#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৩৯
পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম আমি। মাথার উপর স্থির অবস্থানে থাকা ফ্যানের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম আমি। অতঃপর পাশ ফিরে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম, জায়গাটা আমার পরিচিত নয়। তবে পুরোপুরি অপরিচিতও নয়। পুরো রুমের এক মাথা হতে অপর মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা আদ্রিশের রুম৷ কিন্তু আমি এ রূমে এলাম কি করে?
আচমকা আপুর কথা মনে পড়তেই আমি চট করে উঠে বসলাম। মনে হাজারো প্রশ্নের মেলা বসলো যেনো। আপু কোথায়? আপুকে কি সত্যি কিডন্যাপ করেছে না কি অন্য কিছু? আপুর খোঁজ কি পেয়েছে ওরা? নাহ, কিছুই বুঝতে পারছি না। কাউকে জিজ্ঞেস করা দরকার। কিন্তু রুমেও তো কেউ নেই। সবাই গেলো কোথায়?
এই ভাবতে ভাবতে আমি দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। রুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম আব্বু আম্মু, আদ্রিশ, ইমাদ ভাইয়াসহ তিন বাড়ির প্রায় প্রতিটা সদস্য ড্রইং রুমে উপস্থিত। সকলের মুখশ্রীতে বিরাজমান রয়েছে দুশ্চিন্তার ছাপ। আম্মু ও আভা নীরবে কান্না করছে। আমি তাদের দেখে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম। আদ্রিশ আমাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন। শেষ দু সিঁড়ি এগিয়ে এসে হাত ধরে আমাকে নামতে সাহায্য করলেন। আমার দিকে চেয়ে নরম সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” এখন কেমন ফিল করছো মিশমিশ? দূর্বল লাগছে কি?”
আমি ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিলাম,
” হালকা একটু দূর্বল লাগছে। আগে বলুন আপুর কি হয়েছে? আমি যা আন্দাজ করছি এমন কিছুই হয়েছে?”
আদ্রিশ বুঝতে পারলেন আমি আপুর কিডন্যাপিং এর কথা বলছি। উনি মুখ ছোট করে বললেন,
” হ্যাঁ। নাফিসা ভাবীকে কিডন্যাপ করেছে। ”
আদ্রিশের কথায় আমি থমকে দাঁড়ালাম। যদিও আপুর কিডন্যাপিং এর কথা পূর্বেই আন্দাজ করেছিলাম তবুও আদ্রিশের জবানো এ কথা শুনে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। অঘোষিতভাবে দু চোখ বেয়ে টুপটুপ করে অশ্রু ঝরতে লাগলো। আদ্রিশ আমাকে নিয়ে এসে আম্মুর পাশে সোফায় বসালেন। আম্মু আমাকে দেখেই কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিলো। আমাকো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্ট কণ্ঠে বললো,
” আমার মেয়েটাকে কোথায় নিয়ে গেলো? কি করছে ওর সাথে? ও ঠিক তো আছে? নাফিসাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে মা? আমাকে বল না মা……”
আম্মুর এ করুণ কণ্ঠের সুর বারবার আমার কানে বাজতে লাগলো। এ কারণে আপুর জন্য চিন্তার পাহাড় পূর্বের তুলনায় আরো বৃদ্ধি পেলো। আম্মু আমাকে এভাবেই কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলো। অতঃপর আব্বু এসে আম্মুকে ছাড়িয়ে নিয়ে আভাকে বললো,
” আভা, তোর আম্মুকে নিয়ে গেস্টরুমে যা। বেচারি কান্না কান্না করতে শেষ হয়ে যাবে। ”
এই বলে আব্বু আম্মুকে বললো,
” এতো চিন্তা করো না। শুধু দোয়া করতে থাকো। আমাদের নাফিসাকে সহিসালামত পেয়ে যাবো ইন শা আল্লাহ। ”
আম্মু আব্বুর কথা শুনেও না শোনার ভান করলো। বরং পূর্বের তুলনায় আরো বেশি কাঁদতে লাগলো। আভা তা দেখে আম্মুকে জোরপূর্বক গেস্ট রুমে নিয়ে গেলো।
আম্মু চলে যেতেই আমি কান্না থামানোর চোখ করে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপুর কোনো খোঁজ পাওয়া গিয়েছে? ”
আদ্রিশ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” এখনও পাওয়া যায়নি।”
আমি আর প্রত্যুত্তর করলাম না। আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো লেডিস ওয়াশরুমের প্রতিটি ঘটনা৷ খানিক বাদে চারপাশের বিস্তর নীরবতা ভেঙে ইমাদ ভাইয়া আচমকা রেগে বলে উঠলেন,
” শা’লা বডিগার্ড দুটো এতোটা অকর্মা এটা জানতাম না। পাহাড়ের মতো শরীর নিয়েও যদি ওরা কাউকে প্রটেক্ট না করতে পারে তাহলে ঐ শরীরের ফায়দা কি? আমার মন চাইছে ঐ দুটোকে ইচ্ছামতো পিটাই। ”
এই বলে ইমাদ ভাইয়া কিছুক্ষণ থামলেন। ক্ষণিক বাদে পুনরায় বললেন,
” এতো সিকিউরিটি রেখে লাভ হলো কি? সেই শেষমেশ যার ভয়ে ছিলাম তাই হলো। আসলে মিম আর নাফিসাকে ঐ পিঁপড়ার মতো বডিগার্ডের ভরসায় দিয়ে বড় ভুল করে ফেলেছি। দরকার ছিলো আমার অথবা আদ্রিশকে সেখানে থাকা। ”
এই বলে ইমাদ ভাইয়া দু হাতে মুখ ঠেকিয়ে প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে লাগলেন। আর আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলাম। এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে,এতো সহজে আপুর কিডন্যাপিং হওয়ার পিছনে কোথাও না কোথাও আমিও দায়ী। আমি যদি ঐ বডিগার্ড দুটোকে দূরে দূরে না থাকতে বলতাম তাহলে হয়তো এ অঘটনটা ঘটতো না।
ইমাদ ভাইয়ার সম্পূর্ণ কথা শুনে কামাল আংকেল সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” কিসের ভয়ে ছিলি ইমাদ? তুই আগেই কি এসব আন্দাজ করেছিলি?”
কামাল আংকেলের এহেন প্রশ্নে আমার মনে ভয় ঢুকে গেলো। ইমাদ ভাইয়া যে কারণে বাসার সিকিউরিটি বাড়িয়েছেন তা আমরদ চারজন বাদে আর কেউ জানে না। এখন যদি ইমাদ ভাইয়া রাগের বশে সে কারণটা বলে দেয় তাহলে?
কামাল আংকেলের প্রশ্নের সাথে আব্বুও তাল মিলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কিসের কথা বলছো ইমাদ? নিজের মধ্যে কিছু রেখো না। আমাদের বলো। ”
ইমাদ ভাইয়া চট করে উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” আমার মাথাটা প্রচণ্ড ব্যাথা করছে। কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই। আদ্রিশ আমাকে তোর রুমে নিয়ে চল প্লিজ। ”
এই বলে উনি সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন। উনার পাশাপাশি আদ্রিশও সেদিকে পা বাড়ালেন। প্রথম সিঁড়িতে পা রেখেই ইমাদ ভাইয়া পিছে ফিরে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,
” মিম, তুমিও আসো। কিছু কথা আছে। ”
ইমাদ ভাইয়ার এহেন কথায় আমি কিছুটা দোদুল্যমান অবস্থায় পড়ে গেলাম। সামনের দিকে চেয়ে দেখলাম, এখানে উপস্থিত প্রতিটা মানুষের চেহারায় সন্দেহের সুক্ষ্ম ছাপের দেখা মিলছে। কোনো সন্দেহ নেই যে ইমাদ ভাইয়ার কথাবার্তায়ই সকলেই নানা কিছু সন্দেহ করেছেন। আমি নিমিষের জন্য সবার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নত করে ইমাদ ভাইয়া ও আদ্রিশের পিছু পিছু এলাম।
ইমাদ ভাইয়া ও আমি রুমে ঢুকতেই আদ্রিশ ভেতর থেকে দরজা আটকিয়ে দিলেন। উনাকে দরজা আটকিয়ে দিতে দেখে আমি সাথে সাথে দুজনকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনারা কেউ পুলিশকে জানাননি? ”
ইমাদ ভাইয়া ব্যালকনির দরজার সামনে দাঁড়ালেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” জানিয়েছি। কিন্তু পুলিশ এখনো রিপোর্ট লিখেনি। যদিও তারা ভেতরে ভেতরে খোঁজ করছে। ”
এ শুনে আমি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলাম। অতঃপর সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” এসব রোহান ভাইয়ার কাজ তাই না?”
ইমাদ ভাইয়া কিছু বললেন না। বরং আদ্রিশ হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
” ঐ কু”ত্তা ছাড়া আর কে-ই বা এতো জঘন্য কাজ করবে। ঐ…..”
আদ্রিশের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই উনার ফোনে একটি কল এলো। উনি পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে।”
ইমাদ এ শুনে সাথে সাথে ছুটে এসে আদ্রিশের সামনে দাঁড়ালেন। ব্যস্ত হয়ে বললেন,
” নিশ্চয়ই রোহান কল করেছে। রিসিভ করে লাউড স্পিকারে রাখ।”
আদ্রিশ ইমাদ ভাইয়ার কথামতো কল রিসিভ করে লাউড স্পিকারে রাখলেন। কল রিসিভ হতেই ওপাশে রোহান ভাইয়ার কণ্ঠ শোনা গেলো,
” আদ্রিশ….বন্ধু আমার। কেমন আছো তুমি? বহুদিন পর তোমাকে মনে করলাম।”
রোহান ভাইয়ার তীব্র উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ শুনে আমার শরীরে জ্বাল ধরলো। আদ্রিশ হাতের মুঠো শক্ত করে বললেন,
” ফোন করেছিস কেনো?”
ওপাশে রোহান ভাইয়া উচ্চস্বরে হেসে বললেন,
” এতো মাসুম হচ্ছিস কেনো আদ্রিশ? তুই জানিস না তোকে আমি কেনো কল করেছি? ”
আদ্রিশ কয়েক সেকেন্ডের জন্য নীরবে রয়ে আমাদের দিকে চাইলেন। অতঃপর রোহান ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
” নাফিসা ভাবীকে কেনো কিডন্যাপ করেছিস? ”
পুনরায় রোহান ভাইয়া হো হো করে হেসে উঠলেন।হাসির দমেকে বললেন,
” এই তো, নিজের ইন্টেলিজেন্সি বের করছিস তুই।”
” আমার প্রশ্নের জবাব দে রোহান। নাফিসা ভাবীকে কিডন্যাপ করার কারণ কি?”
রোহান ভাইয়া এ পর্যায়ে রসিয়ে রসিয়ে বললেন,
” কেনো আবার? আমার পুরোনো প্রেম সে। তাকে নিজের করে পেতে এনেছি আমার কাছে। তোরা তো ওর সাথে আমাকে মিল করিয়েই দিলি না। শেষমেশ বিয়ে দিলি ইমাদ নামের ঐ অকর্মার সাথে!”
রোহান ভাইয়ার কথা শুনে ইমাদ ভাইয়া প্রচণ্ড রেগে গেলেন। আদ্রিশের কাছ থেকে ফোন নিয়ে রোহান ভাইয়াকে দু চারটা গা’লি দিয়ে বললেন,
” নাফিসার যদি কিছু হয় তোকে আমি ছাড়বো না রোহান। ভালো মতো বলছি ওকে ঠিকঠাক বাসায় পৌঁছে দে।”
রোহান ভাইয়া ওপাশে বিস্মিত হওয়ার ভান করে বললেন,
” ও বাবা! এ দেখি ইমাদ সাহেব! তা কেমন আছেন ইমাদ সাহেব?”
” রোহান, তোর এসব কথাবার্তা আমার একদম সহ্য হচ্ছে না। নাফিসাকে ঠিকঠাকমতো বাসায় দিয়ে যা।”
” মামা বাড়ির আবদার না কি ইমাদ সাহেব? ওকে এতো সহজে ছেড়ে দিলে এতোদিন অপেক্ষায় থেকে আনতাম না কি!”
আদ্রিশ এবার উঠে এসে রাগত স্বরে বললেন,
” কি চাস তুই রোহান? তুই নিশ্চয়ই শুধু নাফিসা ভাবীকে ঐ কারনে কিডন্যাপ করিসনি। আর কি রিজন আছে?”
” এই যে, এই যে, এই হলেন আমাদের ট্যালেন্টেড, উপস মাল্টিট্যালেন্টেড আদ্রিশ সাহেব। দেখো তোমরা সবাই। আমাদের আদ্রিশ সাহেব কি মারাত্মক ট্যালেন্টের অধিকারী! ”
” রোহান, সোজাসুজি তোর ডিমান্ডে চলে আয়। ”
ওপাশে রোহান ভাইয়া আয়েশি ভঙ্গিতে হাই ছেড়ে বললেন,
” তোর ঐ ড্রাগের ফর্মূলা আমায় দিয়ে দে আমার নাফিসাকে নিয়ে যা। ”
আদ্রিশ সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন,
” মোটেও না। ঐ ড্রাগের ফর্মূলা তোর হাতে কিছুতেই দেওয়া যাবে না। তুই ভালো করেই জানিস ঐ ড্রাগ কারোর উপর এপ্লাই করা হলে কি হবে।”
” জি হ্যাঁ। আমি এও জানি যে ঐ ড্রাগ এখন যে পর্যায়ে আছে সে পর্যায়ে কোনোরকম কিছু হলেই তোদের কোম্পানি ব্যানড,লকড হয়ে যাবে। সাথে তুই আর তোর বাপ দু জনেই জেলে চলে যাবে। বাহ, ভারী মজাদার ইনফেকশন তো!”
রোহান ভাইয়া ও আদ্রিশের এহেন কথোপকথনে আমি ও ইমাদ ভাইয়া বিস্মিত চাহনিতে আদ্রিশের দিকে চেয়ে রইলাম। তাহলে রোহান ভাইয়া এসব করেছেন আদ্রিশের কাছ থেকে সেই ফর্মুলা পাওয়ার জন্য?
আদ্রিশ বললেন,
” এর ফল সবই তোর জানা। তারপরও এর পিছনে পরে আছিস কেনো?”
ইমাদ ভাইয়া শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” সেসব জেনে তোর লাভ নেই। আমি যেটা বলছি সেটা কর। আমার হাতে ঐ ফর্মূলা দিয়ে নাফিসাকে নিয়ে চলে যা। আর হ্যাঁ, ইমাদ সাহেব। আপনার বউকে ঠিকঠাক পেতে চাইলে আপনার বন্ধুকে আমার ডিলে রাজি হতে বলুন। ”
এই বলে রোহান ভাইয়া কল কেটে দিলেন। সাথে সাথে আমি ও ইমাদ ভাইয়া প্রশ্নাতুর চাহনিতে আদ্রিশের দিকে চাইলাম। আদ্রিশ আমাদের দিকে এক নজর চেয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন। বিরবির করে বললেন,
” আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছি ঐ রিসার্চট করে। ”
আমি আদ্রিশের সম্মুখপানে দাঁড়িয়ে বললাম,
” কি বানিয়েছেন আপনি যার কারণে রোহান ভাইয়া এভাবে আপনার পিছনে পরে আছে? এমনকি সে আপুকে পর্যন্ত কিডন্যাপ করে নিয়েছে!”
আদ্রিশ আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বরং হাঁটুর উপর দু-হাত রেখে থুতনিতে ভর দিয়ে বসে রইলেন। এবার ইমাদ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ব্যাপার আদ্রিশ? বল।”
আদ্রিশ মিনমিনে কণ্ঠে বললেন,
” এটা কনফিডেনসিয়াল। আপাতত তোদের সাথে শেয়ার করা সম্ভব হচ্ছে না। ”
আদ্রিশের এরূপ কথা শুনে ইমাদ ভাইয়া রেগে পাশে থাকা চেয়ারটা ফেলে বললেন,
” কিসের কনফিডেনসিয়াল? ওখানে নাফিসা বিপদে পড়েছে। আর তোর ফর্মুলা না কি হ্যানত্যানের কনফিডেনসিয়াল ব্যাপার যাচ্ছে না। কি নিয়ে এসব হচ্ছে। আমি সব শুনতে চাই। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি। ”
আদ্রিশ অসহায় চাহনিতে আমার ও ইমাদ ভাইয়ার দিকে তাকালেন। অতঃপর প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন……..
®সারা মেহেক
#চলবে
#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৪০
প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে আদ্রিশ বললেন,
“এমাইট্রোফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরেরোসিস। রোগটার নাম শুনেছো?”
আমি ও ইমাদ ভাইয়া এপাশ ওপাশ মাথা দুলালাম। অর্থাৎ আমরা কেউই এ রোগের নাম শুনিনি৷ ফলে আদ্রিশকে বললাম,
” না। এ রোগের নাম আজ প্রথম শুনছি। ”
আদ্রিশ ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” শোনারও কথা না। কারণ রোগটা পরিচিত কোনো না রোগ না৷ পরিচিত না হওয়ার কারণ আছে। কারন এ রোগ কোনো রোগ না। সবচেয়ে বড় কথা, এ রোগের কোনো কিউর নেই। দ্যাট মিনস কোনো চিকিৎসা নেই৷ পুরোপুরিভাবে ঠিক হয় না এটা। ”
উনার কথা শুনে আমার ভেতরে কৌতূহল জাগলো। আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কিন্তু এ রোগে আসলে হয় কি?”
” এটা নার্ভাস সিস্টেমের একটা ডিজিজ। যেটা ব্রেইন আর স্পাইনাল কর্ডকে ইফেক্ট করে। এর কারণে মানুষ মাসলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ”
” মাসলের নিয়ন্ত্রণ বলতে?”
” এই যেমন ধরো, মাসল দূর্বল হয়ে যাবে এ রোগে। আর যতই রোগটা বাড়বে ততই মানুষের হাতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। কথা বলা, হাঁটাচলা করা এমনকি শ্বাসপ্রশ্বাসেও সমস্যা হয়। ”
” এটা কি জেনেটিক্যালি হয়?”
” হ্যাঁ। সেক্ষেত্রে রোগের কারণগুলো জানা থাকে না। ”
” এ রোগে কি মানুষ মারা যায়?”
” অবশ্যই। ডাক্তাররা ধরাবাঁধা সময়ও দিয়ে দেয় রোগীকে। মাত্র কয়েক বছর। এই ধরো তিন থেকে পাঁচ বছর। কিন্তু এমনও হয়েছে যে ডাক্তারদের নির্ধারণ করে দেওয়া সময়ের চেয়েও বেশি সময় বাঁচে অনেকেই। স্টিফেন হকিংই তার উদাহরণ।”
আদ্রিশের কথায় আমি ও ইমাদ ভাইয়া বিস্মিত হলাম। বিস্ময় সহিত জিজ্ঞেস করলাম,
” এর মানে এই রোগটা স্টিফেন হকিংয়েরও হয়েছিলো!”
” হ্যাঁ। আর উনি তো উনার জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া সময়ের চেয়েও অনেক বেশিদিন বেঁচেছিলেন। ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন উনি৷ ”
” এ রোগে মানুষ ধরাবাঁধা সময়ই বেঁচে থাকে কেনো? মানে, এ রোগে কি কারণে মানুষ মারা যেতে পারে ঐ সময়ের মধ্যে?”
” এ রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশিরভাগ মানুষই মারা যায় রেসপিরেটরি ফেইলিউরের কারণ। অর্থাৎ শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হওয়ার কারণে। শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যাও হয় সেই মাসল অর্থাৎ মাংসপেশির কারণে৷ এক্ষেত্রে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার সময় যে মাসলগুলো সাহায্য করে সেগুলো প্যারালাইসিস হয়ে যায়। এর কারনে মানুষ মারা যায়। তবে অনেক সময় শ্বাসপ্রশ্বাসে সাপোর্ট করার জন্য ট্রাকিওটমিও করা হয়। ”
এই বলে আদ্রিশ প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আমি উনার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা শেষে উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিলেই ইমাদ ভাইয়া সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” এর মানে এই রোগের সাথে তোর ফর্মুলার কোনো সম্পর্ক আছে? ”
আদ্রিশ হতাশাজনক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” হ্যাঁ। আর এটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। ”
এই বলে আদ্রিশ ক্ষণিকের জন্য থামলেন। অতঃপর বললেন,
” এই রোগ পুরোপুরিভাবে ঠিক করা যায় না। তবে কিছু থেরাপির মাধ্যমে এটার উপশম করা যায়। আমার মাথায় কি চলছিলো আল্লাহ ভালো জানেন। অনেকদিন ধরেই এই রোগটা সম্পর্কে অনেক রিসার্চ করছিলাম। এ রোগ হলে যেনো পেশেন্ট পুরোপুরিভাবে ঠিক হতে পারে সেজন্য একটা ড্রাগ ফর্মুলা খুঁজছিলাম। অনেক রিসার্চের পর একটা ড্রাগ বানাতে পেরেছি৷ কিন্তু এটা এখনও প্রসেসিং পর্যায়ে আছে। অর্থাৎ এতে আরো রিসার্চের প্রয়োজন। এখন ড্রাগটা যে পর্যায়ে আছে এটা যদি রোগীর শরীরে ইনজেক্ট করা হয় তাহলে রোগী কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যেতে পারে বা তার অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে পারে। যেখানে আমি রোগীর প্রাণ বাঁচাতে ড্রাগ ফর্মুলা বের করছি সেখানে আমি কিছুতেই চাইবো না রোগী মারা যাক। এজন্য এই ড্রাগ নিয়ে আরো রিসার্চ করতে হবে। ”
আদ্রিশের কথায় আমি বিস্ফোরিত নয়নে ক্ষণিকের জন্য উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ এতোদিন ধরে আমি উনাকে চিনি। অথচ উনি এ ব্যাপারে আমাকে ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেননি!
এই অব্দি উনার কাছে যা যা শুনলাম তাতেও আমার মনে প্রশ্ন রয়ে গেলো যে, রোহান ভাইয়া এখন কেনো ফর্মূলাটা চাইছেন? এ চিন্তার সূত্র ধরেই আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি ড্রাগটা পুরোপুরি বানিয়ে ফেললেই রোহান ভাইয়া সেটি চাইতে পারতেন। এখনই বা কেনো চাইছেন উনি?”
আদ্রিশ পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” ও চাইছে এ ড্রাগটা ইউজ করে আমার ক্যারিয়ার, আব্বুর কোম্পানির নাম নষ্ট করতে। এখন এ ড্রাগ ওর হাতে দেওয়ার পর ও যদি কোনো রোগীর শরীরে এটা ইনজেক্ট করে তাহলে রোগী নির্ঘাত মারা যাবে এবং এর সম্পূর্ণ দায়ভার পরবে আমার ও আমাদের কোম্পানির উপর। এ কারণে সরকার আমাদের কোম্পানিও বন্ধ করে দিতে পারে আর আমাদের রেজিস্ট্রেশনও ক্যান্সেল করিয়ে দিতে পারে। তাহলে বুঝতে পারলে রোহান কেনো এই ফর্মুলাটা চাইছে?”
সম্পূর্ণ ব্যাপারটি ধরতে পেরে আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ বসে রইলাম। রোহান ভাইয়া যে কতোটা খারাপ মানুষ তা চিন্তা করতেই আমার শরীর শিউরে উঠলো। আদ্রিশ আরো বললেন,
” আমার মনে হয় মিস্টার ইকবালের সাথে ও ডিল করেছে এই ফর্মূলা বাইরের দেশে বিক্রি করার জন্য৷ এমনও হতে পারে যে মিস্টার ইকবাল ফর্মুলাটা নিয়ে বাকি প্রসেসিং করিয়ে এটা নিজের নামে চালাবেন। হয়তো……”
আদ্রিশের কথা সম্পূর্ণ শেষ হতে না হতেই আবারো উনার ফোনে কল এলো। স্ক্রিনে শুধু নাম্বার দেখেই আদ্রিশ সুপ্ত রাগ নিয়ে বললেন,
” রোহান আবারো কল করেছে। ”
উনার কথা শোনামাত্রই ইমাদ ভাইয়ার চেহারার রঙ বদলিয়ে গেলো। উনি উদ্বিগ্নতার সহিত আদ্রিশকে বললেন,
” কল রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিস আদ্রিশ।”
আদ্রিশ ইমাদ ভাইয়ার কথামতো কাজ করলেন। কল রিসিভ করতেই ওপাশে রোহান ভাইয়া বললেন,
” ওহ হ্যাঁ, তোদেরকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন দেওয়া হয়নি। ”
আদ্রিশ কিছুটা ক্রোধান্বিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ইনফরমেশন দেওয়া বাকি আছে তোর?”
রোহান ভাইয়া প্রচণ্ড উৎসুকভাবে বললেন,
” তোর নাফিসা ভাবীর প্রাই’ভেট ভিডিও আছে আমার কাছে। বুঝতে পারছিস? ওর শা’ও’য়া’র নেওয়ার ভিডিও আছে আমার কাছে। ”
এই বলে রোহান ভাইয়া পৈশাচিক আনন্দে হেসে উঠলেন।
রোহান ভাইয়ার এ কথা শোনার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি নিজের কানকে কিছুতেই এ কথা বিশ্বাস করাতে পারলাম না। আকস্মিক ঘটনার ধাক্কায় আমি ধপ করে নিচে বসে পড়লাম। স্তব্ধ চাহনিতে আদ্রিশের ফোনের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার পুরো পৃথিবী যেনো চক্কর দিতে শুরু করলো। শেষমেশ আমার আপুর ইজ্জত সম্মান সব খোয়া গেলো! রোহান ভাইয়া আমার আপুর মানসম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিলো!
ইমাদ ভাইয়া কোনো কথা বলছেন না। উনি স্তব্ধ চাহনিতে আদ্রিশের দিকে চেয়ে রইলেন। আদ্রিশের দৃষ্টিও একই। এরূপ অকল্পনীয় কিছু ঘটনার সম্মুখীন উনি হবেন তা হয়তো উনি কল্পনাও করেননি।
ক্ষণিক বাদে রোহান ভাইয়া বলে উঠলেন,
” কি ব্যাপার? সব দেখি এক্কেবারে চুপ হয়ে গেলো। বড়সড় ঝটকা লাগলো না কি রে?”
আমরা কেউই কোনোরূপ কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে রইলাম না। কয়েক সেকেন্ড বাদে আদ্রিশ থমথমে গলায় বললেন,
” এজন্যই তুই নাফিসা ভাবীকে কিডন্যাপ করেছিস? ”
” অবভিয়েসলি….. আমার কাছে একটা মেয়ের এতো বড় দূর্বল জিনিস রয়েছে আর সেটার আমি ফায়দা উঠাবো না। এটা টোটালি ইম্পসিবল দোস্ত। তোর ফর্মুলা পাওয়ার জন্য আমি প্রথমে তোর ওয়ান এন্ড ভালোবাসা মিমকে কিডন্যাপ করার প্ল্যানিং করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে নাফিসার ভিডিও পাওয়ার পর আমার পুরো প্ল্যানই চেঞ্জ হয়ে গেলো। শেষমেশ প্ল্যান মোতাবেক আমি নাফিসাকে কিডন্যাপ করাই।
এখন সবচেয়ে বড় কথা…… তুই বা তোর পরিবারের কেউ যদি নাফিসার কিডন্যাপের ব্যাপারে পুলিশ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিস, তাহলে আই সয়্যার, নাফিসার ভিডিও আমি ভাইরাল করে দিবো। তখন বুঝে নিস, কত ধানে কত চাল। তাহলে নাফিসাকে ছাড়িয়ে নিতে কি করতে হবে তোকে? সিম্পল, ফটাফট আমাকে ফর্মুলা দিবি আর নাফিসাকে নিয়ে যাবি। ”
এই বলে রোহান ভাইয়া খট করে কল কেটে দিলো। (বি:দ্র: আজকের পর্বে আমি যে রোগটি সম্পর্কে আলোচনা করেছি তার সবটাই সত্য। নেট থেকে ইনফরমেশন কালেক্ট করে লিখেছি। সবচেয়ে বড় কথা, গল্পের প্রয়োজনে আমি এটা ব্যবহার করেছি যে রোগটি সারিয়ে তোলার জন্য ড্রাগ বা মেডিসিন উদ্ভাবন করা হয়েছে। কিন্তু আসলে এ রোগ পুরোপুরি সারিয়ে তোলার জন্য কোনো ড্রাগ বা মেডিসিন উদ্ভাবন করা হয়নি৷ আমি গল্পের প্রয়োজনে কাল্পনিকভাবে এটি ব্যবহার করেছি। তাই দয়া করে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না।
®সারা মেহেক
#চলবে