#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
২৭
রোহান ভাইয়াদের বাসা হতে বেরিয়েছি বেশ কিছুক্ষণ পূর্বে। রিতুর জোরাজোরিতে কোনোমতে দুপুরের খাবার খেয়েই বেরিয়েছি। ইচ্ছা ছিলো, বাসায় গিয়ে আব্বু আম্মু আর আভার সাথে দেখা করে আসবো৷ কিন্তু তখন রোহান ভাইয়া ও মিস্টার ইকবালের কথোপকথন শুনে এখনো অব্দি আমার মন কিছুতেই শান্ত হতে চাইছে না৷ এমতাবস্থায় বাসায় গেলে আম্মুর কাছে নির্ঘাত ধরা খেয়ে যেতাম। আমার মুখমণ্ডলে চিন্তার ছাপ দেখেই প্রশ্নের বন্যা বইয়ে দিত আম্মু, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব হতে বাঁচতেই বাসার ত্রিসীমানার মাঝেও যাইনি। এখন আমার গন্তব্য ইমাদ ভাইয়াদের বাড়ি। রোহান ভাইয়াদের বাসায় থাকা অবস্থায় আপু ফোন দিলে আপুকে মিথ্যে কথা বলতে বাধ্য হই। কারণ আপু এ বাসায় থাকবার কথা শুনতে পেলে নির্ঘাত নানা ধরনের চিন্তায় মাথা ব্যাথা নিয়ে বসে থাকবে।
রোহান ভাইয়াদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথচারী রাস্তা দিয়ে ধীরেসুস্থে হেঁটে চলছি আমি। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রোহান ভাইয়া ও মিস্টার ইকবালের কথোপকথন। এপার ওপার নানা চিন্তাভাবনায় মাঝে মাঝে মাথায় শূন্যতা অনুভব করছি। যখন কিছুতেই এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করা বন্ধ করতে পারলাম না তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, এ নিয়ে আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করবো৷ কারণ, উনার সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা না করা অব্দি আমি কিছুতেই শান্ত হতে পারবো না। কিন্তু আজই যে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি উনার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবো, সে সিদ্ধান্তের কি হবে?
এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে অবশেষে মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে গিয়ে নির্ধারিত করলাম, আজ উনার ও রোহান ভাইয়ার এ শত্রুতার কারণ জেনে তবেই বাকি সিদ্ধান্তে অটল হবো। আপাতত বাসায় গিয়ে উনার সাথে দেখা করাই আমার মূখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত হলো।
বেশ কিছুদূর আসবার পর হঠাৎ আমার পাশে আচমকা একটি গাড়ি এসে দাঁড়ালো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ঘাবড়ে গেলাম। তবে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে আদ্রিশকে দেখে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেলাম। আমায় দেখে আদ্রিশ দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
” ভয় পেয়েছো না?”
আমি প্রতিক্রিয়াহীন সরু চোখে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। অতঃপর বললাম,
” আপনার উদ্দেশ্যই ছিলো আমায় ভয় দেখানো। ঠিক না?”
আদ্রিশ এবার স্বাভাবিক হয়ে বললেন,
” মোটেও না৷ আমার এ উদ্দেশ্য ছিলো না। আমার উদ্দেশ্য হলো, তোমার সাথে কিছু কথা বলার। তো, ম্যাডামের কি সময় হবে?”
আদ্রিশের কথা শোনার পর মনে হলো, যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি এসে নামলো আমার কাছে। আমি তৎক্ষনাৎ বলে ফেললাম,
” জি হবে। আমারও আপনার সাথে কথা আছে। কোথায় যাবেন? চলুন।”
আমার কথা শোনামাত্র খুশিতে আদ্রিশের চোখ চকচক করতে লাগলো। উনি হাস্যজ্জ্বল চেহারায় বললেন,
” এতো ইজিলি তুমি রাজি হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। যাই হোক, গাড়িতে উঠে বসো এণ্ড অবভিয়েসলি পেছনের সিটে বসবে না৷ আমি তোমার ড্রাইভার রূপে পরিচিত পেতে চাই না। আমার পাশে এসে বসো। ”
আদ্রিশের কথা শুনে আমি ভীষণ অবাক হলাম৷ কারণ আমি মনে মনে এ উদ্দেশ্য নিয়েই গাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছিলাম যে, গাড়ির পিছনের সিটেই বসবো আমি। কিন্তু আদ্রিশের আদেশ পেয়ে কোনো কথা না পেয়ে আমি চুপচাপ উনার পাশে এসে বসে পড়লাম। অতঃপর আদ্রিশ এক নজর আমার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
সদ্য বিকেলের তেজহীন রোদেলা পরিবেশ ঈষৎ সোনালী আভায় ছেয়ে আছে। গাড়ির জানালা পেরিয়ে শো শো হাওয়া প্রবেশ করছে ভেতরে। এ হাওয়ায় খানিক শীতল অনুভূতি সৃষ্টি হলেও তা যেনো বদ্ধ মনের দুয়ার খুলে দিতে সক্ষম হলো। আমি জানালা পেরিয়ে বাইরের পরিবেশ উপভোগ করতে করতে কল্পনায় আদ্রিশের সাথে সকল কথোপকথন সাজিয়ে ফেললাম। এখন শুধু উনাকে আমার প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া বাকি রইলো।
দশ মিনিটের মাঝেই আমরা একটি রূফটপ রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছে গেলাম৷ পুরো রাস্তায় আদ্রিশ আমার সাথে কোনো কথা বললেননি। আমিও আগ বাড়িয়ে উনার সাথে কথা বলিনি। আমায় গাড়ি হতে নামিয়ে দিয়ে উনি গাড়ি পার্ক করতে গেলেন। দু মিনিটের মাঝেই গ্রাউন্ড ফ্লোরে ফিরে এসে উনি আমায় নিয়ে দোতালায় উঠলেন। খুঁজে খুঁজে কোনার দিককার একটি টেবিলে গিয়ে বসলেন আমায় নিয়ে। আমাদের বসবার কিছুক্ষণের মাঝেই একজন ওয়েটার এসে ওর্ডার নিয়ে চলে গেলেন৷ অতঃপর আদ্রিশ মুচকি হেসে বললেন,
” তো, কি নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলে তুমি? আগে তুমি বলো। এরপর আমার কথা বলবো আমি। ”
সুযোগ সন্ধানী আমি আদ্রিশের কথা শোনামাত্র উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি কি ড্রাগ তৈরী করেছেন যার জন্য রোহান ভাইয়া আর মিস্টার ইকবালের সাথে আপনার শত্রুতা হয়েছে? ”
আমার প্রশ্ন শোনামাত্র আদ্রিশের ওষ্ঠদ্বয় হতে সেই মুচকি হাসি উবে গেলো। মুহূর্তেই উনার চেহারা পাংশুটে বর্ন ধারণ করলো। উনি যে আমার নিকট হতে এ ধরণের প্রশ্ন আশা করেননি তা উনার হাবভাব দেখেই বুঝতে পারলাম আমি। উনি আমার দিকে চেয়ে হতভম্ব হয়ে বললেন,
” তুমি মিস্টার ইকবালের নাম জানলে কি করে?”
আমি উনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম,
” সে ব্যাপারে আপনার না জানলেও চলবে। আপনি শুধু আমার প্রশ্নের জবাব দিন। ”
মুহূর্তেই যেনো আদ্রিশের চাহনি শক্ত হয়ে এলো। উনার এ চাহনিতে আমি মৃদু ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে শক্ত রেখে পুনরায় একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। উনি এবার চোয়াল শক্ত করে বললেন,
” কোথায় গিয়েছিলে তুমি? আর মিস্টার ইকবালকে কিভাবে চিনলে তা বলো। ”
আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে বললাম,
” আজ রোহান ভাইয়াদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ফোনে উনাকে আর মিস্টার ইকবালকে কথা বলতে শুনেছি৷ ”
আদ্রিশ শক্ত চাহনিতে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি বলেছে ওরা?”
” এই যে, আপনার কাছ থেকে সেই ড্রাগের ফর্মূলা নিবেন উনারা। আপনাদের কোম্পানিতে একজন স্পাইও রেখেছেন মেবি।”
আদ্রিশের চেহারা সুক্ষ্ম চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো। উনি ঠোঁট কামড়ে খানিক আতংকিত সুরে বললেন,
” এর মানে রোহান আর মিস্টার ইকবাল একসাথে ডিল করেছে!”
” হ্যাঁ। উনারা আপনার কাছ থেকে সেই ফর্মুলা চায়। এবার আমায় বলুন, এমন কি আছে ঐ ফর্মূলায় যার জন্য মিস্টার ইকবাল সুদূর সুইজারল্যান্ড থেকে এসেছেন?”
আদ্রিশ খানিক সময় নিয়ে চিন্তিত হয়ে টিস্যু ট্রে হতে একটি টিস্যু নিয়ে মুচড়াতে লাগলেন। উনি বিড়বিড় করে কিছু বললেনও। তবে কি বললেন তা উনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলো। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম,
” প্লিজ আমায় বলুন, কি চলছে আপনাদের তিনজনের মাঝে। এ নিয়ে চিন্তা করতে করতে আমার মাথা ধরে গিয়েছে। ”
আমার কথা শোনামাত্র আদ্রিশ চট করে দৃষ্টি তুলে চাইলেন আমার দিকে। আমাকে বিস্মিত করে উনি চেহারায় পূর্বের ভাবখানা ফিরিয়ে আনলেন। এ মুহূর্তে উনায় দেখে কখনোই বলা সম্ভব নয় যে উনি কিছুক্ষণ পূর্বেই ভাবনার অতল সাগরে পাড়ি জমিয়েছিলেন। আমার দিকে চেয়ে আদ্রিশ বিস্তৃত হেসে বললেন,
” তোমায় এ কথা বলেছি মিশমিশ। ইউনিভার্স সবসময় অতল গহ্বরে সব লুকিয়ে রাখতে চায়। সে চায় না, কিছু তথ্য জনসম্মুখে আসুক। ”
আদ্রিশের এরূপ প্রত্যুত্তরে আমি খানিক রাগান্বিত হলাম। মৃদু উত্তাপে বললাম,
” নিজের ব্যাপারটা ইউনিভার্স নামক এই থিওরি দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করবেন না। চুপচাপ বলুন, আপনি কি লুকাচ্ছেন?”
আদ্রিশ ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠে বললেন,
” এতো জানতে চাচ্ছো কেনো?”
” আমার চিন্তা হচ্ছে তাই জানতে চাইছি।”
আদ্রিশ আমার জবাব শুনে স্মিত হাসলেন। ভ্রু নাচিয়ে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” আচ্ছা? আমায় নিয়ে এতো চিন্তা হচ্ছে তোমার! তা কি কারণে এ চিন্তা হচ্ছে জানতে পারি?”
আদ্রিশের এহেন বাচনভঙ্গিতে আমি সংকুচিত হয়ে এলাম। এলোমেলো দৃষ্টিতে চেয়ে বললাম,
” এটা আমার প্রশ্নের জবাব ছিলো না। ”
” আমার প্রশ্নের জবাবও এটা ছিলো না। ”
” আপনার প্রশ্নটা ভিত্তিহীনবলে আমি জবাব দিতে ইচ্ছুক নই। ”
” তোমার জন্য সে প্রশ্নের উত্তর অজানা থাকা ভালো বলে আমিও এর জবাব দিতে ইচ্ছুক নই। ”
আমি এবার ভীষণ বিরক্ত হলাম। হাত দুটো একত্রে মুঠো করে বললাম,
” আমার ভালো নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। ”
আদ্রিশ মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাসলেন। অতঃপর বললেন,
” তুমি নিজের জন্য যথেষ্ট নও বলেই তোমায় নিয়ে ভাবতে হয় আমার।”
আদ্রিশের এরূপ কথাবার্তায় আমি ভীষণ বিরক্ত এবং রাগান্বিত হলাম৷ অতঃপর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে শেষমেশ উনায় প্রশ্ন করেই ফেললাম,
” আমার পিছে এভাবে পড়ে আছেন কেনো? আমায় নিয়ে এতো ভাবছেন কেনো? কে বলেছে আমায় নিয়ে ভাবতে? ”
আমার এহেন প্রতিক্রিয়ায় যে আশেপাশের কিছু উৎসুক দৃষ্টি আমাদের দিকে চেয়ে রইলো তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার পরও আমি বিন্দুমাত্র ঘাবড়ালাম না৷ উল্টো চাপা ক্রোধে আদ্রিশের দিকে চেয়ে রইলাম আমি। এদিকে আদ্রিশ পলক ফেলা বিহীন এবং প্রতিক্রিয়াহীন চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো। কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে এভাবে চেয়ে থেকে মৃদু হাসির সহিত শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
” এতো অবুঝ কেনো তুমি মিশমিশ? এতোদিনেও কিছু বুঝতে পারোনি তুমি?”
আদ্রিশের এরূপ প্রশ্নে আমি যেনো হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেলাম। সকল রাগ উবে গিয়ে ঠাণ্ডা জলস্রোত বয়ে গেলো আমার উপর দিয়ে। আমি উনার চোখের দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম,
” আমি নয় দশ বছরের কোনো অবুঝ বাচ্চা নই আদ্রিশ। আর না সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কিশোরী মেয়ে যে এসব সচক্ষে দেখা সত্ত্বেও অবুঝ হবে। ”
®সারা মেহেক
#চলবে
#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
২৮
আমার কথা শোনার পরমুহূর্তে আদ্রিশ প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে ভ্রুজোড়া উঁচু করলেন। নিস্তরঙ্গ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” তাহলে সবটা বুঝেও অবুঝ হবার ভান করছিলে তুমি?”
আদ্রিশের এরূপ কণ্ঠস্বরে আমি খানিকটা নড়েচড়ে বসলাম। কারণ এখন হতে যা যা বলার প্রয়োজন, সবটাই দৃঢ়চিত্তে বলতে হবে। আমি খানিক গলা পরিষ্কার করে বললাম,
” আমি বুঝতে চাইছিলাম না। ”
আদ্রিশ কিছুক্ষণ আমার পানে নিশ্চুপ দৃষ্টিপাত করলেন। অতঃপর তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
” সোজা কথায় বলো, ভান করছিলে তুমি। ”
আমি দৃঢ়চিত্তে বললাম,
” ভান করা বা না বুঝার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আমার উপর নির্ভর করে। আমার ফিলিংস, আমার লাইফ। আপনি তো বলার কেউ না এখানে। ”
আদ্রিশ পুনরায় নিভৃতে আমার পানে চেয়ে রইলেন। আহত স্বরে বললেন,
” কত সহজেই বলে দিলে তুমি! আসলেই কি এসব এতো সহজ?”
” অবশ্যই সহজ। সহজ হিসেবে মেনে নিলেই সহজ। বরং আপনি ব্যাপারটা জটিল করছেন।”
আদ্রিশ আমার কথার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মুখ ফিরিয়ে হাসলেন। অতঃপর আমার দৃষ্টি বরাবর চেয়ে বিষাদমাখা কণ্ঠে বললেন,
” অনুভূতি নামক শব্দের সাথে সম্পৃক্ত সকল বিষয়বস্তুই জটিল হয়। একে কখনো সরল নামক দাঁড়িপাল্লায় মাপা সম্ভব নয়।
কিন্তু তুমি কত সহজেই একে সরলসোজা বলে দিলে! অদ্ভুত! ”
আদ্রিশে এরূপ কথাবার্তায় আমি নিজেকে সংযত রাখতে ক্রমেই ব্যর্থ হয়ে পড়ছি। তা সত্ত্বেও আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সম্পূর্ণ চেষ্টা করে দৃঢ়তার সহিত বললাম,
” আপনার জন্য এটা অদ্ভুত হলে অদ্ভুতই। কিন্তু আমি যা বলছি একদম সঠিক বলছি। ”
আমার কথা শোনামাত্র উনার দৃষ্টি আচমকা শক্ত হয়ে এলো। উনি টেবিলের উপর পূর্বের তুলনায় কিঞ্চিৎ এগিয়ে এসে ধারালোভাবে বললেন,
” তুমি এতোটাও কঠোর না যতোটা দেখাতে চেষ্টা করছো। এ কঠোরতার কারণ কি? বয়ফ্রেন্ড আছে?”
কি মনে করে আমিও আদ্রিশের ন্যায় টেবিলের উপর এগিয়ে এসে পূর্বের দৃঢ়তা বজায় রেখে বললাম,
” আমি এতোটাই কঠোর যতোটা দেখাচ্ছি। আর রইলো বয়ফ্রেন্ড নামক মানুষটার কথা। সে আছে কি নেই তা নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।”
আদ্রিশ এ পর্যায়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন।
মুঠো শক্ত করে দৃঢ়তার সহিত বললেন,
” বাহ! কি সহজেই বলে দিলে এ নিয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে হবে না! কিন্তু তুমি মানো আর নাই বা মানো, তোমার প্রতিটি ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করবোই। এতে তুমি কখনোই আমাকে বাঁধা দিতে পারবে না। মাইন্ড ইট, কখনোই না৷ ”
আদ্রিশের এরূপ বাচনে আমি হতভম্ব হয়ে এলাম। নিজের চোখকে এ দৃশ্য কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না আমি। অনুভব করলাম, আমার হৃদপিণ্ডের স্পন্দনগতি স্বাভাবিকের তুলনায় ক্রমেই বেড়ে চলছে। আমি নিমিষের জন্য আদ্রিশের শক্ত দৃষ্টি বরাবর চাইলাম৷ অতঃপর শুকনো একটা ঢোক গিলে বললাম,
” আপনি আমাকে এসব বলার জন্য ডেকেছিলেন?”
” অবভিয়েসলি এগুলো বলার জন্যই ডেকেছিলাম তোমাকে। কিন্তু তোমার ব্যবহারে আমি বাকরূদ্ধ হয়ে পড়েছি। ”
” আপনি আজ এমনটা করবেন, এটা জানলে কখনোই আপনার সাথে আসতাম না। ”
আদ্রিশ প্রতিক্রিয়াহীন শান্ত চাহনিতে চেয়ে বললেন,
” না আসলে তুলে নিয়ে আসতাম। সিম্পল। ”
আদ্রিশের এরূপ কথায় আমি বিস্ময়ে হা হয়ে এলাম। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললাম,
” আপনি আমায় কিডন্যাপের হুমকি দিচ্ছেন!”
আদ্রিশ পূর্বের ন্যায় বললেন,
” হ্যাঁ দিচ্ছি। এনি প্রবলেম?”
” আপনার কাছ থেকে এমনটা আশা করেছিলাম না আদ্রিশ।”
” তোমার কাছ থেকেও এমনটা আশা করেছিলাম না আমি মিশমিশ। ”
” তো কি আপনি চাইছেন আমি আপনার প্রস্তাব রাজি হয়ে যাই?”
” অবশ্যই। ”
কি মনে আমি চট করে বলে ফেললাম,
” আমি কখনোই রিলেশনে যেতে চাইনি। ”
আদ্রিশ আচমকা উদগ্রীব হয়ে বললেন,
” আমিও চাই না রিলেশনশিপে যেতে। আর আমি তোমাকে আমার সাথে রিলেশনেও যেতে বলছি না।”
” তাহলে কি বলতে চাইছেন আপনি?”
” আমি সোজা তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তোমার পরিবারের মতেই বিয়ে করতে চাই তোমাকে।”
আমি উনার এ কথার প্রত্যুত্তর দিলাম না৷ বরং সাহস করে কিছুক্ষণ উনার দৃষ্টি বরাবর চেয়ে রইলাম। অতঃপর দৃষ্টি নত করে বললাম,
” বাস্তবতা মানতে শিখুন আদ্রিশ। বিয়ে করতে চাই বললেই হয়ে যায় না। সবকিছু দেখেশুনে বিয়ে করতে হয়।”
আদ্রিশ উতলা কণ্ঠে বললেন,
” আমার মধ্যে কোনো কমতি আছে মিশমিশ? বলো, আমি নিজেকে শুধরে নিচ্ছি। ”
আমি এ পর্যায়ে হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
” আপনার মধ্যে কোনো কমতি নেই আদ্রিশ। বরং আমার মধ্যে কমতি আছে। এসব ছাড়ুন। আজ বরং আমি উঠি। আমার মাথা ধরছে। ”
এই বলে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিলাম। কিন্তু এর পূর্বেই আদ্রিশ আমার হাত ধরে আমাকে উঠতে বাঁধা দিলেন। পুনরায় ঈষৎ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
” আমার জীবনটাকে মধ্য সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে তুমি কি করে ভাবলে যে আমার প্রশ্নের জবাব না শোনা অব্দি তোমাকে যেতে দিব?”
আমি এ পর্যায়ে গরম চোখে চেয়ে বললাম,
” এটা পাবলিক প্লেস আদ্রিশ। আর আপনার সাহস কি করে হয় আমার হাত ধরার?”
” সাহস, দুঃসাহসের কিছুই দেখোনি তুমি। সো ভদ্র মেয়ের মতো বসে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। ”
উনার এরূপ আচরণে আমি অকারণে এবং অঘোষিতভাবে গোঁ ধরে বসলাম। হাতের মুঠো শক্ত করে বললাম,
” আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য আমি বাধ্য নই। ”
আদ্রিশ হয়তো আমার কথায় চটে গেলেন। বললেন,
” আমাকে বাধ্য করো না মিশমিশ। পাবলিক প্লেসে আমি কোনো সিন ক্রিয়েট করতে চাই না। ”
” আমিও এমনটা চাই না। এজন্য ভালোয় ভালোয় বলছি আমাকে যেতে দিন। ”
” আচ্ছা তাই? আমিও নাছোড়বান্দা। আমার জবাব আজকে না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়ছি না তোমায়। যত দ্রুত এন্সার দিবে, তত দ্রুত ফ্রি হয়ে যাবে।”
অতঃপর আদ্রিশের জিদমূলক কথাবার্তার কাছে আমি হার মানতে বাধ্য হলাম। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে নতমস্তকে দু চোখ বন্ধ করে বললাম,
” আপনাদের ক্লাসের সাথে আমাদের ক্লাস কখনোই মিলবে না। আপনাদের এই হাই ক্লাসের সোসাইটিতে আব্বু কখনোই আমাকে বিয়ে দিবে না। ”
আদ্রিশ আমার কথা শুনে নিমিষের জন্য নিশ্চুপ রইলেন। অতঃপর হাসতে হাসতে বললেন,
” এমন সিলি রিজন দিও না আমাকে।”
উনার কথায় আমি চোখ মেলে তাকিয়ে বললাম,
” আপনার জন্য এটা সিলি রিজন হলেও আমার জন্য এ রিজনটাই যথেষ্ট। আপুর বিয়ের সময় আব্বু আম্মুকে দেখেছি আমি৷ আপনার হলুদে করা কাণ্ডের জন্য আপুকে মিথ্যে অপবাদ দিতে শুনেছি। আত্মীয়দের তীক্ষ্ণ কথা শুনেছি। আপনাকে বিয়ে না করার আর কি কারণ চাই?”
আদ্রিশ পুনরায় আমার দিকে নিরবতার সহিত চেয়ে রইলেন। কিয়ৎক্ষণ বাদে বললেন,
” মানুষের কথায় এতো কান দাও তুমি! সোসাইটিতে এমন লোকের অভাব নেই। তাই বলে তাদের কথায় আমাদের জীবন থেমে থাকবে?”
” আমি তাদের কথায় কান দিতে চাই না। কিন্তু এমনটা না করেও থাকতে পারি না৷ কারণ এ সমাজেই আমাদের বাস করতে হবে। আর আপুর এমন ফ্যামিলিতে বিয়ে হওয়ার পর আমার এমন ফ্যামিলিতে বিয়ে মানে আব্বু আম্মুকে মেন্টাল প্রেশারের মধ্যে রাখা। ”
” আচ্ছা, এই কথা? আমি আংকেল আন্টীর সাথে কথা বলবো। তাদেরকে এ বিয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে বলবো। ”
” কথা বলে লাভ নেই। তারা রাজি হবে না। সবচেয়ে বড় কথা। আমি রাজি না। কারণ সমাজের কটু কথা শোনার মতো ধৈর্য শক্তি আমার নেই। আমি খুবই দূর্বল। কেউ কিছু বললে আমি মোটেও তা সইতে পারি না। ”
এই বলে আমি নিমিষের মাঝে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
” আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়া শেষ। এবার আমি উঠি। প্লিজ আমাকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। ”
এই বলেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলাম। আশপাশে না চেয়ে চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে এলাম। পিছে আদ্রিশ আমাকে একটিবারের জন্যও ডাকলেন না। হ্যাঁ, এটাই চাইছিলাম আমি। আমি চাইছিলাম আদ্রিশের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে। অবশেষে আমি হয়তো সে সিদ্ধান্তে সফল হতে চলেছি। তবে এ সফলতা আমার জন্য আনন্দ বয়ে আনলো না। বরং কোথাও একটা সুক্ষ্ম তবে ভোঁতা যন্ত্রণা কাজ করলো। কিন্তু আমি চাইলেই এ যন্ত্রণাকে দূর করতে পারবো না। বরং এ যন্ত্রণাকে তিলে তিলে ভোগ করতে হবে আমাকে। এর কারণও আছে অবশ্য, যা আদ্রিশের অজানা।
#চলবে