ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-১৬
রোকসানা আক্তার
দুপুর নাগাদ নাতাশার মায়ের রান্নাবান্না সব শেষ হয়।উনি আজ জামাইয়ের জন্যে ইলিশ মাছের কোরমা,মুরগির মাংসের রোস্ট, ভুনা ঝালে গরুর মাংস,মশারীর ডালের হালিম,পোলাও ইত্যাদি রান্না করেন।আর নাতাশা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুরো বাড়ি ধকধকে-তকতকে পরিষ্কার করে গুছিয়ে ফেলে
নাতাশা যোহরের নামাজ সেরে একটা পাতা কালার শাাড়ি পড়ে এখন বিছানার উপর পা এলিয়ে বসে আছে।চুলগুলো কোমর অব্দি ছড়ানো।জানলার ফাঁক দিকে বাইরের মৃদু বাতাসে নাতাশার চুলগুলো কিছুক্ষণ পর পর এসে দোল খাচ্ছে।
পাশে নিদ বসে বসে বুলবুল খেলা করছে একা নিজেই।আর নিতু আয়নার সামনে বসে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।নিতুর মাথার চুলগুলো জট পেঁকে আছে।
যতবার চিরুনি দিয়ে মাথার চুলগুলোকে সরল করতে যায়,ততবারই চিরুনির সাথে কয়েক গোছা চুল ছিঁড়ে আসে। নাতাশা তা লক্ষ করে ভ্রু কুঁচকায়।তার ঠিক খেয়াল নেই শেষ কবে নিতুর মাথায় হাত দিয়েছিল।সম্ভবত, বিয়ের তিনদিন আগে নিতুর চুলে বিলি কেটে বেণী গেঁথে দিয়েছিল।রুক্ষ চুলগুলোর বর্তমান অবস্থা বলছে অনেকটা দিন নিতুর চুলের যত্ন নেওয়া হয়নি।আগে,নাতাশাই নিতুর চুলগুলোর খুব যত্ন সহকারে আঁচড়িয়ে দিত।নিতু দুপুর বেলা স্কুল থেকে ফেরলে নাতাশা এক বাটি তেল হাতে নিয়ে নিতুকে নিয়ে বারান্দার উপর পা ছড়িয়ে বসতো।আর বিলি কেটে কেটে তেল মাখিয়ে দিত।তাতে নিতুর অনেক আরাম হত,সাথে কিছু ভালোবাসার উষ্ণ পরশ।নাতাশা নিতুর দিকে অনেকক্ষণ অব্দি দৃষ্টি রেখে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।আর নিতুকে বলে,
-এই নিতু?চিরুনি নিয়ে এখানে আস।আমি তোর চুল আঁচড়িয়ে দিচ্ছি।
নিতু তড়িঘড়ি চিরুনি হাতে নিয়ে নাতাশার সামনে এসে ধপসে বসে।আর চুলগুলো নাতাশার দিকে মেলে দেয়।নাতাশা চুলগুলোর আগায় হাত দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে আবার বলে,
-আমি বাড়ি নেই বলে মাথা আঁচড়ানো যায় না?চুলের কি অবস্থা করেছিস!দেখছিস আয়নায় একবার?
নিতু কাচুমাচু ভাব এনে বলে,
-আপু, হয়েছে রাখো তোমার আদুরী মাখা কথা!তুমি চলে যাবার পর মা আমার চুলগুলোর কথা একদম ভুলেই গেলেন।
-মার হাতে এক একগাদা সময় যে সারাক্ষণ তোকে নিয়ে থাকবেন?!ঘরের কাজ,রান্নাবান্নার কাজ,বাবাকে দেখা এসবে মায়ের সময়টা কোথায়!?আমি ত তোর সমান থাকতে আমি নিজেই নিজের চুল আঁচড়াতাম।কই আমি ত মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি নি!?এসব যেন আর না শুনি।ঠিক আছে?
নিতু দু’পাশে মাথা নাড়ে।নাতাশা বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর দেয় একটা।
নাতাশার মা ঠাস করে দরজা খুলে ভেতরে আসেন।নাতাশাকে এখনও প্রস্তুত না দেখে তাগাদা দিয়ে বলেন,
-কিরে নাতাশা, তুই এখনও রেডি হস নি?
নাতাশা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আলবোলা হয়ে বলে,
-মা হবো।
-কখন?
-এই ত মা নীতুর চুলগুলো আঁচড়ানোর পর।
-তাড়াতাড়ি রেডি হ।আমি গেলাম।
বলেই নাতাশার মা চলে যান।নিতুর মাথায় দুটো জুটি করে দেয়।তারপর,নিতু ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।আর নিতুকে “পিকু পিকু”-বলে খেপানোর জন্যে পেছন পেছন নিদও চলে যায়।নিতু যখন মাথায় জুটি করে তখন নিদ নিতুকে পিকু বলে ডাকে।কারণ,জুটিতে নাকি নিতুকে পিকুর মতো দেখায়।
নাতাশা নিদের চলে যাওয়া বুঝতে পেরে মুঁচকি একটা হাসি দেয়।তারপর বিছানা থেকে নেমে বিছানাটা একটু ঝেড়ে নেয়।তারপর নাতাশা আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ায়।নিজেকে একনজর দেখে আক্ষেপ একটা শ্বাস ছাড়ে।আসলে সে এখনো সাদামাটায় প্রস্তুত। যেখানে মেয়েরা তাদের স্বামী আসবে বলে চোখে কালো টিপ,কাল কাঁজল,ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক ইত্যাদি নানান বাহারি ধরনের সাঁজ মুখে লাগায়,সেখানে নাতাশার মাঝে তেমন কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
মুখে তার নেই কোনো হাঁসি,নেই কোনো উৎসাহ।আছে শুধু হৃদয় কাঁপানো রুদ্ধশ্বাস!!
দুুপুর গড়ায়।
সারাটা বেলা নিজ ঘরের বিছানার কোণে বসে বসে নাতাশা সময় কাটে।আসরের আযান পড়ে চারদিক।নাতাশা জানলার দিকে তাকায়।দৃষ্টি যায় পথের দিকে।কারণ,এই পথ দিয়েই নীরের আসার সময় হয়ে গেছে।।
নীর তার বাবাকে বলেছিল অয়নকে সঙ্গে নিয়ে বিকেলে আসবে।।নাতাশার ফকফক চোখের চাহনির মাঝে দুটো আবছা মূর্তির ছায়া চোখে পড়ে।দূর সীমানায় নাতাশা তা ভালোভাবে পরখ করতে পারেনি। ছায়াগুলো যখন অতি নিকটে আসে নাতাশার চোখদুটো থমকে যায়।নীর ঝিলিক দাঁতের হাসির ফাঁকে অয়নের সাথে কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে।হাতে তার গাদা ভর্তি ফলের ব্যাগ,মাছ,সবজি এবং ফাস্টফুড খাবার।
নাতাশা হনহন বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ে,আর জানলার আড়ালে দাড়িয়ে লুকিয়ে যায়।সে চায়না নীর তাকে এই মুহূর্তে দেখে পেলুক।।
নাতাশা কানখুলে শুনে কাঠের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ পড়তেই তার মা দরজাটা খুলে দেয়।
ভেতরে অয়ন এবং নীর প্রবেশ করে।নাতাশার মাকে দুজনে সালাম করে।নাতাশার মা হাসিমুখে সালামের জবাব নেন।আর নীর এবং অয়নকে চেয়ারে বসতে দেন।নাতাশার মা মলীন মুখ করে বলেন,
-বাবা রা,গরীব মানুষের বাড়ি আসলে….!
অয়ন ভড়কে বলে,
-এসব কেমন কথা আন্টি?প্লিজজ এসব বলবেন না।ধনী, গরীব মানুষের ভেদাভেদ না।মানুষের ভেদাভেদ মনে।
-তা বাবা তোমরা থাকো।আমি নাতাশাকে ডেকে আনতেছি।
বলেই নাতাশার মা নাতাশার ঘরে আসে।
-নাতাশা?এই নাতাশা?আমাদের জামাই বাবাজী আসছে।যা মা ওদের সাথে গিয়ে দেখা কর।আর আমি নাস্তা নিয়ে যাইতেছি।
।
নাতাশা সং হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তার মায়ের কথায় কোনোরকম কু-শব্দ তুলছে না।নাতাশার মা কিছুটি আর না বলে স্বাভাবিক হয়ে পাকঘরের দিকে চলে যায়।
নাতাশার মা চলে যাবার পর নাতাশার মনে আতঙ্ক এসে গ্রাস করে।কারণ,সে ত কিছুতেই এখন নীরের সামনে যেতে পারবে না।তাছাড়া,এই মুহূর্তে সম্ভবও না দেখা করা।কালকের ঘটনায় নাতাশার মুখটা থমকালো।কিছুতেই মুখ দিয়ে কথা আসছে না।
।
নাতাশা দম খিঁচে বিছানার উপর ব্যর্থমনে বসে পড়ে।
একটু পর আবারো নাতাশার মা ঘরে এসে উপস্থিত। ঝংকার আওয়াজে ধবনি তোলে বলেন,
-তুই এখনো এখানে বসে আছিস?আমার নাস্তাটাস্তা সব দেওয়া শেষ!
-না ইয়ে মানে মা আমার মাথাটা খুব ঘুরচ্ছে।
-ঘুরচ্ছে বলে বসে থাকবি এটা কোন ধরনের ভদ্রতা!?
নাতাশা মাথাটা নিচু করে আনে।
আর চোখ যায় জানলার দিকে।রুব্বান ঢ্যাং ঢ্যাং পা নাচিয়ে বাড়ির দিকে আসছে।আর বাড়ির সদর দিকটা দিয়েই পা বাড়াচ্ছে।তা দেখে নাতাশার বুক ভয়ে ধুকপুক করে উঠে।
কে জানে রুব্বান নীরদের সাথে আবার কেমন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে!তা নাতাশা ভাবতেই সারা গাঁ ছমছম করে উঠে।নাতাশা তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-মা রুব্বান সদরের দিকে যাচ্ছে।তুমি রুব্বানকে ডাক দিয়ে এখানে একটু নিয়ে আসো!প্লিজজ মা?
নাতাশার মা উল্টো মুখটাকে বাঁকা করে বলেন,
-ও তোর থেকেও ভালো।মুখের বুলি গৎবাঁধা হলেও ও তোর মতো ঘরকুনো ব্যঙ নয়,বুঝলি?
বলেই রাগ মনে চলে যান।
চলবে…