ভুলবশত প্রেম পর্ব-৪৭+৪৮

0
461

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৪৭

তিনদিনের ছুটি কাটাতে আমরা গন্তব্য হিসেবে ঠিক করলাম সিলেট শহরকে। এ সিদ্ধান্ত অবশ্য আগেই নিয়ে নিয়েছিলেন ইমাদ ভাইয়া ও আদ্রিশ। আমাকে জানানো হয়েছে গতকাল রাতে। গতকাল ক্লান্ত থাকায় ব্যাগপত্র গোছানোর সময় পাইনি৷ এজন্য আজ সকাল থেকেই সব গোছগাছ শুরু করলাম।
সকালের নাস্তা শেষে আমি ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম। এদিকে আদ্রিশ যে তিনদিন শহরে থাকবেন না সে কারণে ল্যাবের কিছু কাজ এক সহকর্মী জুনিয়রকে বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে সেই এক ঘণ্টা যাবত অনবরত ফোনে লেগে আছেন উনি।

আমার জামাকাপড় ব্যাগে ভরে আদ্রিশের জামাকাপড় গুছাতে শুরু করলাম। আলমারি থেকে উনার টিশার্ট, প্যান্ট নিয়ে নিয়ে ব্যাগে ঢুকালাম। আলমারি থেকে গুছানো একটি শার্ট উঠিয়ে নিতেই শার্টের নিচে উনার পিস্তল আবিষ্কার করলাম আমি। আচমকা পিস্তলটি দেখে খানিক চমকিত হলেও পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলাম৷ কারণ আদ্রিশের কাছে পিস্তল থাকার ব্যাপারটি এখন স্বাভাবিক। তবে সেদিন উনার কাছে পিস্তলটি না দেখলে আজকে এটি স্বাভাবিক মনে হতো না আমার কাছে৷ সেদিন ঘটনাস্থলে আদ্রিশের কাছে পিস্তল দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। তৎক্ষনাৎ মস্তিষ্কে প্রশ্ন খেলে গিয়েছিলো, আদ্রিশের কাছে পিস্তল এলো কি করে? কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে সেদিন প্রশ্নটা করা হয়ে উঠেনি এবং এ তিনদিনেও ছোট বড় ব্যস্ততার বেড়াজালে উনাকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে আজ যেহেতু সময় ও সুযোগ উভয়ই আছে সেহেতু উনাকে এ ব্যাপারে আজ জিজ্ঞেস করতেই হবে।
আমি মন্থর গতিতে পিস্তলটা হাতে নিলাম। জিনিসটা দেখতে ছোট হলেও ওজনে একটু ভারী। এতোদিনে সিনেমায় দেখে আসা পিস্তল আজ সচক্ষে নিজ হাতে ছু্ঁয়ে দেখলাম। জীবনে প্রথম আসল পিস্তল হাতে নিয়ে অকারণেই একটু ভয়জনক অনুভূতি হলো। কিয়ৎক্ষণ পিস্তলটি এদিকে ওদিক ঘুরিয়ে দেখলাম৷ অতঃপর সেটি নিয়ে ব্যালকনিতে গেলাম। আদ্রিশ পুরো ব্যালকনি পায়চারি করে কথা বলছেন। হঠাৎ পিস্তলসহ আমাকে ব্যালকনিতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন উনি। মুহূর্তেই উনায় চেহারায় ক্ষীণ আঁতকে উঠা ভাব বিরাজ করলো। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে নিলেই উনি ফোন কানে নিয়ে ইশারায় আমাকে বাধা দিলেন। আমিও আগ বাড়িয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
দু মিনিটের মাঝেই আদ্রিশ ফোন রেখে দ্রুত আমার হাত থেকে পিস্তল নিয়ে নিলেন। প্রায় ধমকের সুরে বললেন,
” এটা বের করেছো কেনো?”

আমি সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনার কাছে পিস্তল এলো কি করে?”

আমার প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে আদ্রিশ পিস্তলটি নিয়ে আলমারিতে রাখলেন। অতঃপর আমাকে রুমে এনে নরম গলায় বললেন,
” তুমি প্রথম যেদিন আমার রুমে এসেছিলে সেদিন দেয়ালে ঐ শ্যুটিং ফেডারেশনের ঐ সার্টিফিকেটটা দেখোনি?”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে চাইলাম। দেয়ালের সার্টিফিকেট লাগানো ঐ অংশের নিচের দিকে তাকালাম। আমি সার্টিফিকেটটা খুঁজে পেয়েছি বুঝতে পেরে আদ্রিশ মৃদু শব্দে হেসে বললেন,
” সার্টিফিকেটটা হাওয়ায় উড়ে আসেনি মিশমিশ। সার্টিফিকেটটা পেয়েছি এই পিস্তল চালানোর উপর ভিত্তি করেই।”

আমি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” এর মানে আপনি পিস্তল চালাতে পারেন!”

” অবশ্যই এবং আমি এতোটুকু কনফিডেন্ট যে আমার টার্গেট কখনো মিস হয় না। একদম সঠিক নিশানায় গিয়ে গুলি লাগে। ”

আমি আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো৷ কিন্তু এর পূর্বেই আমার ফোনে আপুর নাম্বার দিয়ে কল এলো। আমি কল রিসিভ করতেই আপু স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
” রেডি হয়েছিস মিম?”

” উঁহু। এখনো না। তোমরা?”

” রেডি হবো। ইমাদ বলছে আর আধ ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়বে। না হলে সিলেটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। তোদের ব্যাগ গুছানো শেষ? ”

” হ্যাঁ। আচ্ছা আমরা তাহলে রেডি হচ্ছি।”

” আচ্ছা। রেডি হয়ে কল দিস।”

আপু ওপাশ থেকে কল কেটে দেওয়ার পর আদ্রিশকে বললাম,
” আপু রেডি হতে বলেছে। আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই বের হবে বলে। ”

আদ্রিশ আলমারি থেকে একটা টিশার্ট ও জিন্সের প্যান্ট বের করে বললেন,
” আচ্ছা। রেডি হয়ে নাও তুমি। আমিও রেডি হয়ে নেই। ”
এই বলে আদ্রিশ ওয়াশরুমে চলে গেলেন৷ আর আমি বাকি জামাকাপড় গুছাতে লাগলাম।

.

হঠাৎ ফোনের রিংটোনে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। কিন্তু প্রথম দফায় কেউ কল রিসিভ করলো না৷ আমি চোখ মেলে সামনে তাকালাম। আদ্রিশ ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করছে আর ইমাদ ভাইয়া ফ্রন্ট সিটে বসে আছে৷ আমি আর আপু পিছনে বসে আছি। আমরা সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি ইমাদ ভাইয়াদের গাড়িতে করে। লম্বা দূরত্বের রাস্তা হওয়ায় আদ্রিশ ও ইমাদ ভাইয়া পালাক্রমে ড্রাইভ করবেন বলেই সামনে বসেছেন। আমি আর আপু বসেছি পিছনে।
এ মুহূর্তে আপু হয়তো গভীর ঘুমে মগ্ন। আমার ঘুম একবার ভেঙে যাওয়ায় আবারো আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পুনরায় ফোন বেজে উঠলো। রিংটোনের শব্দ শুনে বুঝলাম, আদ্রিশের ফোনে কল এসেছে আদ্রিশ ড্রাইভ করতে করতেই বললেন,
” ইমাদ, কলটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দে তো। কে কল করেছে দেখি। ”

ইমাদ কল রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিলেন৷ সাথে সাথে ওপর পাশ হতে একটি অর্ধপরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
” মিস্টার আদ্রিশ বলছেন?”

আদ্রিশ বললেন,
” জি। আপনি শাহেদ সাহেব না?”

” জি জি৷ তাহলে চিনতে পেরেছেন। ”

” জি অবশ্যই। হঠাৎ আমায় ফোন করলেন যে অফিসার?”

” আপনাকে কিছু কথা বলার ছিলো। একচুয়েলি আপনাকে সাবধান করতেই আমি কল করেছি। ”

আদ্রিশ সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” আপনার কথা বুঝলাম না অফিসার। কি নিয়ে সাবধান করবেন?”

ওপাশে শাহেদ সাহেবের ক্ষীণ দ্বিধাদ্বন্দ্বিত কণ্ঠ,
” রোহানের বেইল হয়ে গিয়েছে মিস্টার আদ্রিশ। ”

শাহেদ সাহেবের কাছ থেকে এ খবর শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। রোহান ভাইয়ার বেইল পাওয়ার কথা শুনে দু চোখ থেকে আধো আধো ঘুমের রেশটুকু কেটে গেলো৷
আদ্রিশ আকাশসম বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কবে কখন হলো! ও বেইল পেলো কি করে?”

” ওকে অ্যারেস্ট করার পরেরদিনই বেইল পেয়ে গিয়েছিলো ও। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মিস্টার রোহানের বাবা একজন বড় রাজনীতিবিদ। উনার সামনে এসব কিছুই না মিস্টার আদ্রিশ। ”

” তো আপনি আমাকে আগে বলেননি কেনো অফিসার!”

” ইমাদকে বলেছিলাম আমি। কিন্তু ও বললো, সামনে আপনাদের রিসেপশন। এ কারণে যেনো আপনাকে এসব জানিয়ে শুধু শুধু টেনশন না দেই। যাই হোক, আপনারা একটু সাবধানে থাকবেন। কারণ রোহানের হাবভাব আমার মোটেও সুবিধার মনে হয়নি। ওর চোখেমুখে স্পষ্ট হিংস্রতা দেখেছি আমি। এজন্য বলবো, সাবধানতা অবলম্বন করুন। ”
এই বলে উনি নিমিষের জন্য থামলেন। পুনরায় বললেন,
” আমি পরে কথা বলছি মিস্টার আদ্রিশ। থানায় একজন আসামীকে আনা হয়েছে। তারা খাতির ব্যবস্থা করতে হবে। ”

আদ্রিশ ক্ষীণ শব্দে বললেন,
” আচ্ছা অফিসার।”

এরপর হয়তো শাহেদ সাহেব কল কেটে দিলেন। তৎক্ষনাৎ আদ্রিশ গাড়িতে ব্রেক কষে গাড়ি থামালেন। অকপট রাগ দেখিয়ে ইমাদ ভাইয়াকে বললেন,
” তুই আমাকে এ ব্যাপারে আগে বলিসনি কেনো ইমাদ! ”

ইমাদ ভাইয়া মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললেন,
” তোদের রিসেপশন ছিলো বিধায় বলতে চাইনি৷ আর আমি চাই না নাফিসা বা মিম এ ব্যাপারে জানুক। নাফিসার কাছে রোহান এখন একটা আতঙ্কের নাম।”

” তো তুই কি ভেবেছিস, আমি নাফিসা ভাবীকে এ ব্যাপারে বলতাম?”

” বলতি না। কিন্তু আমি তোদের কাউকেই এ ব্যাপারে জানাতে চাইনি৷ শাহেদকেও বলেছিলাম না জানাতে। কিন্তু ও কি মনে করে তোকে বললো বুঝলাম না। ”

” আশ্চর্য! আমাদের জানাতে চাসনি কেনো? এখন রোহান কিছু করে বসলে?”

ইমাদ ভাইয়া এবার খানিক রেগে গেলেন। বললেন,
” তো! রোহানের ভয়ে আমরা কতদিন গুটিয়ে থাকবো? কতদিন বাসায় বসে থাকবো?”

আদ্রিশ আর কথা বাড়ালেন না। হয়তো ইমাদ ভাইয়ার যুক্তির সাথে উনিও সহমত প্রকাশ করেছেন।
খানিক সময় পর উনি বললেন,
” ওদের দুজনকে এ ব্যাপারে কিছুই জানতে দেওয়া যাবে না। ওরা ঘুমাচ্ছে না এখন?”

আদ্রিশের কথা শুনে আমি তড়িঘড়ি করে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমি যে রোহান ভাইয়ার ব্যাপারে জেনে গিয়েছি তা উনাকে জানতে দেওয়া যাবে না। এতক্ষণ চলমান ঘুমের অভিনয় এখনও চালিয়ে গেলাম আমি৷
ইমাদ ভাইয়া বললেন,
” এখন বাসায় ব্যাক করবি না কি?”

” তা কি করে সম্ভব। আমরা তো সিলেট শহরে ঢুকে পড়েছি। ”

ইমাদ ভাইয়া আর কথা বাড়ালেন না। এদিকে চাপা ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে এলো। বন্ধ চোখের সামনে বারবার রোহান ভাইয়ার চেহারা ভেসে এলো৷ সেদিন শেষ মুহূর্তে উনার চেহারায় যে হিংস্রতা লক্ষ্য করেছি তা সে মুহূর্তে আমাকে ভীত করে না তুললেও এখন ঠিকই আমাকে ভয়ের অতল সাগরে ডুবিয়ে দিচ্ছে। জানি না সামনে কি হবে। তবে মনেপ্রাণে চাইছি, খারাপ কিছু যেনো না হয়৷ চোখ বন্ধ রেখেই আল্লাহর নাম নিচ্ছি।

.

সিলেট পৌঁছে আমরা হোটেলে উঠেছি কিছুক্ষণ পূর্বেই। পাশাপাশি দুটো রুম খালি না পাওয়ায় ইমাদ ভাইয়া ও আপু উঠেছে চতুর্থ তলার একটি রুমে। আর আমি ও আদ্রিশ উঠেছি তৃতীয় তলার একটি রুমে।

রুমে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আদ্রিশ কিছু কাজে বেরিয়ে পড়লেন। আমায় বললেন, জরুরি কিছু কাজ আছে এবং এ জরুরি কাজটা কি তা আমি ঢের আন্দাজ করতে পেরেছি। এতে কোনো সন্দেহ নেই আদ্রিশ রোহান ভাইয়া সম্পর্কিত কোনো কাজেই বেরিয়েছেন।
আদ্রিশ রুম থেকে বেরুনোর পূর্বে আমায় সতর্কতার সহিত বলে গেলেন উনি বাদে অন্য কেউ আসলে যেনো আমি দরজা না খুলি। রোহান ভাইয়ার বেইল হওয়ার খবরটা আমার জানা থাকায় এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে আর প্রশ্ন করিনি উনাকে। আদ্রিশ বেরিয়ে যেতেই আমি ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে গেলাম। দীর্ঘ জার্নির কারণে ক্লান্তি শরীর নিয়ে বেশি সময় ওয়াশরুমে রইলাম না আমি৷ দশ মিনিটের মাঝেই শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই হঠাৎ সোফায় কাউকে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠলাম আমি। আমার চমকানোর মাত্রা আরো বেড়ে গেলো যখন সোফায় বসে থাকা ব্যক্তিটিকে রোহান ভাইয়া হিসেবে চিনলাম আমি। অস্ফুটস্বরে উনার নাম নিতেই উনি মুহূর্তমধ্যে উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন৷ আতঙ্কে চিৎকার করার পূর্বেই রোহান ভাইয়া আমার সামনে কি যেনো স্প্রে করলেন৷ ক্ষণেই কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই আমার চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে দেখতে লাগলাম। ধীরে ধীরে সব অস্পষ্ট হয়ে আসছে। বুঝতে পারছি আমি জ্ঞান হারাচ্ছি।
চলবে।

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৪৮

পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম আমি। ক্ষণিকের মাঝেই নিজেকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। মুহূর্তমধ্যেই আমার হৃদপিণ্ড ধক করে উঠলো৷ তুমুল গতিতে দ্রিমদ্রিম শব্দে ভয়ের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে সে। দু হাত পা বাঁধা দেখে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি, আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসা হয়েছে৷ আর এ কাজটি করেছে রোহান ভাইয়া। স্পষ্ট মনে করতে পারলাম সেসময় হোটেল রুমে রোহান ভাইয়া ছিলেন। কিন্তু উনি রুমে এলেন কি করে?

আমি সম্পূর্ণ চোখ মেলে পরিবেশটা দেখলাম। আমাকে যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে চারিদিকে আবছা অন্ধকার। কেমন যেনো গুমোট একটা পরিবেশ৷ ভ্যাপসা এক প্রকার গন্ধও এসে বাড়ি খেলো নাকে। বোধহয় জায়গাটা পরিত্যক্ত ধরনের বা কেউ খুব একটা আসা-যাওয়া করে না। কিন্তু এ জায়গাটা আসলে কোথায়? রোহান ভাইয়া আমাকে কোথায় এনে রেখেছেন? গুমোট পরিবেশের রুমে থেকে বাইরের পরিবেশ অনুমান করতে পারলাম না আমি।

হাত দুটো পিঠের দিকে বাঁধা, পা দুটোও বাঁধা। হাতের যন্ত্রণাকর বাঁধন খুলতে সাধ্যমত চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু ফলাফল শূন্য। পা দুটো নাড়িয়ে পায়েরও বাঁধন খুলতে চেষ্টা করলাম। খানিক সময়ের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলাম। হঠাৎ রুমে শব্দ শুনতে পেয়ে তটস্থ হয়ে বসে রইলাম আমি। নিশ্চয়ই রোহান ভাইয়া এসেছেন।
আমার ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করে রোহান ভাইয়াই রুমে ঢুকলেন। কালো একটা জ্যাকেট পরে মাথায় হুডি তুলে দিয়েছেন উনি। উনাকে দেখামাত্র শক্ত গলায় বলে উঠলাম আমি,
” এভাবে আমাকে কিডন্যাপ করার উদ্দেশ্য কি আপনার? ”

রোহান ভাইয়া হুডি খুলে ফিচেল হাসি দিলেন। ধীরেসুস্থে হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসে বললেন,
” উদ্দেশ্য যে ভালো কিছু না তা তুই ভালো করেই জানিস। ”

রোহান ভাইয়ার এ প্রতিক্রিয়ায় আমার শরীর ঘিনঘিন করতে লাগলো। আমি তীব্র ঘৃণা সহকারে বললাম,
” এক ফর্মুলার পিছনে এভাবে পরে আছেন কেনো আপনি? নিজ বুদ্ধিতে একটা বানলেও তো পারেন। ”

রোহান ভাইয়া কৌতুক শুনেছে এমন ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে বললেন,
” এতো সহজেই যে ফর্মুলা আমি নিতে পারবো সেখানে বছরের পর বছর সময় দিবো কেনো?”

” কে বলেছে আপনাকে যে আপনি এতো সহজেই ফর্মুলা নিতে পারবেন?”

” তা নয়তো কি? গতবার পারিনি। কিন্তু এবার পারবো। কারণ এবার আদ্রিশের কলিজায় হাত দিয়েছি আমি। ”
এই বলে উনি পূর্বের ন্যায় হেসে উঠলেন। উনার হাসি দেখে আমার শরীর জ্বলতে লাগলো। আমি প্রচণ্ড ঘৃণা সহকারে বললাম,
” আপনার মতো জঘন্য মানুষ হয়তো দ্বিতীয়টা নেই। ছিঃ একবারও কি আপনার বিবেকে বাঁধে না এসব করতে?”

রোহান ভাইয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে বিশ্রি রকমের একটা হাসি দিলেন। বললেন,
” আমি তো এখনও কোনে জঘন্য কাজ করিনি রে মিম। করবো। খুব শীঘ্রই করবো। যা তোর বোনের সাথে করতে পারিনি তা তোর সাথে করবো৷ বুঝতে পারছিস তো কি বলতে চাইছি আমি?”
এই বলে রোহান ভাইয়া বাজেভাবে আমার গালে স্পর্শ করলেন। উনার এ স্পর্শে আমার গা গুলিয়ে কেমন বমি পেলো। উনার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে এলাম আমি। হাত পা দুটো ঘামতে শুরু করলো। আমার প্রতিক্রিয়া দেখে রোহান ভাইয়া হাসলেন। বললেন,
” এই ভয়টাই দেখতে চাচ্ছিলাম তোর চোখে। আমাকে থাপ্পড় দিয়ে অপমান করবি আর আমি কিছু করবো না তা ভাবলিও কি করে মিম? আমি এক তীরে দুই পাখি মারার প্ল্যানে আছি। বুঝছিস?”
এই বলে রোহান ভাইয়া খুব বিশ্রি রকমের একটা হাসি দিলেন৷ উনার হাসি দেখে ঘৃণায় চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললাম আমি। রোহান ভাইয়া পুনরায় বললেন,
” একটা সিক্রেট জানিস মিম? খুব বড় একটা সিক্রেট?”

আমি চোখ খুলে চাইলাম৷ রোহান ভাইয়া বাঁকা হেসে বললেন,
” তোকে কোথায় এনে রেখেছি জানিস? তোদেরই কোম্পানির গ্রাউন্ড ফ্লোরের বিল্ডিং এ। যেখানে সহজে কেউ আসে না৷ পরিত্যক্ত আর কি। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না? আদ্রিশের ধরা ছোঁয়ার মধ্যেই তুই থাকবি৷ অথচ আদ্রিশ তোকে খুঁজে পাবে না। ”

রোহান ভাইয়ার কথা শোনামাত্র আমি বিস্ফোরিত নয়নে উনার দিকে চাইলাম৷ উনি যে আমায় নিয়ে সিলেট শহর থেকে চলে এসেছেন তা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি৷ এখন আদ্রিশ আমাকে কি করে খুঁজে পাবেন! উনি নিশ্চয়ই সিলেট শহরে তন্নতন্ন করে খুঁজছেন আমায়। কিন্তু আমি যে উনাদের কোম্পানিরই গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছি। কি করে সম্ভব আমাকে এখান থেকে বের করা? উনি নিশ্চয়ই অনুমানও করতে পারবেন না রোহান ভাইয়া এ কাজ করেছেন। তাহলে কি আমার মুক্তি পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হবে? এখানেই বন্ধি থেকে রোহান ভাইয়ার ঘৃ’ণ্য ষ’ড়’য’ন্ত্রের শিকার হতে হবে?

রোহান ভাইয়া আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আড়মোড়া ভেঙে বললেন,
” যাই একটু রেস্ট নিয়ে আসি। তারপর না হয় তোর কাছে আসবো। ততক্ষণ তুইও একটু রেস্ট নিয়ে নে৷ ”
এই বলে রোহান ভাইয়া হাতের নাগালে থাকা কাপড় দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিলেন। যেনো আমি চিৎকার না করতে পারি। এ পর্যায়ে আমার হাত ও পায়ের বাঁধন ছোটার জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু শক্ত বাঁধন থেকে ছুট পাওয়া সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। আমার এ চেষ্টা দেখে রোহান ভাইয়া খুব করে হাসলেন। বললেন,
” চেষ্টা করে লাভ কি বল৷ এখান থেকে বের হওয়া এতোটা সহজ ভেবেছিস? আর তুই চেষ্টা করলেও বের হতে পারবি না। কারণ আমি তোকে বের হতে দিবো না। ”

এই বলে রোহান ভাইয়া উল্টো পথে পা বাড়ালেন৷ কিন্তু কি মনে করে আবারো ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
” আদ্রিশকে তোর কিডন্যাপিং এর কথা কখন বলেছি জানিস? যখন আমরা সিলেটে ছিলাম তখনই। ও বেচারা তো তখন থেকেই তন্নতন্ন করে খুঁজে যাচ্ছিলো তোকে। কিন্তু ততক্ষণে আমরা সিলেট ছেড়ে দিয়েছি। অবশ্য এখন ও এখানেই আছে৷ কারণ ওকে আমরাই এখানে এনেছি। আফটার অল ফর্মুলা লাগবে আমাদের। কিন্তু এবার আমি ওর সাথে আর কোনো প্রকারের যোগাযোগ করিনি। কারণ ও যে লোকেশন ট্রেস করে ফেলবে। এজন্য এবার ইকবাল সাহেবের লোকদের দিয়ে কাজ করিয়েছি৷ আদ্রিশ ইকবাল সাহেবকে ফর্মুলা দিবে। তারপর তোর খোঁজ পাবে। কিন্তু ততক্ষণে তো সব শেষ। বুঝেছিস এবার? কি করে এক তীরে দুই শিকার করবো আমি? ওদিকে আদ্রিশের কাছে ফর্মুলাও নেওয়া হয়ে যাবে, আবার এদিকে তোর কাছ থেকে অপমানের শোধও তোলা যাবে। আচ্ছা, অনেক কথা বললাম। একটু জিড়িয়ে আসি। ”
এই বলে রোহান ভাইয়া চলে গেলেন। আমি অসহায় চাহনিতে সেদিকে চেয়ে রইলাম। সহিসালামত বেঁচে ফিরার সব আশা দুরাশা মনে হচ্ছে আমার কাছে৷ সবদিক দিয়েই বিপদ ঘিরে ধরেছে। আদৌ কি এ থেকে বের হওয়া সম্ভব?

ঘোর বিপদে পরে সব সম্ভাবনা ধোঁয়ার ন্যায় উবে যেতে লাগলো। আমার দু চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে লাগলো। শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে এলো। ভয়ে ক্রমশ উর্ধগতিতে চলমান হৃদপিণ্ডটিও ধীরেধীরে নিস্তেজ হয়ে এলো যেনো। মস্তিষ্ক শূন্য অনুভূত হলো। তবুও জোরপূর্বক চেষ্টা করছি এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। সে আশাতেই চারপাশ তাকালাম৷ কিন্তু হাত পায়ের বাঁধন খোলার মতো কিছু পেলাম না।
হঠাৎ আমার দৃষ্টি আটকে রুমে কোনার একটি দেয়ালের দিকে। রুমের ঐ কোনায় ভেন্টিলেটর এর মতো বোধহয় কিছু দেখতে পেলাম। এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আমি ফ্লোর ঘেঁষে ডান পাশে এগিয়ে যেতে লাগলাম। একটু এগিয়ে যেতেই পিলারের পিছনে ভেন্টিলেটর দেখতে পেলাম। তৎক্ষনাৎ আমার ভেতরে সাহস ও আশা সঞ্চার হলো যেনো। কোনোরকমে ঐ ভেন্টিলেটরের কাছে গিয়ে আশেপাশে কেউ থাকলে হয়তো সাহায্য চাওয়া যাবে। কিন্তু সেখানে যাবো কি করে? পা দুটো যে বাঁধা আমার!

আমি কিছুক্ষণ পায়ের বাঁধনের দিকে চেয়ে রইলাম। কি করে এটা খুলবো? হাত দুটো যে পেছনে বাঁধা। কিছুক্ষণ এ নিয়েই চিন্তা করলাম। অতঃপর বেশ দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে পা ভাঁজ করে পেছনের দিকে নিলাম। কোমড়ের কাছে বাঁধা হাত দুটো দিয়ে খুব কষ্টেসৃষ্টে বাঁধন খোলার চেষ্টা করলাম। বহু চেষ্টার পর এ পায়ের বাঁধন খুলতে সক্ষম হলাম। দু হাঁটুর সাহায্যে মুখের কাপড় টেনে সরিয়ে খুলে ফেললাম। সাথে সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি৷ অতঃপর কোনোপ্রকার বিলম্ব না করে দ্রুত উঠে সেই ভেন্টিলেটরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভেন্টিলেটরটা অনেকটাই আমার নাগালে। শুধু পা দুটো একটু উঁচু করে দাঁড়ালেই বাইরের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।

বাইরে রাত হয়ে এসেছে। কিন্তু কত রাত অর্থাৎ সময় কত তা অনুমান করতে পারলাম না। মাথা উঁচু করে চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে রইলাম। এই আশায়, যদি কেউ আসে।
বোধহয় পাঁচ দশ মিনিট বা তারও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। হঠাৎ এ বিল্ডিং থেকে বেশ খানিকটা দূরে একজন মানুষের অবয়ব দেখতে পেলাম। মুহূর্তমধ্যেই মানুষটি সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টিগোচর হলো। আমি কোনোপ্রকার বিলম্ব না করে মুখ দিয়ে বিভিন্ন প্রকার শব্দ করতে লাগলাম। কোনো প্রকার বাক্য উচ্চারণ করলাম না। কারণ রোহান ভাইয়া যদি আশেপাশে থেকে থাকে তাহলে আমার কথার মাধ্যমেই নিশ্চিত তিনি ধরে ফেলবেন যে আমি বাইরে সাহায্য চাইছি।

আমি নানা প্রকারের শব্দ করে লোকটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। কিন্তু লোকটি যেনো কিছুতেই কিছু শুনছে না। অদ্ভুত! ক্ষণিকের মাঝেই আমার বেঁচে ফেরার একমাত্র সম্বল স্বরূপ লোকটি আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো। আমি হতাশ হয়ে দেয়াল ঘেঁষেই বসে পড়লাম। দু চোখ বেয়ে নিঃশব্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। হঠাৎ রোহান ভাইয়ার কণ্ঠ শুনে আমি চকিতে ফিরে তাকালাম।
” হেল্প চাচ্ছিলি না কি মিম? পেয়েছিস? পাবিও না। কারণ এ দিকটায় কেউ আসে না। ”
এই বলে রোহান ভাইয়া ক্রুর হাসি দিলেন। মুহূর্তমধ্যেই পরনের শার্টের বোতাম খুলতে খু্লতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। পৈশাচিক আনন্দিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন,
” ভেবেছিলাম আরেকটু পর আসবো। কিন্তু তুই তোর ভুলের কারণে সময়টাকে কমিয়ে আনলি। কি আর করার৷ পরে যা করবো তা এখন করে নিলেই হয়। ”
রোহান ভাইয়া অগ্রসরমান চলন ও কথায় ভয়ে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো।

#চলবে