমাতে পারি নি । মানে উনার সাথে দেখা হ‌ওয়ার পর থেকেই একটার পর একটা কুফা লেগেই আছে !! হুহ !!

প্রেনা হাসতে হাসতে শেষ ঐপাশে । পূর্ণতা ওর হাসি শুনে রেগে ফোনটা কেটেই দিল ।

ফোন কান থেকে নামিয়ে পেছনে ঘুরে তাকাতাই দেখল ……………………….

#চলবে ♥️