#ভিনদেশি_তারা
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৫
৭৬.
বৃষ্টিস্নাত ভোর তখন। চারপাশে হলদে আলোর ছটা। কালো কালো মেঘেরা থেকে থেকেই বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। ঠান্ডা আবহাওয়া! কেমন ভিজে মাটির গন্ধ আসছে। কয়েকটা মশা ভনভন শব্দ করছে কানের পাশে। বিরক্ত হয়ে গেলাম একদম। ঘুমিয়েছি আধঘন্টাও হয়নি। এর মধ্যেই অত্যাচার শুরু করলো এরা। চোখ খুলে তাকালাম, ঘুম লেগে আছে চোখে।
নড়তে পারলাম না, আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে ক্লেভ। গভীর ঘুমে মগ্ন। মশা বাবাজিরা ওর উদোম পিঠ কামড়ে লাল করে দিয়েছে। কিন্তু ওর কোনো হেলদোল নেই। আমি উঠতে চাইলাম ওকে ঠেলে, চট করেই ওর ঘুম ভেঙে গেলো। আর ঘুমন্ত গলায় বললো, ‘ ঘুমুটে দ্যাও চিট!’
‘ ঘুমাচ্ছোই তো।’
‘ টোমি নড়ছো ক্যান?’
‘ আমি উঠবো।’
‘ ক্যান?’
‘ ঘুম ভেঙে গেছে তাই।’
‘ অ্যামি উঠতে দেব না।’
‘ কেন?’
‘ অ্যামি ঘুমাবো।’
‘ তো ঘুমাও।’
‘ টোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো।’
‘ কী আজব!’
আমি নড়েচড়ে ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ঠুস করে উঠে গেলাম। বিশ্বজয়ীর হাসি দিলাম একটা। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার শাড়ি নেই। ওহ মাই গড! মনেই নেই শাড়ির কথা! আমি বিছানার উপর শাড়ি খুঁজতে লাগলাম, পেলাম না। ক্লেভ দাঁত বার করে হাসছে। ‘ওফফ.. চিট! টোমায় যা লাগছে না!’
আমি রেগে বললাম, ‘এই চুপ করো।’
কে শুনে কার কথা! ও আরামসে বালিশে শুয়ে পড়লো। বললো, ‘টুমি রাতে যা করলে না!’
‘ক্ক কী ক করেছি আমি?’
‘ যেভাবে অ্যামাকে আদর করলে!’
‘ ছিঃ!’
‘ বিলিভ হয় ন্যাহ? দেখো, আমার গলায় কীভাবে কামড়ে দিয়েছো!’
সত্যিই তাই! এ মা! গলায় কামড়ের দাগ, পিঠে নখের দাগ। ঠোঁটের কোণেও কেমন কালচে হয়ে আছে। ইয়া আল্লাহ! দড়ি ফালান, আমি উপরে চলে যাবো। এসব দাগ বাড়ির মানুষ দেখলে কী বলবে? প্রথম দিনই চিত্রানি ছক্কা মেরে দিয়েছে? এর এতো ফর্সা হওয়ার দরকার কী ছিলো! আমি তো আজ ঘর থেকে বেরুতেই পারবোনা। জামাই লাল ভূত হলে যা হয় আরকি!
৭৭.
‘ চিট, টোমি যেভাবে অ্যামায় খামচি দিয়েছো ডূর্লববাবুরা কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলবো?’
আমি আনমনে লজ্জ্বায় বললাম, ‘তুমি আজ ঘর থেকেই বেরুবে না।’
ও ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘ক্যান?’
‘ নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছোনা? সবাই এসব দেখলে কী ভাববে?’
‘ ইট’স নরমাল। এমন হটেই পারে।’
‘ কাকে কী বলছি, পোড়া কপাল।’
ক্লেভ বুঝতে পারলোনা। জিজ্ঞেস করলো, ‘কী বলছো?’
আমি বললাম, ‘তুমি ঘর থেকে বেরুবেনা, বুঝলে!’
‘ অ্যামি ঘরে বসে তাকবো না। অ্যামার বালো লাগেনা।’
‘ না থাকলে আমি আর তোমার সাথে কথা বলবো না।’
‘ প্লিজ চিটু!’
‘ ওকে। কথা বলবেনা!’
ক্লেভ হাড়ির মতো মুখ করে বললো, ‘ওখে তাকবো। একলা একলা আমার বালো লাগেনা।’
আমি মুচকি হাসলাম। এদিকে আমার শাড়িও নেই। ঘর অন্ধকার বলে রক্ষা, যেটুকু আলো আছে তাতে ক্লেভকে পরিষ্কার দেখা গেলেও অন্যপাশে আমাকে দেখা যায়না, তাই কথা বলতে পারছি। নইলে লজ্জ্বায় মরেই যেতাম।
ইতস্তত করে ওকে বললাম, ‘আমার শাড়ি কোথায়?’
ক্লেভের মুচকি হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ও বললো, ‘অ্যামার কাছে।’
হতভম্ব আমি বললাম, ‘মানে?’
‘ স্যাড়ি অ্যামার কাছে।’
‘ দাও।’
‘ দেব না।’
‘ কেন দেবেনা?’
‘ টোমাকেও ঘুমাতে হবে, অ্যামার ঘুম পাচ্ছে। নইলে দেব না। যাও!’
‘ আমি ঘুমাবোনা, ঘুম নাই আমার চোখে।’
‘ বালো।’
আমার রাগ উঠে গেলো। কী শুরু করলো ও! রাগী স্বরে বললাম, ‘ এই দাও তো শাড়ি। নইলে তোমার প্যান্ট খুলে নেবো।’
ক্লেভ হা হা করে হেসে উঠলো। আমি বেক্কলের মতো তাকিয়ে আছি। ও বললো, ‘রিয়েলি চিট? টোমি আমায় প্যান্ট খুলে নেবে? আমি টোমার সবকিছু কাল রাটেই দেখে নিয়েছি, টোমিও দেখে নিয়েছো আমার মানসম্মান। অবশ্য প্যান্ট খুলতে চাইলে আমি নিজেই খুলতে পারবো।’ তারপর চোখ মেরে বললো, ‘খুলবো নাকি? টুমি বললে খুলতেই পারি!’
আচমকা হতভম্ব হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। ছিঃ! এটা আমার কপালে কী জুটলো। লজ্জ্বাশরম কিচ্ছু নাই? বাইরে গিয়ে সবাইকে যে এসব বলে বেড়াবে তাতো নিশ্চিত। ইতিমধ্যেই ডোনাকে রকি বীচে যে কিস করেছিলো সেই খবর বাসার সবাই, আব্বু-চাচ্চুরা পর্যন্ত জানে। ওর এসব শুনে আম্মু-চাচীরা লজ্জ্বায় ওর দিকে তাকায়ইনি। তাহলে তাঁদের মেয়ের সাথে কী কী করেছে তাতো নিশ্চয়ই বলবে। আমি হুট করে ওর মুখ চেপে ধরে বললাম, ‘এসব যদি বাসার কাউকে বলেছো দেখবা আমি কী করি!’
ও অবাক হয়ে বললো, ‘কী করবে?’
‘ ডিভোর্স! ডিভোর্স দেবো। সারাজীবন একলা কাটাবো।’
ক্লেভ চুপ করে গেলো। ওর বালিশের নিচ থেকে আমার শাড়িটা বের করে হাতে ধরিয়ে দিলো। তারপর ওঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ‘টু’ শব্দটিও করলোনা কারণ আমি ওর চোখের কোণে পানি দেখতে পেয়েছি। সিরিয়াস ভাবে নিলো নাকি কথাটা? নিলে নিক। ছাড় দিলে সবাইকে এসব বলে বেড়াবে। এর চেয়ে এটাই ভালো।
৭৮.
গাছের পাতা বেয়ে টুপটাপ করে শিশিরের মতো ঝরে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে মেঘ ডাকছে ক্ষণে ক্ষণে,বাতাস ঠান্ডা। আমি উঠে কাপড়চোপড় ঠিক করে বসলাম। বাতি জ্বালালাম না। বারান্দায় দরজা খুলে দিলাম। একটু পর ওয়াশরুম থেকে ক্লেভ বেরুলো, গা ভেজা। এসেই লাইট জ্বালিয়ে দিলো। আমি ঘরের ভেতর এলে অদ্ভুত চোখে আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। আমি লজ্জ্বা পেতে লাগলাম, অন্ধকারে কথা বলা যতোটা সহজ ছিলো এই মুহূর্তে দশগুণ কঠিন মনে হচ্ছে।
‘ একী চিট!’
‘ ক কী?’
‘ টোমার ঠোঁট কেটে আছে।’
আমি চমকে উঠলাম।
‘ মানে?’
‘ দেকো মিররে!’
আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমার অবস্থা ঠিক ক্লেভের মতোই। রাগ হলো আমার। তেড়ে এসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এসব কী করেছো তুমি? ছিঃ!’
ও অবাক হবার ভান করে বললো, ‘কী করেছি অ্যামি?’
‘ তোমার সাথে কথা বলাই দোষ হয়েছে আমার।’
ক্লেভ এবার রেগে বললো, ‘সব দোষ অ্যামার? নিজে অ্যামাকে কী করেছ?’
ঠিকই তো! ধুর..।
সকাল হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। আমি অনেকক্ষণ মুখ ফুলিয়ে বসে থেকে দরজা খুলে বাইরে এলাম। রান্নাঘরে খাবারদাবার তৈরি হচ্ছে। টুংটাং শব্দ আসছে। আমি ওদিকে গেলাম। ছোটচাচী আর নীরাফুপি পরোটা বেলছেন। আমি কফি বানাতে গরম পানি চুলায় দিলাম। ক্লেভের জন্য!
নীরাফুপি প্রায় আমাদের সমবয়সী। আমার দিকে চোখ পরতেই কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইলো। আমি শাড়ি টেনে গলা ঢেকে নিলেও ঠোঁটের পাশটার কালচে দাগ দেখতে পেয়ে গেলো। নীরাফুপি হেসে বললো, ‘ও আল্লাহ! এসব কী রে চিত্রানি?’
‘ কিছুনা।’
‘ অতো জোড়ে কেউ কামড় দেয় রে? আসলেই! তোর জামাই তো আবার সবার চেয়ে আলাদা। বউকে তো বেশি বেশিই আদর করবে। তবে এসব আমাদের না দেখালেও পারতিস!’
‘ ফুপি!’
‘ কী হ্যাঁ? আরো কিছু দেখাবি নাকি? আর কই কামড় দিলো দেখি তো!’
‘ ছিঃ ছিঃ! তোমার এসব কী অশ্লীল চিন্তাভাবনা। তোমরা যা ভাবছো তেমন কিছুই না।’
ছোটচাচী বললো, ‘হয়েছে! আমাদের আর শিখাতে হবেনা।’
আমি বুঝলাম এদের এসব বলে কাজ নেই। “রিভেঞ্জ অব নেচার” বলে একটা কথা আছেনা, সবার ক্ষেত্রেই সত্যি। সেদিনই তো আপু শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার পর আমি এসব নিয়ে কত হাসাহাসি করেছিলাম, এখন তাই আমাকেও শুনতে হচ্ছে।
‘ কী রে এখানে দাঁড়ায় আছিস কেন? বাবুকে ডেকে নিয়ে আয়।’
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, ‘আম্মু এসব কী বলো? ও কী বাবু? বয়স কত দেখছো?’
‘ যতোই হোক। বেচারা আমার কাছে ছোটই, নিজের ছেলের মতো দেখি। মায়ের কাছে তাঁর ছেলে সবসময় ছোট বাবুটিই থাকে।’
‘ তোমার ছেলে নেই দেখে আমার ওকে তুমি নিজের ছেলে বানিয়ে একেবারে বাবু বানায় দিলা!’
‘ তুই এসব পকরপকর না করে ভাগ। বাবুর জন্য হালুয়া বানিয়েছি!’
‘ আম্মু প্লিজ বাবু বলবা না। আর হালুয়া দাও আমি ঘরে নিয়ে যাচ্ছি, এখানে আসতে পারবেনা!’
আম্মু রেগে বললো, ‘তোর মাথায় কী ঘিলু নাই? নতুন জামাই ঘরে বসে খাবে? গেস্টরা কী বলবে? তোর দাদু, চাচ্চু, আব্বু কী বলবে? ছিহ! এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে? যা এক্ষুনি নিয়ে আয়।’
আমি আর আম্মুর সাথে পারলাম না। অগত্যা ওকে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসতে হলো। ঘর থেকে বের হয়ে মহাখুশি। দাদুর সাথে হাইফাইভ করলো, রাগে গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। দাদু বললো, ‘বাসর রাত কেমন কাটলো বন্ধু?’
‘ অনেক বালো।’
দূর্জয় এসে দৌড়ে ওর কোলে বসলো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমার মুখে কী হয়েছে?’
ক্লেভ আমার দিকে একবার তাকালো। তারপর হেসে বললো, ‘রাটে ককরোচ আমার মুখ খেয়ে নিয়েছে।’
অনেকের রিকুয়েষ্টে একটা রোমান্টিক পর্ব দিলাম। গল্পের প্রয়োজনে ব্যবহৃত কিছু শব্দ করেছি। ভুল ত্রুটি মাফ করবেন, ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত! রি-চেইক হয়নি।
চলবে….ইনশাআল্লাহ!