#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim_Nishi
#পর্ব_৩৪
–“কেনো,খারাপ কেনো লাগবে?আমি তোমাকে ভালো করেই চিনি। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা সেটা ভালোই বুঝি।এখন বলো কী হয়েছে যে কাল কাঁদতে কাঁদতে একদম ফ্লোরেই ঘুমিয়ে গিয়েছো।”
.
উনার কথাটা শুনে আমি বিষ্মিত হয়ে গেলাম।উনি সবকিছুতে স্বাভাবিক কীভাবে থাকে?কথাটা যদি উনি আমাকে বলতেন তাহলে আমি এতক্ষনে কেঁদে বন্যা বানিয়ে ফেলতাম।আমার কত খারাপ লাগতো,একবারও সত্য না মিথ্যা সেটাও ভাবতাম না। আচ্ছা,উনি এত ভালো কেনো?আমাকে কেনো এত বুঝে,আমাকে এত বিশ্বাস কেনো করে?উত্তরগুলো আমার জানা নেই।
–“তোমার ভাবনা-চিন্তা শেষ হলে আমাকে বলো।না মানে পরের কাহিনী শুনবো।”
উনার কথা শুনে আমি ভেংচি কাটলাম।তারপর যা যা হয়েছে এক এক করে সব বললাম। আমার কথা শেষ হতেই পিনপিন নিরবতা বিরাজ করলো। কিছুক্ষণ পর উনি আমার দিকে ঘুরলেন,আমার চোখের দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে বললো,,,
–“দাত থাকতে দাতের মর্যাদা না দিলে এমনই হয়। কথায় আছে না,ভাবিয়া করিও কাজ,করিয়া ভাবিও না। সৌরভ ও ভেবে করে নি তাই ওকে পস্তাতে হচ্ছে। কিছু মানুষ তাদের ভুলগুলো দেখে না, বুঝে না কিন্তুু জীবনের শেষ সময়ে এসে ঠিকই বুঝে।তখন পস্তানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।তাই যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভেবে-চিন্তে নেওয়া উচিত। আচ্ছা বাদ দেও,যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে।”
কথাটা শেষ করেই উনি আমাকে শক্ত জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লেন।এতে আমি কিছুটা অবাক হলাম।মিনিটখানেক পর কেউ দরজায় কড়া নাড়লো। আমি আস্তে সুর তুলে বললাম,,”কে?”
দরজার অপাশ থেকে উত্তর আসলো “আমি”। কন্ঠস্বর শুনে আমার চিনতে সময় লাগলো না। আমি ব্যস্তভঙ্গিতে বললাম,,”জ্বি,আসছি মা।”
বলেই আমি উঠতে নিচ্ছিলাম কিন্তুু উনি আমাকে এখনও ধরে রেখেছেন।আমি উনাকে বারবার ধাক্কাতে লাগলাম ছাড়ার জন্য কিন্তুু উনার কোনো হেলদোল দেখা গেলো না।
ওদিকে শাশুড়ি মা বললেন,,”আসার দরকার নেই,তুমি রেস্ট করো। আমি বলতে এসেছি যে আমি পাশের বাড়ী যাচ্ছি,নাস্তা পানি টেবিলেই আছে।তুমি উঠে কষ্ট করে খেয়ে নিও।”
কথাটা শেষ করেই শাশুড়ী মা চলে গেলেন।আর আমি রেগে গেলাম।উনি কী মনে করবেন, এতক্ষণ কেউ ঘুমায় নাকি। আমি প্রচন্ড রেগে উনাকে ধাক্কা দিয়ে বললাম,,”আজব,সরুন।আপনি শুনতে পাচ্ছেন না মা আমাকে ডাকছে।ছাড়ুন না।”
–“উঠার দরকার নেই, আরো কিছুক্ষন রেস্ট করো।তাছাড়া মা এখন চলে গেছে।”
–“কিহ?আপনি পাগলা নাকি, মা চলে গেছে বলে কি আমি উঠবো না।”
—“আমি না করেছি কখন?আমি শুধু বললাম আরো কিছুক্ষণ রেস্ট করো। দুদিন থেকে তো শরীর ভালো না তাই বলছি।আর উঠার পর বেডশিট বদলে রেখো, তোমার ধোয়ার দরকার নেই আমি ধুয়ে দিবো।”
–“আরে না,কি বলতেছেন?আপনি এসব কেনো করবেন?”
–“ফালতু কথা না বললে হয় না?চুপচাপ শুয়ে থাকো।আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।আর শুনো, তোমার ওগুলা আছে তো?”
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে মাথা নাড়িয়ে বললাম,,”না,আজকেই শেষ হয়ে গিয়েছে।”
—“এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, আমি তোমার স্বামী।আচ্ছা একটুপর এনে দিবো।এখন কিছুক্ষণ শুয়ে থাকো আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই উনি উঠে চলে গেলেন।কিছুক্ষন পর ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসলেন।আমি উঠে বসতেই উনি আমাকে ধরে পিছনে বালিশ দিয়ে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলেন। এরপর উনি নিজে আমাকে ধরে খাইয়ে দিলেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসলাম।উনি আমাকে হাসতে দেখে ভ্রু কুচকে বললেন,,”কী?”
আমি হাসিমুখে বললাম,,”লোকে দেখলে বলবে বউয়ের আচল ধরে বসে আছেন।বউয়ের কথায় উঠেন বসেন।”
—“বউ অসুস্থ থাকলে বউয়ের সেবা করাকে যদি লোক এসব ভাবে তাহলে আমার করার কিছু নেই।এটা উনাদের মানসিকতার সমস্যা।আমার বউ, আমি আমার বউয়ের কথা শুনবো কী শুনবো না সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার। লোকে তো কত কিছুই বলে,সব কিছুতে কান দিলে চলা যায় না।”
উনার কথায় আমি ভেংচি কাটলাম।উনি কিছু বললেন না উনার মতো মুচকি হেসে আমাকে খাওয়াতে লাগলেন।
.
ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছি আধ ঘন্টা হতে চললো। আরো মিনিট দশেকের মতো অপেক্ষা করতে হবে। সব উনার কারনে, ডাক্তার আসার আগেই চলে এসেছেন। মাঝে মাঝে উনার ওভারপসিসেভনেস দেখলে রাগ লাগে।কী দরকার ছিলো এত তাড়াতাড়ি আসার।এদিকে বসতে বসতে একদম বোরিং হয়ে গিয়েছি।এদিকে পরীক্ষার রেজাল্টের টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছি। প্রায় অনেক্ষন পর ডাক্তার আসলেন। ডাক্তারকে সমস্যার কথা বলতেই উনি কিছু চেক আপ করান। ঘন্টাখানেক পর রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম।
ডক্টর রিপোর্ট দেখতে দেখতে বললেন,,”আই এম সরি।”
ডাক্তারের কথা শুনে কপাল কুচকে একবার উনার দিকে তো আরেকবার ডাক্তারের দিকে তাকালাম।
এহসান উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,,”সরি,মানে ডক্টর?”
ডক্টর রিপোর্ট টা উনার দিকে এগিয়ে দিলেন।চোখের চশমা টা খুলে উনাকে বললেন,,”সরি মানে আপনার বাচ্চা মিসক্যারেজ হয়ে গিয়েছে। ”
ডাক্তারের কথা শুনে আমরা দুজনেই বেশ বড় ঝাটকা খেলাম।
—“বাচ্চা নষ্ট হয়ে গিয়েছে মানে ও কি প্রেগন্যান্ট ছিলো?”
–“হ্যা,উনার ৪৫ দিনের বাচ্চা ছিলো।কেনো আপনারা জানতেন না?”
এহসান টলমলে চোখে মাথা নাড়ালেন।
—“মে বি ফার্স্ট টাইম, তাই হয়তো টের পান নি।”
এহসান কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,,”বাচ্চা মিসক্যারেজ কেনো হয়েছে?”
–“এটা বিভিন্ন কারনেই হয়।পেশেন্টের কিছু সমস্যা রয়েছে।উনার দুটো টিউবেই সিস্ট রয়েছে এবং থাইরয়েডও রয়েছে যার কারনে ভ্রুন নষ্ট হয়ে গিয়েছে।”
–“ভবিষ্যৎ এ কি সমস্যা হবে?”
–“হতে পারে আবার নাও হতে পারে।তবে মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।কারন একটা টিউবে না দুটো টিউবেই সিস্ট।”
এহসান ছোট্ট করে বললেন,,”ওহ্”
আমি মূর্তির মতো বসে উনাদের কথাবার্তা শুনতেছি।আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম?কিন্তুু কই আমি তো জানলাম না। কালকে থেকেই তো পেট ব্যাথা আর প্রচুর ব্লাড যাচ্ছিলো। ওহ,বাচ্চা নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলেই এ সমস্যা হচ্ছিলো। চোখের কোনে পানি চিকচিক করে উঠলো,নিজের অজান্তেই পেটে হাত দিলাম।’আমার বাচ্চা ছিলো’ কথাটা ভাবতেই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়লো।আড়ালেই চোখের পানি মুছে নিলাম।
হসপিটাল থেকে বের হয়েছি প্রায় মিনিট বিশেক আগে। দুজনেই চুপচাপ রাস্তার পাশ দিয়ে হাটতেছি। অজানা এক নিরবতা ঘিরে আছে আমাদের। দুজনের মনের অবস্থা একটুও ভালো না। একটুপর পর দুএকজন রিক্সাচালক জিজ্ঞেস করছে যাবো কী না?উনারা কোনো জবাব না পেয়ে চলে যাচ্ছেন।
অনেক্ষন পর উনি হাতের ইশারায় একটা রিক্সাওয়ালাকে ইশারা করতেই রিক্সাওয়ালা এসে হাজির হলো।উনি আমাকে ইশারায় উঠতে বলে নিজেও চড়ে বসলেন।
আমরা দুজনেই নিরব,কারো মুখে কথা নেই।
কিছুক্ষন পর উনি আমার হাতে হাত রেখে বললেন,,”চলো,আজকে আমরা একটু ঘুরাঘুরি করি।এখানে আসার পর তো তেমন কোথাও যাই নি।”
আমি উনার হাত টা সরিয়ে দিয়ে শক্ত গলায় বললাম,,”না আমি কোথাও যাবো না।সরাসরি বাড়ী যাবো।”
উনি কিছু বললেন না শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর আমরা কোথাও যায় নি, সোজাসুজি বাড়ীতেই চলে এসেছি। রুমে এসে ব্যাগপত্র ছুড়ে ফেলে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। উনিও আমার পিছন পিছন রুমে আসলেন।
মিনিটখানেক পর চোখ মুখ ফুলিয়ে বের হয়ে আসলাম। উনি আমার কাছে এসে এক ধমক দিয়ে বললেন,,”কিছু হলেই কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কিছু করতে পারো।সবকিছুতে এত কান্না করা কী জরুরী?দেখো ওটা এক্সিডেন্ট ছিলো তাছাড়া আমরা কেউ তো এ বিষয়ে জানতাম না তাই না?আর এত দ্রুত আমি বাচ্চা নিতামও না,বুঝেছো?”
আমি ঠোঁট ফুলিয়ে উনার বুকে মাথা রাখলাম।যথাসম্ভব চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারলাম না, ডুকরে কেঁদে দিলাম।উনি পরম আবেশে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমি কাঁদতে কাঁদতে উনার বুকেই ঘুমিয়ে পড়লাম। উনি আমাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে, শরীরে কাঁথা টা টেনে দিয়ে দরজা চাপিয়ে চলে গেলেন।
.
মাগরিবের আযানের পর আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো।চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম উনি আমার হাত ধরে বসে আছেন। ঘুম ভাঙ্গতেই উনি আমাকে ধরে বসিয়ে দিলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বললেন,,”রেজাল্ট দিয়েছে তো। জানো কী পেয়েছো?”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম না। উনি আমার মাথাটা বুকের সাথে টেনে ধরে বললেন,,”আলহামদুলিল্লাহ, ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছো।”
আমি মাথা নাড়ালাম। রেজাল্টের কথা শুনে আমার তেমন উৎফুল্লতা কাজ করলো না।অন্য সময় হলে হয়তো খুশিতে আটখানা হয়ে যেতাম।মন টা একদম বিষন্নতায় ছেয়ে গিয়েছে।মাথায় শুধু বাচ্চার কথা ঘুরতেছে।আচ্ছা,আমি কী মা হতে পারবো না?ডাক্তার তো বলেছে সম্ভাবনা আছে,কিন্তু সেটা তো কম।উনার নিশ্চই বাবা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে। কারই বা না থাকবে।আমার জন্য এমনিতেই উনার পুরো জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছে।না,না আমি চাই না আমার জন্য উনি আরো কিছু হারাক।
আমার ভাবনা-চিন্তার মাঝেই উনি বললেন,,”কিছু খাবে?”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম না।
টলমল চোখে নিজেকে শক্ত করে বললাম,,”একটা কথা বলি।”
উনি বললেন,,”হ্যা,বলো।”
–“আপনি আরেকটা বিয়ে করে ফেলুন।”
আমার কথাটা উনার কানে বর্জ্রপাতের মতো বাজতে লাগলো।
উনি চোখ লাল করে আমার দিকে তাকালেন।উনাকে এভাবে তাকাতে দেখে আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম, তাও সাহস যুগিয়ে বললাম,,”দেখুন সবাই বাচ্চা চায়।আপনারও তো একটা আশা বলে কিছু আছে। আমার থেকে আপনি কিছুই পান নি,আর হয়তো পাবেন ও না।তাই আমি বলছি যে আপনি না হয় আরেকটা বিয়ে করে ফেলুন,আমি কখনো আপনাদের জন্য সমস্যার কারন হবো না।শুধু আপনাদের বাচ্চাকে একটু আদর করতে দিলেই হবে।”
আমার কথা শেষ হতেই উনি চোখ বন্ধ করে দাত চেপে বললেন,,”আমার বাচ্চা চাই না।আমার তোমাকে চাই।বুঝো নি তো?স্বাভাবিকভাবে বলতে গেলে আমি তোমার সাথে সেক্সুয়াল লাইফ লিড করতে চাই। ”
আমি কান্নামাখা কন্ঠে বললাম,,”আপনি এটা বলতে পারেন না।আপনাদের পরিবারেরও কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে।আপনি এখন এগুলা বলছেন কারন আপনি বুঝতেছেন না।”
—“আমি বুঝতে চাইও না।আমি যতটুকু বুঝি তা হলো তুমি আমার বউ।তুমি ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করলে আমি একরা কিস ও দিতে পারবো না শোয়া অনেক দূরের কথা।বুঝোতো তুমি ছাড়া অন্য কারো সাথে সেক্সুয়াল ব্যাপারটা,,”
উনার কথা শেষ হওয়ার আগে আমি কান চেপে ধরলাম।রাগের মাথায় উনি খুব খোলামেলা কথা বলতেছেন তা বেশ ভালোই বুঝতে পারতেছি।কারন এর আগে উনি আমার সাথে কখনও এমন ধরনের কথা বলেন নি।খুব বুঝেছি উনি ভয়ংকর রেগে গিয়েছেন।কারন রেগে গেলে মানুষের হুশ থাকে না যে সে কোথায় কী বলতেছে।
.
.
.
চলবে?