ভুলবশত প্রেম পর্ব-৪৫+৪৬

0
565

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৪৫

ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালাচ্ছেন আদ্রিশ৷ উনার পাশে ফ্রন্ট সিটে বসে আছি আমি এবং আপু ও ইমাদ ভাইয়া পিছনের সিটে বসে আছেন। আপুর অবস্থা খুব একটা ভালো না। আপুকে পাওয়ার পর থেকে আপু টু শব্দটুকুও মুখ দিয়ে বের করেনি৷ শুধু নিঃশব্দে কেঁদে গিয়েছে। রোহান ভাইয়াকে নিয়ে যাওয়ার পর আমি কিছুক্ষণ আপুর সাথে ছিলাম। চেষ্টা করেছি, আপুর সাথে কথা বলার। কিন্তু আপু একটি কথাও বলেনি আমার সাথে। বরং বিরতিহীনভাবে কান্না করে গিয়েছে। এর কারণটাও অবশ্য অজানা নয় আমার। এ ঘটনায় আপু বড়সড় একটা ধাক্কা পেয়েছে। জানি, এ বাজে ঘটনার স্মৃতি থেকে নিজেকে সামলে নিতে আপুর যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন।

ইমাদ ভাইয়া আপুকে সামাল দিচ্ছে। আপু এখন কান্না করছে না ঠিকই। তবে থমথমে এবং বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ইমাদ ভাইয়ার কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে। আদ্রিশ ড্রাইভিং করতে করতে গাড়ির ইনার মিরর দিয়ে একবার পিছনের পরিস্থিতি দেখে নিলেন। অতঃপর আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
” বাসায় জানিয়ে দিয়েছো?”

আমি ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
” হুম।”

এবার উনি ইমাদ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,
” তোদের ড্রাইভারকে বলে দিয়েছিস, ওখানে গিয়ে গাড়ি নিয়ে আসতে?”

ইমাদ ভাইয়া জবাব দিলেন,
” হুম বলে দিয়েছি। আচ্ছা শোন আদ্রিশ।”

” হ্যাঁ, বল। ”

” বাসায় নাফিসার কিডন্যাপিং এর কারণটা কি বলবো? এতোক্ষণ তো কোনোরকমের টালবাহানা করে লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন তো এ নিয়ে নির্ঘাত আলোচনা করবে। ”

ইমাদ ভাইয়ার কথা শুনে আমি ও আদ্রিশ দুজনেই চিন্তায় মগ্ন হলাম। আসলেই এর কারণটা কি বলা যায়? রোহান ভাইয়ার কথা বললে ব্যাপারটা খারাপ পর্যায়ে চলে যেতে পারে। আবার আদ্রিশের ফর্মুলার কথাও বলা যাবে না৷ এ যেনো উভয়সংকট! আমি খানিক চিন্তিত কণ্ঠে বললাম,
” রোহান ভাইয়ার কথাও বলা যাবে না। আবার আদ্রিশের ফর্মুলাটার কথাও বলা যাবে না। তাহলে কি বলবেন ইমাদ ভাইয়া?”

ইমাদ ভাইয়া তৎক্ষনাৎ জবাব দিলেন না। বরং খানিকটা সময় নিয়ে ভেবে বললেন,
” ভাবছি বলবো, ভার্সিটিতে পুরোনো এক বন্ধু আমার সাথে শত্রুতার জোরে শোধ তুলতে নাফিসাকে কিডন্যাপ করেছে। আমার মনে হয়, এটা বললে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না।”

ইমাদ ভাইয়ার বুদ্ধিটা বেশ পছন্দ হলো। এ ব্যাপারে আদ্রিশের মতামত জানার জন্য উনার দিকে তাকাতেই উনি বললেন,
” আইডিয়াটা মন্দ না। এটা বলেই আপাতত পার পেতে হবে। রোহানের ব্যাপারটা তো কিছুতেই কারোর সামনে আনা যাবে না। ”

আদ্রিশের সাথে আমরা দুজনেই সায় জানালাম।

.

ইমাদ ভাইয়াদের বাসায় আপুর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলো। শেষে সিদ্ধান্ত হলো, আপু এ সপ্তাহের বাকি তিনটে দিন রেস্ট করবে এবং আগামী সপ্তাহের শনিবারে আপুর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নতি ও পরিবর্তনের জন্য শহরের বাইরে কোথায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হবে। ইমাদ ভাইয়া ও আপুর সাথে অবশ্য আমাকে ও আদ্রিশকেও যেতে বলা হলো। এও ঠিক হলো যে, এ সপ্তাহের শুক্রবারেই আমার ও আদ্রিশের বৌভাতের অনুষ্ঠান করে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে বিদায় করবে। বৌভাতের এ অনুষ্ঠান আরো পরে করার কথা থাকলেও পরিস্থিতির শিকার হয়ে আব্বু ও আম্মু ভালোয় ভালোয় আমাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিতে চাইছে। এতে অবশ্য কেউ দ্বিমত পোষণ করেননি। কারণ আপুর এ অবস্থা দেখার পর সবাই আমাকে নিয়ে খানিক দুশ্চিন্তায় আছে। এজন্যই বৌভাতের সিদ্ধান্তটা আগে আগে নেওয়া হলো।

আপু ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। অবশ্য ঘুমানোর পূর্বে আপু দীর্ঘ সময় পর নিজের মৌনব্রত ভেঙেছিলো। তখন আপুকে দেখে মনে হয়েছিলো, আপু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে, স্বাভাবিকভাবে সবার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করছে৷ আপুকে স্বাভাবিক হতে দেখে আমরা সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
ঘুমানোর সময় ঠিক হলো, আম্মু ও আপু আপুদের রুমে ঘুমাবে, আমি ও আভা একরুমে এবং ইমাদ ভাইয়া ও আব্বু অপররুমে ঘুমাবে। আপাতত আজ রাতটুকু ইমাদ ভাইয়াদের বাসায় থেকেই আগামীকাল সকালে আমরা আমাদের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বো।

আদ্রিশ, নদী, আব্বু, আম্মু ইমাদ ভাইয়াদের বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমরা সকলে যে যার মতো শুয়ে পড়ি। আভা ও আমি নিচের গেস্টরুমটায় শুয়ে পড়লাম। শোবার কিছুক্ষণের মধ্যেই আভা ঘুমিয়ে পড়লো। আমারও চোখ দুটো ঘুমুঘুমু হয়ে এলো। কিন্তু পুরোপুরিভাবে ঘুমের দেশে চলে যাওয়ার পূর্বেই আমার ফোনটা তারস্বরে বেজে উঠলো৷ আধো আধো ঘুমে চমকে উঠে আমি দ্রুত কল রিসিভ করলাম। কল রিসিভ করতেই ওপর পাশে আদ্রিশের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,
” মিশমিশ, এক্ষুনি বাইরে আসো। কুইক।”

এই রাতবিরাতে আদ্রিশের এহেন আদেশ শুনে মুহূর্তেই আমার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেলো। আমি চাপা ক্রোধ নিয়ে বললাম,
” পারবো না আসতে। ”

ওপাশে আদ্রিশ কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের সহিত জিজ্ঞেস করলেন,
” কেনো?”

আমি ঘুমু জড়ানো কণ্ঠে বললাম,
” কারণ এখন আমার ঘুম প্রয়োজন। ”

ওপাশে আদ্রিশ লঘুগামী কণ্ঠে বললেন,
” কিন্তু আমার তোমাকে প্রয়োজন। ”

” আপাতত এ প্রয়োজনটা ভুলে যান। ”

” তা যে অসম্ভব। ”

এবার আমি বেশ বিরক্ত হলাম। বললাম,
” এখন অসম্ভবকে সম্ভব করুন। আর আমাকে ঘুমাতে দিন। ”

আদ্রিশ এবার কড়া গলায় বললেন,
” মিশমিশ, আর একবার বলছি, এক্ষুনি বাইরে আসো। ”

আমি আদ্রিশের কথা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে বললাম,
” সরি মিস্টার আদ্রিশ, মিশমিশ ইজ নট এভেইলেবল নাউ। ”

” মিশমিশ…..বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। ”

আমি আদ্রিশের কথা পূর্বের ন্যায় উপেক্ষা করে বললাম,
” দ্য পার্সন ইউ আর ওয়ান্ট টু মিট ইজ কারেন্টলি আনরিচেবল। প্লিজ ট্রাই এগেইন লেটার।”
এই বলে আদ্রিশকে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে টুট করে কল কেটে দিলাম আমি। চোখ বন্ধ করে পুনরায় ঘুমানোর চেষ্টায় মত্ত হলাম আমি। কিন্তু মিনিট খানেকের মাঝেই গেস্টরুমের জানালায় খটখট আওয়াজ হতে লাগলো। আমি ভীষণ বিরক্তি নিয়ে চোখ মেলে ওপাশে আদ্রিশকে দেখতে পেলাম। আধো আঁধারি পরিবেশে আমার আধো ঘুমের কারণে আচমকা আদ্রিশকে দেখামাত্র আমি চমকে উঠলাম। দু চোখে ঘুমের যে রেশ ছিলো তাও ধীরেধীরে হারিয়ে যেতে লাগলো। আমি আদ্রিশকে দেখে তৎক্ষনাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ রাগত স্বরে আদ্রিশকে বললাম,
” এই ছেলে এই, সমস্যা কি?”

এ পর্যায়ে আদ্রিশ আমার প্রতিক্রিয়ার কোনো তোয়াক্কা করলেন না৷ বরং গরম চোখে চেয়ে বললেন,
” ভালভাবে বলছি, বেরিয়ে আসো। না হলে এই জানালায় খটখট শব্দ করে আভার ঘুম ভাঙিয়ে দিবো। তখন সামলে নিয়ে ব্যাপারস্যাপার।”

আমি পড়লাম মহাবিপদে। আদ্রিশের এরূপ হুমকিধামকি সম্পন্ন কথায় আমি নিরুপায় হয়ে পড়লাম৷ সাধের ঘুমের বিসর্জন দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,
” আপনি মানুষটা বড্ড খারাপ। ”

আদ্রিশ ঠোঁট কুঁচকে হাসির ভান করে বললেন,
” আই নো। এবার ফটাফট বেরিয়ে আসো। ”

আমি জানালার এপাশ হতেই পূর্বের ন্যায় বললাম,
” আসছি আসছি। এসে আগে আপনার মাথা ফাটাবো। তারপর শান্তিতে ঘুমাবো। ”
এই বলে আমি কালবিলম্ব না করে চুপিসারে খুব সাবধানতা অবলম্বন করে রুমের দরজা খুলে ড্রইং রুমে এলাম৷ অতঃপর প্রধান দরজা খুলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলাম। ইমাদ ভাইয়াদের গার্ডেন এরিয়াতে আসতেই আদ্রিশের দেখা মিললো। ক্ষীণ জ্যোৎস্নাময় রাতে উনার মুখশ্রী কিঞ্চিৎ দৃশ্যমান হলো। আমায় বেরুতে দেখে উনি মুচকি হাসলেন। তবে উনাকে দেখে আমার মোটেও মুখ ফুটে হাসি বেরুলো না। কারণ এ মুহূর্তে ঘুম নামক প্রয়োজনটা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু আদ্রিশের জন্য আমি ঘুমকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না।

আমি বড় বড় পা ফেলে আদ্রিশের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝেঁঝে উঠা গলায় বললাম,
” আমার সুন্দর ঘুমটাকে নষ্ট করে কি সুন্দর মুচকি হাসছেন আপনি! নির্দয় মানুষ একটা৷ ”

আমার কথা শুনে আদ্রিশ হো হো করে হেসে উঠলেন। আচমকা আমার গাল দুটো টেনে আদুরে গলায় বললেন,
” ইশ! মিশমিশের ঘুম নষ্ট হয়ে গিয়েছে! কি কষ্ট! কিন্তু কি আর করার বলো। সে যে আমার ঘুমটা নষ্ট করে দিয়েছে। তাই তাকে কি আর শান্তিতে ঘুমাতে দেওয়া যায়? হুম?”

আমি বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে বললাম,
” খামোখা আমার উপর মিথ্যে অভিযোগ আনবেন না। আপনার ঘুম নষ্টের জন্য আপনি নিজেই দায়ী। এই যে এখন আমার সাথে দেখা করতে না এসে বিছানায় গড়াগড়ি করলেই ঘুম এসে যেতো। হুহ…..”

আদ্রিশ মিটিমিটি হেসে বললেন,
” এখনও তোমার চোখে ঘুম আছে?”

আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
” তা নয়তো কি। গতকাল রাতে ঠিকমতো ঘুমুতে পারিনি। আবার আজকের দিনেও শরীরের উপর কম ধকল যায়নি। আমার কাঁচা ঘুমটাকে বারোটা বাজিয়ে আবার জিজ্ঞেস করছে, আমার চোখে এখনও ঘুম আছে কি না! বেয়াদব লোক একটা। ”

আদ্রিশ আমার এহেন কথায় প্রাণখোলা হাসি দিলেন। অতঃপর অকস্মাৎ আমার হাত দুটো ধরে আপাদমস্তক ঘুরিয়ে নিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। গলার স্বর খাদে নামিয়ে ধীরলয়ে বললেন,
” আমার ঘুম কুমারী মিশমিশ, অন্যের ঘুম নষ্ট করে এতো সহজে কি করে ঘুমাতে চাও তুমি?”

উনার এ স্পর্শ ও কণ্ঠস্বরে মুহূর্তেই আমার ঘুম পুরোপুরি উধাও হয়ে গেলো। কিঞ্চিৎ সংকুচিত হয়ে এলাম আমি। জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনার কি সত্যিই ঘুম পাচ্ছে না?”

” উঁহু। ”

” শরীর কি একটুও ক্লান্ত লাগছে না?”

” উঁহু। ”

প্রতি প্রশ্নে আদ্রিশের না বোধক জবাব শুনে আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
” আপনি পারনেও বটে। ”

আদ্রিশ প্রত্যুত্তরে ক্ষীণ শব্দে হেসে বললেন,
” যে মানুষটার প্রয়োজন তোমার জন্য অপরিহার্য তার থেকে দূরে থাকাটা অসাধ্য মিশমিশ। ”

” কোনো মানুষকে নিজের জন্য এতোটাও অপরিহার্য করা ঠিক না আদ্রিশ।”

” ঠিক বেঠিক কিছু জানি না৷ তুমি আমার জন্য অপরিহার্য, অবধারিত একজন। মাঝে মাঝে তোমার অনুপস্থিতি আমায় এমনভাবে জাপ্টে ধরে যে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়৷ মন চায় তখনই গিয়ে তোমাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে। অবশ্য আর তিনদিন বাদে তোমার অনুপস্থিতি আর অনুভব করবো না৷ কারণ তখন তুমি সবসময়ের জন্য আমার কাছে থাকবে। ”

আমি প্রত্যুত্তরে ক্ষীণ শব্দে হেসে বললাম,
” যদি হঠাৎ করে এ সিদ্ধান্ত বদলে যায় যে তিনদিন পর রিসেপশন হবে না। তাহলে?”

আদ্রিশ তৎক্ষনাৎ ঘোর প্রতিরোধ করে বললেন,
” মিছিল মিটিং করে হলেও এ সিদ্ধান্ত অটল রাখার চেষ্টা করবো৷ কারণ আমার আর তর সইছে না মিশমিশ। ”

আদ্রিশের কথায় আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। উনি হয়তো তা উপলব্ধি করতে পারলেন। আমার কাঁধে থুতনি রেখে ধীরলয়ে বললেন,
” এ কথায় এতো লজ্জা! না জানি তিনদিন পর তোমার কি হবে!”

আমি এবার আরো লজ্জায় পড়ে গেলাম। ফলস্বরূপ উনার নিকট হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে পেলব গলায় বললাম,
” আপনি কি কখনো শুধরাবেন না আদ্রিশ? বড্ড বেহায়া আপনি। ”

আদ্রিশ মুচকি হেসে দু হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে বললেন,
” উঁহু। প্রেমিক পুরুষেরা কখনো শুধরায় না৷ প্রিয়তমার জন্য তারা সর্বদা বেহায়া হতে প্রস্তুত। ”

উনার প্রত্যুত্তরে আমি মুচকি হেসে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
” এখনই চলে যাবেন আপনি?”

” কেনো? আমাকে যেতে দিতে মন চাইছে না? অবশ্য তুমি বললে আমি এক পা-ও নড়বো না এখান থেকে। ”

” আচ্ছা? জ্যোৎস্না বিলাস করবেন?”

আদ্রিশ ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে আকাশের দিকে একবার চাইলেন। অতঃপর বললেন,
” আজ তো পূর্ণিমা না। তাহলে?”

আমি তৎক্ষনাৎ জবাব দিলাম না। বরং এগিয়ে এসে আদ্রিশের পাশে দাঁড়ালাম। উনার ডান হাতের বাহু ধরে আমিসহ আচমকা উনাকে ঘাসের উপর বসিয়ে দিয়ে বললাম,
” পূর্ণিমা না তো কি হয়েছে? আকাশে হালকা জ্যোৎস্না তো আছে। এই হবে। ”

আদ্রিশ প্রত্যুত্তরে টিপ্পনী কেটে বললেন,
” কি ব্যাপার মিশমিশ? হঠাৎ রোমান্টিক মুডে কনভার্ট হয়ে গেলে যে?”

আমি মৃদু শব্দে হেসে বললাম,
” এনি প্রবলেম?”
এই বলে আমি উনার কাঁধে মাথা রাখলাম। উনি তড়িঘড়ি করে বললেন,
” উঁহু, কোনো প্রবলেম নেই। আমি তো চাই, তুমি সবসময় এমন রোমান্টিক মুডে থাকো। ”

উনার কথার ঘোর বিরোধিতা করে তৎক্ষনাৎ বললাম,
” ইশ! শখ কত ছেলের! আমি আপনার মতো বেহায়া নই। ”

আদ্রিশ ক্ষীণ শব্দে হাসলেন। অতঃপর আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,
” তো, বেহায়া হও। নিষেধাজ্ঞা আছে না কি কোনো?”

” উহুঁ। ইচ্ছুক নই আমি। এবার চুপচাপ বসে থাকুন তো। ”

আমার কথার প্রত্যুত্তর দিলেন না আদ্রিশ। চুপচাপ বসে রইলেন৷ উনার কাঁধে মাথা রেখে আমি রূপালি সৌন্দর্যে মণ্ডিত চাঁদখানা দেখতে লাগলাম। আম গাছের আড়ালে উঁকি দিয়ে থাকা চাঁদখানা দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে, অর্ধ পূর্ণিমাতেও চাঁদমামা আজ তার সকল সৌন্দর্য উজার করে বসে আছে। এ সৌন্দর্য কি আমাদের উপভোগ করার জন্য? আজ কি তবে চাঁদমামা আমার ও আদ্রিশের জন্য নিজের সৌন্দর্যের একাংশ উৎসর্গ করলো? হয়তো সে করলো। আমাদের ক্লান্তিময় রাতটা স্নিগ্ধময় রাতে পরিণত করলো। উষ্ণ ভালোবাসা মণ্ডিত সময়টা আদুরে ভালোলাগার পরশে আচ্ছাদিত করলো। মন চাইছে, স্নিগ্ধ এ সময়টাকে এখানেই স্থির করে দেই। মন চাইছে, আদ্রিশকে এ অনুভূতি সম্পর্কে চুপিসারে জানিয়ে দেই। কিন্তু আমি যে বড্ড অন্তর্মুখী! এ অনুভূতি জানানোর সাধ্য আমার নেই।

আদ্রিশের কাঁধে মাথা রেখে জ্যোৎস্না বিলাস করতে করতে কখন যে আমি ঘুমের দেশে তলিয়ে গিয়েছি আল্লাহ জানে! আচমকা হুঁশ ফিরে আসতে আমি তড়িঘড়ি করে উনার কাঁধ থেকে মাথা তুলে অবিন্যস্ত চাহনিতে উনার দিকে চাইলাম। তীব্র অপরাধবোধ হতে জিজ্ঞেস করলাম,
” আমি কি অনেক সময় ঘুমিয়েছি? ”

আদ্রিশ ঈষৎ হেসে হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন,
” বেশি না। মাত্র আধ ঘণ্টা। ”

বিস্ময়ে চোখজোড়া বড় বড় করে বললাম,
” আধ ঘণ্টা! এতোক্ষণ হয়ে গিয়েছে! সরি সরি। আপনার কাঁধটা নির্ঘাত ব্যাথা করে দিয়েছি আমি। বুঝতেই পারিনি এভাবে ঘুমিয়ে পড়বো আমি। ”

আদ্রিশ স্নিগ্ধপূর্ণ হাসি দিয়ে আমার গালে হাত রাখলেন। আদুরে গলায় বললেন,
” সত্যিই তুমি ভীষণ ক্লান্ত আজ। যাও রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমিও চলে যাই। ”
এই বলে আদ্রিশ উঠে পড়লেন। উনার দেখাদেখি আমিও উঠে পড়লাম। কেনো যেনো উনাকে যেতে দিতে মন চাইছে না। মন বলছে, পুরো রাতটা উনার পাশে কাটিয়ে দিতে। উনার কাঁধে মাথা প্রশান্তির ঘুম ঘুমাতে। মনের এ ইচ্ছে উনাকে বলার প্রস্তুতি নিতেই উনি বললেন,
” অনেক রাত হয়ে গিয়েছে মিশমিশ। আভা যদি হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে তোমাকে না দেখে তাহলে নিশ্চিত চিন্তা করবে। কি ভরসা তোমায় না পেয়ে আব্বু আম্মুকে ডেকে আনবে! তখন কিন্তু ব্যাপারটা বড্ড অগোছালো হয়ে যাবে৷ এর চেয়ে বরং তুমি এখনই চলে যাও। ”

আদ্রিশের যুক্তির সাথে আমি সায় দিলাম। আমার আকুল ইচ্ছেকে বিসর্জন দিয়ে বললাম,
” আচ্ছা। যাই তাহলে। আপনিও গিয়ে এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বেন। ”

আদ্রিশ মুচকি হেসে বললেন,
” জো হুকুম মেরে আকা।”
উনার কথায় আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম। অতঃপর কিয়ৎক্ষণের জন্য উনার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়ালাম। দু কদম যেতেই আদ্রিশ পিছন থেকে ডাকলেন,
” মিশমিশ? ”

আমি তৎক্ষনাৎ উনার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি?”

আদ্রিশ জবাব দিলেন না। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আমার সম্মুখপানে দাঁড়ালেন। প্রগাঢ় গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” প্রিয়তমার সাথে দেখা হলে কি করতে হয় জানো?”

আমি প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে আদ্রিশের দিকে পানে চাইলাম। লাজুক কণ্ঠে বললাম,
” উঁহু, জানি না৷ ”

আদ্রিশ মুচকি হাসলেন। আচমকা আমার আরো নিকট এসে আমার গালে দু গালে হাত রাখলেন। অতঃপর আমার কপালে আলতো ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বললেন,
” প্রিয়তমার ললাটে মিষ্টি ভালোবাসার পরশ এঁকে দিতে হয়।”

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৪৬

রিসেপশনের পর অন্যান্য মেয়েরা যেখানে বাবার বাড়ি যায়, সেখানে রিসেশনের পর আমি শ্বশুরবাড়িতে চলে এলাম৷ এমনটাই অবশ্য হওয়ার ছিলো। কারন অন্যান্যদের মতো বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি না এসে বাবার বাড়ি থেকেছি আমি।

আদ্রিশদের বাড়িতে আসার পর আপু ও জেবা ভাবী আমাকে আদ্রিশের রুমে দিয়ে গিয়েছে। আপুর অবস্থা এখন তুলনামূলক বেশ ভালো। সেদিনের ঘটনার পর থেকে আপু এমনকি আমরা কেউই এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে আর আলোচনা করিনি। কারণ আমরা প্রত্যেকেই চাইছি আপু ঘটনাটি সম্পূর্ণরূপে ভুলে যাক। আপু নিজেও এ চেষ্টায় আছে।

আমাকে রুমে দিয়ে আপু ও জেবা ভাবী চলে গেলেন। ফুলে সাজানো রুমের বিছানার মাঝ বরাবর বসে আছি আমি। অপেক্ষা আদ্রিশের। কিন্তু দশ পনেরো মিনিট পার হওয়ার পরও যখন আদ্রিশ এলেন না তখন ভীষণ বিরক্তি নিয়ে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। আজকের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হওয়া সত্ত্বেও ভারী লেহেঙ্গা ও গহনাদির জন্য ভীষণ গরম লাগছে আমার। এতোক্ষণ অব্দি অপেক্ষা করার পরও আদ্রিশের নামনিশানা না পাওয়ায় আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। বিছানা থেকে নেমেই আমি হাতের চুড়িগুলো খোলা শুরু করলাম। কিন্তু তন্মধ্যে আচমকা রুমের দরজা খুলে আদ্রিশ রুমে প্রবেশ করলেন। আমায় আয়নার সামনে হাত থেকে চুড়ি খুলতে দেখে আদ্রিশ দ্রুত রুমের দরজা লাগিয়ে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। ঈষৎ আঁতকে উঠার প্রয়াস করে বললেন,
” এসব কি মিশমিশ! চুড়ি খুলছো কেনো?”

আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য স্থির দৃষ্টিতে আদ্রিশের দিকে তাকালাম। অতঃপর ঠোঁট বাকিয়ে ভেঙচি কেটে বললাম,
” তো কি করবো শুনি? সারারাত পরে থাকবো না কি?”

আদ্রিশ তৎক্ষনাৎ জবাব দিলেন না। বরং আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন। আমার গাল দুটো আলতো করে টেনে বললেন,
” ভেঙচি কাটলে একদম বাচ্চাদের মতো মনে হয় তোমাকে। ”
এই বলে উনি ড্রেসিং টেবিলের উপর হতে কিছু সংখ্যক চুড়ি নিয়ে আমার হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
” সাজটা যেহেতু আমার জন্য সেহেতু আমি প্রাণভরে যদি তোমায় না-ই দেখলাম তাহলে কি সাজের কোনো মূল্য রইলো?”

আমি নিশ্চুপ রয়ে আড়চোখে আদ্রিশের পানে চাইলাম। আদ্রিশ চুড়ি পরানো শেষে বললেন,
” আমি মানুষটা একান্তই তোমার। এতো লুকোচুরি করে দেখার কিছু নেই। সরাসরি দেখলেই পারো।”

আদ্রিশের ফোঁড়ন কাটায় আমি লজ্জায় চুপসে গেলাম। ফলস্বরূপ নত মস্তকে উনার স্পর্শ হতে নিজেকে কিঞ্চিৎ দূরে সরিয়ে নিলাম। উনি আমার এ কাজে ঈষৎ হাসলেন। অতঃপর বললেন,
” আজ মন ভরে তোমায় দেখবো মিশমিশ। তোমার স্নিগ্ধ রূপের পরশে আজ পুনরায় তোমার ভালোবাসায় মত্ত হবো আমি। আজ আমাকে বাঁধা দেয়ার কেউ নেই। স্বয়ং তুমিও না।”
এই বলে আদ্রিশ আমার নিকটে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে পিছানোর সুযোগ না দিয়ে অকস্মাৎ আমার কোমড় চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন উনি৷ ঘটনার প্রেক্ষিতে আমি কিঞ্চিৎ চমকে উঠলাম। ফলস্বরূপ উনার সাথে ক্ষীণ সময়ের দৃষ্টি বিনিময় হলো। পুনরায় দৃষ্টি নত করার সুযোগকে প্রশমিত করে উনি অপর হাত দিয়ে আমার থুতনি ধরে বললেন,
” আমার চোখে চোখ রেখে রাখতে পারবে না?”

আমি লজ্জামিশ্রিত চাহনিতে অবিন্যস্তভাবে এদিক ওদিক চাইলাম৷ পেলব গলায় বললাম,
” উঁহু। এ দুঃসাধ্য সাধনের সাহস আমার নেই। ”

আদ্রিশ আমার থুতনি ছেড়ে আমার হাত ধরলেন। প্রতিটি আঙুলের ভাঁজে আঙুল পুরে ধীরলয়ে বললেন,
” জানো মিশমিশ? কারোর সাথে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়ার মতো ওয়াদা করা ভীষণ কঠিন৷ আর এ ভীষণ কঠিন কাজটা সেসময় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে যখন মন থেকে ভালোবাসার অনুভূতিটা আসে না৷
আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার সাথে কাটাতে চাই মিশমিশ। আমি চাই আমার সকল অনুভূতি তোমায় ঘিরেই থাকুক। বুড়ো বয়সেও যেনো আমরা লাঠি ভর দিয়ে একে অপরের হাত ধরে হাঁটতে পারি। এটাই চাওয়া। বিনিময়ে আমি চাই, তোমার অব্যক্ত ভালোবাসায় সবসময় আমায় সিক্ত করে রাখবে। পারবে তো?”

আদ্রিশের এ আকুল আবেদনে আমি অল্পবিস্তর কেঁপে উঠলাম। মন চাইছে উনার মতোই আপন সুরে আমার জবাবটা জানিয়ে দেই উনাকে। কিন্তু এতো সাহস কুলায় না আমায়। ফলে কম্পনমান কণ্ঠে জবাব দিলাম,
” এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। ”

আমার জবাবে আদ্রিশ মৃদু শব্দে হাসলেন। অতঃপর আমায় ধীরেধীরে ছেড়ে দিয়ে তিনি বললেন,
” যাও, চেঞ্জ করে আসো। তুমি চেঞ্জ করে আসার পর আমি যাবো৷ এতক্ষণ একটু এসিতে জিড়িয়ে নেই। ”

এই বলে উনি এসির রিমোট নিয়ে এসি চালিয়ে দিলেন। পরনের কোট খুলে প্যান্ট, শার্ট পরিহিত অবস্থায় উনি গিয়ে বসলেন বিছানার উপর। হাতের উপর ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় ফোন চালাতে লাগলেন। আমি আর দেরি না করে পরনের গহনাদি খোলা শুরু করলাম।
এ রুমের ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে বিছানার অর্ধেকাংশ দেখা সম্ভব। আমি ধীরেধীরে পরনের গহনাদি খুলছি আর আয়নার মাধ্যমে আদ্রিশকে দেখছি৷ উনাকে সরাসরি দেখার সুযোগটা নেই। কারণ উনি সর্বদা আমায় লজ্জা দিতে প্রস্তুত থাকেন। সুতরাং এমন মানুষকে আড়ালে দেখাই শ্রেয়। তবে আর যাই হোক না কেনো, এ মানুষটা তো শুধুই আমার। উনার উপর সকল প্রকার হক অধিকার আরোপ করার ব্যক্তিগত অধিকার রয়েছে আমার৷ মাঝে মাঝে মন চায় আমার মনের সকল অনুভূতি উনার সামনে খোলা বইয়ের ন্যায় মেলে ধরি৷ কিন্তু এ অনুভূতির কিতাব উনার সামনে খোলা মাত্রই তা অগোছালো শব্দগুচ্ছের ন্যায় জমাট বেঁধে যাবে৷ গাঢ় হয়ে জড় হবে কণ্ঠনালীতে। ফলস্বরূপ হৃদয়ের বুলিগুলো প্রকাশ করতে ব্যর্থ হবো আমি।
আয়না দিয়ে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি আদ্রিশকে। সাদা শার্টে দারুন মানিয়েছে উনাকে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, ঘন ভ্রুজুগল, খাড়া নাক সব যেনো একদম পরিমিত অনুপাতে সঠিক জায়গায় আছে। তার উপর এ মুহূর্তে ব্যাপৃত চোখজোড়ায় দেখা মিলছে রাজ্যের ব্যস্ততা। উনায় দেখে মনে হচ্ছে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু দেখছেন, ভাবছেন। মাঝে মাঝে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবুক মুখশ্রীতে ক্ষুদ্র দার্শনিকের ছাপ এঁকে রাখছেন। এ যেনো মুহূর্তেই শশব্যস্ত হয়ে পড়া অদ্ভুত এক মানুষের আত্মা!

.

রাত গভীর হওয়ায় শীতল অনুভূতিটা আরো জেঁকে বসলো। চুলে হেয়ার স্প্রে থাকায় এই গভীর রাতেও বাধ্য হয়ে চুলে শ্যাম্পু করতে হয়েছে আমার। ফলস্বরূপ অসময়ের এ কাজে শরীর হিম করে দেওয়া শীত লাগতে শুরু করলো। ভেজা, ঠাণ্ডা চুলগুলো ছেড়ে শীতে অল্প-বিস্তর কাঁপতে লাগলাম আমি। তন্মধ্যে আদ্রিশ ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলেন। আমায় এভাবে কাঁপতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” শীত লাগছে?”

আমি ঠোঁট জোড়া চেপে ধরে মাথা দুলিয়ে বললাম,
” হুম। ”

আদ্রিশের চেহারা এ পর্যায়ে আরো একটু উদ্বিগ্নতায় ছেয়ে গেলো। হাতে থাকা তোয়ালে দিয়ে তৎক্ষনাৎ আমার ভেজা চুলগুলো পেঁচিয়ে বললেন,
” তোমার শরীরে শীত যেহেতু এতো বেশি সেহেতু এই রাতে চুল না ভেজানোই উচিত ছিলো। ”

” না ভিজিয়ে উপায় ছিলো না। চুলে হেয়ার স্প্রে ছিলো। আর এই স্প্রে নিয়ে আজ ঘুমানো মানে চুলের বারোটা বাজানো। ”

আদ্রিশ মুখ দিয়ে ‘চ’ সূচক আওয়াজ বের করে বললেন,
” ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসো।”

” কেনো?”

” আহহা, প্রশ্ন না করে বসো তো।”

আদ্রিশের কথা মান্য করে বাধ্য মেয়ের মতো ড্রেসিং টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে পড়লাম। আদ্রিশ জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমার লাগেজে হেয়ার ড্রায়ার আছে না?”

” আছে তো। কিন্তু আমি ব্যবহার করবো না। ”

” কেনো? ”

” চুল নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। আর একবার এটার অভ্যেস হয়ে গেলে আমার মাথার সব চুল নাই হয়ে যাবে। ”

” বিপদে একদিন ব্যবহার করলে কিছু হয় না। ”
এই বলে আদ্রিশ আমার লাগেজ থেকে হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে এসে আমার চুল শুকিয়ে দিতে লাগলেন।
চুল প্রায় শুকিয়ে এলে আমার শীত শীত ভাবটা কমে গেলো। আমি পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। আদ্রিশ বললেন,
” এই কাজটা আগেভাগে করলে এই শীতটা আর লাগতো না।”
এই বলে উনি আয়নার মাধ্যমেই আমার দিকে চাইলেন। খোলা চুলে আলতো হাত বুলিয়ে স্নিগ্ধ গলায় বললেন,
” খোলা চুলে তোমার সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায় মিশমিশ। খোলা চুলে তুমি যেনো অন্য এক রমনী হয়ে উঠো। ”
বলেই উনি মুহূর্তমধ্যেই ভ্রু কুঁচকে ভাবুক গলায় বললেন,
” তবে এ সুন্দরী রমনীর সৌন্দর্যতায় একটি কমতি রয়ে গেলো। ওয়েট, এখানেই বসো। আমি আসছি।”
এই বলে উনি আমায় রেখে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ালেন। সেই সুযোগে আমি হেয়ার ড্রায়ারটা আপাতত লাগেজের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলাম।

আদ্রিশ ব্যালকনিতে গিয়ে মাধবীলতার এক গুচ্ছ এনে আমার সামনে দাঁড়ালেন। অতঃপর আলতো করে আমার বাম কানের পিছনে চুল সরিয়ে দিয়ে সেখানে মাধবীলতা গুঁজে দিয়ে স্মিতহাস্যে বললেন,
” এই না হলে পরিপূর্ণ রমনী। আদ্রিশের মাধবীলতা। ”

উনার প্রশংসামূলক বাক্যে আমি ঈষৎ লাজুকমিশ্রিত হাসি হাসলাম। উনি বললেন,
” তুমি কি জানো, মাধবীলতা ফুলে তোমার সুপ্ত সৌন্দর্যটা মন উজার করে প্রকাশ পায়?”

প্রত্যুত্তরে আমার বলার মতো কিছু রইলো না বিধায় চুপচাপ নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। আদ্রিশও কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। অতঃপর
অকস্মাৎ আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে মন্থর কণ্ঠে বললেন,
” একটা গোপন কথা কি জানো মিশমিশ?”

অকস্মাৎ উনার এহেন আগমন, উনার এ কণ্ঠস্বর আমায় স্থবির করে তুললো। আমি কোনো রকমে বললাম,
” কি গোপন কথা?”

আদ্রিশ আমার কানের আরো নিকটে ঠোঁট এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,
” তোমায় ভালোবাসি। অপরিমেয় ভালোবাসি। ”

এ প্রথম উনার মুখ নিঃসৃত ‘ভালোবাসি’ শব্দটি শোনা মাত্র আমার শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। অতিশয় অনুভূতিতে নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম হলো। হাত পা যেনো অবশ হয়ে এলো। এমতাবস্থায়ও আমি কি মনে করে কম্পিত কণ্ঠে ধীরলয়ে বললাম,
” তা আমার অগোচরে নেই আদ্রিশ।”

আদ্রিশ আমার কথায় ক্ষীণ শব্দে হেসে উঠলেন। আমার কোমড় চেপে পূর্বোক্ত অবস্থায় থেকে ক্ষণিকের বিরতি নিলেন। পুনরায় আচ্ছন্ন কণ্ঠে বললেন,
” ভালোবাসি জানো। তবে এ ভালোবাসার সীমা তোমার অজানা মিশমিশ। একজনকে কতোটা ভালোবাসলে নিজের মধ্যকার সবকিছু হারিয়ে সে নিঃস্ব হয়ে বসে তা তোমার জানা নেই মিসেস মিম আরসালান আহমেদ আদ্রিশ। এর পরিসীমা সম্পর্কে তুমি কখনও অবগত হতে পারবে না। কারণ তুমি কখনও আমার মতো ভালোবাসতে পারবে না। কখনও না। মাই লাভ হ্যাজ নো লিমিট মিশমিশ।”
®সারা মেহেক

#চলবে