ভুলিনি তোমায় পর্ব-২৪

0
3307

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :২৪

সবাই যদি তোমার মতো হতো তাহলে তো কথাই ছিলো না।তুমি হ্যাবলা বলে কী আমিও হ্যাবলা হবো?

উনার কথা শুনে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো।বলে কী এসব?

—-“আমি হ্যাবলা মানে?আমি শুধু আপনাকে প্রশ্ন করেছি যে আপনি কীভাবে জানলেন?এখানে আমি হ্যাবলা কীভাবে হলাম?”

উনি বিছানায় হেলান দিয়ে দু হাত ভাঁজ করে বললেন,,”তুমি হ্যাবলা নয় তো কী?আজব, কেউ যখন সুইসাইড করে তাহলে নিশ্চয় তোমমার ভেতর কিউরিসিটি হবে যে কেনো এমন করেছে?রেদোয়ানের থেকেই জেনেছি, তুমি নাকি কোন ছেলের জন্য এমন করেছো।”

আমি মুখ টা ভার করে নিলাম।

–“জানো,প্রথম না আমার খুব খারাপ লেগেছিলো,,ছেলেটার উপর এত রাগ হয়েছিলো বলে বুঝাতে পারবো না।কিন্তুু ওরে এত খুশি হয়েছিলাম যে কী বলবো।আমি তো রীতিমতো ওই ছেলের জন্য দোয়া করে ফেলতাম।”

উনার কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগলো,,আমি কাতর কন্ঠে বললাম,,”আমাকে কষ্ট দিয়েছে আর আপনি খুশি হয়ে ওর জন্য দোয়া করেছেন!আমি কষ্ট পেলে আপনি খুশি হন?”

আমার কথা শুনে উনার হাসি মুখটা চুপসে গেলো।কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসলেন।আমাকে ইশারায় উনার কাছে ডাকলেন,আমি গেলাম না।ঠাই বসে রইলাম,উনার উপর আমার অভিমান হলো,প্রচুর অভিমান। উনি একবার আমার দিকে তাকালেন,আমাকে আগের ন্যায় বসে থাকতে দেখে উনি উঠে আসলেন।

আমাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলেন।আমি জোরাজুরি করতেই আমাকে বাহু বন্ধনে আটকিয়ে দিলেন।

–“হ্যা,খুব খুশি হয়েছিলাম তবে তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়।তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে তার জন্য,কারন ও যদি তোমাকে না ছাড়তো তাহলে আমি কখনো তোমাকে পেতাম না।তুমি আমাকে ভালোবাসো আর না বাসো এটলিস্ট আমার সাথে তো আছো।আচ্ছা তুমি বলো,,যে মানুষটার জন্য আমি তোমাকে পেয়েছি তার জন্য দোয়া করব না?”

আমি চুপ করে রইলাম।উনি আবারো বললেন,,”বলো?”

আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,,”কী বলবো?”

উনি আমার দিকে কপাল কুচকে তাকালেন।কিছু সময় পর হুট করে আমাকে বললেন,,”আচ্ছা,ওকে ভালেবাসো এখনও?”

উনার কতা শুনে কলিজা কেপে উঠলো।এ প্রশ্ন হয়তো আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রশ্ন।আমার হার্টবিট অনেক ফাস্ট হয়ে গেলো।আমি প্রসঙ্গ বদলে বললাম,,”আরে সে কখন থেকে আমরা রুমে বসে আছি চলেন না,দেখে আসি আপু কী করতেছে।”

—“কথা কাটাচ্ছো কেনো?দেখো সবার ভালোবাসা কিন্তুু মিথ্যা হয় না।যেমন রেদোয়ান আর রেশমি।তুমি এটা মনে করো না যে একবার ভালোবাসায় হেরে গেলে দ্বিতীয়বার আর ভালোবাসা যায় না।”

উনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই উনি কিছুটা অবাক হয়ে গেলেন।

আমি চিৎকার করে বলতে লাগলাম,,,

—“সব মিথ্যা,এসব ভালোবাসা বলতে কিছুই হয় না।যা হয় সব আবেগ,সবাই এমন আবেগজড়ানো কথা বলে মিছে মায়ায় জড়িয়ে এরপর হুট করে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।কেউ কাউকে ভালোবাসে না,ভালোবাসা বলতে কিছুই হয় না।আপনি কোনো আমাকে ভালোবাসেন না,,এটা আপনার বুঝার ভুল যে আপনি মনে করেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন।আসলে আপনি এখন আমার মোহে আছেন,,দেখবেন কয়েকদিন অথবা কয়েক বছর পর কেটে যাবে।যেমন সৌরভের ও কেটে গিয়েছিলো।বাস্তবে ভালোবাসা বলতে কিছুই হয় না।”

—“আচ্ছা,আচ্ছা কিছুই নাই।তুমি প্লিজ উত্তেজিত হইও না,আমি কী বলেছি তোমাকে ভালোবাসি,কি বলি নি তাই তো, তাহলে কেনো এসব বলতেছো।তুমি যেমন বলতেছো তেমনই সব ঠিক, এখন প্লিজ শান্ত হও।নাহলে তোমার শরীর খারাপ করবে,,প্লিজ।”

–“না,না,,আপনি তো,, ”

–“আমি বলেছি তো,তুমি যা বলেছো তা ঠিক।”

আমি কিছু বলতে নিচ্ছিলাম তার আগেই উনি আমার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে থামিয়ে দিলেন।আমিও চুপ করে গেলাম।সেদিন আর আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয় নি।
___________________________

সময় এত দ্রুত অতিবাহিত হয় যে টেরও পাওয়া যায় না।বিশেষ করে সুখের সময়গুলো খুব দ্রুত চলে যায়। জীবন মানেই সুখ,দুঃখ আর হাসি কান্না। মানুষও সময়ের সাথে সাথে অনেক বদলে যায়।আমার আর এহসানের সম্পর্কের অনেকগুলো দিন কেটে গিয়েছে।কখন যে এতগুলো মাস পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না।সৃষ্টিকর্তার রহমতে এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ,তবে এর পিছনে এহসানের অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে। দেখতে গেলে একটা বাচ্চার মতো উনি আমার দেখাশুনা করেছেন। আমাকে টাইম মতো খাওয়ানো,পড়ানো, সবকিছু। সবসময় আমাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করেছেন। আমাদের সম্পর্ক আট-দশটা স্বামী-স্ত্রী এর মতো নয়,তবে তার থেকেও কম নয়।উনি আমাকে একটা বন্ধুর মতো ট্রিট করেন।সেদিন উনি আমাকে বলেছিলেন আমি যাতে সময় নেই,কারন এভাবে হুট করে যে কাউকে ভালোবাসা যায় না তা উনি ভালো করেই বুঝেন।যতদিন পর্যন্ত উনাকে মেনে নিতে না পারি ততদিন পর্যন্ত আমরা বন্ধু হয়ে থাকবো।আমিও উনার কথাতে সম্মতি দিয়েছিলাম। এরপর থেকেই আমরা বন্ধু হয়ে যাই,,সাথে সাথে পাল্টে যায় আমার জীবনের অনেক কিছু।এখন আমি মোটামুটি রান্না করতে পারি, উনি কখনও বলেন না যে এটা ভালো হয় নি, ওটা ভালো হয় নি।সবসময় বলতো খুব মজা হয়েছে।রান্না পারলেও প্রতিদিন সকালে উনিই আমাকে চা বানান। শুক্রবারের রান্নাটাও উনি করেন। সারাদিন ভার্সিটিতে পড়ে এসে এক গাদা স্টুডেন্ট পড়ায়,তারপর অনলাইনে অনেক রাত জেগে কাজ করেন।যার ফলে উনার চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে।
এত কিছুর পরেও কখনও আমার সামনে নিজেকে ক্লান্ত দেখান না,সবসময় হাসিমুখে থাকেন।আমার ছোটখাটো সব জিনিসের প্রতিই উনি খুব যত্নশীল,মাঝে মাঝে ভাবি একটা মানুষ কীভাবে এমন হতে পারে?অনেক সময় নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়,আমার কারনেই তো উনার এত কষ্ট।

ফুফিরা গ্রাম থেকে প্রায় সাপ্তাহ খানেক পর ফিরে এসেছিলেন।এসেই যখন জানতে পারলেন রেদোয়ান ভাইয়া এ কাহিনী করেছেন তখনই এলাহিকান্ড হয় দুই পরিবারের মধ্যে, ফুফিরা তো রেশমি আপুকে কিছুতেই মানবে না। আর রেশমি আপুর বাবা তো পণ করেই নিয়েছিলেন যে রেদোয়ান ভাইকে কোনোভাবেই উনার মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নিব না। রেশমি আপুকে উনার পরিবার নিয়ে যেতেই আপু আত্নহত্যার চেষ্টা করে ছিলেন।তখন রেদোয়ান ভাইয়া পুরো পাগলের মতো বিহেভ করেছিলেন।তখন ফুফিরা গিয়ে রেশমি আপুর আব্বুর কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন।রেশমি আপুর আব্বুও মেয়ের অবস্থা দেখে না করতে পারে নি। অবশেষে পরিবারের সম্মতিতেই উনাদের বিয়েটা হয়েছিলো।রেশমি আপু খুশিতে প্রায় কেঁদেই দিয়েছিলেন, উনি বলেছিলেন ,”শুনেছি,কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে নাকী তুমি তাকে পাবেই।আমিও হয়তো রেদোয়ানকে মন থেকে ভালোবেসেছি তাই পেয়েছি।”

উনাদের অবস্থা দেখে তখন আমার আর সৌরভের কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো,,আমিও তো রেশমি আপুর জায়গাতে ছিলাম।কই সৌরভ তো আমার জন্য এমন করে নি,আরে ও তো আমার খবর ই নেয় নি সেখানে এসব আশা করাটা নিতান্ত বোকামি।আচ্ছা,আমি তো ওকে মন থেকে ভালোবেসেছিলাম তাহলে কেনো ওকে পাই নি?কেনো পাই নি? তাহলে কী আমি ওকে মন থেকে ভালোবাসি নি?

এরমধ্যে আবার কেয়া আপুও অনেক কাহিনী করেছিলেন।ফুফিরা আপুকে বিয়ে দিয়ে উনার স্বামীর সাথে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছেন।

ঘুমের মধ্যেই মনে হলো কেউ আমাকে ডাকছে, পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখলাম এহসান দাড়িয়ে আছেন।ঘুমঘুম চোখে ভালো করে তাকাতেই দেখলাম টেবিলে চায়ের কাপ রাখা। উনি যে মাত্র এনেছে তা বুঝাই যাচ্ছে কারন কাপ থেকে ধুয়া উড়তেছে। আমি আবারো ঘুমাতে নিচ্ছিলাম উনি আমাকে টেনে বসিয়ে দিলেন।আমি বসে বসে ঝিমুতে লাগলাম, উনি আমার মাথাটা উনার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন।

আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,,”এই যে ঘুমকুমারী আর কত ঘুমাবেন?এত ঘুম কীভাবে ঘুমাতে পারো?প্রতিদিন তোমাকে ঘুম থেকে তুলতে যুদ্ধ করতে হয়।উঠুন,ভুলে গিয়েছেন আজকে আপনার পরীক্ষা আছে।পরে পরীক্ষায় ডিম পাবে আর বলবে আমি কিছু পড়াই না।তোমার থেকে তো মিথি আরো ভালো এটলিস্ট পড়া পারুক আর না পারুক তাও পড়ে।”

মিথিলার কথা টা শুনতেই মেজাজ চরম খারাপ হয়ে গেলো।আমি ঝট করে উনার বুক থেকে মাতা সরিয়ে নিলাম,নাক মুখ ফুলিয়ে উনাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম,,”দুনিয়াতে কী মানুষের অভাব পড়ছে যে আপনি ওই ডাইনীর সাথে আমার তুলনা করলেন।বলছি না ওই বেহায়া মেয়ের কথা আমাকে বলবেন না।বুঝি না ঘুরে ফিরে আপনি ওই মেয়ের কথাই বলেন।যত্তসব ফালতু..!!”

বলেই ঘটঘট করে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে আসলাম।সকাল সকাল মেজাজ টা ই বিগড়ে গেলো।এ একটা কারনেই উনাকে আমার ভালো লাগে না।যখন তখন এ মিথি না তিথি ওই মেয়েটার কথা বলবে।
আজকে এ মেয়ের কথা বলছে নিশ্চিত পরীক্ষা খারাপ হবে, আস্ত একটা কুফা মেয়ে ।দাত ব্রাশ করতেছি আর মনে মনে ওই মেয়েটাকে হাজার টা গালি দিতেছি। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখলাম উনি বসে বসে আপনমনে হাসতেছেন।

আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকাতেই উনি ঠোট কামড়ে হেসে বললেন,,”হয়ে গেছে?”

আমি কপাল কুচকে বললাম,,”কী হয়ে গেছে?”

উনি মুখ টিপে হেসে বললেন,,”আমার মিথিকে বকা হয়ে গেছে?”

উনার কথা শুনে আমার রক্ত গরম হয়ে গেলো।হোয়াট দ্যা হেল? আমি রেগেমেগে বললাম,,”আমার কী আর কোনো কাজ নেই যে আপনার মিথিবেবীকে বকবো।আপনার এমন কেনো মনে হচ্ছে যে আমি ওকে বকতেছি।আমি বুঝি না সারাদিন ওই মেয়ের কথা কেনো আপনার মাথায় ঘুরে?”

উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি দমফাটা হাসি আটকে রেখেছেন।উনি মুখে হাত দিয়ে কোনোরকম হাসতে লাগলেন,উনার হাসি দেখে আমার গা জ্বলে উঠলো।

—“একদম হাসবেন না,ছিঃ আপনি এত খারাপ।সবসময় পরনারীর কথা ভাবতে থাকেন।ওই মেয়ের জন্য যখন এতই দরদ আপনার তাহলে ওকেই বিয়ে করে ফেলুন।”

—“সত্যি বিয়ে করে ফেলবো?তোমার কোনো সমস্যা হবে না তো?”

—“আমার কোনো সমস্যা কেনো হবে?আপনিও বিয়ে করে ফেলবেন আমিও বিয়ে করে ফেলবো।”

—“তোমাকে আবার কে বিয়ে করবে?”

–“কেনো,কে বিয়ে করবে মানে?আপনি জানেন আমার জন্য কত ছেলে পাগল।”

উনি মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,,”না তো,তুমি বলো,কত ছেলে পাগল?”

আমি রাগী চোখে তাকাতেই উনি ভদ্র মানুষের মতো বসে রইলেন।আমি কিছু একটা ভেবে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বললাম,,”জানেন আমার কোচিং এর টিচার টা না দেখতে সেই।কি বলবো,একদম ফাটাফাটি।উনাকে দেখলেই আমার প্রেম প্রেম পায়।মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে উনার গালে টুস করে একটা চুম্মা দিয়ে দেই।
আমি তো ভেবেছি আপনাকে ওই ডাইনীর গলায় ঝুলিয়ে উনাকে বিয়ে করে ফেলবো।”

কথাটা বলেই অতিরিক্ত লজ্জাভাব নিয়ে উনার দিকে তাকতেই চমকে গেলাম।
.
.
.
চলবে?