ভুলে যেতে ভালোবাসিনি পর্ব-১৭

0
3707

ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-১৭
রোকসানা আক্তার

রুব্বান সদর দরজার চৌকাঠে হাত রেখে ভেতরে একটা উঁকি মারে।ভেতরে অয়ন এবং নীরকে বসা দেখতে পায়।সাথে নিদ এবং নিতুও আছে।রুব্বান মুখে বেখেয়ালি একটা হাসি চেপে মাথার ওড়না ঠিক করে নেয়।গলার খেচকি টেনে ভেতরে ঢোকে,আর দুজনকে সালাম করে।
নীর, অয়ন ফকফক চোখে রুব্বানের দিকে তাকায়।অনেকটা জিজ্ঞাসুসূচকে সালাম গ্রহণ করে।নিতু পাশ থেকে বলে উঠে,
-ভাইয়া,উনি আমার আপুর বান্ধবী।এই ত একটু পরই উনাদের বাড়ি।
নীর টানা টানা চোখে বলে,
-উনাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি।

রুব্বান খিলখিল হেসে উঠে।এমন উচ্চ তড়িৎ বেগে হাসে যা দেখে নীর,অয়ন একে-অপরের চোখেচোখে তাকায়।নিদ ভড়কে বলে,
-আপু,যেখানে সেখানে দাঁত ভেটকে হাসা অভদ্রতা!তোমার এই অভ্যেসটি এখনোও গেলো না।
রুব্বান সবার সামনে নিদকে একটা ধমক দিয়ে বলে,
-তুই ছুপ করতো!আইসে পাকনামি করতে।ছোডরা ছোডগো মতন থাকবি,বুঝলি?
নিদ চুপ হয়ে যায়।তারপর রুব্বান ছলছল চোখে নীরের দিকে তাকায়।আর ছলাৎ ছলাৎ কন্ঠে বলে,
-আহা গো দুলাভাই,আপনে বুঝি আমার চেহারা ডা আন্দাজ করবার পারলেন না!মনে আছে?আপনে যে একদিন নাতাশাকে সাথে কইরা নদীর পাড়ে ঘুরতে আইসিলেন আর আমি সেইখানে আপনের হাতে কচুরিপানা ফুল তুইলা দিলাম।আপনি খুশি হইয়া আমারে একশো ডা টাহা বকশিশ দিসিছেল।

নীর ভাবতে থাকে। মনে করতে পারছে না।আসলে দু’বছর আগে যখন ও নানুদের বাড়ি আসছিল,তখন নদীর পাড়ই তার নিত্যদিনের আড্ডা ছিল।কখনো নাতাশাকে সঙ্গে নিয়ে আসতো,কখনোবা ছোট কাজিনকে নিয়ে।তার কাছে নদীর বয়ে চলা স্রোতের কলকল ধ্বনি কান পেতে শুনতে ভালোই লাগতো।
তারসাথে নদীতে ছড়ানো অবধারিত কচুরিপানা ফুলে তার দু’চোখ জুড়াত।তার উৎফুল্লতায় গ্রামের মানুষ তার হাতে কচুরিপানা ফুল তুলে দিতে।বলতে গেলে অনেকের থেকেই সে কচুরিপানা ফুল নিয়েছে।

রুব্বান নীরের ভাবুকতা দেখে বলে,
-কি দুলাভাই,মনে করতে পারসেন না?আইচ্ছা মনে করা লাগবো না।
নীর মাথা নাড়ে।
-তয় দুলাভাই,কি মনে কইরা এই বাইত আইলেন?আপার কথা বুজি খুব মনে পইড়া গেল?
নীর মাথা নিচু করে চুপ হয়ে যায়।রুব্বান তা দেখে মুখ চেপে হাসে,আর বলে,
-বুঝসি,দুলাভাই লজ্জা পাইসে।আইচ্ছা লজ্জা পাওন লাগবো না।।
অয়ন চোখদুটো চরকার মতো ঘুরিয়ে মনে মনে বলে,
-বাপরে বাপ, গ্রামের মেয়েরাও যে এত চতুর তা ভাবনায় ছিল না!
অয়ন এবার গলাটা পরিষ্কার করে জোর গলায় বলে,
-এই মেয়ে তোমার নাম কি?
-জ্বী আমার নাম রুব্বান। ডাক নাক রুবু।মেইনসে মজা কইরা কয় রুব্বা।কি নিতু ঠিক কইলাম না বুবু?
নিতু মাথা নাড়ে
-বাব্বাহ,খুব সুন্দর নাম ত।(অয়ন)
রুব্বান মাটির সাথে নখ খুঁড়ে দুলেদুলে বলে,
-হু,আমার মা রাখসে।
-আচ্ছা,বুঝলাম।তো একটা কাজ করতে পারবে?
-কী কাজ কন?
-তোমার বান্ধবীকে..আই মিন নাতাশা ভাবীকে এখানে একটু ডেকে নিয়ে আসতে পারবে?
-হ পারুম।এইডা ত মাএ এ মিনিটের কাম।আপনারা বহেন আমি এই যাইতাছি,নাতু রে সাথে নিয়া এই আইতাছি।।
অয়ন হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে বলে,
-আচ্ছা,আচ্ছা।

রুব্বান টপকে ভেতরে চলে যায় নাতাশাকে আনতে।অয়ন নীরকে একটা খোঁচা দিয়ে বলে,
-এই শোন,মেয়েটাকে ত আমার পছন্দ হয়েছে অনেক।কি ছলাৎ ছলাৎ কথা রে ভাই!
নীর অয়নের চোখের দিকে তাকায়।আর বিমূঢ় হয়ে বলে,
-তো এর সাথে এখন প্রেম করতে করার আক্রোশ জন্মাইছে নাকি?তোর ত আবার অভ্যেস যখন যে মেয়েকে দেখিস,তাকেই ভালো লেগে যায়!
-তুই না আসলে আজাইরা কথা বলস!যদি এরকই হত এখন পর্যন্ত আর সিঙ্গেল থাকতাম না,গফ থাকত একশোটা,বুঝলি?
-হয়েছে,রাখ এবার বকবকানি। একটু আগে এক বকবকানি কানের কাছ থেকে গেল,আবার আরেক বকবকানির বকবক করা শুরু হলো!
-তুই না শালা মানুষ হইবি না।তবে যাই বলিস মেয়েটাকে আমার সেই ভালো লেগেছে। মুখটা গোলগালের মধ্যে শ্যাম বর্ণের,মাথার চুলগুলো কোমর ছুই ছুই,পড়নে প্রিন্ট থ্রী-পিস।সাদামাটা মুখে সাদা সাদা কথা।আসলে,এদের মাঝে অনেক নিক্ষুত আর্ট ঘেরা যদি তা অনুভূতির কান দিয়ে শুনতে পেতিস!

নীর অবাক চোখে অয়নের দিকে তাকিয়ে আছে।নিঃশ্বাস বিহীন ওর কথাগুলোই শুনছে।তবে,মনের মাঝে সামান্য তম জেদ চেপে আসছে।কারণ,যে মেয়ে ভালোভাবে কথাটুকুই বলতে জানে না তার মাঝে কি এমন ভালো লাগার দিক আছে। তার উপর ভদ্রতা টুকুও দেখা যাচ্ছে না।দেখে মনে হয় প্রাচীন যুগের মাটির টেলা থেকে উঠে আসা কোনো গাঁইয়া। নীর মনে মনে কথাগুলো ভাবলেও অয়নকে কিছু আর মুখে ফসকে বলেনি।

কিছুক্ষণ পর নাতাশার বাবা নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বাড়ি ফেরে।ঘরে ঢুকে নীর এবং অয়নকে দেখে খুশিতে চোখদুটো ঝলমল হয়ে উঠে।
নীর এবং অয়ন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়।সালাম করে। নাতাশার বাবা অতি খুশির তালে নীর এবং অয়নকে জড়িয়ে ধরে।দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
-বাবারা আমি খুবই খুশি!আমি এতটাই খুশি যে তোমাদের বলে বুঝাতে পারবো না।
তারপর নাতাশার বাবা নীর এবং অয়নকে ছাড়িয়ে চোখের কোটরের পানি মুছে নেন।হাঁক ছেড়ে আবার বলেন,
-আজকের রাতটা কিন্তু তোমরা দু’জন আমাদের বাড়ি থাকবে।ঠিক আছে?

নীর হাই তুলতে তুলতে বলে,
-কিন্তু…..অয়ন নীরকে হাতের কণুই দিয়ে থামিয়ে নাতাশার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-আমরা থাকবো আঙ্কেল।
নাতাশার বাবা আরো খুশি হয়ে যান।আর ওখান থেকেই নাতাশাকে জোর গলায় ডাকতে থাকেন।
-নাতাশা,এই নাতাশা?ইয়ে বাবা তোমরা বসো আমি নাতাশাকে ডেকে নিয়ে আসতেছি।
-আচ্ছা, জ্বী আঙ্কেল।

নাতাশার বাবা নাতাশার ঘরে ঢুকেই নাতাশার সামনে এসে দাড়ান।আর বলেন,
-নাতাশা,নীর বাবা ওখানে এসে বসে আছে। তুই দেখা করেছিস ওদের সাথে?
নাতাশা হাই তাই করতে থাকে আর পাশ থেকে টপকে রুব্বান বলে উঠে,
-খালু,আমি বুঝলাম না ওর হইলো ডা কি?দুলা ভাইয়ের লগে নাই কাইজা, নাই কিছু।হুদাই একগুঁয়ে হইয়া এইহানে বইসা রইছে। একটু বুজান ত ওরে?
নাতাশার বাবা রুব্বানের থেকে চোখ সরিয়ে নাতাশার দিকে তাকায়।
-নাতাশা?এরকম কেন করছিস?যা গিয়ে সালাম টালাম দিয়ে দেখা কর।যদি এরকম করস তাহলে আমাদের খারাপ ভাববে।
-খালু মনে হয় লজ্জায় ও ওনাদের সামনে যাইতাছে না।
বলেই রুব্বান মিটিমিটি হেসে দেয়। রুব্বান কথায় নাতাশাা হালচোখা হয়ে যায়।একনজর তার বাবার দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি মাথাটা নিচু করে ফেলে।আর মনে মনে বলে,এই মেয়েটার লজ্জা-সরম কিচ্ছু নাই।কখন কার সামনে কি বলবে সে নিজেই জানে না।
নাতাশার বাবা নাতাশার কাঁধে হাত রেখে বলেন,
-নাতাশা,দেরী করিস না তাড়াতাড়ি যা মা।নাহলে,বাবার মান যাবে।
কথা শেষ করেই নাতাশার বাবা চলে যান সদর ঘরে।
নাতাশা এবার রুব্বানের দিকে কটু দৃষ্টিতে তাকায়।আর খছখচ গলায় বলে উঠে,
-তোর মাঝে লজ্জার এত ঘাটতি ক্যারে?
-ক্যান?
-সর এখান থেকে।
বলেই নাতাশা কাপড়ের আঁচল ঠিক করতে থাকে।আর চুলে হাত লাগিয়ে একটা খোঁপা করে নেয়। মাথায় আলতো আঁচল টেনে সদর ঘরের দিকে রওনা করে।তবে নাতাশার ওখানে যেতে কোনোমতেই ভালো লাগছে না।অনেকটা অপ্রস্তুত বোধ লাগছে।তবে ত আর উপায় নেই।আতিথেয়দের সৌজন্য বোধ টুকু দেখানো উচিত,সে যতই বড় শএু হোক না কেন!
লজ্জা,রাগ,ঘৃণা,ক্রোধ সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে নাতাশা সবার সামনে গিয়ে দাড়ায়।আর সালাম করে উঠে।ব্যাসিকেলি সালামটা অয়নের জন্যেই!
অয়ন ফকফক চোখে নাতাশার দিকে তাকায়।মশকরা করে বলে উঠে,
-আমরা ভাবীকে দেখতে আসছি নাকি বন্ধুকে বিয়ে করানোর জন্যে মেয়ে দেখতে আসছি।
নাতাশা লজ্জায় আরো রাঙ্গা হয়ে যায়।রুব্বান মিটিমিটি হেসে দেয়।এই মুহূর্তে নাতাশার মন চাচ্ছে রুব্বানের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে মাটির সাথে মিশে যেতে।

নীর নাতাশার দিকে নিমজ্জক চাহনিতে তাকায়,যেন দেখেও না দেখার ভান।
নাতাশার বাবা নাতাশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-নাতাশা?এখানে এসে বস।
নাতাশা চেয়ার টেন বসে।

চলবে..