#ভুলতে_পারিনি_তাকে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_০৪||
আভাস ফোন কানে গুঁজে বিরক্ত হয়ে বললো,
—মা, আমি তোমাকে আগেও বলেছি, এখনো বলছি ; আমি কোনো বিয়ে-টিয়ে করতে পারবো না।
আরিহা খান চোখ মুখ শক্ত করে বললেন,
—আমি নাতাশার বাবাকে কথা দিয়ে ফেলেছি, আভাস।
—কথা যখন আমার বিয়ে নিয়ে দিয়েছো, তখন আমায় একবার জিজ্ঞেস করাটা কি উচিত ছিল না? তোমার সব কথা মেনে চলার চেষ্টা করি বলে তোমার ইচ্ছে আমার ওপর চাপিয়ে দিবে, এমনটা তো নয়?
—আমার কথা তুই কবে শুনলি? দুই ভাই-বোন রাজশাহী চলে গেলি আমি এতো বার বারণ করা সত্ত্বেও। আর বিয়ের কথা বললে বারবার ঐ মরা মেয়েটার কথা তুলিস।
আভাস নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,
—মা, তোমাকে অনেকবার বলেছি, ডোন্ট এড্রেস শ্রুতি এজ আ মরা মেয়ে। ওর স্থানটা আমার কাছে আগে যেরকম ছিল, এখনো সেরকমই আছে আর আজীবন থাকবেও। শুধু শুধু নাতাশার জীবনটা নষ্ট করে দিও না। ও কখনো সুখী হবে না আমার সাথে।
—সুখী হবে কি হবে না, সেটা নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। তোকে নাতাশাকেই বিয়ে করতে হবে, এটাই আমার শেষ কথা। আমার কসম রইলো, তুই এই বিয়েটা করবি।
আভাস পুরোই থম মেরে বসে রইলো। তার মা কেন এভাবে কসম দিল? শ্রুতিকে হারানোর পর থেকে তো সে বিয়ে নিয়ে ভাবা বাদই দিয়েছে। ভালো তো একজনকেই বাসে সে! তাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ভাবাও অসম্ভব, বিয়ে করা তো দূরের কথা! অথচ তার মা তার ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিচ্ছে।
আভাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—আমাকে মেরে ফেললেও আমি বিয়ে করছি না, মা। সো, ডোন্ট ডেয়ার টু ফোর্স মি অ্যাগেইন।
বলেই ফোন কেটে নিজের চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো আভাস। চোখ বুঝতেই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই ষোড়শী মেয়েটার প্রতিচ্ছবি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল তার চোখ দুটো, যেখানে বারবার নিজেকে হারিয়ে ফেলতো। সাদা আর আকাশী রঙের মিশ্রণের স্কুল ড্রেস পরিহিত ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মেয়েটার চোখের মায়ায় প্রথম হারিয়ে ফেলেছিলে নিজেকে। তার সাথে করা খুনশুটি, বাচ্চামো, ঝগড়া আর কাটানো মুহূর্ত গুলো তো চাইলেও ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
এদিকে শ্রুতি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনেছে। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, আভাসের বিয়ে হতে চলেছে। তার মানে আভাস চিরকালের জন্য অন্য কারো হয়ে যাবে। কিন্তু এটা তো হওয়ারই ছিল আর এটাই তো হওয়ার কথা! তার মতো একটা মেয়েকে তো আভাস কোনো দিনই বিয়ে করবে না, করা উচিতও না। তার তো কোনো যোগ্যতাই নেই আভাসের পাশে দাঁড়ানোর মতো! বরং এই মুখশ্রী দেখলেই হয়তো তার আর কোনো মূল্যও থাকবে না!
শ্রুতি আড়াল থেকেই উঁকি দিয়ে আভাসের দিকে তাকালো। এসির নিচে বসে থেকেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে, বাতাসের কারনে চুলগুলো বারবার কপালে গিয়ে পড়ছে। চোখ দুটো বন্ধ থাকায় চোখের ঘন কালো পাপড়ি গুলো এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মুখের ওপর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, লালচে ঠোঁট আর কুৃঁচকানো ভ্রু যুগল দেখে শ্রুতি ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো,
—ধলা বিড়াল।
যদিও শব্দটা শুধু সে নিজেই শুনতে পেয়েছে, তবুও অনেকদিন পর এ নামটা বললো সে। আর দেরী না করে চোখ দুটো মুছে দরজায় নক করে বললো,
—স্যার, মে আই কাম ইন!
আভাস চোখ বন্ধ রেখেই কুঁচকানো কপালে আরো গভীর ভাঁজ ফেলে বললো,
—নো, ইউ মে নট। লীভ মি এলোন। ইউ মে গো নাও।
শ্রুতি একটু অবাক হলেও আর বাক্য ব্যয় না করে সেখান থেকে চলে এলো। যতো যাই হোক, আজ যদি আভাস ওর মুখ দেখতে চাইতো, তখন কী হতো? মনে মনে শুকর গুজার করতে করতে ক্যাম্পাস ত্যাগ করলো শ্রুতি।
এদিকে আভাসের হুট করেই কিছু একটা মনে পড়তেই চোখ খুলে ফেললো।
—মিস অদ্রিতার তো আমার সাথে দেখা করার কথা ছিল! তার মানে একটু আগে ও-ই এসেছিল! আর আমি ওকে চলে যেতে বললাম? ওহহ,শিট!!
নিজের ওপর একরাশ বিরক্তি ও রাগ নিয়ে বাইরে এসে দেখলো, সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস অনেক আগেই শেষ আর সবাই চলেও গেছে। আভাস অনেকটা বিমর্ষ মনে বাইরে তাকালো। রোজ রোজ তো আর কাউকে ডেকে পাঠানো যায় না! নিজের কাছেও খারাপ লাগে আর অন্যান্যরাও সেটা ভালো চোখে দেখবে না। অনেকক্ষণ হা-হুতাশ করার পর কিছু একটা মাথায় আসতেই ছুট লাগালো ডিপার্টমেন্টের হেড আরাফ আহসানের রুমে।
—স্যার, আপনি কি এখন ব্যস্ত আছেন?
আভাসকে এভাবে হন্তদন্ত অবস্থায় নিজের রুমে দেখে আরাফ আহসান বললেন,
—আরে আভাস, প্লিজ কাম ইন মাই বয়। আমার সামনের চেয়ারটাতে বসো।
আভাস চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
—স্যার, আমার কিছু কথা আছে, একটু আর্জেন্ট। আপনার কাছে কি টাইম হবে?
আরাফ আহসান নিজের চশমা খুলে টেবিলে রেখে শান্ত ভঙ্গিতে বললেন,
—তিনদিন পরেই ফ্রেশারস দের জন্য একটা প্রোগ্রাম করা হবে, যেটাকে নবীনবরণ বলে। তার জন্য পার্টিসিপ্যান্টের লিস্ট আমাকে তৈরি করতে হবে। তবে এটার চেয়েও তোমার ব্যাপারটা আমার কাছে বেশি জরুরি। এখন বলো কী বলতে চাও?
আভাস মনে মনে বেশ উশখুশ করছে। যতই হোক সেও এই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছে, আরাফ আহসান তার একজন টিচার। এখন ওনার কাছে একজন মেয়ের সম্পর্কে জানতে চাওয়াটা নিতান্তই লজ্জাজনক ব্যাপার। কিন্তু এটা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। আভাস ইতস্ততভাবে বলে উঠলো,
—স্যার, আই নিড সাম ইনফরমেশন এবাউট আ স্টুডেন্ট।
আরাফ আহসান যে প্রচুর অবাক হয়েছেন, তা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মুখে ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললেন,
—আমি যেকোনো স্টুডেন্ট সম্পর্কেই তোমায় জানাতে পারি শুধু একজনকে ছাড়া।
আভাস ভ্রূকুটি কুঁচকে বললো,
—সেই একজনটা কে, স্যার?
—অদ্রিতা, পুরো নাম অদ্রিতা রুবাইয়াত।
আভাস বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—কিন্তু কেন? আমি যে ওর ব্যাপারেই জানতে চাই।
আরাফ আহসান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
—আম এক্সট্রিমলি সরি, আভাস। আমি চাইলেও কাউকে অদ্রিতার ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। আমি ওয়াদা বদ্ধ।
অদ্রিতার সম্পর্কে জানার ভুতটা আভাসের মাথায় আরো বেশি করে জেঁকে বসেছে। ও কেন স্যারকে ওয়াদা করিয়েছে? একদিকে স্যার কিছু বলছে না, অন্যদিকে আর কোনো উপায়ও খুঁজে পাচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর আভাস আরাফ আহসানের দিকে তাকিয়ে আকুলতার স্বরে বললো,
—আপনাকে কিছু বলতে হবে না আমায়, স্যার। জাস্ট একটা ছোট হেল্প করতে হবে। প্লিজ না করবেন না।
আরাফ আহসান সম্মতি জানিয়ে বললেন,
—তোমাকে আর তন্ময়কে আমি কখনো আলাদা চোখে দেখিনি, সেটা তুমি নিশ্চয়ই জানো। যদি আমার দ্বারা সম্ভব হয়, তবে অবশ্যই করবো।
আভাস উনাকে কী কী করতে হবে সব বুঝিয়ে বললো। সবকিছু শুনে আরাফ আহসান বললেন,
—ঠিক আছে, আমি ম্যানেজ করে দেব। কিন্তু তুমি এসব কেন করতে চাচ্ছো?
আভাস চোখ বন্ধ করে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,
—বলবো, স্যার। সময় আসলে সব জানতে পারবেন।
_____________
—খালামনি, আভাস কী বললো? ও রাজি হয়েছে বিয়েতে, তাই না?
নাতাশার এক্সাইটমেন্ট ফুঁশ করে দেওয়ার জন্য আরিহা খান বিরক্ত হয়ে বললেন,
—কোনো কাজ হয়নি। আভাস বলেছে, ও নাকি মরে গেলেও বিয়ে করতে পারবে না।
নাতাশার মুখ থেকে হাসি উড়ে গেল।
—এখন কী করবে তাহলে, খালামনি?
—জানি না কী করবো? আভাস এখনো ঐ থার্ড ক্লাস মেয়েটাকে নিয়ে পড়ে আছে। মেয়েটা মরে গেল, তাও আমার ছেলেটার মাথা থেকে ওর ভুত নামলো না!
—এক কাজ করো, ওকে রাজশাহী থেকে এখানে আনার ব্যবস্থা করো।
—আসবে না, আমার ছেলে আমি চিনি। একসপ্তাহও হয়নি ও গেছে, এখনি আসবে না। তুই এক কাজ কর।
—কী?
—আভাসের সাথে তোকে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। ওর মন মতো করে নিজেকে গড়ে তোল। ওর মনে জায়গা করে নে।
নাতাশা কিছুক্ষণ আরিহা খানের দিকে তাকিয়ে থেকে ওনার কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করলো।
________________
তন্ময় আর আরাফ আহসান ডাইনিং টেবিলে বসে বসে ডিনার করছে। তানিয়া আহসান তাদের খাবার সার্ভ করছেন আর এটা-সেটা বলছেন। হঠাৎ করেই তন্ময়ের ঘর থেকে ওর ফোন বাজার শব্দ আসতে লাগলো। ফোনের রিংটোন শুনেই তন্ময়ের নাক-মুখ কুঁচকে এলো। বিরক্তি নিয়ে খাবার চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে আর মনে মনে স্নেহার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে।
—তন্ময় তোমার ফোন বাজছে। এনে দিবো?
তন্ময় হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
—না, না, আনতে হবে না, মা। আমি খাওয়া শেষে কথা বলে নেব।
তানিয়া আহসান আর কথা বাড়ালেন না। আর আরাফ একদম চুপচাপ খাবার খাচ্ছেন। এদিকে তন্ময়ের ফোন ফ্রিকোয়েন্টলি বেজেই চলেছে আর তন্ময়ও যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব খাবার শেষ করার চেষ্টা করছে। আরাফ আহসান থমথমে গলায় বলে উঠলেন,
—হয়তো কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কল এসেছে। আই থিংক ইউ শ্যুড পিক আপ দ্য ফোন ফার্স্ট।
—না, বাবা। তেমন আর্জেন্ট কল আসার কথা নয়। আর আমার খাওয়াও শেষ প্রায়।
তন্ময় দ্রুত খাবার ফিনিশ করে নিজের রুমে গিয়ে ফোন নিয়ে দেখলো স্নেহার নাম্বার থেকে সাতটা মিসড কল এসেছে। তন্ময় কল ব্যাক করতেই একটা রিং হওয়ার সাথে সাথে স্নেহা রিসিভ করলো।
তন্ময় চোয়াল শক্ত করে বললো,
—থাপ্পড় চিনো? তোমাকে সামনে পেলে যে এখন আমি কী করতাম ইউ ক্যান নেভার ইম্যাজিন, ইডিয়েট!
স্নেহা কাচুমাচু হয়ে বললো,
—স্যার, এতো রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি তো…….
—জাস্ট শাট আপ। এতোবার কেউ কাউকে কল দেয়? আমি নিশ্চয়ই ব্যস্ত আছি বলেই তোমার কল রিসিভ করছি না, এটা কি তোমার বোঝা উচিত ছিল না? আমি এই সময়ে ডিনার করি, আর বাবা-মা ও সাথে থাকে। তাদের সামনে কীভাবে আমি তোমার সাথে কথা বলবো?
—কীভাবে আবার বলবেন? ওনারা তো নিজেরাই আমার আর আপনার………
বলেই জিহ্বায় কামড় দিলো। ইশশ, কী থেকে কী বলছিলো? ভাবতেই লজ্জায় লাল নীল হতে লাগলো স্নেহা। এদিকে তন্ময় স্নেহার কথা শুনে মনে মনে হাসছে।
—কী যেন বলছিলে? তোমার আর আমার কী?
স্নেহা আমতা আমতা করে বললো,
—কিছু না, কিছু না।
তন্ময় বিরক্ত হয়ে বললো,
—আচ্ছা, তুমি কতটুকু জানো আমার আর তোমার সম্পর্ক নিয়ে?
—আপনি আমার শিক্ষক আর আমি আপনার ছাত্রী।
তন্ময় রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—স্টুপিড।
বলেই খট করে ফোন কেটে দিলো। সেই কবে থেকে ওর সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে রয়েছে আর এই মেয়ে কিনা বলছে শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্ক! ভাবতে ভাবতেই আবার স্নেহার কল চলে এসেছে। এখন না ধরেও উপায় নেই, নয়তো কলের ওপর কল দিতে থাকবে। রিসিভ করতেই স্নেহা বললো,
—আপনি ফোন কেটে দিলেন কেন? আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।
—তা নয়তো কী করবো? তুমি নিজের বাগদত্তাকে বলছো তোমার শুধু টিচার হই আমি। ইজ’ন্ট ইট আ রিডিকিউলাস ম্যাটার?
—শুনেন, আমি জানি আপনি অনেক হ্যান্ডসাম বলে আপনার ভাব বেশি। তবে ভুলে যাবেন না, আমার ভাইয়া আপনার থেকে বেশি হ্যান্ডসাম।
তন্ময় বিড়বিড় করে বললো,
—সব দোষ তো আভাসেরই। ওর সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার সুবাদেই তোমায় দেখেছিলাম, আর সেজন্য আজ আফসোস!!!
স্নেহা শুনতে না পেয়ে বললো,
—কী বললেন? শুনতে পাইনি।
—বললাম যে, তুমি কথা অন্য দিকে টানছো কেন? আমি জানি, আভাস অনেক হ্যান্ডসাম। সেটা তোমাকে বলতে হবে না। আমার ফ্রেন্ড কেমন তা আমার জানা আছে। আর তোমাকে তো আমি কাল দেখে নিচ্ছি!
-চলবে……………
Written by MAHFUZA AKTER