ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-১৮(বোনাস পর্ব)
রোকসানা আক্তার
নাতাশার বাবা কিছুক্ষণ অব্দি সৌজন্য সাক্ষাত শেষ করে অন্যএে চলে যান।নাতাশার বাবা চলে যাবার পর রুব্বান এসে নাতাশার গাঁ ঘেষে বসে।আর গলার হাঁক ছেড়ে বলে,
-আহা!এহন একটু শান্তি হইলো।এতক্ষণে পা টা ব্যথায় অবোধ হইয়া গেল!!
নাতাশা রুব্বানের কথায় কোনোরকম শব্দ না করে চুপ হয়ে থাকে।অয়ন মিটিমিটি হাসে।রুব্বান তা দেখে বলে,
-এই মিয়া,আপনে এত হাসেন ক্যা?হেই তহন থাইকা দেখতাছি খালি হাসেন!আইজগা কি হাঁসের গোস্ত দিয়া ভাই খাইয়া আইছেন?
অয়ন রুব্বানের কথায় এবার আর হাসিটা চেপে রাখতে পারেনি।হো হো শব্দ তুলে হেসে উঠে!রুব্বানের রাগ বেড়ে যায়।চোখদুটো লাল করে বিরক্তি নিয়ে বাইরের দিকে চলে যায়।
রুব্বান চলে যাওয়ার পর অয়ন নাতাশাকে বলে,
-ভাবী,মেয়েটাকে দেখতে যতটা-না সহজ-সরল, ততটাই তেজ!
নাতাশা মুঁচকি হেসে বলে,
-ও এমনই।ভালোর মধ্যেও মাথায় ভূত চেপে বসে।।।
-তবে যা-ই বলো না ভাবী মেয়েটাকে হেব্বি লাগছে।
নাতাশা মাথানিচু করে হাসে।নীর আড়নয়নে অয়নের দিকে তাকায়।অয়ন ভড়কে গিয়ে নীরকে চোখটিপ মারে।নীর মুখটা কুঁচকে এনে আবার দৃষ্টি অন্যদিক করে নেয়।।অয়ন এবার গলা ঝেড়ে নাতাশাকে বলে,
-ভাবী?আপনি বোধহয় আমায় চেনতে পারেন নি, না?
নাতাশা দু’পাশে মাথা নাড়ে।
-ওকে,এবার আমার পরিচয়টা জেনে নিন।আমি নীরের পুরনো কালের বন্ধু!পুরনো বললে ভুল হবে।আপনাদের গ্রাম্য ভাষায় ন্যাংটা বলে না?আমি নীরের সেই ন্যাংটা কালেরই বন্ধু ।
নীর ইতস্ততা বোধ করে অয়নের কথায়।মাথাটা অয়নের কানের কাছে গুঁজে ফিসফিসিয়ে বলে,
-শালা,তুই আর মানুষ হইলি না!
-রাখ তোর ফিসফিসানি।ভাবীর সামনে এত লজ্জা রাখা ভালো না।নাহ ভাবী?
নাতাশা নিচের দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে আরো হেসে দেয়।অয়নও নাতাশার সাথে তাল মিলিয়ে হাসে।নীর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। অয়ন সেদিকে লক্ষ করে বলে উঠে,
-কোথায় যাচ্ছিস?
-ইয়ে মানে বাথরুম টা কোনদিকে?জানি না তো!
নাতাশা মুহূর্তেই ঘোমটা টানতে টানতে নিদকে ডাকতে থাকে।নিদ সদর ঘরে এসে উপস্থিত হয়।নাতাশা নিদকে ফিসফিসিয়ে বলে নীরকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিতে।নিদ নাতাশার কথামতো নীরকে সাথে নিয়ে যায়।
নিদ এবং নীর চলে যাওয়ার পর অয়ন নাতাশার দিকে চেয়ারটি আরেকটু এগিয়ে নেয়।নাতাশা তা দেখে ভড়কে উঠে।অয়ন হাঁক ছেড়ে বলে,
-ভাবী আপনার সাথে আমার কিছু কথা বলার আছে যেহেতু নীর এখন এখানে নেইই।
নাতাশা পিটপিট চোখে চারপাশটা তাকিয়ে চোখগুলো নিচের দিকে নামিয়ে বলে,
-জ্বী,বলুন?
-ভাবী? নীর এখানে কেন এসছে এর কারণ জানেন?
নাতাশা দু’পাশে মাথা নাড়ে।
-আপনাকে তার অধিকার দিতে!!
নাতাশা কড়া চোখে অয়নের দিকে তাকায়।এসব কি কোনো ফাঁদে ফেলার ফন্দি?নাকি সহজ মানুষ গুলোকে বোকা বানানোর প্লান!নাতাশার মনে এমন ভাবনা ধেয়ে যায়।সে অন্যদিক তাকিয়ে কঠিন হয়ে বলে,
-আর কিছু বলার আছে?
-ভাবী আপনি বোধহয় নীরের উপর এখনো রাগ!বিশ্বাস করুন ভাবী নীর এখন আর আগের নীর নেই।ও আপনাকে অনেক ভালোবাসে ভাবী।
নাতাশা তাচ্ছিল্য ভরে বলে,
-লোক দেখানো ভালোবাসা সবাই বাসতে পারে।
-নাহহ ভাবী তেমন কিছুই নয়।ও আপনাকে সত্যিই অনেক ভালোবাসে।ইভেন,কাল ওর মুডটা দেখে আমি বুঝতে পারি ও কোনো ডিপ্রেসড-এ আছে।দ্যান অনেক কষ্টে ওর ওর থেকে মন খারাপের কারণ জেনে নিই।যতটা বুঝলাম ও আপনাকে ইগনোর করেছে ঠিকই,এর বিপরীতে ভালোও বেসে ফেলেছে।
নাতাশা চুপ থাকে।অয়ন আবারও বলে উঠে,
-ভাবী?আপনি কি সত্যিই নীরকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছেন?
নাতাশা অয়নের দিকে একনজর তাকিয়ে দৃঢ় একটি শ্বাস ফেলে।আর আক্ষেপ স্বরে বলে,
-অবহেলিত ভালোবাসার এই পৃথিবীতে কোনো দাম নেই।নিজেকে অবহেলিত ভালোবাসার আদলে না রেখে হয়তো মুক্ত পেলাম!
-ভাবী এ কেমন কথা!নীরকে না আপনি খুব ভালোবাসতেন?
-বাসতাম কোনো একসময়।তবে এখন না।
-ভাবী এরকম পাষাণ কথা বলতে নেইই। ভাবী,খুব আশা নিয়ে এসেছি আপনার কাছে,প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না।বিশ্বাস করুন, আমি আমার বন্ধুর কষ্ট একদম সহ্য করতে পারি না।ওর মন খারাপ যেন আমায় পীড়িত করে।ভাবী ও এরকম একটু হট মেজাজের!তবে,অন্তঃপুরের মনটা খুব সাদা।
-তো এখন আমি কি করবো?
-কিছু না।জাস্ট সিম্প্যাথিভাবে আগের সব ভুলে যান।সামনের দিকে কিভাবে শুরু করলে ভালো হবে ওটাই করুন।মানুষের সাংসারিক লাইফে এরকমটা হয়-ই।এইযে আমার মামাতো বোনটা আছে না?ও-ও আপনার মতো সেইম ঝামেলায় ছিল। লিনা হাল ছাড়েনি।নিজের স্বামীকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আপন করে নিয়েছে!তাদের সংসারটা দেখে মনে হয়েছিল দুই বাধন দু’দিকে ছিঁড়ে যাচ্ছে। মারামারি, কাটাকাটি দু’পক্ষে। ওমা সে কি রে দাবানল।তবে লিনা সে ছিল প্রতিবাদী এবং সাহসী।সাহসের সাথে সবকিছুকে ধামাচাপা দিয়ে নারী জাগরণের মতো নিজের সংসারকে নিজের করেছে।আপনি অবশ্য শিক্ষিত মেয়ে আপনার ক্ষেএেও ব্যতিক্রম না।তাই বলছি কি ডিভোর্সের মতো এরকম কলুষতা বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।আপনাদের গ্রামেই ত বলে একটা সংসার ভাঙ্গা মসজিদের সমান।তাহলে সেখানে কেন এতকিছু!?
এরফাঁকে নীর সদর দরজায় সামনে দাড়িয়ে গলা ছাড়ে।অয়ন সেদিকে তাকায়।নীর বলে,
-মাগরিবের আযান পড়েছে।চল নামাজটা সেরে আসি।
অয়ন বাইরের দিকে তাকিয়ে চমকে বলে,
-কখন যে সন্ধা নেমে এলো খেয়ালই ছিলনা।আচ্ছা ভাবী থাকুন।পরে কথা হবে.
বলেই অয়ন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।নাতাশা মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।নাতাশার বাবা সদর ঘরে এসে বাইরের দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে বলে,
-আরেহ বাবারা, দাড়াও দাড়াও।
অয়ন এবং নীর উঠোনে চলাবস্থায় দাড়িয়ে যায়।নীর মুচকি হেসে বলে,
-নামাজ পড়তে যাবেন আমাদের সাথে?
-হু, বাবা।আমি সবসময় মসজিদেই নামাজ পড়ি।তোমরা যেহেতু মসজিদের দিকেই যাচ্ছ তাই ভাবলাম একসাথেই যাই।
-আচ্ছা,সমস্যা নেই।সমস্যা নেই।
নাতাশার বাবা নীরের একটা দিক লক্ষ করে মুখটা খানিকটুকু মলীন করে আনেন।আর হাঁক ছেড়ে বলেন,
-আচ্ছা নীর বাবা,এইযে আমাদের বাড়ি এতবার আসলে একবারও তোমার মুখ দিয়ে বাবা ডাক শুনলাম না।আমাকে কি তোমার বাবার সমতূল্য মানায় না?
নীর চমকে উঠে এবং অয়নও।অয়নের এতক্ষণ পর খেয়ালে আসলো নীর যে নাতাশার বাবাকে একবারও বাবা বলে ডাকে নি।নীর তোতলে তোতলে বলে,
-ইয়ে মানে বাবা এসব কেমন কথা!কে বলেছে আমি আপনাকে বাবার সমতূল্য ভাবি না?!দয়া করে এসব বলবেন না।
-এখন যে বাবা বললে সত্যিই আমার বুকটা ভরে গেল।আয় বাবা আমার একটু বুকে আয়।
পথিমধ্যে নাতাশার বাবা নীরকে বুকের দিকে জড়িয়ে নেয়।আর টপটপ চোখের অশ্রু ফেলে।নীর তা উপলব্ধি করতেই নাতাশার বাবাকে ছাড়িয়ে নেয় এবং মাথাটা সমনে এনে চোখের পানি মুছে দেয়।আর বলে,
-কাদবেন না বাবা।একদম কাদবেন না।
অয়ন তা দেখে একটা ঝিলিক হাসি এঁটে নেয়।আর মনে মনে ভাবে,নীর সত্যিই আগ থেকে অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। আর এরজন্যে সবথেকে বড় অবদান নাতাশা নামের মহীয়সী মেয়েটির।
নীর হাসি মুখে বলে,
-আচ্ছা,নামাজের দেরী হয়ে যাচ্ছে।আমরা আগে নামাজটা সেরে নিই?
।তারপর সবাই পার্শ্বস্ত পুকুর থেকে নামাজের ওযু সেরে মসজিদের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
এখন রাত।নাতাশা বিছানার উপর ভাবনা মগ্নে বসে আছে।রাতের খাবার নাতাশার মা বেড়ে দিচ্ছেন,আর নাতাশার বাবা পাকঘর থেকে সব টেবিলের উপর জড়ো করছেন।রুব্বানও আর আসেনি।সন্ধে যে অভিমান করে চলে গিয়েছিল।
নাতাশার মায়ের সব খাবার টেবিলে সার্ভ করা শেষে নাতাশার মা নাতাশার ঘরে ঢোকেন।নাতাশাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-নাতাশা?সবার সঙ্গে একসাথে রাতের খাবারটা সেরে আস।
-নাহহ, মা।আমি এখানেই খেতে পারবো।নিদ এবং নিতু কোথায়?ওরা খাচ্ছে?
-হু,ওরা জামাই বাবাজীদের সাথেই খাচ্ছে।
-।তুমি খাবে না?
-তোকে ছাড়া কি আর খাওয়া হবে?
সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হয়। পরে, নাতাশা ঘোমটা টেনে টেবিলের উপর এটে প্লেটগুলো গাদাগাদি জড়ো করে পাকঘরের দিকে নিয়ে যায়।নাতাশার মা সেখানে তার জন্যে এবং নাতাশার জন্যে খাবর বেড়ে রাখেন।নাতাশা প্লেটগুলো একসাইডে রেখে বলে,
-মা?এগুলো কলে গিয়ে এখন ধুঁয়ে ফেলি?
-আরেহ নাহ,নাহ!কাল সকালে আমি ধুঁয়ে ফেলবো।এতরাত ধোঁয়াও সম্ভব না।এই নে ভাতের প্লেট।তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।নাতাশা একটি বোলে ডানহাতটি চুবিয়ে ধুয়ে নেয়।আর ভাতের থালাটি হাতে নিয়ে মুখে নালা তুলে।
এখন রাত প্রায় ১১ টা ছুই ছুই।নাতাশা জানলার ফাঁক দিয়ে তারাভরা আকাশটার দিকে তাকিয়ে আছে।শীতে জলীয় কণাগুলো আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে।তা চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।নাতাশা কাঁথাটা গাঁয়ের দিকে আরো ভালোভাবে এঁটে আঁটসাঁট হয়ে বসে।দরজার বাহিরে দেখে কারো গলার শব্দ শুনে।নাতাশা সেদিকে লক্ষ করে বলে,
-দরজা ঠেসে দেওয়া।
মুহূর্তে দরজা ঠেলে নীর প্রবেশ করে।
চলবে…..