ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-১৫
রোকসানা আক্তার
নাতাশার মায়ের কথায় বাবা পানিপড়া নিয়ে আসেন।পানির গ্লাস হাতে নিয়ে নাতাশার মা নাতাশার ঘরে আসেন এবং পেছন পেছন রুব্বানও।
গ্লাস থেকে এক কোষ পানি হাতে নিয়ে নাতাশার সারা গাঁয়ে ছিটিয়ে দেন।নাতাশা চমকে উঠে।সে তার মায়ের দিকে তাকায়।অবাক হয়ে মাকে বলে,
-মা,হঠাৎ পানি!?
নাতাশার কথা বলা দেখে নাতাশার মা পাশের টেবিলের উপর তড়িঘড়ি গ্লাসটা রাখেন।আর উপরের দিকে তাকিয়ে দু’হাত দিয়ে মুনাজাত থাকেন।খুশির আহ্লাদে ভ্রু কুঁচকে রুব্বানকে বলেন,
-রুব্বান তোকে বললাম না?দরবেশ কালা মিয়ার পানি ওস্তাদি। দেখলি? গাঁয়ে পানি ছিটানোর সাথে সাথেই নাতাশা স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
-হ খালা তাই ত দেখতাছি।
নাতাশা চোখদুটো আড়াআড়ি করে একবার রুব্বানের দিকে তাকায়,একবার তার মায়ের দিকে।তার মায়ের উদ্ভট কথায় ভড়কে উঠে নাতাশা।
সে বুঝে তার মায়ের ভ্রম হচ্ছে।আর গ্রামে এসব অহরহ।তাই নাতাশা স্যাম্পেথিভাবে বলে,
-মা তোমরা যেমনটি ভাবছো,তেমন কিছুই নয়।আমি ঠিক আছি।এমনিই মাথা ঘুরাচ্ছে তাই আর কি কথা বলার ইচ্ছে নেই।
রুব্বান নাতাশার মায়ের চোখাচোখি তাকায়।নাতাশার মা নাতাশার কাছে গিয়ে বসেন।আর কাঁধে হাত রেখে বলেন,
-নাহ রে নাতু, সত্যিই!তুই রুব্বানকে জিজ্ঞেস কর কি হয়েছিল তোর।তুই কোনো কথা বলতে পারিস নি,কারো দিকে তাকাতে পারিস নি। নিজমনে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলি।ডাক্তারও তোর অসুখ নির্ণয় করতে পারেনি।আর আল্লাহর কি কুদরৎ দরবেশের পানিপড়া দেওয়ার সাথে সাথেই ভূতটা তোর শরীর থেকে চলে গেছে।দেখ,এখন ভালো করে নিজেকে দেখ, তুই কথা বলতে পারছিস।
নাতাশা এবার মুখে বিরক্তি ছাপ নিয়ে বলে,
-প্লিজজ মা,আমার ঘর থেকে একটু যাবে? আমি এখন একটু একা থাকতে চাই।
-হায় মা!!একা থাকা ভালো না।নাহলে,ভূত আবার ভর করবো।
নাতাশার রাগ এবার চরমে উঠে যায়।সে বিছানা থেকে নেমে বাইরের বারান্দায় চলে আসে।আর আকাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তারাগুলোকে মনভরে দেখতে থাকে।পেছন থেকে নাতাশার বাবা বলে উঠেন,
-মা তোর কিছু হয়েছে?আমায় বলতে পারিস।
নাতাশা পেছনে তাকায়।মুখে কৃএিম হাসি এঁটে বলে,
-নাহ বাবা,আমি ঠিক আছি।
নাতাশার বাবা কিছু আর না বলে মেয়ের কাঁধ চেপে অন্যএে চলে যান।রুব্বান মাথার বেণী নাড়তে নাড়তে বারান্দায় আসে।আর হেলেদুলে বলে,
-নাতু,আমি চইলা যাইতাছি।অনেক রাইত হইয়া গেছে।নিজের দিকে খেয়াল রাখিস।আর ওষুধ খাইয়া শুইয়া পড়িস।আইজকা খালাম্মা তোর লগে ঘুমাইবো।আমি গেলাম রে।
রুব্বান কথা শেষ করেই ঘটাং ঘটাং পা পেলে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।অন্ধকার বললে ভুল হবে।গতকাল রাত থেকে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের দেখা মিলেছে।তাই রাতটা পূর্ণিমার আলোর মেলায় নাচছে। পুরো গ্রাম-গন্জ, মাঠ,বিল,খেত,পথ,বাগান স্বচ্ছ আলোতে ধকধক করছে।সেকারণে, কোনোরকম আলো ছাড়াই রুব্বানের বাড়িতে যাওয়াটা সহজ।আর এসব গ্রাম্য মানুষদের কাছে সাধারণ কিছু।
।
রাত যত গভীর হচ্ছে,নাতাশার বুকটা তত ভার হয়ে আসছে।নিজেকে কোনোমতে মানাতে পারছে না।নীর ফোন রাখার পর থেকেই নাতাশার মাঝে এমন অসদাচরণ প্রকোপ পাচ্ছে ।সে বোধহয় নীরকে ডিভোর্স ব্যাপারে বলাটা মানতে পারে নি।ভালোবাসার টুকরো খানি এখনো বিরাজ করছে নীরের প্রতি।তবে,আবেগের কাছে বিবেককে সে কখনোই হেয় হতে দিবে না।মানুষের মোমের মন কঠিন পাথরে তখনই রূপান্তরিত হয় যখন সেই মানুষটি শত কষ্টের আঘাতে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে শেখে।
নিজকে এবং অন্যকে এর রেশটুকুও বুঝতে দেয় না নাতাশা। একটা আক্ষেপ দীর্ঘশ্বাস টেনে ঘরের দিকে ফিরে যায়। চাদর টেনে একসাইড হয়ে বিছানার উপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে।রাতের খাবারটা আর খাওয়া হলোনা।নাতাশার মাও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে খাওয়ার জন্যে ওতো জোর চাপান নি।
সকাল হয়।
কোহিনুর বেগম মোবাইল হাতে নিয়ে পুরো ঘরে পায়চারী করতে থাকেন।একবার দক্ষিণ মুখী,একবার উওরমুখী।না উনার মনকে মানাতে পারছেন।কারণ,কাল রাত থেকে নীর বাসায় আসেনি, ইভেন ফোনটাও বন্ধ।নীরের সব বন্ধু-বান্ধবকে কল করা শেষ তাদের কারো বাসায় নীর যায়নি।
কোহিনূর বেগম এবার পায়চারিটা বন্ধ করে ধপসে সোফার উপর বসে পড়েন।আর তড়িঘড়ি নাতাশাকে কল করেন।
নাতাশা কল রিসিভ করে।
-হ্যালো,নাতাশা?
নাতাশা কোহিনুর বেগমের অস্থির মতিগতি দেখে ভয় পায়।টাল সামলে বলে,
-মা,বলেন!
-নাতাশা,তোমার সাথে নীরের কথা হয়েছে কাল রাত?
-নাহ মা।তবে,কেন?
-ও কাল রাত থেকে বাসায় আসেনি।তাছাড়া,ফোনেও ওকে পাচ্ছি না।খুব টেনশন হচ্ছে মা।ছেলেটা না জানি কোথায় পড়ে আছে!
নাতাশার বুকের বাম পাজরটা ছ্যাৎ করে উঠে। মুহূর্তে চোখ পানিতে ভিজে আসে। নাতাশা স্বাভাবিক হয়ে আবার বলে,
-মা,উনার সব বন্ধুদের সাথে কথা হয়েছে?
-হ্যা,হ্যা,কথা হয়েছে নাতাশা।কারো বাসায় ও যায়নি।
নাতাশা খানিকটুকু ইতস্তত হয়ে বলে,
-মা,চিন্তা করবেন না।হয়তো,অফিসের কারো বাসায়ও যেতে পারেন,জানেন ত কোম্পানির নানান ঝামেলা।চলে আসবে।
-নাতাশা এই ছেলে আমাকে কখনো কোথাও না বলে যায় না,কিন্তু—–!
-প্লিজ মা,কুল।।ইনসাল্লাহ উনি চলে আসবেন।আমার মন বলছে।এমনো হতে পারে আর্জেন্ট কাজে ফেঁসে গেছেন।
কোহিনুর বেগম চুপ হয়ে মুখে একটা মলিন ভাব এনে লম্বা শ্বাস ফেলেন। নিহানকে বাসার মধ্যে ঢুকতে দেখেই কোহিনুর বেগম নাতাশাকে বলেন,
-নাতাশা,পরে কথা হবে।নিহান আসছে। ওর সাথে একটু কথা বলে নিই।
-আচ্ছা,মা।আর আমিও উনার ফোনে ট্রাই করতেছি।
-আচ্ছা,মা।
নাতাশা কলটা কেটে দেয়।ভীষণ চিন্তায় তার মাথা নিমজ্জিত হয়ে আসে।নীর কোথায় যেতে পারে?তাও কার বাসায়?আচ্ছা,সেদিন গাড়িতে হাত দেখা সেই মেয়েটির সাথে নয়তো নীর?
এসব ভাবনার মাঝে নাতাশা মুখটা কুঁচকে আনে।কুঁচকে আনাটা কান্নার ভাব। কান্নাটাকে মূহুর্তেই ধামাচাপা দিয়ে মোবাইল ঘেটে নীরের নাম্বার স্ক্রীনের সামনে আনে।আর কল দেয়।মোবাইলটা কানের কাছে গুঁজতেই নাতাশাও শুনতে পায়–”নাম্বারটি এই মুহূর্তে সংযোগ দেবার সম্ভব হচ্ছে না।অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন।”
নাতাশা এবার সত্যিই কান্না করে দেয়।।বিছানার চৌকাঠের সাথে হেলান দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে।মাথাটা নিচু করে নিস্তব্ধতায় চোখের পানি ফেলে।ফাঁকে ফাঁকে ফুঁপিয়ে ওঠা নিঃশ্বাসের ধ্বনি জোরে শব্দ করে উঠে।ক্লান্তিচোখে ঘোর হয়ে আসে।রুব্বানের কথার আওয়াজে নাতাশার ঘোর কাটে।সরু চোখে রুব্বানের দিকে তাকায়। রুব্বান নাতাশার পাশে বসে বলে,
-কীরে শরিল ঠিক হইসে তোর?
নাতাশা দু’পাশে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত জানায় সে ভালো আছে।রুব্বান খিলখিলিয়ে হাসে।বলে,
-আমি কইলাম না কালা মিয়ার পানি ওস্তাদি। দেখলি তুই একরাইতেই ভালা হইয়া গেছস।
নাতাশা কোনোকিছু আর না বলে বিছানা থেকে নেমে পড়ে।বাইরে এসে দেখে নিতু,নিদ উঠোনে কানামাছি খেলছে।নাতাশা পলকহীন চোখে একমগ্নে দাড়িয়ে তাদের খেলা দেখে।নিতু নাতাশাকে দেখামাএই চিল্লিয়ে বলে,
-আপু,আমাদের সাথে খেলবা?
নাতাশা মুখে মুঁচকি হাসির রেখা টানে।আর বলে,
-না,তোরা খেল।
নাতাশার মা নাতাশার কাছে এসে কপালে হাত রাখে।
-মা এখন তোর শরীরটা কেমন আছে?
-আলহামদুলিল্লাহ মা,ভালো আছে।
-আচ্ছা,থাক।আমি কিছু রাঁধবার জন্যে যাচ্ছি।
বলেই নাতাশার মা হনহন করে পাকঘরের দিকে চলে যান।রুব্বান নাতাশার পেছনে দাড়িয়ে শিষ বাজায়।নাতাশা পেছনের দিকে তাকাতেই রুব্বান নাতাশার হাতে তার ফোন তুলে দেয়।
-ধর,কথা ক।তোর হোরি কল দিসে।
নাতাশা কাঁপা কাঁপা হাতে রুব্বানের থেকে মোবাইলটা নেয়।হ্যালো বলতেই কোহিনূর বেগমের চৈচৈ মুখের কথা শুনতে পায়।অনেকটা উৎফুল্ল হয়ে কোহিনুর বেগম নাতাশাকে বলেন,
-নাতাশা জানো?নীর এখন কোথায় আছে?
নাতাশা খানিকটুকু আচমকা হয়ে বলে,
-কোথায় মা?
-আরেহ ও ত তোমাদের ওদিকেই গেছে।এখন অয়ন সহ নীর তার নানুর বাড়ি।ছেলেটা আসলেই একটা চতুর।সেখানে যাওয়ার কথা তোমাকেও জানায়নি এবং আমাকেও!
নাতাশা অবাক হয়।থতমত মুখে বলে,
-উনি যে এখানে এসছেন কে বলেছে, মা?
-নিহান।আর ওই অয়ন গাধাটা একটু আগে নিহানকে কল করে জানালো। ইচ্ছেই সারারাত সিম বন্ধ করে রেখেছে ওরা।কতটাই না ভয় পেলাম ওদের লুকোচুরি খেলায়।জানিস মা?এখন একটু দম নিতে পারছি।খুব শান্তি হচ্ছে আমার।
নাতাশার বুকটা পানিতে ভরে উঠে।আসলেই সন্তানদের প্রতি মায়েদের ভালোবাসার কোনো কমতি নেই।নাতাশা মুখে হাসি হাসি ভাব এনে বলে,
-আচ্ছা মা,বুঝলাম।যাক অন্তত চিন্তাটা মাথা থেকে ঝাড়া গেল!
-হু।আর নীর তোমাদের বাসায় গেলে আমায় জানাবে।
-আচ্ছা মা।
তারপর, কোহিনুর বেগম কল রেখে দেন।নাতাশার মনে ভয় এসে আকুপাকু খায়।নীর হঠাৎ এদিকে কেনই বা এলো!আর কি এমন উদ্দেশ্য আছে এখানে আসার।ডিভোর্সের ব্যাপারে ত কাল কথা হলো, তাহলে আজ…!!!
নাতাশা মাথাটাকে কোনোকিছইু ভাবতে দিতে পারছে না।কথা নেই বার্তা নেই ধমকা এখানে উপস্থিত!
নাতাশার মাথাটা অনেকক্ষণ অব্দি ঝিম হয়ে থাকে।রুব্বান বুঝতে পেরে বলে,
-কীরে নাতু?তোর আবার হইলো ডা কি?তুই এমন করতাছিস ক্যান!?
নাতাশা মাথাটাকে দু’পাশে ঝেড়ে চোখগুলোকে হালকা করার চেষ্টা করে।পরমুহূর্তেই নাতাশার বাবা কোথা থেকে এসে নাতাশার মাকে ডাকতে থাকেন।
-কইগো নাতুর মা?আরেহ কই তুমি?
নাতাশার মা পাকঘর থেকে তড়িঘড়ি বের হয়েই বলেন,
-আরেহ হয়েছে টা কী?এভাবে ডাকছেন কেন?
নাতাশার বাবা উল্লাসিত মনে নাতাশার মায়ের কাছে এগিয়ে যেয়ে বলেন,
-আমাদের জামাই বাবাজী এসছে।
-কোথায়?
-তার নানুর বাড়ি এখন।বিকেল বেলায় নাকি আমাদের বাড়ি আসবে।
-কী,সত্যি?!!
-হু।তাড়াতাড়ি একটু ভালোমন্দ রাঁধার ব্যবস্থা করো।নতুন জামাই আসবে বলে কথা।আর আমাকে পাটের ব্যাগটা দাও ত।আমি বাজারে গিয়ে কিছু মাছ,মাংস,তরিতরকারি কিনে নিয়ে আসতেছি।
নাতাশার মা খুশি মনে মাথা নাড়েন।আর কাপড়ের ঘেমটা টেনে বড় ঘরের দিকে পা বাড়ান।বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা নাতাশাকে বলেন,
-নাতাশা শুনলি ত জামাই বাবাজী আসছে।যা দাড়িয়ে থাকিস না।তাড়াতাড়ি ঘরবাড়ি গোছগাছ করে পেল।
রুব্বান খুশির চোটে ধকধুকি বাজাতে থাকে।আর ড্যাং ড্যাং একটা নাচ দিয়ে বলে,
-সত্যি খালাম্মা?দুলাভাই আইছে?
-হ।।
-ওরেহ আইলো গো দুলাভাই।দেখবার পারমু তারে।কত যে খুশি আনন্দ বাতাসে।রুব্বানের সাথে উঠান থেকে দৌড়ে এসে নিদ এবং নিতুও যোগ হয়।তারাও পুরো বাড়ি মেলার আসর বসায়।।
নাতাশার মা এরকম দেখে বলে উঠেন,
নাতাশা এখনো ভ্যাবাছ্যাকায় আছে।কি হবার কথা ছিল,আর এখন হচ্ছেটা কী!!?
তারপরও নাতাশা সংকোচ নিয়ে নিজঘরের দিকে চলে আসে।আর কাল বলা ডিভোর্সের কথা বারবার ভাবনায় আসছে।
চলবে…