#ভিনদেশি_তারা
#পর্ব-২০
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
৫৯.
আজ আপুর বিয়ে। বিয়ে হচ্ছে আমাদের বাসার লনে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে কোনোমতে একটা জামা পড়ে, হালকা সাজগোজ করে বেরুলাম। ইচ্ছে করছে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকি। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি পাঁচদিনের। ভেবেছিলাম এই বাহানায় শান্তিমতো ঘুমিয়ে নিবো। তা আর হলো কই!
যাইহোক, বিয়ে পড়ানো একসময় শেষ হলো। দাদু বললেন, ‘বর বাবাজিকে বাচ্চা বাচ্চা লাগে কেন রে চিতুনি?’
‘ বাচ্চা কোথায় দাদু? বয়স বত্রিশের কোঠায় পড়তে চলেছে।’
দাদু লাঠিটা মেঝেতে ঠকঠক করতে করতে বললেন, ‘চৈতীর বয়স কী কম নাকি! তুই শুধু অন্যের বয়সটা দেখলি।’
‘ দেখবোই তো।’
‘ নিজেরটা দেখ।’
‘ তোমার নিজের বয়সই তো সত্তর হতে চললো। দাদীমা থাকলে দেখতে তোমাকে রেখে আরেকটা বিয়ে করতো।’
‘ বললেই হলো। তো দাদীমাকে তুলে নিয়ে আসতাম, বয়স সত্তর হলে কী হবে। মনটা একুশ বছরের যুবা পুরুষ।’
‘ হুহ।’
‘ তোর বরটাকে দেখিস কী করি।’
আমি হেসে বললাম, ‘ বিয়ে করলে তো বর দেখবা।’
‘ ওওহ, তুই বিয়ে করবিনা?’
‘ জীবনেও না। চিরকুমারী থাকার স্বাদ জেগেছে, বুঝলা।’
‘ যা তো।’
‘ তুমি যাও। তোমার এই খিটখিটানির জন্যই দাদীমা আগেই চলে গিয়েছে।’
‘ ভালোই হয়েছে। বেহেশতে আছে, সুখেই আছে। তুই ভাগ।’
‘ ভাগছি ভাগছি। শুনো আমি ঘরে গিয়ে ঘুম দিই, ওকে?’
‘ তোর বোন চলে যাবে আর তুই ঘুমাবি।’
‘ হুম। গেলাম বাই।’
‘ পাষাণ একটা। তোর বর দেখিস তোকে ঠ্যাঙাইয়া সোজা বানাবে।’
‘ কচু বানাবে।’
‘ আমার কথা মিলিয়ে নিস!’
‘ মিলাবোনা। কারণ তোমার সব কথাই ভিত্তিহীন।’
দাদু রেগে বললো, ‘আমার সাথে কথা বলবিনা।’
‘ বয়েই গেছে কথা বলতে আমার।’
আমি চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই দাদু বললো, ‘আয় না একটা ছবি তুলি। কী যেন বলে.. উম..সেলফি না কী যেন।’
আমি এগিয়ে গিয়ে দাদুর মোবাইলটা নিয়ে দুজনে মিলে সেলফি নিলাম। সম্প্রতি দাদু নাতনির বিয়ে উপলক্ষে তাঁর বাটন মোবাইল ইচ্ছে করে ভেঙ্গে আব্বুর সাথে ঝগড়া করে স্মার্টফোন নিয়েছে। একটা এফবি একাউন্ট খুলে সারাদিন নিউজফিড ঘুরবে। আব্বু এজন্য দাদুর উপর প্রচন্ড বিরক্ত। আমি আর দাদু মিলে এক্ষুনি যে সেলফিটা তুললাম দাদু মুহূর্তেই সেটা আপলোড করে ফেললো। এবং দাদুর বুড়ো ফ্রেন্ডরা রিয়্যাক্ট, কমেন্ট করতে লাগলো। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘যাচ্ছি!’
‘ শোন তোর বয়স যেন কত?’
‘ আঠাশ। কেন?’
‘ সিক্রেট!’
এবার যাই?’
‘ যা!’ বলে মিটিমিটি হাসতে লাগলো।
আপুকেও একপলক দেখে আসলাম এবং কানেকানে ভাইয়া/আপুর থেকে বিদায় নিয়ে এলাম। সবাই লনে হওয়ায় বাসা খালি। আমি রুমে ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করে দিলাম। বাতি জ্বাললাম না। বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কান্ত শরীর মুহূর্তেই ঘুমে ঢলে পড়লো।
৬০.
ঘুমের মধ্যে মনে হলো কে যেন আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ খুলতে পারছিলাম না। কে যেন আবার ফুঁ ও দিচ্ছে, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। হাত-পা শক্ত, আরে হলো কী আমার! বোবা ধরলো নাকি?
মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়তে লাগলাম। মনে হলো কে যেন আমার ঠোঁটে চুমু দিলো। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। অন্ধকার ঘর, দরজা খোলা! একী! আমি দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম। তাহলে কী কেউ আগে থেকেই রুমে ছিলো আর ঘুমের মাঝে আমার সাথে অসভ্যতা করেছে? কে সে?
১১০ ডিগ্রি মেজাজ নিয়ে ঘর থেকে বেরুলাম। আশ্চর্য! বাসার ভেতরই সবাই, কে এ কাজ করলো জানবো কীভাবে। আর আমার ঘরে কোনো লোক ঢুকেছিলো সেটা কী কেউ দেখেনি!
কেমন ঘ্রাণ আসছে যেন আমার ওড়না থেকে। বোধহয় পারফিউমের। আমি বা বাসার কেউওই এই পারফিউম ইউজ করিনা। অসভ্য লোকটা হয়তো ইউজ করে। কেমন জুঁই ফুলের সুবাস।
‘ এখানে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
‘ কোথায় দাঁড়িয়ে আছি?’
‘ এতক্ষণ কোথায় ছিলি?’
‘ রুমে ঘুমাচ্ছিলাম।’
‘ খেয়েছিলি?’
‘ নাহ!’
‘ খাবি কেন? খেলে তো মরে যাবি, না খেলে তো ফিগার ঠিক থাকবে,তাইনা?’
‘ আম্মু বাজে কথা বলোনাতো।’
‘ হাতমুখ ধুয়ে আয়!’
‘ খাবোনা আমি!’
‘ তোর ঘাড় খাবে।’
‘ জোর করছো কেন?’
‘ তুই আমার মেয়ে? নাকি আমি তোর মেয়ে? এভাবে মুখের উপর কথা বলা কোথায় শিখেছিস?’
‘ কোথায় মুখের উপর কথা বললাম?’
‘ তুই বিদেশে থেকে বেয়াদব হয়েছিস।’
‘ আম্মু!’
‘ আমাকে মা ডাকবি না।’
আমি মজা করে বললাম, ‘ভাবি ডাকবো?’
‘ তোর আব্বু তোর ভাই লাগে? এই শিক্ষা দিলাম এতো বছর?’
‘ উফফ! তোমার সাথে কথা বলাই বৃথা।’
‘ বলিস না।’
বলে আম্মু আমাকে জোর করে ডাইনিংয়ে বসিয়ে দিলো। মিতু আপু খাবার প্লেট সাজিয়ে এনে আমাকে পাহারা দিতে লাগলো, যেন আমি পালাতে না পারি। আম্মু রুমাল ভিজিয়ে এনে আমার মুখচোখ মুছে দিলো। হাত ধুয়ে আমাকে জোর করে খাওয়াতে লাগলো। অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও মাংস নামক অখাদ্য গিলতে লাগলাম। হুট করে বললাম, ‘ একটু আগে আমার ঘরে কে গিয়েছিলো?’
আম্মু অবাক হয়ে বললো, ‘জানিনা তো।’
মিতু আপু বললো, ‘কত জনই তো ছিলো বাসায়। একটা লম্বা, ফর্সা ছেলেকে দেখেছিলাম। তোর বন্ধু নাকি?’
‘ মানে? আমার বন্ধু মানে?’
‘ আমরা কী জানি!’
‘ দেখতে কেমন?’
‘ লম্বা, ফর্সা। ভালো করে দেখিনি, হঠাৎ দেখলে অদ্ভুত লাগে৷ মাথায় ক্যাপ ছিলো। না না ক্যাপ না.. উম.. ওই দাদুর একটা গোল টুপি আছেনা? ওই ঘুরতে গেলে যে মাঝেমধ্যে পরে? ওইরকম একটা টুপি ছিলো।’
‘ ওটা টুপি না, হ্যাট!’
‘ ওই হলো। হাফপ্যান্ট আর টি-শার্ট ছিলো গায়ে। চেহারা দেখিনি।’
‘ ওহহ আচ্ছা।’
আম্মু ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘কিছু হয়েছে নাকি?’
‘ আরে না।’
৬১.
রাত বারোটায় ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম। অফিসের কিছু কাজ ছিলো। সেগুলো শেষ করতে করতে বাজলো একটা। ঘুম আসছিলো না কিছুতেই। ফেসবুক স্ক্রল করতেই কয়েকটা ফটোগ্রাফি পেইজ সামনে এলো। ওয়ার্ল্ডের বেস্ট বেস্ট ফটোগ্রাফারদের তোলা ছবি। আমি একমনে দেখতে লাগলাম। আকাশ, পাহাড়-পর্বত, সাগরের ছবি৷ নাইজেরিয়ার নিগ্রো কিছু ছেলেমেয়েদের ফটোসেশান দেখতে পেলাম। শিশিরভেজা ঘাসে কালো কালো বাচ্চারা দাঁত বের করে হাসছে। মাথার উপর হলুদ সূর্য! ছবিটা এতো সুন্দর বলার বাইরে। মনে পড়লো নর্থ ডাকোটাতে ঘুরতে গিয়ে আমি একটা ড্যাফোডিল ফুল গুঁজেছিলাম কানের পাশে। একটা বাচ্চা আমাকে দেখে বলেছিলো,
You are beautiful…..
You are beautiful…..
You are beautiful it’s true……
আমি লজ্জ্বা পেয়ে হেসেছিলাম। ক্লেভ সেটা দেখে চিৎকার করে গাইতে লাগলো,
Lana Del Rey Lyrics
“Summer Wine”(originally by Lee Hazlewood)
Strawberries cherries and an angel’s kiss in spring
My summer wine is really made from all these things
I walked in town on silver spurs that jingled to
A song that I had only sang to just a few
She saw my silver spurs and said lets pass some Time.
……
Strawberries cherries and an angel’s kiss in spring
My summer wine is really made from all these things.
‘ কী হচ্ছেটা কী ক্লেভ?’
‘ কিছুনা।’
‘ সামার ওয়াইন! তুমি এসব কী গাইছিলে?’
‘ কিচ্ছুনা। বাচ্চাটা কী বললো শুনলে?’
‘ শুনেছি।’
‘ দাঁড়াও তোমাকে একটা ছবি তুলে দিই!’
আমি ছবি তুলতে চাইলাম না। ক্লেভ আমাকে ঘাসের উপর শুইয়ে দিয়ে রোদের আলোয় আমার ছবি তুলেছিলো। হাসতে হাসতে আমার অবস্থা শেষ, ক্লেভ সব ক্যামেরাবন্দি করে রেখেছিলো। ছবিগুলো দারুণ ছিলো, সময়টাও।
ভাবনার প্রহর কাটিয়ে ল্যাপটপে মনোযোগ দিলাম। হঠাৎ সামনে পড়লো “Adward Elclev Best Photography”.
হার্টবিট জোরে চলতে লাগলো, নিঃশ্বাস ক্রমশই বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। পেইজে ঢুকলাম, পৃথিবীর নানান দেশের বিভিন্ন জায়গার ছবি। সব সুন্দর। কিন্তু একজায়গায় গিয়ে হতাশ হলাম, কারণ এটা আমার ক্লেভের পেইজ নয়। একই নামের অন্য কেউ। রাগ হলো, ইচ্ছে করছে ল্যাপটপ আছাড় মারি নিজের মাথায়। একপাশে ছুঁড়ে ফেলে মুখ ঢেকে বসে রইলাম। ভেবেছিলাম ওদ খোঁজ পাওয়া যাবে। কিন্তু কিছুই না! আর কখনো কী ওর খোঁজ পাবোনা? গোপনে?
রাতের আঁধার ছাপিয়ে, একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে কে যেন করুণ সুরে আমার জানালার পাশে গাইতে লাগলো,
Lady Gaga Lyrics
“Marry The Night”
I’m gonna marry the night
I won’t give up on my life
I’m a warrior King (Queen হবে)
Live passionately tonight
……
I’m gonna marry
Marry
I’m gonna marry
Marry
C’mon c’mon the night
The Night.
মানে কী? এতোরাতে কেউ আমার জানালার বাইরে এই অদ্ভুত গান গাইবে কেন? লেডি গাগার এই গান কী শুধু আমার জানালার বাইরে বসে গাইতে বলেছে? গানের বাংলা অর্থ শুনে আমি শিহরিত!
“আমি রাতে বিয়ে করতে যাচ্ছি
আমি আমার জীবন ছেড়ে দেবোনা
আমি একজন যোদ্ধা রাজা
আজ রাতে আবেগপ্রবণভাবে লাইভ!”
আমি জানলা খুলে উঁকি দিলাম এবং যা দেখলাম তাতে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। রাস্তার মাঝখানে, আমার জানালার পাশে একটা লোক মুখ ঢেকে গুনগুন করে এই গান গাচ্ছে আর হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করছে। মাতালের মতো। কে এই লোক!
চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।