ভুলিনি তোমায় পর্ব-২৯( প্রথম অংশ)

0
3102

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :২৯(প্রথম অংশ)

উনার দেশের বাড়ীও তো আমার দেশের বাড়ীতে। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো। আমি আমতা আমতা করে বললাম,”আমি গিয়ে কী করবো?তার চেয়ে বরং আপনি যান।”

–“হোয়াট!!তোমার মাথা খারাপ,বউ রেখে আমি বাড়ী যাবো?তাছাড়া বাবা তোমাকে দেখতে চেয়েছে..!!”

উনার কথা শুনে আমি চমকে কেপে উঠলাম।উনার বাবা আমাকে দেখতে চেয়েছে মানে?আমি তড়িৎগতিতে বিছানা থেকে উঠে উনার সামনে গিয়ে দাড়ালাম।

–“আপনার বাবা আমাকে দেখতে চেয়েছে মানে?”

–“দেখতে চেয়েছে মানে তোমাকে দেখতে চেয়েছে।”

–“আরে দূর,আমি সেটা বলি নি।আমি বলতে চাইতেছি উনি আমার কথা জানেন কীভাবে?আরে আপনি বুঝতেছেন তো আমি কী বলতে চাইতেছি।”

–“আমি বলেছি তাই জেনেছে।”

–“উফফ,আপনি পেঁচাচ্ছেন কেনো?সোজাসুজি বলুন না। ”

উনি জামা কাপড়সহ ব্যাগটি নিচে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,”যেদিন তোমাকে বিয়ে করেছি সেদিনই বাবাকে বলেছিলাম।ইনফেক্ট বাবাই আমাকে তোমাকে বিয়ে করতে বলেছিলো। সেদিন রেদোয়ানের সিচুয়েশনের কথা বাবাকে বলতেই বাবা আমাকে বলেছিলেন আমি যেনো তোমাকে বিয়ে করি এবং তোমারর দায়িত্ব নেই,হয়েছে?এবার চুপচাপ সব প্যাক করো।”

উনার কথা শুনে আমার মষ্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো।কী বললো উনি? আমি থম মেরে দাড়িয়ে উনার কথার হিসাব মিলাচ্ছিলাম। কিছু বুঝতে না পেরে উনাকে প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুলতেই উনি আমার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বললেন,,”চুপ,একটা কথাও নয়।যেতে যেতে সব বলবো।”

আমি মোটেও চুপ থাকলাম না, বারবার এটা সেটা প্রশ্ন করতে লাগলাম,কিন্তুু উনি একটা কথাও বললেন না। উনার কোনো জবাব না পেয়ে আমিও বিরক্ত হয়ে চুপ করে গেলাম।

.
সবকিছু প্যাক করে বসে আছি, আর উনি অনলাইনে টিকিট কাটতেছেন।কী খুশি লাগতেছে ট্রেনে করে যাবো,আসলে বাসে যেতে যে আমার সমস্যা হয় তাই উনি আমার জন্য ট্রেনের ব্যবস্থা করেছেন। একটুপর উনি বারাদা থেকে এসে বললেন এখনও নাকি ঘন্টাখানেক সময় আছে।এর মধ্যে বাড়ী থেকে ফোন এসেছে, উনার বাবার অবস্থা নাকি এখন অনেক ভালো,কথাটা শুনতেই উনি শান্ত হয়েছিলেন।

–“শুনেন না,,এখনও তো অনেক সময় আছে।আপনি কী আমাকে আপনার ফ্যামিলি সম্পর্কে বলবেন?না মানে আমি তো আপনার সম্পর্কে কিছুই জানি না।”
মাথা নিচু করে কথাগুলো বললাম।উনি কয়েক সেকেন্ড কি যেনো ভাবলেন,তারপর আমাকে ইশারায় বারান্দায় যেতে বললেন,আমিও উনার পিছন পিছন চলে গেলাম। বারান্দার ইজি চেয়ার টা টেনে উনি বসে পড়লেন,আমি যেতেই আমাকে টান মেরে উনার কোলে বসিয়ে দিলেন। আচমকা এমন হওয়া আমি বলতে লাগলাম,,”আরে,কী করছেন?”

উনি আমার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বললেন,,”শশশ,চুপ। একদম এভাবে থাকবে, আমি তোমাকে সব বলবো।চুপচাপ শুধু শুনবে,আমার সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পর কথা বলিও।”

আমিও মাথা নাড়ালাম।উনি আমাকে সহ পেঁচিয়ে বসলেন, লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন,,”আমার পরিবারে আমি,বাবা,মেহেদী, মেহেদীর মা আর দাদী থাকে। আম্,,”

উনার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি প্রশ্ন করে বসলাম,,”মেহেদীর মা কেনো?আপনার মা নয়?”

কথার মাঝে ব্যাঘাত ঘটায় উনার কপালে বিরক্তির ভাজ পড়লো। উনি আমাকে চেপে ধরে বললেন,,”তোমাকে চুপ থাকতে বলেছি না?আমি কি বলতেছি না? ”

চেপে ধরায় আমি ব্যাথা পেতে লাগলাম। উনি একটুপর বাধন হালকা করলেন, আমিও ভদ্র মেয়ের মতো চুপ করে গেলাম।

–“মেহেদীর মা বলেছি কারন উনি মেহেদীর মা আমার মা নয়।”

কথাটা বলে উনি কিছুষন দম নিলেন,নিজেকে স্বাভাবিক করে ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,,”আমার ৮ বছর বয়সে আমার মা কঠিন রোগে মারা যান।আমি জানি না কী রোগ ছিলো। মা মারার যাওয়ার ছয় মাস না হতেই দাদী আমার বাবাকে জোর করে দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে দেয়। শুরু হয়ে যায় আমার উপর অত্যাচার।না,মেহেদীর মায়ের অত্যাচার নয়,আমার দাদীর অত্যাচার। এখানে আবার অনেক কাহিনী আছে, যাক বাদ দেও আমি তোমাকে শর্টকার বলি। তারপর আশেপাশের মানুষ নানান কথা শুনাতে লাগলো,কেমন যেনো কথা বলতো।সব মিলিয়ে আমার অবস্থা খুব খারাপ ছিলো।দিনদিন কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছিলাম,সবকিছু দেখে বাবা সিদ্ধান্ত নেয় যে আমাকে হোস্টেলে দিয়ে দিবেন। তারপর আর কি দিয়ে দেয় আমাকে ৯বছর বয়সে ঢাকার স্কুল হোস্টেলে, সেখানেই রেদোয়ানের সাথে আমার পরিচয়।ওর সাথে আমার ফ্রেন্ডশীপ অনেক গভীর হয়ে যায় যার কারনে কলেজ লাইফ থেকে আমি ওদের সাথে থাকি। মাস শেষে বাবা ফোন দিয়ে খবর নেয় আর টাকা পাঠিয়ে দেয়। বাবা অনেকবার আমাকে যেতে বলেছিলেন কিন্তুু আমি সবসময় কথাটা এড়িয়ে চলতাম।ওখানে যাওয়ার আমার কোনো ইচ্ছা নেই তাই। বাবার বিয়ের প্রথম বছরেই জন্ম হয় মেহেদীর।ওর পুরো নাম টা মনে নেই,আসলে আমি কখনও ওদের সাথে যোগাযোগ ই করি নি।বাবা উনাদের প্রসঙ্গ তুললেই আমি কথা কাটিয়ে ফেলতাম। দাদী মারা গিয়েছে অনেক বছর হয়েছে , মেহেদী এখন ভার্সিটিতে পড়ে। এর থেকে আর বেশি কিছু জানি না।”

এটুকু বলে উনি দম নিলেন। এরপর বেশি কিছুক্ষণ আমরা নিরব ছিলাম। নিরবতা ভেঙ্গে আমি বললাম,,”উনাদের কারো ছবি নেই।”

উনি কপালে ভাজ ফেলে কয়েক মুহূর্ত ভেবে বললেন,,হ্যা,আছে।বাবা একবার ঈদের ছবি পাঠিয়ে ছিলো।”

কথা শেষ করেই উনি আমাকে কোল থেকে সরিয়ে উঠে রুমের দিকে পা বাড়ালেন।মিনিটখানেক পর উনি ফোন সহ আসলেন। আবারও পূর্বের ন্যায় বসে মোবাইল গ্যালারিতে ছবি খুজতে লাগলেন। অনেক্ষণ খোজাখুজির পর উনি আমাকে একটা ফটো বের করে দিলেন। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই আমার নিশ্বাস আটকে গেলো,মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না, মনে হচ্ছে কেউ যেনো গলা চিপে ধরে রেখেছে। আমি কি সত্যিই দেখতেছি নাকি এসব আমার ভ্রম। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো।

কাপা কাপা গলায় বললাম,,”উনি কককে?”

আমাকে এমন করতে দেখে উনি কিছুটা অবাক হলেন।উনি স্বাভাবিকভাবেই বললেন,,,”ও মেহেদী,ওর পাশের জন ওর মা আর পিছনের উনি বাবা।”

উনার কথা শুনে আমি যেনে বরফের মতো জমে গেলাম।এ কী শুনছি আমি?ও মেহেদী কী করে হতে পারে ও তো সৌরভ। আমি দু-একবার ঢোক গিলে ছবিটাকে দেখতে লাগলাম।

—“আপনি শিউর উনি মেহেদী?”

–আজব,শিউর হওয়ার কী আছে।শতভাগ নিশ্চিত ও মেহেদী।”

এবার আমার হিচকি উঠে গেলো,আমি অনবরত হিচকি দিতে লাগলাম,হাত-পা কাপতে লাগলো। আমাকে এমন করতে দেখে উনি মুহূর্তে ভড়কে যান। দ্রুত উঠে আমাকে বসিয়ে পানি আনতে চলে যায়। পানি নিয়ে আসতেই আমি ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে ফেললাম,তবুও আমার হিচকি বন্ধ হচ্ছে না।

আমার কান্ড দেখে উনি আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলেন।

–“হঠাৎ কী হলো যে তোমার এমন হিচকি শুরু হয়ে গিয়েছে?”

আমি হিচকি দিতে দিতে বললাম,,
–“ববলছি,,আআগে আপপনি আমার হিচকি বন্ধ করান।শুনেছি, প্রচন্ড অবাক হওয়ার মতো কিছু করলেই নাকি হিচকি বন্ধ হয়ে যায়।আপনি কিছু করুন।”

উনি কয়েক সেকেন্ড কপাল কুচকে আমার দিকে তাকালেন। অবশেষে উনি সত্যিই অবাক করার মতো কাজ করে ফেললেন আর আমি সাথে সাথে আম্মু গো বলে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।

আমি ভ্যা ভ্যা করতে করতে বললাম,,
–“আপনি এটা কী করলেন?”

উনি দাত বের করে বললেন,,”তুমি যা করতে বলেছো তাই করেছি।”

–“আমি আপনাকে অবাক করার মতো কিছু করতে বলেছি,তাই বলে আপনি আমার হাতে কামড় দিবেন?”

—“দেখো তোমার হিচকি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার মানে এটা অবাক করার মতো ছিলো।”

আমি হা করে উনার দিকে চেয়ে রইলাম।উনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমাকে প্রশ্ন করলেন,, “তুমি এটা বলো তোমার হঠাৎ হিচকি উঠেলো কেনো?”

হিচকির চক্করে সৌরভের বিষয় তো আমার মাথা থেকে চলেই গিয়েছে।আবার সৌরভের কথা মনে পড়ে গেলো,আমার ভেতর অজানা ভয় গ্রাস করতে লাগলো।উনাকে বলবো কী বলবো না তা নিয়ে দোটানায় পড়ে গেলাম। তার চেয়ে বড় কথা সৌরভ কি সত্যিই উনার সৎ ভাই? দুনিয়াতে কী মানুষের টান পড়েছে? সৌরভকেই কেনো উনার ভাই হতে হলো। আর আমি যদি এখন উনাকে এসব বলি তাহলে কেমন রিয়েক্ট করবে?

ভয়ে ভয়ে উনার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নিশ্চিত উনার মুখের দিকে এসব বলতে পারবো না।আমি চুপচাপ উনার কোলে গিয়ে বসে বুকে মাথা রাখলাম। আমাকে এমন করতে দেখে উনি আরেক দফা অবাক হলেন। আমি শার্টের বুতাম নাড়াচাড়া করতে করতে বললাম,,”আমি যদি আপনাকে কিছু বলি তাহলে কী আপনি আমাকে ছেড়ে দিবেন?”

আমার কথা শুনে উনি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন,হঠাৎ রেগে গিয়ে একটু আওয়াজ করে বললো,,”একটা থাপ্পর দিবো বেয়াদব।এসব কী ধরবের কথা?ছাড়াছাড়ি..!!”

আমি একটু ঢুক গিলে বললাম,,”কথাটা সত্যি এমন ধরনের।আমি জানি এটা শুনলে আপনার খুব খারাপ লাগবে।”

–“এত হেয়ালি না করে সরাসরি বলো..!! তোমার এসব একদম ভাল্লাগছে না। ”

আমি অনেক্ষণ চুপ করে রইলাম,তারপর হুট করে বলে দিলাম সৌরভের কথা।
.
.
.
চলবে?