ভুলিনি তোমায় পর্ব-৩০

0
2903

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :৩০

“আপনি কথায় কথায় এত রেগে যাচ্ছেন কেনো? আমি তো স্বাভাবিকভাবেই বলেছি আপনার কাছেই এমন লেগেছে।আমি আপনার সাথে কথাই বলবো না।কার না কার রাগ আমার উপর ঝাড়তেছে।হু হু..!!

বলেই আমি অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়লাম।৫ মিনিটের মতো হয়ে গেছে অথচ উনার কোনো রিয়েকশন দেখতেছি না।মনকে বারবার বুঝালাম যে উনার সাথে কথা বলবো না কিন্তুু কোনো মতেই মানাতে পারতেছিলাম না।তাই একটুপর চিকন সুরে বললাম,,”আপনি কী ঘুমিয়ে গিয়েছেন?”

উনি কোনো জবাব দিলেন না,কিন্তুু আমি ঠিকই দেখতেছি উনি ঘুমান নি।

–“আচ্ছা,শুনেন না..!!আপনার মা কীভাবে জানলো যে আমি আপনার বউ। মনে হয় বাবা বলেছেন,তাই না?”

উনার সাড়া না পেয়ে আমি আবারো বললাম,,”আচ্ছা, আপনি মায়ের সাথে এভাবে কথা বলেছিলেন কেনো?জানেন,উনি কত কষ্ট পেয়েছিলো?”

উনি আগের মতো চুপচাপ শুয়ে রইলেন কোনো রিয়েক্ট করলেন না।

—“বেচারি কত কষ্ট পেয়েছে।আচ্ছা,সৎ মা বলে কী আপনি উনার সাথে এমন বিহেভ করেছেন?আমার খুব খারাপ লেগেছে,এমন টা করা আপনার উচিত হয় নি।আপন,,”

আমার পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে উনি ঘুরে আমার উপরে উঠে বিছানার সাথে চেপে ধরেন।রক্তিম বর্ন চোখ করে বললেন,,”সবার কষ্ট তোমার চোখে পড়ে শুধু আমার ছাড়া।আমি কি করেছি উনার সাথে হ্যা?বলো কী করেছি?”

উনাকে এত জোরে কথা বলতে দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই।চোখদুটো টলমল করতে লাগলো।উনার বিহেভিয়ার এত চেঞ্জ!! আমি শুধু চোখ দিয়ে উনার দিকে তাকিয়েই আছি,কোনো কথা বলছি না,উনি কী বলছেন তাও শুনতেছি না।শুধু উনাকেই দেখতেছি।উনার চিকন ঠোঁটদুটো নড়ছে, বুঝতে পারতেছি উনি কথা বলছেন।হঠাৎ উনি চিন্তিত সুরে আমার গালে মিছি মিছি থাপ্পর দিয়ে আমাকে ডাকতেছেন,আমি শুনতে পারতেছি কিন্তুু কথা বলতে পারতেছি না,মাথা টা ঝিমঝিম করতেছে।চোখ দুটো বুজে আসছে,আমি বারবার তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করছি তবুও মেলতে পারতেছি না।

খুব কষ্টে এক হাত তুলে উনার সারা মুখে হাত বুলাতে লাগলাম,উনি তো প্রায় কান্না করেই দিচ্ছেন। উনার গাল বেয়ে আমার মুখের উপর কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।উনি কেঁদে কেঁদে আমাকে ডাকতেছেন আর বারবার প্রশ্ন করছেন কী হয়েছে?এমন কেনো করছো? কথাগুলো বলে আমাকে উনি আধশোয়া করে জড়িয়ে ধরলেন। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে যে উনার কষ্ট হচ্ছে।

–“রিলেক্স, আমি ঠিক আছি?”

কথাগুলো ফিসফিস করে উনার কানের কাছে বললাম।আমার কথা শুনে উনি একদম শকড,আমাকে ছাড়িয়ে সামনে নিয়ে এসে বললেন,”তুমি ঠিক আছো?”

আমি হেসে চোখ টিপ দিলাম। উনি বুকে হাত দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিলেন।আর আমি ঠোঁট কামড়ে উনার কান্ড দেখে হাসতেছি,লোকটা কত পাগল?আমাকে কত ভালোবাসে অথচ এ কথা আমাকে বলতে গেলে মনে হয় উনার মুখে কেউ করলা দিয়ে দেয়।আজ পর্যন্ত একদিন ও বলে নাই,”নায়লা আমি তোমাকে ভালোবাসি।” হু হু,তাতে কী হয়েছে আমিও তো বলি নাই।যতদিন উনি বলবেন না ততদিন আমিও কিছু বলবো না।

–“এই,তোমাকে কী ভূতে ধরেছে?একটু আগে উদ্ভট কান্ড করেছো আর এখন নিজে নিজে হাসতেছো। আর বিরবির করে কী বলতেছো?”

উনার কথার বিনিময়ে আমি আবারো হাসলাম।আমাকে হাসতে দেখে উনি কিছুটা চমকে গেলেন। বিছানা থেকে নেমে লাইট টা বন্ধ করে দিলেন।

–“এই,এই আপনি লাইট বন্ধ করেছেন কেনো?”

উনি কোনো কথা না বলে আমাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লেন।আমি বারবার ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তুু উনার বাহুবন্ধন থেকে মোটেও ছুটতে পারছি না।উনি আমার কপালে আলতো চুমু খেয়ে বললেন,,”থ্যাংকইউ আমাকে ডাইবার্ট করার জন্য।এখন চুপচাপ ঘুমিয়ে যাও,পুরো পথ জার্নি করে এসেছো।সরি তখন মাথা ঠিক ছিলো না।”

আমি কিছু বললাম না মিষ্টি হেসে উনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লাম।আমি জানি উনি এখন কিছু টা হলেও টেনশন মুক্ত।আমিও যখন এমন টেনশন করতাম তখন অন্যদিকে আমার মনোযোগ করে দিতেন আর তখন টেনশনের কথা একদম ভুলে যেতাম।তাই উনার উপর উনার ট্রিক প্রয়োগ করলাম,অথচ উনি ঠিকই বুঝে গিয়েছেন।উনি এত চালাক কেনো?কী খায় উনি?
.
সকাল ৫ টা,
ঘুমের মধ্যে অনুভব করছি কেউ আমাকে ডাকছে।ঘুমের রেশ ভারী হওয়ায় চোখ মেলতে পারছি না।কোনোরকম আদো আদো চোখ খুলতেই দেখলাম উনি আমার উপর ঝুঁকে আছেন,উনার ঠোঁটদুটো নড়ছে।বুঝতে পারতেছি আমাকে ডাকতেছে।আমি পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম,উনি আমাকে টেনে বসিয়ে দিলেন।আমি বসে বসে ঝিঁমাতে লাগলাম। উনিও বোধ হয় পন করে রেখেছেন আমাকে ঘুম থেকে তুলবেন। ইমোশনাল ব্লাকমেইল করেও কোনো লাভ হয় নি, উনি ঠিকই আমাকে তুলেছেন।অতঃপর আর কি মুখ ফুলিয়ে রেগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজ পড়ে নিলাম।

নামাজ শেষ করতেই দেখলাম উনি জানালার পাশে দাড়িয়ে আছেন। আমি ধীরে দীরে উনার কাছে গেলাম। আমার উপস্থিতি টের পেতেই উনি নড়েচড়ে সাবধানে চোখের পানি মুছে ফেললেন যা আমার চোখ এড়ায় নি। আমি কিছু জিজ্ঞাস করলাম না,কারন এতটুকু তো উনাকে চিনি যে উনি কিছু বলবেন না।

–“আপনার কী খুব কষ্ট হচ্ছে?”

উনি পাশ ফিরে আমার দিকে একপলক চেয়ে আবারো সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন,,”কষ্ট? কই না তো।কষ্ট কেনো হবে?”

বুঝলাম উনি কিছুই বলবেন না।এজন্য যে রাগ লাগে।আমি সেখান থেকে সরে আসতেই উনি আমার হাত ধরে ফেললেন।আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকাতেই উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলেন।আমি বারবার প্রশ্ন করলাম কী হয়েছে?কিন্তুু উনি কোনো জবাব দিলেন না।হঠাৎ উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন।আমি বোকা বনে চেয়ে রইলাম।উনি এমন উদ্ভট বিহেভ কেনো করছেন?উনার মনে কী চলছে? আমি কী কখনও উনাকে বুঝতে পারবো না,কথাটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
.
আন্টির কাছে যাওয়ার উদ্দেশে রুম থেকে উঠে কিচেনের দিকে পা বাড়ালাম।কারন ইতোমধ্যে হাড়ি-পাতিলের টুংটাং শব্দ ভেসে আসছিলো।শব্দের কারনে কিচেন খুজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয় নি। আমাকে দেখে আন্টি মিষ্টি হেসে বললেন,,”উঠে গেছো?আচ্ছা যাও টেবিলে বসো আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।”
প্রতিউত্তুরে আমিও হেসে বললাম,,”কী বানাচ্ছেন?”

আন্টি বললেন,,”রুটি বানাচ্ছি।খাও তো?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,,”হুম।”

–“আমি বানাই?”

–“ওমা,কী বলো এসব?না, না।”

–“প্লিজ বানাই।আচ্ছা কালকে যখন বলেছেন আপনাকে মা ডাকতে আমি ডেকেছি না?তাহলে আমাকে মেয়ের কাজ করতে দিচ্ছেন না কেনো?”

–“আরে কী বলো?মেয়েদের কাজ কী রান্না-বান্না করা নাকী?”

–“উহু,তবে এখন আমি করতে চাইতেছি আপনি করতে দেন।না হলে আমি আর আপনার কথা শুনবো না।”

আন্টি হেসে বললেন,,”আচ্ছা নেও।তুমি বড্ড জেদী। ”

আমি রুটি বেলতে বেলতে বললাম,,”উনিও এ কথা বলেন।”

–“ও তোমাকে খুব ভালোবাসে তাই না?ওহ্,তোমাদের তো আবার লাভ মেরেজ,ভালো তো বাসবেই তাই না?”

আন্টির কথা শুনে আমার হাত থেমে গিয়েছে।কী বলে এসব উনি?আমাদের লাভ মেরেজ মানে?তার চেয়ে বড় কথা শাশুড়ী হয়ে বউ এর সাথে এসব বলে কীভাবে?আমি চুপচাপ রুটি তে মনোযোগ দিলাম।

–“আসলে আমি এমনই সবার সাথে মিশে যাই,তাই একটু পার্সোনাল প্রশ্ন করে ফেললাম।ভুলেই গিয়েছি যে তোমার আর আমার কীসের সম্পর্ক।তুমি কিছু মনে কইরো না।”

–“আরে মনে করার কী আছে?আর কী মনে করবো? আসলে উনার সাথে আমার এক্সিডেন্টলি বিয়ে হয়ে যায়। আপনারই বা কী দোষ যে কেউই এ কথা বলবে। তবে,আমাদের লাভ মেরেজ না।”

আন্টি ওহ বলে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন।আমিও চুপচাপ কাজ করলাম।
.

–“আমাকে দেন,আমি রেখে আসি।”

–“আরে না, তুমি আর কত কাজ করবে?তুমি বরং গিয়ে বসো।না, এক কাজ করো,তুমি না হয় সৌরবের বাবার সাথে দেখা করে এসো।”

আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম,,”আচ্ছা।” বলেই নাস্তার প্লেট টেবিলে রেখে দরজা পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেলাম।আবারো আন্টির কাছে এসে কাচুমাচু করে বললাম,,”আচ্ছা,আমি উনাকে কী বলবো?না মানে উনি কী আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে?”
কথাটা বলে মাথা নিচু করে ফেললাম,আন্টি আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে মুখ চেপে হাসতে লাগলেন।

–“আরে,ভয় পাচ্ছো কেনো যাও উনি কিছু বলবেন না।তাছাড়া উনি মনে হয় সব জানে।তুমি গিয়ে বলো খেতে আসতে।”

আমি তাও আমতা আমতা করতে লাগলাম,যাবো না বলে।আন্টি আমাকে ঠেলে শশুরবাবার রুমে পাঠিয়ে দিলেন।

রুমে ঢুকে আমি উনাকে সালাম দিয়ে বললাম,,”মা,আপনাকে নাস্তা খেতে ডাকছে।”
কথাটা বলে আমি সামনে তাকাতেই দেখলাম এহসান বাবার সামনে বসে আছে।দুজনে কী যেনো কথা বলছিলো আমাকে দেখে থেমে গেলেন। এহসান আমাকে ইশারায় বললেন চলে যেতে,পরে আসতে। আমি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে বাবা বললেন,,”আরে আসো আসো।এখানে বসো।”

আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললাম,,”আপনারা কথা বলুন আমি পরে আসবো। তাড়াতাড়ি আসুন নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

কথাটা বলে আমি দ্রুত চলে আসলাম। ডাইনিং রুমে আসতেই দেখলাম আন্টি সব রেডী করে দাড়িয়ে আছেন,আমাকে দেখে বললেন,,”কী? ” আমি বললাম,,”কিছু না,উনারা আসছেন।”

আন্টি বললেন,,”ওহ্,তুমি বসো আমি সৌরভকে ডেকে আসছি।”

আন্টির কথা শুনে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছে।আমি গটগট করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। কেনো যেনো টেনশন হচ্ছে।সৌরভ আমাকে দেখলে কেমন রিয়েক্ট করবে?ও কী আমাকে চিনবে?সবাইকে কী সবকিছু বলে দিবে?শশুড়-শাশুড়ীর সামনে কী একটা অবস্থা হবে তখন। আমি চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে উদ্ভট ভাবনা ভাবতে লাগলাম।মিনিটখানেক পর দেখলাম সৌরভ আর আন্টি একসাথে আসছেন। বার বার নিজেকে বুঝালাম যে আমি তাকাবো না কিন্তুু বেহায়া মন মানলে না।সৌরভের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই আমি স্থির হয়ে গেলাম।সৌরভের চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে,আগের সৌরভ আর এখনকার যে সৌরভ দেখতে পাচ্ছি তার কোনো মিল নেই। সৌরভ ওর মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে আসছিলো তখন আমার দিকে চোখ পড়তেই সৌরভ থেমে গেলো।ও অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি মাথা নামিয়ে ফেলতেই সৌরভ অস্ফুটসুরে বলে উঠলো,”ন্ নায়লা..!!”

আমি চমকে আবারো সৌরভের দিকে তাকালাম,আমার গলা বারবার শুকিয়ে আসছে। আমি উশখুশ করতেছিলাম তখনই পিছন থেকে শশুরবাবা বলে উঠলো,,”হ্যা,নায়লা।তুমি চেনো নাকি?”

সৌরভ আমার দিকে একবার তাকিয়ে শশুর বাবাকে বললো,,
–“হ্যা,চিনি তো।”

সৌরভের কথা শুনে বাবা ভ্রু কুচকে বললেন,,”কীভাবে চিনো?”
.
.
.
চলবে?