ভুলিনি তোমায় পর্ব-১৩

0
3749

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :১৩

সকালবেলা।আটটা কি নয়টা।ফুফির পুরো পরিবারের সাথে ড্রয়িংরুমে বসে আছি। সবাই মিলে আলোচনা করছেন আর আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু আমি।অথচ উনারা নিজেরাই প্রশ্ন করছেন আর নিজেরাই উত্তর দিচ্ছেন।কিছুক্ষণ আগে যখন আমাকে ওই মহিলারা নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বড় আপু,কেয়া আপু আর রেদোয়ান ভাইয়া সবার সাথে তুমুলকান্ড বাঁধিয়ে আমাকে নিয়ে আসলেন।অতঃপর এখন উনারা সবাই মিলে কথাবার্তা বলছেন উহু তর্ক করছেন।আমি চুপচাপ কেয়া আপুকে জরিয়ে ধরে বসে আছি।

কী অদ্ভুদ তাই না?জীবন আমার আর আমার জীবনের সিদ্ধান্ত উনাদের।
এ পৃথিবীতে আপন মানুষগুলো চলে যাওয়ায় বাকিদের জন্য বোঝা হয়ে গেলাম।
নিজের উপরেই রাগ লাগতে লাগলো,, কেনো সেদিন ওখানে গিয়েছিলাম??
ইশশ সেদিন যদি ওখানে না যেতাম তাহলে আজ আমার বাবা বেঁচে থাকতেন।সেদিনের ঘটনা মনে পড়তেই শরীর শিউরে উঠলো..!!

অতীত,,

আমি বাবা বলে ডাকতেই সামনের ব্যক্তিটি চমকে আমার দিকে তাকালো।তিনি আর কেউ নন আমারই বাবা।
তার মানে বাবাও আমার মতো মায়ের পিছন পিছন এসেছিলেন?

বাবাকে আমাকে দেখেই অবাক হয়ে গেলেন,, উনি অবাক স্বরে বলে উঠলেন,,,”নায়লা,তুই এখানে???কীভাবে আসলি?ওহ্,, তার মানে তুই আবার তোর মায়ের পিছনে এসেছিলি?কিন্তুু কেনো?
তোকে না আমি বারন করেছি?”

আমি আমতা আমতা করে বললাম,,,”ইয়ে,মানে,বাবা..!!”

বাবা ধমকে বলে উঠলেন,,”ইয়ে মানে কী?তোকে বারন করেছিলাম না?”

এবার আমি প্রতিবাদী সুরে বললাম,,,”তুমি কেনো এসেছো?”

এবার বাবা আমতা আমতা করতে লাগলেন..!!আর ওদিকে আমাদের কথার আওয়াজ শুনে আমার মা আর ওই ছেলেটি চলে আসে।

মা আমাকে দেখার সাথে সাথে হুংকার দিয়ে দিয়ে উঠলেন।ফোসফোস করে বলে উঠলেন,,

—“কীরে ফকিরের জাত,সেদিন তো খুব বললি আমরা ফকির তাই আমাদের ওগুলো কিনে দিতে এসেছিলি।আর আজ ফকির গিরি করতে আমার
পিছন পিছন চলে আসলি?আসলে এগুলা তোদের প্রবলেম না,,,প্রবলেম তোদের বাবা-মায়ের তারা তোদের শিখিয়ে দেয় কীভাবে মানুষের সামনে ইনোসেন্ট ফেস করে তাদের জিনিসপত্র চুরি করতে হয়..!!খুব ভালোই চেনা আছে তোদের মতো চোরদের..!!গত ১২ বছর থেকে ঢাকায় থাকতেছি,,তোদের মতে অনেক দেখছি..!!কী মনে করেছিস আমি চিনতে পারবো না?এখন বল তোদের দলে কে কে আছে?আর কার সাথে মিলে মানুষের বাসাবাড়ীতে চুরি করিস?না হলে এখনই মানুষ ডেকে তোকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিবো,,বেয়াদব..!!”

আমি খুব ভালোই বুঝতে পারতেছি উনি সেদিনের রাগ মিটাচ্ছেন।
উনি কথা বলতে বলতে হটাৎ বাবাকে দেখে চমকে গেলো।
সাথে সাথে উনার মুখের রং বদলে গেলো।উনি হয়তো বিশ্বাস করতে পারতেছেন না।

উনি অবিশ্বাসের স্বরে কাপা কাপ গলায় বললেন,,, “ত ত তুমি?””

বাবার দিকে চোখ পড়তেই আতকে উঠলাম,,বাবার চোখ লাল হয়ে আছে।বুঝতে পারলাম বাবা মায়ের কথা শুনে রেগে আছেন।

বাবা শক্ত করে আমার হাত ধরে বললেন,,”চল,মা..!!”

আমার মা এবার অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকালেন,, তারপর তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,,

—–“ওহ্,,তাহলে এটা তোমার মেয়ে।বাহ বাহ, বিয়ে করে নিয়েছো আবার এত বড় মেয়েও আছে?বাহ এত ফাস্ট? আর আগে আমাকে যেনো কী বলতে,,কী যেনো?ওহ্ মনে পড়েছে..!!
“জানো তুমি আমার জীবনের প্রথম নারী,, তুমিই আমার জীবনের সব, কোনোদিন তোমাকে ভুলতে পারবো না।তুমি যদি কোথাও চলেও যাও তাহলেও তোমাকে ভুলবো না,,,তোমার জায়গা কাউকে দিবো না।তোমার স্মৃতি দিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিবো।”

শেষের কথাগুলো অনেকটা ব্যাঙ্গ করেই বললেন।

বাবা এবার প্রচন্ড জোরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,,,”শাট আপ..!!তুমি বোধহয় ভুলে গিয়েছো যে তোমার আর আমারও একটা মেয়ে ছিলো।”

শেষের কথা শুনার সাথে সাথে মায়ের মুখের রং পুরো বদলে গেলো। উনার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো..!!উনি বড় বড় চোখ করে কাপা কাপা গলায় বললো,,,”না’না না’য়’লা..???”

এবার বাবা তাচ্ছিল্যে স্বরে বলে উঠলো,,”যাক,,তাহলে তোমার মনে পড়েছে।আমাদেরও যে মেয়ে আছে তা বোধ হয় ভুলে গিয়েছিলে?ভুলাটা স্বাভাবিক,, অনেক সুখে আছো যে ..!!আফসোস শুধু আমরাই তোমার মতো স্বার্থপর হয়ে সুখী হতে পারলাম না। আর কী যেনে বললে তোমাকে ভুলার কথা?তাহলে বলি আজোও ভুলিনি তোমায়..!!আর না তোমার জায়গা দ্বিতীয় কাউকে দিয়েছি..!!”

শেষের কথাটা অনেকটা নিচু সুরেই বললেন বাবা।আর এদিকে আমি আর এহসান উনাদের দিকে তাকিয়ে সব বুঝার চেষ্টা করছি।আমি কিছুটা বুঝলেও এহসান যে একফোটা কথাও বুঝে নি তা উনার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।এমন একটা সিচুয়েশনে উনার চেহারা দেখে আমার হাসি পাচ্ছে।কিন্তু এমন সিরিয়াস মুহূর্তে হাসলে চলবে না।

হটাৎ দেখলাম আমার মা আমার দিকে একপা একপা করে এগিয়ে আসছেন।উনি কাপা কাপা হাত আমার দিকে ছোঁয়ার উদ্দেশ্যে এগিয়ে দিলেন।

কিন্তুু মা ছোঁয়ার আগেই বাবা এসে উনার হাত ধরে বললেন,,,”নো,নো..তোমার ওই নোংরা হাত দিয়ে আমার পবিত্র মেয়েকে ছুবে না। আমি চাই ননা তোমার কোনো নোংরা স্পর্শ ও পাক,তাই হাত টা সংযত করো।”

মা অবাক চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,,”তুমি এসব কী বলছো আশরাফ,,,,আমি ওর মা হই..!!”

বাবা এবার হু হা করে হেসে দিলেন। হঠাৎ হাসি সংযত করে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,,,,,,,”হুম,,এমন মা যে মেয়েকে জন্ম দেওয়ার চার বছর বয়সেই তাকে ছেড়ে পর পুরুষের সাথে চলে গিয়েছে।একবার ভাবে নি ওই ছোট্ট মেয়েটি কীভাবে থাকবে?মেয়েটার যে তার মা কে প্রয়োজন হতে পারে,,,সে কথা একবারও ভেবে দেখে নি। মেয়েকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর একবারের জন্য তার খবর নেয় নি।আর না তার কথা মনে রেখেছে। মেয়েকে চোখের সামনে দেখেও তাকে চিনতে পারে নি,,উল্টো তাকে যা নয় তা বলে অপমান করেছে।তার বাবা-মা নিয়ে কতা শুনিয়েছে। আর এখন যখন জানলো যে ও তার মেয়ে তখনই দরদ উল্টিয়ে পড়লো।জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না,,তুমি তো মা জাতির কলঙ্ক..!! তোমার মতো মায়েদের কারনে পুরো মা জাতির বদনাম হচ্ছে।
একজন মা তার সকল সুখ-আশা,,বিসর্জন দিয়ে দেয় তার সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে।আর তুমি নিজের সুখের জন্য একটা ছোট্ট মাসুম বাচ্চাকে ছেড়ে চলে গিয়েছো।তাহলে তুমিই বলো তুমি কী আদৌ কোনো মা???”

মায়ের চোখের দিকে তাকাতেই অনুতপ্ততার রেশ দেখতে পেলাম।উনি হয়তো কিছুটা হলেও বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন..!!

উনি এবার মুখ তুলে নির্লিপ্ত গলায় বললেন,,,”কিন্তুু মা তো মা ই হয়,,,তাই না।আর আমি ওকে জন্ম দিয়েছি,,, সে হিসেবে আমি ওর জন্মদাত্রী মা তাই না?তাহলে আমি কেনো ওকে স্পর্শ করতে পারবো না?তুমি সবসমসয় আমার সাথে এমন করতে,, আমাকে মারতে।আমার মেয়েকে তুমিই আমার থেকে দূরে সরিয়ে ছিলে,,তোমার কারনেই তো আমি চলে এসেছিলাম।এখন আমার মেয়েকে আবার স্পর্শও করতে দিচ্ছো না।কেনো এমন করো??”

বাবা এবার চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিলেন।এরপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,,”যে বুঝে না তাকে বুঝানো যায় আর যে বুঝেও বুঝে না তাকে বুঝানো যায় না।তাই আমি তোমার সাথে ফালতু বকবক করে আমার সময় আর শক্তি কোনো কিছুই খরচ করতে চাই না।তাছাড়া তোমার মতো মহিলাদের সাথে আমার কথা বলতেও রুচিতে বাঁধে।”

এবলেই বাবা আমার হাত ধরে হাটতে নিলেই আমি শক্ত হয়ে দাড়িয়ে যাই।বাবা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন,, “যার অর্থ এই যে কী হয়েছে?”
আমি বাবাকে মাথা নাড়িয়ে বললাম,,” না..!!”
বাবা ভ্রু কুচকে তাকাতেই আমি বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে মায়ের কাছে চলে গেলাম।

মায়ের চোখে বিজয়ের হাসি দেখলাম।মুখে বাকা হাসি রেখে বাবার দিকে ভ্রু নাচিয়ে তাকালেন,,যা মোটেও আমার চোখে এড়ালো না। আমি মায়ের সামনে গিয়ে উনার গালে এক থাপ্পর দিয়ে দিলাম।আসলে কম বয়সে রক্ত গরম তো তাই মায়ের এমন অভিনয় দেখে রাগ সামলাতে পারি নি।

আমার এমন কান্ডে সবাই অবাক হয়ে গেলো,,মা গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে তাকাতেই আমি বলে উঠলাম,,”আপনি এত অভিনয় কীভাবে করেন?আপনি কী মনে করেছেন,, আমি আপনার অভিনয় ধরতে পারবো না?আপনি প্রথম দিনেই যে আমাকে চিনেছিলেন তা আমি ভালো করেই জানি।শুধু শুধু কেনো এত নাটক করলেন?বাবাকে আমার সামনে খারাপ করতে যে এসব করেছেন তা ভালো করেই বুঝেছি।আমি জানতে চাইবো না আপনি কেনো এমন করেছেন,,তবে এটা বলবো নেক্সট টাইম এমন কিছু করার সাহস দেখাবেন না।আমার বাবা কেমন তা আমি ভালো করেই জানি..!!”

বলেই আমি চলে আসলাম বাবার কাছে।এহসান চুপচাপ আমাদের সাথে হাটতে লাগলেন।পিছন থেকে মা অনেক কিছুই বলতেছেন।মায়ের থেকে আড়াল হতেই বাবা অবিশ্বাস্য কান্ড করে ফেললেন।

আমার হাত ধরে আমাকে সামনে এনে প্রচন্ড জোরে এক থাপ্পর দিয়ে দিলেন।আমি অবাক হয়ে গেলাম,,প্রথম বাবার হাতে মার খেলাম।বাবা আবারো অপর গালে আরো জোরে এক থাপ্পর দিয়ে দিলো।
এবার এহসান ভাইয়া এসে বাবাকে ধরে বলতে লাগলেন আমাকে কেনো মারছে?বাবা আবার মারতে নিলে এহসান বাবাকে ধরে সরিয়ে নিলেন।

বাবা হুংকার দিয়ে বলতে লাগলেন,,,”তোকে আমি এ শিক্ষা দিয়েছি?কত বড় বেয়াদপ হলে মায়ের গায়ে হাত তুলে। মা যেমনই হোক মা তো মা ই।মায়ের গায়ে হাত তুললে যে আল্লাহও নারাজ হয়ে যায়।কত বড় পাপ করেছিস।এজন্যই তোর কপালে সুখ নেই,,!!ছিঃ ছিঃ,,তুই কীভাবে এমন একটা কাজ করলি?আমার মেয়ে এত বড় বেয়াদপ হবে এমন জানলে তোকে সেদিনই মেরে ফেলতাম। তুই জানিস তোর আর তোর মায়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।”

বাবা বলেই যাচ্ছেন বলেই যাচ্ছেন আর এদিকে এহসান ভাইয়া উনাকে থামানোর চেষ্টা করতেছে।

চলবে???