ভুলবশত প্রেম পর্ব-২৩+২৪

0
590

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

২৩

কিছুক্ষণের মাঝেই রাতের খাবারের জন্য নদী রুমে এসে আমাকে নিচে নিয়ে এলো। মাঝের একটি চেয়ারে আমাকে বসিয়ে সেও আমার পাশে বসে পড়লো। আমার পাশে এবং সামনে কুহু, দাদি ও আন্টী বসে আছেন এবং আমার একদম সামনাসামনি বসে আছেন আদ্রিশ। উনাকে দেখে পুনরায় আমার মাঝে অস্বস্তিকর অনুভূতির উদয় হলো। কেনো যেনো, আজ উনার বাড়িতে এসে উনার প্রতি এ জড়তা ভাবটা তীব্রভাবে জন্ম নিয়েছে। যদিও এতোদিনেও এ জড়তা ভাবটা ছিলো। তবে তীব্র নয়।

আমি সুক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করছি আদ্রিশ আমার দিকে চেয়ে আছেন। তবে একনাগারে নয়। সালাদ চিবুতে চিবুতে এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে আছেন যে হুট করে এই বিষয়টা কেউ ধরে উঠতে পারবে না। উনার এ লুকোচুরি চাহনি দেখে আমার মন বলছে সালাদের মতোই উনাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। কিন্তু এ ইচ্ছেটা অপূরণীয় বলে শীঘ্রই এ ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিতে হলো। অতঃপর আমি স্বগোতক্তি করে বললাম,
” আজ আমার রাতের খাবার গেলো।”

কিছুক্ষণ পর সার্ভেন্ট এসে সবাইকে খাবার সার্ভ করে চলে গেলো। সবাই খাওয়া শুরু করলেও আমি শুরু করতে পারলাম না৷ কারণ আদ্রিশ সামনে থাকায় খাবার খেতে বেশ অস্বস্তি লাগছে। ফলস্বরূপ লোক দেখানোর জন্য এক গাল ভাত মুখে তুলে ধীরেসুস্থে চিবুতে লাগলাম। এদিকে সবাই তৃপ্তি সহকারে আরামে খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কণ্ঠনালী দিয়ে খাবার নামছে না। এরই মাঝে হঠাৎ আন্টী আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ব্যাপার মিম? খাবার কি ভালো হয়নি? খাচ্ছো না কেনো?”

আন্টীর কথার প্রত্যুত্তরস্বরূপ আমি তৎক্ষনাৎ জোরপূর্বক হেসে বললাম,
” না না আন্টী। খাবার খুব ভালো হয়েছে। আমি খাচ্ছি তো। ”
এই বলে পুনরায় আরেক গাল ভাত মুখে তুলে নিয়ে চিবুতে লাগলাম আমি। পাশাপাশি আদ্রিশকে সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। কিন্তু এই পর্যবেক্ষণ কারণটা সঠিক জানা নেই। হয়তো আমার দিকে ফের উনি তাকাচ্ছেন কি না তা জানার জন্য দেখছি উনাকে!
হঠাৎ খাবার মাঝেই আদ্রিশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। খাবার প্লেট হাতে নিয়ে ড্রইং রুমের সোফার দিকে যেতে যেতে বললেন,
” তোমরা এখানে খাও। আমি সোফায় বসে খাচ্ছি।”

আদ্রিশের এ কাজে আমি ভীষণ অবাক হলাম। কিন্তু অন্যান্যদের চেহারা দেখে মনে হলো, তারা বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। আন্টী খেতে খেতে আদ্রিশকে বললেন,
” কিছু লাগলে বলিস। নদীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিবো।”

আদ্রিশ প্রত্যুত্তর করলেন না। বরং সোফায় বসে আমাদের বিপরীত দিকে মুখ করে খাবার খেতে লাগলেন। এদিকে আমার সামনে থেকে আদ্রিশ চলে যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি৷ ফলে স্বাভাবিকভাবে তৃপ্তিসহকারে খাবার খাওয়া শুরু করলাম আমি।

রাতের খাবার শেষ হওয়ার আধঘণ্টার মাঝেই আদ্রিশ আমাকে ও কুহুকে ইমাদ ভাইয়াদের বাসায় রেখে এলেন। পথিমধ্যে আমার এবং আদ্রিশের মাঝে কোনোরূপ কথাবার্তা হয়নি। হয়তো কুহু আছে বলে। তবে আমি নিশ্চিত, আজ কুহু না থাকলে আদ্রিশ নিশ্চয়ই আগ বাড়িয়ে কথা বলতেন। এ যেনো উনার এক চিরাচরিত স্বভাব, যা এ কয়দিনেই আমি বুঝতে পেরেছি। আর এও লক্ষ্য করেছি যে, উনি সবার সামনে আমার সাথে খুব একটা কথা বলেন না। কিন্তু আমাদের মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি উপস্থিত না থাকলে উনার মুখ দিয়ে কথার ফুলঝুরি বেরুতে থাকে। আসলেই উনি অদ্ভুত নামের কিম্ভূতকিমাকার একটা মানুষ।

——–

গত পরশু আদ্রিশদের বাসা থেকে ডিনার করে এসে যে ঘুম দিয়েছিলাম, সে ঘুম আমার ভাঙে পরেরদিন সকাল সাড়ে নয়টায়। ফলে সকালের ক্লাসটাও মিস যায়। অবশ্য পরে জানতে পারি কলেজে একটা পরীক্ষার জন্য ক্লাস সাসপেন্ড রাখা হয়েছে। ব্যস আমার খুশি আর দেখে কে! ক্লাস বন্ধ থাকার ফায়দা লুটে গতকাল প্রায় সারাটাদিন ঘুমু ঘুমু ভাবেই কাটিয়েছি আমি। তবে ইমাদ ভাইয়া না থাকায় গতকাল আমি আপুর রুমে শিফট হয়েছি এবং আপুর রুমেই আমি সারা বিকেল সন্ধ্যা শুইয়ে কাটিয়েছি। অতঃপর গতকালের আরামময় আরামের খেসারত আজ কলেজে রেগুলার আইটেম ও পেন্ডিং আইটেম দিয়ে চুকাতে হয়েছে। ক্লাস, আইটেম, ওয়ার্ড, সব মিলে আমার অবস্থা আজ বেগতিক। ক্লান্তিতে দু চোখ ভেঙে এরূপ ঘুম আসছে যে মনে হচ্ছে এখনই রাস্তায় ঘুমে ঢলে পড়বো আমি। অথচ আমি গতকাল ঘুমিয়েই কাটিয়েছি!

কলেজ হতে ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর নিয়ে বাড়ির গেটে ঢুকতেই দারোয়ান চাচা এসে আমার হাতে চিঠিস্বরূপ কিছু ধরিয়ে দিলেন। চুপিসারে বললেন,
” আপা, এটা শুধু আপনাকেই দিতে বলেছে। ”

দারোয়ান চাচার কথা শুনে আমি ভ্রু কুঁচকে খামের দিকে তাকালাম। এপাশ ওপাশ উল্টে প্রেরকের নাম না দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
” কে পাঠিয়েছে এটা?”

দারোয়ান চাচা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
” সে বলা নিষেধ। ”
এই বলে উনি সিকিউরিটি রুম থেকে মাধবীলতা ফুলের এক গুচ্ছ এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
” সে বলেছে, এই ফুল আপনাকে দিলেই আপনি তাকে চিনে যাবেন। ”

দারোয়ান চাচার কথা শোনামাত্রই আমি চট করে উপলব্ধি করলাম, চিঠিটি আর কেউ নয় বরং আদ্রিশ পাঠিয়েছেন। এতে আমি ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম৷ দারোয়ান চাচা যে আদ্রিশের এ কাণ্ডে ভারী মজা পাচ্ছেন তা উনার দাঁত কেলানো হাসি দেখেই টের পেলাম। আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চিঠি নিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে গেস্টরুমে চলে এলাম। কারণ আদ্রিশ হতে প্রাপ্ত এই চিঠি নামক ভয়ংকর কাগজখানা কোনোমতেই আপুর চোখের সামনে আনা যাবে না। এজন্যই নিরাপদ রুম হিসেবে গেস্টরুমে চিঠিটি নিয়ে এলাম।
রুমে এসে দ্রুত কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে চিঠিটা নিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়তেই এই চিঠি নামক বস্তুটি দেখে আমার বুকের ভেতরে হৃদপিণ্ডটা দ্রিম দ্রিম করে বাজতে শুরু করলো। এক হাতে চিঠির খাম, অপর হাতে মাধবীলতার গুচ্ছ। নির্ভাবনায় আমি চিঠির খামের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। অতঃপর জিহ্বা দ্বারা শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করলাম। ধীরেসুস্থে মাধবীলতার গুচ্ছ পাশে রেখে চিঠির খাম খুলে চিঠিটা বের করলাম। অতঃপর কাগজের ভাঁজ খুলতেই আমার দৃষ্টি গিয়ে আটকালো সম্বোধনে। ‘মাধবীলতা’! নতুন এ সম্বোধনে আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম। তবে এ বিস্ময়ের মাত্রা কিছু কাটিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করলাম,
” প্রিয় মাধবীলতা,
এ সম্বোধনে কিছুটা অবাক হলেও এটা জানো যে, এ সম্বোধনটা আমি করেছি এবং এই ‘আমি’টা কে সেটাও জানো। তবে হ্যাঁ, এ সম্বোধনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমার জন্য এ সম্বোধনটা কিন্তু গত পরশুই উদ্ভাবন করেছি আমি। সে যাই হোক, আশা করি, আপনি আমার এ পত্র এবং পত্রের সম্বোধনটা মন দিয়ে কবুল করেছেন। অবশ্য কবুল না করেও উপায় নেই তোমার কাছে। তোমায় কিন্তু এ সম্বোধনে আমি সবসময় ডাকবো না। নির্দিষ্ট কিছু সময়ে, কিছু সুযোগ বুঝে ডাকবো।এবার আসি মূল কথায়।

এই চিঠি লেখালেখি কিন্তু আমার দ্বারা খুব একটা হয় না। ছোট বেলায় সেই বাংলা দ্বিতীয় পত্রের চিঠি লিখতে গিয়ে ভীষণ রাগ লাগতো। মন চাইতো, এই ‘চিঠি লেখা’ উদ্ভাবন করা লোকটির মাথা ফাটাই। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, সেই লোকটি শতবার ধন্যবাদ বলে আসি। কারণ, এ বয়সে একটি মেয়েকে চিঠি লেখার মতো মজার বিষয় আর দ্বিতীয়টি নেই। এ চিঠি লেখার আইডিয়া কিন্তু হুট করে মাথায় আসেনি। মনে আছে, সেদিন কামাল আংকেলের কথা? ব্যস, সেই সূত্র ধরেই আমার চিঠি লেখা।
জানো মাধবীলতা? তোমায় এ নাম দেয়ার কি কারণ? আমার মনে হয় তুমি জানো না। জানবেই বা কি করে? আচ্ছা আমিই বলি। গত পরশু যখন আমার অনুপস্থিতিতে আমার ব্যালকনিতে এসে মাধবীলতা দেখছিলে তখন আমি নিচেই দাঁড়িয়েছিলাম। সে সময় মাত্রই বাড়িতে পা রেখেছি। অমনি আমার ব্যালকনির দিকে দৃষ্টি চলে গেলো। সেখানে দেখলাম, মাধবীলতা ফুলের প্রেমে পড়ে যাওয়া এক যুবতীকে। যার চোখে সে মুহূর্তে বিরাজ করছিলো, অপার মুগ্ধতা, অপার বিস্ময়তা। সে কি এক চাহনি! যেনো রাজ্যের সৌন্দর্য এবং বিস্ময় সে মুহূর্তেই ঐ মাধবীলতার মাঝেই বিরাজ করছিলো। এরপর বারংবার সেই যুবতীর দৃষ্টি মাধবীলতার কাছে ছুটতে যাওয়া দেখলাম। অতঃপর তার হাতে যখন মাধবীলতার গুচ্ছ এলো তখন তার খুশি চোখে পড়ার মতো ছিলো। এরপর সেই যুবতী কি করলো জানো? সেই যুবতী চুলের বাঁধন খুলে মাধবীলতার গুচ্ছ কানের পিছনে গুঁজে নিলো। তার চেহারায় দেখা মিললো অস্পৃশ্য এক খুশি। সাথে তার মুখশ্রী ভরে উঠলো এক অপরূপ স্নিগ্ধতায়। মন চাইছিলো সে মুহূর্তকে থমকে দেই। মন চাইছিলো সেই যুবতীর অদ্ভুত লালিমায় মাখা চেহারাখানা ক্যামেরায় বন্ধি করে রাখি এবং আমি করলামও তাই। আড়ালে সেই যুবতীর স্নিগ্ধ রূপের একটা স্থির দৃশ্য তুলে রাখলাম। তবে অনুমতিহীন এ কাজের জন্য আমি সেই যুবতীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। শুনছো, মাধবীলতা নামক যুবতীটা? আমায় ক্ষমা করে দিও কিন্তু। ক্ষমা করেছো তো? অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু। ”

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতেঃসারা মেহেক

২৪

আমি কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ দৃষ্টিতে চিঠির পানে চেয়ে রইলাম। চিঠিতে লেখা প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্য আমাকে ভাবনার অতল সাগরে ডুবিয়ে দিলো। সাথে অনুভব করছি, আমার হৃদপিণ্ড পুনরায় তার স্পন্দন গতি বাড়িয়ে তুলছে। আমার কানজোড়া লজ্জায় গরম হয়ে আসছে।
হঠাৎ আপুর ডাক শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম। তড়িঘড়ি করে চিঠিটা ভাঁজ করে ফুলসমেত ব্যাগের মধ্যে ডুকিয়ে গেস্টরুম হতে বেরিয়ে এলাম। রুম হতে বেরুতেই আপুর মুখোমুখি পড়ে গেলাম। আপু আমায় দেখে জিজ্ঞেস করলো,
” গেস্টরুমে কি করছিস তুই? আমি কখন থেকে তোর জন্য ওয়েট করছি!”

আপুর প্রশ্নে আমি শুকনো ঢোক গিলো বললাম,
” না মানে ঐ আর কি আমার একটা জিনিস রয়ে গিয়েছিলো। সেটাই নিতে এসেছিলাম। তুমি ডাইনিং এ যাও আপু। আমি ফ্রেশ হয়ে চলে আসছি।”
এই বলে আপুকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আপুর রুমে গেলাম।

——

বিকেলের দিকে আমার ফোনে হঠাৎ ইমাদ ভাইয়ার কল দেখে খানিক ঘাবড়ে গেলাম। মনের দূর প্রান্তে এক অশনিসংকেতের দেখা মিললো। ফলে কিছুটা ভীতি নিয়ে ইমাদ ভাইয়ার কল রিসিভ করেই সালাম দিলাম। ওপাশে ইমাদ ভাইয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে সালামের জবাব দিয়ে বললো,
” কেমন আছো মিম?”

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন ভাইয়া? ”

” আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। ”
ওপাশে ইমাদ ভাইয়ার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। অতঃপর জিজ্ঞেস করলাম,
” কোনো সমস্যা ইমাদ ভাইয়া? হঠাৎ আমার ফোনে কল করলেন যে?”

ওপাশে এবার ইমাদ ভাইয়ার কণ্ঠস্বর কিছুটা বদলে গেলো। পূর্বের তুলনায় খানিক চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
” তোমার আপু কোথায়?”

” আপু তো ঘুমাচ্ছে ভাইয়া। আপুকে ফোন দিবো?”

” না না। ওকে ফোন দেবার দরকার নেই। তোমার সাথেই কথা বলার জন্য কল করেছিলাম আমি। ”

” হ্যাঁ বলুন ভাইয়া। কি বলবেন।”

” আচ্ছা? নাফিসার ফোনে বা তোমার ফোনে কোনো আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে এ পর্যন্ত? সোজা কথা বললে, রোহান কি আবারো কল করেছে নাফিসাকে?”

এতো দিনে রোহান ভাইয়ার কথা, তার কর্মকাণ্ডের কথা বেমালুম ভুলে বসেছিলাম আমি। আচমকা ইমাদ ভাইয়ার মুখে উনার নাম শুনে পুনরায় ভয় জেঁকে ধরলো আমায়। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ইমাদ ভাইয়াকে বললাম,
” না ভাইয়া। রোহান ভাইয়ার কোনো কল আসেনি। আপু তো আমাকে এ বিষয়ে কিছু বললো না। তাহলে হয়তো আসেনি। ”

” নাফিসা এ ব্যাপারটা লুকাতেও পারে মিম।”

” না ইমাদ ভাইয়া। এমন কিছুই হয়নি আমি নিশ্চিত। আপুর ফোনো রোহান ভাইয়ার কল আসলেও আপুর চেহারা সুরত দেখে একদম ধরে ফেলতাম আমি। কিন্তু আপু এখনও স্বাভাবিক আছে।”

” তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে ওকে নিয়ে ভয় হয়। যদি হঠাৎ একদিন রোহান কিছু করে বসে?”

ইমাদ ভাইয়ার এ প্রশ্ন আমার মনেও জাগ্রত হলো। তবে নিজেকে এবং ইমাদ ভাইয়াকে সান্ত্বনা দিতে বললাম,
” কিচ্ছু করবে না রোহান ভাইয়া। এতোদিনে এমনকি বিয়ের দিনেও যেহেতু এমন কিছু করেনি সেহেতু আর ভয় নেই। ”

” এতোদিনে কিছু করেনি এর মানে এ নয় যে, সামনেও সে কিছু করবে না। মনে রেখো, ঝড় আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও কিন্তু সবকিছু শান্ত স্বাভাবিক থাকে। ”

ইমাদ ভাইয়ার কথা আমার মাঝে আরো ভীতির সৃষ্টি করলো। আমি শুকনো একটা ঢোক বললাম,
” আপনি চিন্তা করবেন না ভাইয়া। কিছুই হবে না আপুর। আর বাসার সিকিউরিটি তো বাড়িয়ে রেখেছেন তো চিন্তা কিসে?”

” জানি না মিম। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। ভয় হয়, হঠাৎ বড় কিছু না হয়ে যায়। ”

” আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন ভাইয়া। রিল্যাক্স হওয়ার চেষ্টা করুন।”

ওপাশে ইমাদ ভাইয়া প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” আচ্ছা রাখছি মিম। পরে কথা হবে। ”

” আচ্ছা ভাইয়া। ”
ওপাশে ইমাদ ভাইয়ার কল কাটার শব্দ শুনে আমি ফোন রেখে দিলাম। যদিও আমি ইমাদ ভাইয়াকে চিন্তা না করার কথা বলে সান্ত্বনা দিলাম কিন্তু আমি নিজেকে শান্ত করতে পারলাম না। সত্যিই তো, রোহান ভাইয়া হুট করে এতো নিশ্চুপ হয়ে যাবেন তা ভাবিনি আমি। বিয়ের দিন উনি যেভাবে আপুকে অনুরোধ করেছিলো তাতে উনাকে নির্ঘাত পাগলা প্রেমিক বলে মনে হয়েছিলো। আর শেষ কথায় যে হুমকি দিয়েছিলেন তাতে বেশ জোর ছিলো। মনে হয়েছিলো হয়তো সত্যিই উনি কিছু করে বসবেন৷ কিন্তু উনি সেদিন কিছু করেননি। এমনকি এখনো পর্যন্ত কিছু করেননি। আর আপুকেও কল করেননি৷ তাহলে ইমাদ ভাইয়ার কথামতো, এটি কি ঝড় আসার পূর্বের সতর্ক সংকেত? না কি আমরাই অতিরিক্ত ভাবছি?

—-

ঘড়িতে এখন সময় রাত বারোটা। আজ রাতের মেঘমুক্ত আকাশে অর্ধ চন্দ্রাকৃতির চাঁদ মামার উদয় হয়েছে। পূর্ণিমার মতো পুরো পৃথিবীতে এতো আলো না ছড়ালেও আজ তার আলো বিলিয়ে দেওয়ার মাত্রা কিছু কম নয়৷ আগামীকালের অর্ধেক পড়া শেষ করে রুমের লাইট নিভিয়ে আপুর রুমের ব্যালকনিতে একা বসে আছি আমি। আপু ঘুমের ওষুধ খেয়ে আজ গভীর ঘুমে মগ্ন। রাতের খাবারের কিছু পরেই হঠাৎ আপুর প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা হওয়ায় আপু আজ তুলনামূলক জলদিই ঘুমিয়ে পড়ে। এজন্য এ সময়ে আজ একা একা সময় কাটাচ্ছি।

গ্রিলবিহীন ব্যালকনিতে বসে আজ রাতের পরিবেশটা পুরোপুরি উপভোগ করতেই রুমের লাইট বন্ধ করেছিলাম আমি। কিন্তু ইমাদ ভাইয়াদের গার্ডেনের আলোয় চারপাশ পুরোপুরি অন্ধকার হতে পারেনি। এ নিয়ে আজকে বিদ্যুতের উপর ভীষণ রাগ হলো। একে তো আজকাল প্রয়োজনে সে গায়েব হয় না। উপরন্তু কালেভদ্রে যখন সে গায়েব হয় তখন নিজের পরিবর্তে জেনারেটরকে তার দায়িত্ব দিয়ে যায়। ফলে ভীষণ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আজকাল চাঁদের আলোয় আলোকিত শহরটা উপভোগ করতে পারি না। উফ, কি ঝামেলা!

কানে ইয়ারফোন গুঁজে ব্যালকনিতে বসে মৃদু তরঙ্গের গান শুনছি আমি। এদিকে মানুষের গানের পাশাপাশি নিশুতি রাতের পরিবেশের ঝিঁঝি পোকার গানও শুনছি আমি। দুটো মিলে রাতের গানের পূর্ণাঙ্গ একটি সংমিশ্রণ তৈরী হয়েছে। এ নিশুতি রাতের পরিবেশটা আরো উপভোগ্য করে তুলতে ঘাটতি আছে শুধু বিদ্যুৎ মহাশয়ের গায়েব হওয়ার। অবশ্য সে গায়েব হয়েই বা কি লাভ। নিজের জায়গায় তো তখন জেনারেটর কে বসিয়ে রেখে যায়।
নিজের সাথে নিজেই কথা বলতে বলতে আচমকা ধুপ করে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো। তাহলে আমরা মন মোতাবেক অবশেষে বিদ্যুৎ মহাশয় গেলো! ইশ! কিন্তু খুশি হয়ে কি লাভ? এখনই তো ঘটর ঘটর শব্দ করতে করতে জেনারেটর জ্বলে উঠবে।
কিন্তু পাঁচ মিনিট পার হওয়ার পরেও জেনারটের জ্বলে উঠলো না৷ তাহলে কি আজ জেনারেটর নষ্ট হয়ে গেলো! বাহ, আজ দেখি সব আমার মন মতো হচ্ছে! সব নিজের ভাবনা অনুযায়ী চলতে দেখে ভীষণ খুশি খুশি লাগলো মনের মাঝে। ফলে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে চোখজোড়া বন্ধ করে গানের তালে তালে মৃদু গতিতে ব্যালকনির এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে হাঁটতে লাগলাম। আহ, এ পরিবেশ উপভোগ করার যেনো আলাদা এক মজাই আছে।

ধীর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে ব্যালকনির এক কোনে এসে আচমকা কারোর সাথে ধাক্কা লাগতেই আমি চোখ খুললাম। ভাবলাম হয়তো আপু জেগে গিয়েছে। কিন্তু ব্যালকনির সাথে লাগোয়া সুউচ্চ ঝাউ গাছের আঁধারে সামনের ব্যক্তিটির অবয়ব এবং পুরুষালি পারফিউমের ঘ্রাণে চট করে বুঝে ফেললাম সামনের ব্যক্তিটি আপু নয়। বরং অন্য কেউ। ব্যালকনির এ প্রান্তে হঠাৎ উদয় হওয়া আগন্তুক পুরুষ মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে ভয়ে আমার ভেতরটা একদম শুকিয়ে এলো। শুকনো ঢোক গিলতেও গলার মাঝে ব্যাথা অনুভব করলাম। আচমকা উদিত এ ব্যক্তিটি কে তা ভাববার পূর্বেই ভয়ে আমার গলা দিয়ে চিৎকার স্বরূপ আওয়াজ বেরুতে চাইলো। কিন্তু এর পূর্বেই আচমকা সেই আগন্তুক আমার কাছে এসে আমার মুখ চেপে ধরলো। ফলে কয়েক কদম পিছিয়ে এলাম আমি। এতে সেই আগন্তুকও আমার সাথে পিছিয়ে এলো। ব্যালকনির এ অংশের আঁধো আলোকিত পরিবেশে আগন্তুকের চেহারা দেখে বিস্ময় এবং ভয়ে আমার চোখজোড়া কোটর হতে বেরিয়ে যাবার উপক্রম হলো।
®সারা মেহেক(নতুন পেজে আগামী ১২/১৩/১৪ তারিখ থেকে ‘নব্য দিনের সূচনা’র দ্বিতীয় খণ্ড দিব। গল্প সবাই নতুন পেজে লাইক দিয়ে রাখুন। নতুন পেজ : সারা মেহেক। গ্রুপ: সারা’র গল্পকুঞ্জ

#চলবে